আমি আজ আমার বান্ধবী মধুরিমা চক্রবর্তীর কথা বলব। কেন বলব? বলাটা খুব জরুরি, তাই। আমি আর চেপে রাখতে পারছি না। আমার পরিচয়টাও বলি। আমি শিলা, শিলা রহমান। আমি আর মধুরিমা একসাথে রাজশাহী সরকারি পি এন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় এসএসসি শেষ করি, রাজশাহী সরকারি সিটি কলেজ থেকে একসাথেই এইচএসসি পাস করি। এর পরে আমি রাজশাহী ইউনিভারসিটিতে বাংলায় চান্স পেলাম, মধু টিকল না কোথাও। দু-এক জায়গায় ওয়েটিংয়ে ছিল, পরে সে আর খোঁজ নিয়ে দেখেনি, রাজশাহী কলেজে ফাইন্যান্সে ভর্তি হয়ে গেল, একরকম জেদ করেই। আমরা সবাই বললাম, অন্য কোনও সাবজেক্ট নে, ফাইন্যান্সটা কঠিন হবে। ও শুনলই না কারও কথা। অবশ্য মধু একটু ওরকমই। কীরকম? তা অবশ্য আমি নিজেই কখনও ঠিক করে বুঝতে পারিনি। ওর এত কাছাকাছি থাকতাম আমি, অথচ... ফার্স্টইয়ারে অত পড়াশোনা না থাকলেও, কীভাবে কীভাবে যেন সময় দ্রুত গড়িয়ে যেতে লাগল। আমি সেকেন্ডইয়ারে উঠে গেলাম। হুট করে মধুর কথা খুব মনে পড়ছিল। দুইজন এখন দুই জায়গায় পড়ি, কতদিন ধরে ওর সাথে আমার দেখাই হয় না। তা-ও তো প্রায় বছরখানেক হবেই। ফোনও করা হয়ে ওঠে না। একদিন ক্লাস থেকে বাড়ি ফিরে দেখি, মধু আমাদের বাসায় এসেছে। কী সুন্দর হয়ে গেছে দেখতে! অবশ্য ও বরাবরই সুন্দরী। আজকে যেন একটু বেশিই সুন্দর মনে হলো। ওর যে এরকম গমের মতন গায়ের রং, একসাথে বড়ো হতে হতে সেটা আলাদা করে কখনও আমার চোখেই পড়েনি। অবশ্য একজন নারীর চোখে আরেকজন নারীর সৌন্দর্য ধরা পড়েই-বা কতটুকু! আজকে যখন ও চা খাচ্ছিল আমার ছোটো বোনের সাথে গল্প করতে করতে, তখন আমি পুরোটা সময় ওকে খেয়াল করেছি। কেমন যেন একটা আলাদা রকমের ভাব চলে এসেছে ওর মধ্যে। অবশ্য আগে থেকেই ও একটু চুপচাপ, আর গুছিয়ে কথা বলে বরাবরই। আজকে তো যেন একদম গুনে গুনে কথা বলছিল। মনেই হলো না, এতদিন পরে ও এসেছে। যাবার সময় আমাকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘তোর সাথে জরুরি কথা আছে, কাল সময় হবে?’ - কী কথা, বল? - শিলা, আমরা কি এখনও স্কুলে পড়ি? সব কথা বাসায় বলা যায় না। তুই ‘স্টার ক্যাফে’তে চলে আসিস কালকে। বলেই বেরিয়ে গেল। যাবার সময় মাকে বলে গেল, ‘মাসিমা, কতদিন পরে এ বাড়িতে এলাম। আপনার হাতে বানানো নিমকির স্বাদ আমি কখনও ভুলব না।’ মা হাসতে হাসতে হাসতে ওকে বিদায় দিতে মেইনগেইট পর্যন্ত গেলেন। আমি মধুর কথা বলার ধরন দেখেও অবাক হলাম। কেমন যেন অন্য রকম লাগছিল। অবশ্য কাল শুক্রবার, ক্লাস নেই। যাওয়া যাবে। কিন্তু ও তো সময়টা বলে গেল না! আমি রুমে চলে গেলাম, গিয়ে দেখি, ও মেসেজ পাঠিয়েছে। ‘সকাল দশটায়।’ আমি পরদিন যথাসময়ে পৌঁছে গেলাম। ঢুকেই অবাক হলাম। দেখি, মধু শাড়ি পরে এসেছে। খুব পরিপাটি করে সেজে এসেছে। হঠাৎ শাড়ি কেন, জিজ্ঞেস করতেই ও হেসে উঠল। - তো, কেমন আছিস, শিলা? - চলছে। ব্যস্ততা বেশি রে। খালি অশান্তি। তোর? - আরে, আমাকেই-বা শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে কে? অবশ্য আমার বয়সটাই অশান্তিতে থাকার। এই কথা বলে একটু চোখ টিপে হাসল মধু। - মানে? - কিছু না। প্রেমে পড়েছিস? হঠাৎ এমন প্রশ্নে আমি একটু বিব্রত হলাম। - ওসব ছোটোবেলার প্রেমটেম মনে আছে নাকি আর? - হা হা হা হা…। আর এই বাইশে এসে যদি কেউ প্রেমে পড়ে? - পড়লে পড়বে, আবার কী? পড়বে আর ঠাস্ করে সেই ব্যথাই পাবে। প্রেমে পড়া মানেই হলো ব্যথা পাওয়া। প্রেমে পড়েছে, অথচ ব্যথা পায়নি, এমন মানুষ আছে নাকি একটাও? - হা হা…। তুই তো ভালোই কথা বলা শিখে গেছিস, দেখছি! - তোর থেকে বেশি না। আহা! শোন, সাম্য চৌধুরীর গান বাজছে স্পিকারে! এরকম একটা ওয়েদারে, সাথে কফি আর সাম্যর গান…চোখের আগুন তুমি দেখতে পাও না… তোর মনে আছে, মধু? কলেজে পড়ার সময় এই লোকের জন্য তুই পাগল ছিলি, কী যে শুরু করেছিলি তখন! উনি কি এখনও তোর প্রিয় গায়ক? উফফ্ পাগল করে রাখতি এঁর নাম বলে বলে। অবশ্য প্রত্যেকটা সময়েরই একটা ক্রেইজ থাকে। এক তারার পতনে জায়গা দখল করে নেয় অন্য কোনও তারা। এটাই তো নিয়ম! - শুরু করেছিলাম মানে? থেমেছি নাকি? আর কীসের পতন? কী বলছিস এসব? তারার কখনও পতন হয় না, শুধু আমাদের দেখার চোখটা জ্যোতি হারাতে থাকে দিন দিন। - আরেহ্, এত রিঅ্যাক্ট করছিস কেন? তিনি নিঃসন্দেহে মেধাবী। গান লেখেন, সুর দেন, আবার নিজেই গান। কিন্তু একজন পাবলিক-ফিগার উনি, তাঁকে নিয়ে আমরা সবাই-ই কিছু-না-কিছু বলব, এটাই তো স্বাভাবিক রে! - উহুঁ, পাবলিক-ফিগার না, ও আমার নিজের মানুষ, আমার ঘরের, আমার ছাদের, আমার বারান্দার। ও আমার মনের মানুষ। এসব বলার সময় মধুর চোখে মুখে ঔদ্ধত্যপনার যেই ছাপ আমি দেখতে পেলাম, তা দেখে আমার বুক কেঁপে উঠল। - এসব কী বলছিস রে তুই, মধু? - হ্যাঁ রে, হ্যাঁ। ও আমার প্রেমিক, আমার ভালোবাসা, আমার মানুষ। দেখবি? ওয়েট…! আমি হতভম্ব হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। কী দেখাবে ও? আর কী বলছে এসব? ও ফোনটা এগিয়ে দিল। আমি মেসেঞ্জারে কনভারসেশন পড়া শুরু করলাম। সাম্য চৌধুরী, মেসেঞ্জারে নিকনেইম সেট করা ‘আমার গান’ এই নামে। আর মধুরিমা চক্রবর্তীরটা, ‘আমার সুর’ এই নামে। সাম্য লিখেছেন, ভালো আছ? - রাখলে তো থাকব! - কী যে বলো না তুমি! - বলার সুযোগটা দিচ্ছে কে? - আসছ তো আজকে? - যাবার জায়গাই তো একটা! - মাকে কী বললে? আসতে দিল? - বলেছি, ‘আজকে স্বর্গে যাব, মা! আমাকে দেবীর মতন করে সাজিয়ে দাও।’ - ও বাবা! কী মারাত্মক! মা কী বললেন শুনে? - জানি না, শুনতে পাইনি। আজকাল আর অত কিছু শুনতে পাইটা কোথায়? - কী শুনতে পাও তাহলে? - কিছু সুর, কিছু শব্দ, কিছু কথা…আর একটা গলার স্বর। - আর? - নিজের বুকে তো আর নিজেই মাথা রাখতে পারি না, তাই গর্জনটা অনুভব করলেও শুনতে ঠিক পাই না। - আচ্ছা বাবা, আমিই শুনব নাহয়! হয়েছে এবার? অভিমানটা গলেছে একটু? - দেখাই পাই না, আবার অভিমান! - ওমা! গত শুক্রবারেও তো এসেছিলাম! - আমি একলা মানুষ, দোকলা মানুষজনের সুখও বুঝি না, শুক্র-শনির হিসেবও বুঝি না। - আবার দুষ্টুমি শুরু করলে? - আমি তো শেষ করতেই চাই, পারছি আর কোথায়? - কী পরেছ আজকে? - কালো শাড়ি, মেরুন লকেট আর আর মেরুন লিপস্টিক। - লিপস্টিক সাথে করে নিয়ে এসেছ তো…নাকি? এটুকু পড়ে আমি চুপ করে গেলাম। ফোনটা দিয়ে দিলাম ওর হাতে। টুং করে আবার শব্দ হলো। মধু মেসেজের রিপ্লাই করছে আর খুব হাসছে। কিন্তু আমি এসবের কিছুই বুঝতে পারছি না। মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে। - সাম্যটা যে কীসব বলে না। গত শুক্রবারে কী করেছে, জানিস? আমার হাত ধরে টানতে টানতে... টুং টুং টুং। আবার একটার পর একটা মেসেজ আসছিল। - আচ্ছা মধু, তোর দুহাতে দুইটা ফোন কেন? - ও ও ও…মানে এটা? বাঁ হাতটা উপরে তুলে শিলা অন্য মোবাইল দেখিয়ে বলল, এটাও তোকে দেখানোর জন্যই বের করেছি রে। শুধু মেসেঞ্জার দেখলে তো আবার বিশ্বাস করবি না। এই যে, এই ফোনের ইনবক্সটাও দেখ, সাম্য প্রায় সময় ফোনেই মেসেজ পাঠায়। আমাদের কথা হয়, যদিও অল্পই কথা হয়। ওর মতন একজন মানুষের কী আর অত কথা বলার সময় আছে রে? ও আমাকে গান পাঠায়, সুর শোনায়। যখন গান লিখে, লিরিকগুলোও সবার আগে আমাকেই মেসেজ করে পাঠায়। রেকর্ডিংয়ের সময় ও ফোন করে একপাশে রেখে দেয়, আমি ফোনের এপাশ থেকে সব শুনি। একই সাথে কিছুটা অনিচ্ছা এবং কৌতূহল নিয়ে আমি ইনবক্সের কয়েকটা মেসেজ চেক করলাম। সে সময় মধু অন্য ফোনটা পার্সে ঢুকিয়ে রাখল। মেসেজগুলো বেশ আগের। গত বছর পুজোর সময়কার। - আমাদের ঠাকুর দেখতে আসবে না, সাম্য? - আসব। অনেক কাজ গো, বেরুনোর ফুরসতই পাচ্ছি না! - বিজয়ায় এসো কিন্তু। আমি ওইদিন কলাপাতা রঙের শাড়ি পরবো। - ওইদিন সবাই লাল সাদা পরে শুনেছিলাম। - সবাই আর আমি যে এক না, সেটা আর কবে বুঝবে? - আচ্ছা, আমি আসব। ভেতরে এরকম আরও অনেক মেসেজ দেখলাম। কেন জানি পড়ে দেখবার সাহস হলো না আর! ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম রীতিমতো! সাম্য চৌধুরীর মতন দেশের অত বড়ো একজন স্টার, তিনি কিনা মধুর সাথে…! আর আমি যতদূর জানি, লোকটা তো বিবাহিত! তাহলে এসব ও কী বলছে? - কী রে? এখনও বিশ্বাস হয়নি? বিশ্বাস করানোর জন্যই আজ তোকে এখানে ডেকেছি। আজ তোদের ক্যাম্পাসে ওর কনসার্ট আছে। যাবি তো? আমার তখন মনে পড়ল, হ্যাঁ, আজকে নাকি কনসার্ট আছে, সবার কাছে শুনেছি। কিন্তু কে আসবে, তার নাম শুনিনি। আমি আবার ওসবে বরাবরই অনাগ্রহী, গান-টান বুঝিও না তেমন, তাই ওসবের খোঁজও আমি রাখি না। মধুই ছোটোবেলা থেকে গানে ভীষণ রকমের আগ্রহী ছিল। আমার, কেন জানি না, সব কিছু এলোমেলো লাগছে। মধু কি ঠাট্টা করছে আমার সাথে? কিন্তু ও তো হাসিঠাট্টা-করা টাইপের মেয়েই না। পেরিয়ে গেল প্রায় দু-ঘণ্টা। মধু এর মধ্যে পর পর কয়েক কাপ কফি খেলো। আমি শুধু ঠান্ডা পানি খাচ্ছিলাম একটু পর পর। এইটুকু সময়ের মধ্যে আমার আর মধুর মধ্যে আর একটা কথাও হয়নি। মধুর আচরণ কিছুটা এরকম…যেন এটা তেমন কোনও ঘটনাই না, এরকম কিছুই যেন হবার কথা ছিল! পুরোটা সময় মধু ডান হাতে মোবাইলে চ্যাটিং করেছে, আর ভারী আঁচলের কারণে ওর বাঁ হাতটা তো দেখাই যাচ্ছিল না। - শিলা, নেইলপলিশটা দিতে ভুলে গেছি রে, পার্সেই আছে যদিও। একটু দিয়ে দিবি আমাকে? - মধু, আমার হাত কাঁপে। আমি পারি না রে নেইলপলিশ আর মেহেদি দিতে। তুই এক হাত দিয়ে অন্য হাতে দিতে পারবি। অথবা হাতটা তোল উপরে, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি। - আরে না না, থাক। নেইলপলিশ দিতেই হবে, এমন তো কিছু না! আমরা ক্যাফে থেকে বেরুলাম। মধু বলল, ‘কনসার্ট তো বেলা তিনটেয় শুরু হবে, হাতে এখনও এক ঘণ্টার মতন সময় বাকি আছে। চল, রুয়েটের ক্যাম্পাসে যাই, ঘুরে আসি। যাবি? সিঁথি, মালিহা…ওদের সাথেও দেখা করতে পারব।’ - চল। রুয়েটের ক্যাম্পাসে ঢোকার পরে মধু বলল, ‘আরে, আজ তো শুক্রবার! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম সে কথা। ধুউর! তুইও কি ভুলে গিয়েছিস?’ - হুঁ…? হ্যাঁ রে, আমারও মনে ছিল না। - হা হা হা…। আচ্ছা, এখানে এসেছিই যখন, একটু ফোন করি ওদেরকে। মধু একে একে ওদেরকে ফোন করে কথা বলে নিল। ফোন রেখে ও বলল, ওরাও নাকি কনসার্টে আসবে। - দেখ, সাম্য চৌধুরী কীভাবে সবাইকে মাতিয়ে রাখে, আর তুই কোনও খবরই রাখিস না। খালি পড়াশোনাটাই করে গেলি জীবনভর। কী হয় অত পড়ে? অত ভালো রেজাল্ট দিয়ে কী হবে, যদি সাম্যর মতন করে কেউ জীবনে না-ই এল? হা হা হা… চল তাহলে, এবার তোর ক্যাম্পাসে যাই। নিজের ক্যাম্পাস তো ঘুরিয়ে দেখাতে পারবি? না কি সেটাও পারবি না? - হ্যাঁ, চল। আমরা প্যারিস রোড ধরে হাঁটছিলাম। মধু বলল, ‘তোদের ক্যাম্পাসের এই রাস্তাটা অসাধারণ রকমের সুন্দর। বৃষ্টিভেজা এই রাস্তায় হেঁটেছিস কখনও? আহা, এই রাস্তাটার সাথে কত আবেগ জড়িয়ে আছে আমার আর সাম্যর! কত হেঁটেছি দুজনে একসাথে। ক্যাম্পাসের বাকি জায়গায়ও ঘুরেছি দুজনে মিলে। অডিটোরিয়াম, স্টেডিয়াম সব ও-ই তো ঘুরে ঘুরে দেখিয়েছে আমাকে। বিকেল তিনটেয় কনসার্ট শুরু হবার কথা। আস্তে আস্তে লোকজনের ভিড় বাড়া শুরু হলো। ক্যাম্পাসের ‘ইবলিশ চত্বর’-এ নাকি প্রোগ্রামটা হবে। আমরা ওদিকেই এগুতে থাকলাম। মধু আমাকে টেনে নিয়ে গেল ভিড়ের মধ্য দিয়ে। আমরা একটু আগেই এসেছিলাম বিধায় তৃতীয় সারিতে জায়গা করে নিতে পেরেছিলাম। সাম্য চৌধুরী তিনটে বেজে বাইশ মিনিটে স্টেজে এলেন। শুরু করলেন প্রথম গান ‘আমি রোজ রাতে তোমার চোখ খুঁজি তারায়, বিকেলের আভায় তুমি ডাকো ইশারায়…’। দ্বিতীয় গান গাইলেন…অন্ধকারে ছুটে চলি অজানা কোন পথে, ভুলেই কি গেছ, একদিন দুজনে ছিলাম একসাথে…। শেষ করলেন তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় গানটি দিয়ে, যেটা গেয়ে তিনি রাতারাতি দেশের একজন নামকরা স্টার হয়ে গিয়েছিলেন। ‘চোখের আগুন তুমি পড়তে পারো না, মনের ক্ষরণ তুমি ধরতে পারো না, আমার আকাশসম ভালোবাসা তুমি সইতে পারো না, আমাকে আমার মতন করে তুমি চিনতে পারো না।’ পুরোটা সময় মধু যেন বুঁদ হয়ে রইল গানে। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল, দুনিয়াতে এক গান ছাড়া যেন আর কিছুই নেই! তখন হঠাৎ মনে পড়ল, মধুও তো গান জানে, গাইত একসময়। ছোটোখাটো প্রোগ্রাম হলে ও সবসময় নিজেই আগ্রহ করে সেখানে গান গাইত। বেশ ভালোই ওর গানের গলা। এখনও প্র্যাকটিস করে কি না, সেটা অবশ্য জানি না। গান শোনার পুরোটা সময় ও চোখ বন্ধ করে ছিল। একবারের জন্যও চোখ খোলেনি, মনে হচ্ছিল, ও কিছু একটা অনুভব করার চেষ্টা করছে। আমি যতই এই মেয়েটাকে দেখছি, ততই অবাক হচ্ছি। না, এটা মধুরিমা না, নিশ্চিতভাবেই এটা অন্য কেউ। কনসার্ট শেষ হলো ঠিক চারটা বেজে সাত মিনিটে। মধু যেন একটু সময় নিল নিজেকে ঠিক করতে। তারপর বলল, আমি একটু আসছি। ভিড় কমে যেতে লাগল ধীরে ধীরে। দশ পনেরো মিনিট পরে মধু ফিরে এসে বলল, ‘দেখা হলো না রে আজও, ওর সময় হলো না। দেখ, মেসেজ পাঠিয়েছে।’ পড়লাম। ‘দেখতে পেয়েছি একঝলক। কালো রঙে দারুণ লাগছে! চোখ বন্ধ করে রেখেছিলে কেন? আমাকে দেখতে ইচ্ছে করে না বুঝি? আজ আর সামনাসামনি দেখা করার সুযোগ হচ্ছে না, আরেকটা প্রোগ্রাম আছে। সরি। দেখা হবে আবার, ভালো থেকো, আমার গানের সুর!’ এটা পড়ে আমি এবার শতভাগ নিশ্চিত হলাম যে, এতক্ষণ ও যা বলে এসেছে, এগুলো সব সত্যি। - ইয়ে মানে মধু, আমি যতদূর শুনেছি, উনি তো বিবাহিত! - এই প্রশ্নটা করতে এত দেরি করলি যে! - আমি আসলে বলতে চাইছিলাম যে, মানে... - আরে বাবা, মায়ের চাপে পড়ে এই বিয়েটা করতে হয়েছে ওকে। নাহলে ওরকম একটা সাদামাটা, সাধারণ মেয়ে কি আর সাম্যর রুচিতে ধরবে? - তুই নিজেকে অসাধারণ বলছিস? - আমি দেখতে যথেষ্ট সুন্দরী! নই কি? - হ্যাঁ। আর? - আমি গান বুঝি, সুর বুঝি, ওকে বুঝি, ওর মন পড়তে পারি, চোখ পড়তে পারি। ওর সাথে একই সুরে গাইতে পারি। নিজেকে ভেঙে ভেঙে আমি নিজহাতে নিজেরই মধ্যে ওকে গড়েছি এতদিন। আমার নিজেকে দিয়ে আমি ওকে একটু একটু করে তৈরি করেছি প্রতিদিন। একজন সাম্য চৌধুরী তো আর একদিনে হয় না। আজকের এই অবস্থানে তো আর উড়ে এসে বসেনি সে। আজকে যখন ও স্টেজে গাইছিল, ওর পাশে তো আমিও ছিলাম। আমাকে ওই অবস্থায় শুধু আমিই দেখতে পাই, আর দেখতে পায় সাম্য। আর শোন, এ তো কিছুই না। এটাই ওর পথ চলার শুরু। আমি আমার পুরো অস্তিত্ব দিয়ে ওকে কোথায় নিয়ে যাই, দেখিস! শুধু তুই না, সেদিন অবশ্য এটা সবাই দেখতে পাবে। - দেখ মধু, সাম্য চৌধুরীর স্ত্রীকে ঠকানো হচ্ছে না ব্যাপারটাতে? হয়তো সেই বেচারি স্বামীকে অনেক ভালোবাসেন। - কাউকে ভালোবাসার চাইতে অনেক অনেক জরুরি হচ্ছে তাকে শান্তিতে থাকতে দেওয়া। ভালো তো সবাই-ই বাসতে পারে, শান্তিতে রাখতে পারে কয়জন? ওই মেয়ে যা শুরু করেছে সাম্যর সাথে, ঠিক সময়ে আমি না এলে একজন সাম্য চৌধুরী এতদিনে হয়তো হারিয়েই যেত! সাম্যকে বেড়ে উঠতেই দিচ্ছিল না ওর বউ। সাম্যর মতন ওরকম একজন সৃষ্টিশীল মানুষকে অত মেনটাল টর্চার করলে হয় না রে! একজন সৃষ্টিশীল মানুষের জীবনসঙ্গিনীর প্রথম দায়িত্বই হচ্ছে, মানুষটাকে তার নিজের মতো করে বাঁচতে দেওয়া, বাড়তে দেওয়া। ওইটুকু করতে না পারলে মানুষটার সাথে থাকবার কোনও যোগ্যতাই তার নেই বলে আমি মনে করি। আমি কথা বলার মতন সব ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম ততক্ষণে। মধু আমার হাত ধরে ইউনিভারসিটির সেকেন্ড গেইট পর্যন্ত নিয়ে গেল। আমার মনে হচ্ছিল যেন হুট করে অন্য কোনও দুনিয়ায় চলে এসেছি আমি। এসব কী ঘটছে, তার কিছুই আমি বুঝতে পারছিলাম না। আমরা রিকশায় উঠে বসলাম। ও খুব জেদ করল, ওর বাসায় নাকি যেতেই হবে। আমি বাধ্য শিশুর মতন ওকে অনুসরণ করছিলাম। - মধু, মেয়েটা যেমনই হোক, ওঁর স্ত্রী তো, কাগজে কলমে হলেও তো স্ত্রী! আর ভুলে যাচ্ছিস কেন, উনি তো বেশ সুন্দরীও বটে। - কারুর প্রেমিকা হওয়ার মুরোদ না থাকলে অন্য কারুর বউই হতে হয়। প্রেমিকা হওয়া কঠিন তো, তাই হতে পারেনি, বউ হওয়া সহজ, তাই হয়ে গেছে। সিম্পল! শোন শিলা, ইতিহাসে কারুর বউয়ের নাম পাবি না, সব ইতিহাস জুড়েই আছে শুধু প্রেমিকাদের নাম। হা হা হা। বোঝাতে পারলাম? আর শুধু রূপ দিয়েই পুরুষমানুষকে আজীবন ধরে রাখতে পেরেছে কি কেউ? কখনও যদি কেউ পারে, তখন থেকে ওসব রূপের গুণকীর্তন করতে শুরু করব আমিও, তার আগে কিছুতেই নয়। মেয়েদের সবচাইতে বাজে এক্সকিউজটা কী, জানিস তো? এই রূপ! যোগ্যতা নাই দুই ফোঁটার, সাম্য চৌধুরীর বউ হয়ে বসে আছে! রাবিশ যত্তসব! - মধু, একজন মানুষকে এতটা অসম্মান করে কথা বলা যায় কি? - ভালোবাসার মানুষটিকে যার সাথে রোজ রোজ ভাগ করছি, তাকে এর চেয়ে বেশি সম্মান আর দেখাতে পারছি না রে! অ্যান্ড আই অ্যাম নট সরি ফর ইট! ওর এসব যুক্তির কাছে আমার সব কথাই যেন মুখ থুবড়ে পড়ছিল, অসহায় মনে হচ্ছিল নিজেকে। কিন্তু আমি একটা মেয়ে হয়ে কিছুতেই সাম্য চৌধুরীর স্ত্রীর ওরকম একটা অবস্থা মেনে নিতে পারছিলাম না। বার বারই মনে হচ্ছিল, এটা ঠিক নয়, এটা অন্যায়! মধুরিমাদের বাড়ি পৌঁছুতে পৌঁছুতে আমাদের সন্ধে হয়ে গেল। মাসিমা আমাকে দেখে প্রায় দৌড়ে এলেন। - শিলা, কতদিন পরে এলি রে, মা। মাসিকে ভুলেই গেলি অমন করে? - না, মাসি। আজকাল সময় পাই না তো, তাই আসা হয় না। - তোর মা ভালো আছেন? বাড়ির সবাই? - সবাই খুব ভালো আছে। - তুই মধুর রুমে গিয়ে বোস, আমি এক্ষুনি আসছি। মধুর রুমে ঢুকে আমি তো অবাক। এ আমি কোথায় এলাম! এ তো দেখি একটা স্টুডিয়ো! হারমোনিয়াম, তবলা, সেতার…এগুলো তো আগেই দেখেছিলাম। কিন্তু আজকে দেখলাম, বাঁশি, মন্দিরা, গিটার, খঞ্জনি, বেহালা, মাউথ-অরগ্যান কিছুই তো দেখি বাদ নেই! আরও কী কী যেন, ওসবের নাম জানা তো দূরে থাক, আমি কখনও দেখিইনি আগে। আমি ওসব কিছু হাত দিয়ে উলটে পালটে দেখছিলাম। - মধু, এগুলোর সবই তুই বাজাতে জানিস? - আরে না, কী যে বলিস। সব কি কেউ বাজাতে জানে নাকি? হারমোনিয়াম আর সেতার তো ছোটোবেলায়ই বাজাতে শিখেছিলাম, আর এখন মাস ছয়েক ধরে গিটারটা শিখছি, মাউথ-অরগ্যানটা নাড়াচাড়া করতে ভালো লাগে, কিন্তু বাজাতে পারি না। আর বেহালা খুব খুব কঠিন। ও আমাকে দিয়ে হবে না রে! এসময় মাসি এলেন, চা নিয়ে। মধুরা তিন ভাই-বোন। দিব্য দাদা, মধুরিমা আর কাব্য। - মাসিমা, বাসার আর সবাই কোথায়? - দিব্য কিছুদিন হলো কলকাতায় আছে, আর কাব্য গেছে প্রাইভেট পড়তে। বাসায় থাকলে কি আর তোর গলা শুনেও না এসে পারত? আমি শুনে হাসলাম। কাব্যটা সত্যি ওরকমই। আগে যখন নিয়মিত এ বাসায় আসতাম, তখন কাব্য সারাক্ষণই আমার সাথে সাথে থাকত। তখন ও ছিল ক্লাস ফাইভে। ও আমাকে খেপিয়ে দেবার জন্য বলত, ‘ঠাকুরের কি লীলা, তোমার নাম শিলা!’ আর আমিও বলতাম, ‘কাব্য, ও কাব্য, তুই আস্ত একটা অসভ্য!’ বাসার সবাই হাসতেন আমাদের খুনসুটি দেখে। আজকে সেই বাড়ির অবস্থাটাই কেমন যেন হয়ে গেছে! একদমই প্রাণহীন। কেমন যেন একটা থমথমে ভাব চলে এসেছে এ বাড়িতে। মধুর সারাটা ঘরজুড়ে কেমন যেন একটা সোনালি আভা। ঝাড়বাতির মতন কী কী যেন লাগিয়েছে চার কোনায়, কিন্তু একদম হালকা আলো দেয়, কিছুক্ষণ পর পর বাতির রং বদলে যায়, বাতির রঙের সাথে সাথে মনের ভাবও যেন বদলে যায়। বাতির রঙের কী এক অদ্ভুত খেলা! মধু চায়ের কাপগুলো রাখতে যেই রুমের বাইরে গেল, সাথে সাথে মাসিমা আমার কাছে এসে বসলেন। - শিলা, তুই কি মধুর খবর কিছু জানিস? শুনেছিস কিছু? ততক্ষণে মধু এসে পড়েছে, উত্তরটা ও-ই দিল। - হ্যাঁ, মা। ও সব শুনেছে। - এমন বুক ফুলিয়ে বলছিস, লজ্জা করে না তোর? কী পাপ করে বেড়াচ্ছিস দিনের পর দিন, সেই খবর রাখিস কিছু? - অনেক পুণ্য করে আমার যে স্বর্গে যাবার খুব শখ, এটা তোমাকে কবে বলেছি, মা? মাসিমা উত্তেজনায় কাঁপছিলেন, চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন, ‘শুনেছিস, শিলা? মেয়ের কথা শুনেছিস?’ - এই বেয়াড়া মেয়ে, ওই লোকটা যে সংসারী একজন মানুষ, ওঁর বউ আছে, এটা তুই জানিস না? - হ্যাঁ, জানি। তো? ওই তো, মধুকেও বলছিলাম, কারও বউ হয়ে যাওয়া দুনিয়ার সবচেয়ে সহজ কাজ, ওর জন্য কিছুই করতে হয় না। একজনকে ভালোবেসেও দিব্যি অন্য কারুর সাথে সংসার করা যায়, আর মা, তুমি তো আরও ভালো করে জানো এটা... মধু চিৎকার করে করে এসব বলছিল। - চুপ কর, আর বলিস না ওসব, মুখেও আনিস না। ছিঃ ছিঃ ছিঃ! - মা, তুমিও তো চুপ করেই ছিলে, কী করতে পেরেছ চুপ করে থেকে? সেই তো বাবার গলায় মালা দিলে, অথচ তোমার কার ঘরে থাকার কথা ছিল? - উহহ্, চুপ কর, অসভ্য মেয়ে কোথাকার! মাসিমা এই বলে বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে। ওই রুম থেকে মধুর বাবার গলা শুনতে পেলাম। - কী হলো তোমার। অমন করছ কেন? - তোমার মেয়েকে আমি টুকরো টুকরো করে কেটে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেবো! আমার জাত, কুল সব ডুবিয়ে ছাড়বে এই মেয়ে! - চুপ করো, দিব্যর মা। কীসব বলে যাচ্ছ! মধু আমার একটা মাত্র মেয়ে! ও আমার ঘরের লক্ষ্মী। - তোমার লক্ষ্মী কীসব অলক্ষ্মীপনা করে বেড়াচ্ছে, সে খবর তুমি রাখো? ওরকম মেয়েকে আমি এ বাসায় রাখব না। বংশরক্ষার জন্য আমার ছেলেরা আছে। এই মেয়েকে আমার চাই না। আমি এপাশ থেকে সব কথাই শুনেছি। এটা বুঝতে পারলাম যে, এ বাসায় এমন অশান্তি রোজ রোজই হয়। - শোন, শিলা, যখন কোনও গানের কথা আমার মাথায় আসে, তখন আমি ওই ঝাড়বাতিগুলো জ্বেলে দিই, অথবা সব বাতি নিভিয়ে দিই, তাহলে ভালো করে লিখতে পারি। - মানে? তুই গান লিখিস? - হ্যাঁ, লিখে সাম্যকে পাঠাই, সেটাতে সুর করে ও আমাকে শোনায়। - গান কীভাবে লিখে রে? কোথায় শিখেছিস এত সব? এই এক বছরে এতকিছু কী করে শিখলি, মধু? - হা হা হা! - শিলা, এগুলো শেখার জিনিস না রে। যার ভেতরে আছে, তার আপনাআপনিই আসে ওসব। গান লেখার সময় আমি নিজেই লেখা হয়ে যাই। গানের কথা আর আমার মাঝে কোনও দূরত্ব থাকে না। তেমনি সাম্য যখন সুর করে, তখন ও নিজেই সুর হয়ে যায়। বুঝলি? আমি ওর কথা শুধু শুনে যাচ্ছিলাম। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমার মনে হচ্ছিল, হয় আমি কিছু ভুল শুনছি, নাহয় মধু কিছু ভুল বলছে। - শিলা, আমার ডায়েরিটা দেখাই তোকে? চল, বারান্দায় গিয়ে বসি। এই যে ডায়েরিটা নিয়ে যা। আমি আসছি এখুনি। আমি বারান্দায় গিয়ে বসলাম। বারান্দাটাও কী সুন্দর করে সাজিয়েছে। ছোট্ট ছোট্ট টবের মধ্যে ফুলগাছ লাগানো। রাতের বেলা বলে বোঝা যাচ্ছে না ঠিক করে, তবে খুব সুন্দর লাগছিল দেখতে। বারান্দার একপাশে দেয়াল ঘেঁষে সুন্দর একটা টি-টেবিল আর ছোট্ট একটা টুল রাখা। ওখানেও হালকা রঙের একটা বাতি জ্বালানো। টেবিলে দেখি আরও দু-তিনটে ডায়েরি, কয়েকটা লেখার খাতা, টেবিলের আশপাশে অনেক কাগজও পড়ে আছে। যেই ডায়েরিটা ভেতর থেকে নিয়ে এসেছিলাম, সেটা খোলার আগেই টেবিলে রাখা কালো রঙের একটা ডায়েরি আমার চোখে পড়ল; সেটা খুলতে যাব, তখনি মধু এসে পড়ল। ভয়ংকরভাবে চিৎকার করে বলল, ‘শিলা, আমি কি তোকে এটা দেখতে বলেছিলাম? কেন ওই ডায়েরিটায় হাত দিতে গেলি? এতে ‘পারসোনাল’ শব্দটা আমি কেন লিখেছি?’ - সরি, মধু। আমি খুলে দেখিনি এখনও, বিশ্বাস কর! - করলাম। তোকে আমি বিশ্বাস করি। আচ্ছা, শোন, তুই জিজ্ঞেস করছিলি না, আমি কী করে সাম্যকে গান লিখে দিই? এই নে, এই কনভারসেশনটা পড়।