অনাদি মায়ার নিদ্রা থেকে জাগরণ: এখানে বলা হচ্ছে, জীব (অর্থাৎ অভিজ্ঞতাজাত আত্মা) অনন্তকাল ধরে অজ্ঞতা বা মায়ার নিদ্রায় ঘুমিয়ে থাকে। যেমন ঘুমন্ত মানুষ বাস্তব জগৎ জানে না, তেমনি জীবও মায়ার কারণে নিজের আসল স্বরূপ—অদ্বৈত সত্য—উপলব্ধি করতে পারে না। কিন্তু যখন সে এই নিদ্রা থেকে “জাগে” (অর্থাৎ আত্মজ্ঞান লাভ করে), তখন সে উপলব্ধি করে সেই বাস্তব সত্যকে—যা কখনও জন্মায় না, কখনও নিদ্রিত হয় না, কখনও স্বপ্ন দেখে না। এই সত্য হলো এক ও অদ্বিতীয় ব্রহ্ম।
ঘটনাজগতের অস্তিত্বের প্রশ্ন: সত্য মানে—যা চিরন্তন, অবিনশ্বর, অবিকৃত। যদি এই চোখে-দেখা কানে-শোনা দৃশ্যমান জগৎ “পরমার্থে সত্য” হতো, তবে এটি কখনও ধ্বংস হতো না। কিন্তু আমরা দেখি, প্রতিটি তৈরি জিনিস একদিন ভেঙে যায়, প্রতিটি জীব জন্ম-বৃদ্ধি-মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে যায়। এখান থেকে বোঝা যায়, জগৎ “অবিনশ্বর সত্য” নয়। এর প্রকৃত স্বরূপের অভাবই হলো ভ্রম। যেমন মরুভূমিতে মরীচিকা দেখা যায়, অথচ তা বাস্তবে নেই, তেমনি এই দ্বৈততার (আমি-তুমি, কর্তা-কর্ম, সুখ-দুঃখ) জগৎও কেবল মায়াজাত বিভ্রম। তাই চূড়ান্ত সত্য হলো একমাত্র অদ্বৈত—যেখানে কোনো ভিন্নতা নেই।
দ্বৈততার কথা কেবল শিক্ষার জন্য: কেউ যদি মনে করে, “না, এই বৈচিত্র্যময় জগৎ তো সত্যিই আছে”—তাহলে বলা হয়, এ কেবল কল্পনা। যেমন ঘুমের স্বপ্ন—যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণ সত্যি মনে হয়, কিন্তু জাগলেই সব মিলিয়ে যায়, তেমনি এই জগৎও জ্ঞানের আলো এলে মুছে যায়, কারণ এটি কখনোই স্বতঃসিদ্ধ সত্য ছিল না। শাস্ত্র যখন দ্বৈততার কথা বলে (যেমন স্বর্গ, নরক, পুণ্য, পাপ ইত্যাদি), তখন তা আসল উদ্দেশ্যে নয়, বরং শিক্ষার জন্য—অজ্ঞকে ধীরে ধীরে সত্যের পথে আনতে। আর যখন সত্য (অদ্বৈত ব্রহ্ম) উপলব্ধি হয়, তখন দ্বৈততার সব কথাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়।
জীব মায়ার ঘুমে আটকে থাকে, তাই জগৎকে সত্যি মনে হয়। কিন্তু জ্ঞানের জাগরণে সে বুঝতে পারে—জগৎ ভ্রম, সত্য হলো অদ্বৈত ব্রহ্ম। দ্বৈততার শিক্ষা কেবল অজ্ঞকে প্রস্তুত করার জন্য, জ্ঞানী জানেন—শেষ সত্যে কোনো ভেদ নেই।
ধরুন, একজন মানুষ ঘুমিয়ে আছে। ঘুমের মধ্যে সে স্বপ্ন দেখছে—সে ধনী, তার বিশাল প্রাসাদ আছে, শত্রুরা তার পিছু নিয়েছে, সে যুদ্ধ করছে, ভয় পাচ্ছে, আবার আনন্দও করছে। স্বপ্নের সময়—সবই একেবারে বাস্তব মনে হচ্ছে। সে সত্যিই ভয় পাচ্ছে, কষ্ট পাচ্ছে, খুশি হচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ সে জেগে উঠল। চোখ খোলার সাথে সাথেই প্রাসাদ নেই, শত্রু নেই, যুদ্ধ নেই—সব মিলিয়ে গেল।
এই ঘুম আর স্বপ্ন—আসলে হলো অনাদি মায়া। স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষটা হলো জীব। আর জেগে ওঠা মানে হলো আত্মজ্ঞান লাভ করা। যতক্ষণ সে মায়ার ঘুমে থাকে, ততক্ষণ জগৎ—আনন্দ-দুঃখ-লাভ-ক্ষতি—সব সত্যি মনে হয়। কিন্তু জ্ঞানের আলোয় জেগে উঠলে বোঝা যায়—এগুলো সবই স্বপ্নের মতো, আসলে কোনো সত্যিই নেই।
যদি এই জগৎ সত্যিই বাস্তব হতো, তাহলে কখনোই তা মিলিয়ে যেত না—আর দশটা সৃষ্ট জিনিসের মতন। কিন্তু আসলে জগতের দ্বৈততা (আমি-তুমি, সুখ-দুঃখ) সবই মিলিয়ে যায়—এসব কখনোই বাস্তব নয়। এসব শুধুই ভ্রম—মরুভূমির মরীচিকার মতো।
তাহলে শাস্ত্রে কেন দ্বৈততার কথা বলা হয়? যারা এখনও স্বপ্নের মধ্যে আছে, তাদেরকে ধীরে ধীরে জাগানোর জন্য। যেমন শিশুকে প্রথমে রঙিন গল্প বলে শিক্ষা দেওয়া হয়, তেমনি শাস্ত্রও “স্বর্গ-নরক, পাপ-পুণ্য”-এর মতো দ্বৈততার শিক্ষা দেয়, যাতে মানুষ ধীরে ধীরে চূড়ান্ত সত্যের পথে এগোতে পারে। কিন্তু একবার যদি জীব জেগে ওঠে—তাহলে বোঝে, “আমি কেবল ব্রহ্ম—অদ্বৈত, অখণ্ড, অনাদি।” তখন আর দ্বৈততার কোনো অস্তিত্ব থাকে না—ঠিক যেমনি জেগে ওঠার পর স্বপ্নের ভয় আর আনন্দ কোনো অর্থই রাখে না। তাই বলা হয়, জীব যখন মায়ার ঘুম থেকে জাগে, তখন সে উপলব্ধি করে সেই ব্রহ্মকে—যা জন্মহীন, নিদ্রাহীন, স্বপ্নহীন, অদ্বৈত।
স্বপ্নের বস্তুর “অসারতা”-র কারণ: জ্ঞানীরা বলেন—স্বপ্নে দেখা সব বস্তুই অসার, কারণ এগুলো দেহ/মনের ভেতরেই ঘটে এবং সেই সীমার ভেতরেই থেমে যায়। “দেহের অভ্যন্তরে” বলতে মূলত অন্তঃকরণ/মন বোঝায়—ঘুমের সময় ইন্দ্রিয়গুলো বাইরের বস্তুর সঙ্গে সত্যিকার সংযোগে থাকে না; সঞ্চিত সংস্কার (স্মৃতি-ছাপ) ও মন মিলে দৃশ্য সৃষ্টি করে। তাই স্বপ্নে খাবার খেলে পেট ভরে না, পান করলে তৃষ্ণা মেটে না, দৌড়োলে পেশী ক্লান্ত হয় না—কারণ ঘটনাগুলো মনের ভেতরেই ঘটছে, শরীরে নয়। যেমন ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি (VR) হেডসেটে পাহাড় থেকে পড়ে গেলে ভয় লাগে, হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়; কিন্তু শরীরে সত্যিকারের আঁচড় লাগে না। স্বপ্নের “বস্তু” ঠিক এরকম—ভীতিকর/আনন্দদায়ক হতে পারে, কিন্তু স্বাধীন বস্তুগত অস্তিত্ব নেই।
জাগরণে-দেখা বস্তুও কেন শেষসত্য নয়: যেমন স্বপ্নে, তেমনই জাগরণেও “যা দেখা হচ্ছে—দ্রষ্টব্য/জ্ঞেয়”—তা শেষসত্য নয়; এর পেছনে যুক্তি হচ্ছে—কেবলই ‘প্রত্যক্ষিত’ হওয়ার কারণেই—অর্থাৎ “দেখা” বলেই তার নিজের কোনো স্বাধীন, স্বয়ংপ্রতিষ্ঠ সত্য নেই; তা দ্রষ্টা ও জ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল।
পার্থক্যটা যেখানে: স্বপ্ন ব্যক্তিগত—“দেহ/মন”-এর ভেতরের প্রক্ষেপ; জাগরণ সামষ্টিক—অনেকের জন্য একই নিয়মে চলা এক “শেয়ার্ড” অভিজ্ঞতা। তবু দুটোই দ্রষ্টার কাছে ‘দেখা’ বলে নির্ভরশীল—তাই চূড়ান্ত সত্য নয়। সিনেমার পর্দায় দিনের শো (জাগরণ) আর রাতের শো (স্বপ্ন)—দুটোরই ছবি পর্দাতেই। দিনের শো সবার জন্য, রাতের শো ব্যক্তিগত—কিন্তু পর্দা একই। বেদান্তে সেই পর্দাই আত্মা; ছবি (দৃশ্য-বস্তু) পর্দার ওপর নির্ভরশীল বলে নিজে আলাদা কোনো সত্য নয়।
তাই এখানে “অসার/অবাস্তব” মানে যে কার্যত কিছুই নেই—তা কিন্তু নয়; বোঝানো হচ্ছে, এগুলো চূড়ান্ত সত্য (পরমার্থিক) নয়, ব্যাবহারিক (ব্যাবহারিক/ব্যবহারস্তর) সত্য মাত্র।
আপত্তি উঠতে পারে—অবাস্তব হলে দেখে কে? কল্পনা করে কে? প্রশ্নটা স্বাভাবিক: যদি স্বপ্ন-জাগরণ উভয় স্তরেই বস্তুই শেষসত্য না হয়, তবে দেখা বা কল্পনা করার কাজটা করে কে?
এ বিষয়ে বেদান্তের সিদ্ধান্ত দেখা যাক। আত্মা স্বয়ং-প্রকাশমান (svayam-prakāśa)—নিজেকে প্রমাণ করতে আরেকটি আলোর দরকার নেই; আত্মার জ্যোতিতেই দেখা/জানা—সব কিছু ঘটে। এই আত্মাই নিজের মায়াশক্তির মাধ্যমে নিজের মধ্যে/উপর নানা রূপ কল্পনা আর প্রক্ষেপ করে (আসলে এ সবই উপাধি বা আরোপ/অধ্যাস)। তাই প্রকৃত দ্রষ্টা-জ্ঞাতা আত্মাই; দেখা-বস্তুর ধারাবাহিকতা মায়া-মন-ইন্দ্রিয়র মাধ্যমে প্রকাশ পায়; আত্মা তাতে জড়িয়ে পড়ে না, কেবল সাক্ষী হিসেবে থাকে।
মুভির তিনটি স্তর দিয়ে উপমাটি বলা যায় এভাবে: আত্মা (সাক্ষী—আলো)—স্বয়ং-প্রকাশমান, অপরিবর্তনীয়। মায়া/মন/উপাধি (প্রজেক্টর)—ছবির ধারাবাহিকতা তোলে, নাম-রূপ দেয়। দৃশ্য/বস্তু (ছবি)—দেখা হয়, আসে…যায়; টিকে থাকার জন্য আলো ও প্রজেক্টরের ওপর নির্ভরশীল।
উপমা ১: স্ফটিক-রং—স্বচ্ছ স্ফটিকের পাশে লাল ফুল রাখলে স্ফটিক লাল দেখায়। রং স্ফটিকের গুণ নয়, তবু স্ফটিকেই দেখা যায়। স্ফটিক = আত্মা, লাল আভা = মায়া দ্বারা আরোপ।
উপমা ২: সূর্য-প্রতিফলন—জল কাঁপলে সূর্যের প্রতিফলন কাঁপে, সূর্য কাঁপে না। আত্মা সূর্যের মতো, মন-সংসার প্রতিফলনের মতো।
নিজেকে নিজে কল্পনা করার মানে: আমি-র বদলে যাওয়াটা কোনো বাস্তব রূপান্তর নয়—আত্মা এখানে পরিবর্তিত হচ্ছে না। আত্মার জ্ঞান-আলোয় “আমি-তুমি-এটা-ওটা” উপাধি-জাত-রূপ উঠে আসে—যেমন আসে পর্দায় বিভিন্ন ছবি। অধ্যাস/আরোপ-এর ভাষা এক্ষেত্রে এমন—“দড়ির ওপর ‘সাপ’ আরোপ” হলেও—দড়ি সাপ হয়ে যায় না; যদিও সাপ-দেখা দড়ির ওপরই ঘটে।
স্বপ্ন: বস্তু অসার—মনের ভেতরের প্রক্ষেপ; শরীর-জগৎকে স্পর্শ করে না। জাগরণ: বস্তু চূড়ান্ত সত্য নয়—দেখা/জ্ঞাত হওয়ার উপরই নির্ভরশীল; পার্থক্য শুধু—একটা ব্যক্তিগত, আরেকটি সামষ্টিকভাবে শেয়ারড। দ্রষ্টা/জ্ঞাতা হলো আত্মা—স্বয়ং-প্রকাশমান; মায়া—মনের মাধ্যমে রূপ–ছবি ওঠে; আত্মা সাক্ষী, নিষ্কলুষ। ব্যক্তিগত স্বপ্ন: আপনি একা দেখেন—জেগে উঠলেই মিলিয়ে যায়। সম্মিলিত স্বপ্ন (জাগরণ): সবাই মিলে দেখে—নিয়ম-বিজ্ঞান-ইতিহাস মেনে চলে। দুটোই আত্মার আলোর ওপর ভর করে—তাই চূড়ান্ত সত্য নয়; চূড়ান্ত সত্য হলো আত্মা নিজে, যে সব কিছুর অদ্বিতীয় সাক্ষী।
আত্মা, মায়া ও অভিজ্ঞতা: অসার—যেটা শেষ সত্য নয়; কেবল অভিজ্ঞতায় ধরা পড়ে, স্বাধীন বাস্তবতা নেই। স্বয়ং-প্রকাশমান (svayam-prakāśa)—আত্মা নিজেই উজ্জ্বল, নিজেকে প্রমাণ করতে অন্য কিছুর দরকার নেই। আত্মা নিজেই সাক্ষী—মায়ার মাধ্যমে নিজের ভেতরেই নানা রূপ কল্পনা করে। স্বপ্ন = মনের ভেতরের প্রক্ষেপ। জাগরণ = শেয়ারড অভিজ্ঞতা, কিন্তু আত্মার ওপর নির্ভরশীল বলে শেষসত্য নয়। আত্মা = চিরন্তন সাক্ষী, স্বয়ং-প্রকাশমান, অকলুষ। দ্বৈততা কেবল মায়ার খেলা; আত্মা সর্বদা অদ্বৈত। স্বপ্ন হোক বা জাগরণ—সবই দৃশ্য। আত্মাই একমাত্র অদ্বিতীয় সাক্ষী।
আত্মার কল্পনা (Projection of the Self): আত্মা বা প্রভু (Lord, Ātman) নিজেই নিজের মায়াশক্তির দ্বারা নানা রূপ কল্পনা করে। যখন তাঁর মন বাইরের অভিমুখী হয়, তখন তিনি “বাহ্য জগতের বস্তু” কল্পনা করেন—যেমন পাহাড়, নদী, আকাশ, দেহ, প্রাণী, মানুষ ইত্যাদি। যখন তাঁর মন ভেতরের অভিমুখী হয়, তখন তিনি কল্পনা করেন চিন্তা, ধারণা, স্মৃতি, ভয়, কামনা ইত্যাদি। মানে—বাইরের জগৎও, ভেতরের ভাবনাও—সবই আত্মার কল্পনার প্রতিফলন।
ভাবুন, অন্ধকারে অস্পষ্টভাবে একটা দড়ি পড়ে আছে। ঠিকভাবে দেখা যাচ্ছে না, তাই কেউ ভাবে এটি সাপ, কেউ ভাবে এটি জলের রেখা। দড়ি আসলে দড়িই থাকে, কিন্তু মনের ভুলে তাকে অন্য কিছু হিসেবে দেখা হয়। আত্মার ক্ষেত্রেও তা-ই। আত্মা সর্বদা অদ্বৈত, নিরাকার, অনাদি—কিন্তু অজ্ঞতা (মায়া) তাকে নানাভাবে উপস্থাপন করে: কখনো “জীব”, কখনো “কর্তা”, কখনো “ভোক্তা”, কখনো “সুখী-দুঃখী”।