এক। আজকে কী কী খেয়েছি তোমাকে ছাড়া, জানো?
বাটার-নান আর চিকেন তন্দুরি, চিকেন-স্যুপ, ছোলাভাজা, গরম গরম বেগুনি, শাকের বড়া; সব অনেক মুচমুচে। তারপর সালাদ, তরমুজ, খোরমা খেজুর, পরে গরম গরম কফি—অরিজিন্যাল আমেরিকান নেসক্যাফে গোল্ড, কড়া। এত কিছু খেয়েছি তোমাকে ছাড়া!
তোমাকে তো বলাই হয়নি, আমার কলিজার টুকরো ভাগনিটার জন্মদিন ছিল। আমরা সবাই সেজেগুজে ওদের বাড়িতে ঘরোয়া পার্টিতে গিয়েছিলাম। শাড়ি পরেছিলাম—জর্জেট, সাথে কটি। চোখে ঝকমকে শ্যাডো আর নীল রঙের কাজল, ঠোঁট রাঙিয়েছিলাম গাঢ় মেরুন রঙে, গ্লসি ছিল লিপগ্লস…মানে ঝিলিক দেয় এমন ঠোঁট-রঙ, চুল ছেড়ে দিয়েছিলাম কাঁধের একপাশে। শাড়ি ছিল লেবু-রঙা, ওতে বেগুনি ফুল আর ডাল-পালার ছাপ-ছোপ।
আমাকে দেখলে তুমি ভারি পছন্দ করতে, আমি জানি। বেশ কিছু ছবিও তুলেছিলাম, কিন্তু…
একটা কথা। তুমি আমাকে ভুলে যেয়ো, আমিও যাব।
আজ আসি। কাল আবার মনে করিয়ে দেবো…
…আমাকে ভুলে যেতে।
পিএস। অনেক বড়ো কেক খেয়েছি…তা-ও তোমার প্রিয়টা—চকোলেট ফ্লেভারের।
দুই। এই যে বৃষ্টিগুলো,
এত এত জলধারা,
অর্থহীন এখন।
কী করব এই জলধারা?
আমি তো ছিলামই না এমন,
আমি জানতামই না,
বৃষ্টিকেও জানালার ধারে বসে বসে দেখা যায়,
রেকর্ড করে মুঠোয় মুঠোয় তোমার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া যায় কিছু বৃষ্টি-সমাচার।
এই যে আমার পাখিদের উচাটন,
এই পাখিগুলোও কখনও আমার আদর পেতই না!
আমি শুধু তাদের রক্ষক ছিলাম,
এদের স্নেহাশিস তুমিই তো বানিয়ে তুলেছিলে আমাকে।
পাখি তোমার খুউব পছন্দ, জানি,
ঝড়ো হাওয়ায় ওরা ছটফট করছে,
বুঝি; তবু
যাই না কাছে!
বাসবী বড়োই অসম্পূর্ণ…ভাস্করকে ছাড়া।
ভাস্কর অবশ্য বলেই দিয়েছে,
জীবন থেকে বেশি কিছু চাইতে গেলেই শুরু হয় গন্ডগোল—
সাহিত্য থেকেও তা-ই।
এভাবেই ভাস্কর নিজের লেখা থেকে করা প্রত্যাশার ভার থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে...
লেখালেখি ছাড়েননি।
আমার দিনগুলো অবশ্য এখনও তুমিময়,
তোমার যত প্রিয় বই,
যত প্রিয় প্রিয় লেখক…যা যা আছে,
সবার সাহিত্যকর্মই এখন আমার অনুরাগের পাত্র।
আমি পড়ি,
তাঁদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি,
সামনেই সাজিয়ে রাখি বইগুলো,
লেখালেখির বাতিকও হয়েছে…
তোমার এই না থাকাতে।
ভালোবাসার মানুষটাকে পেয়ে গেলে
জীবনে আর কিছুই পাওয়া হয় না।
আচ্ছা, আমার হঠাৎ থেমে যাওয়া,
উধাও হয়ে যাওয়া,
কতকী-ই তো হয়ে গেল, আর
তোমার জীবনযাপনে কিছুই বদল হয়নি?
তোমার শান্ত জীবনটা কোনো উৎকণ্ঠা বা অভাব অনুভব করে না?
করে না হয়তো!
ব্যস্ততা বড়ো ভালো জিনিস—
মানুষকে বাঁচিয়ে দেয়,
ভুলে যেতে দেয়,
ঘুম পাড়িয়ে রাখে দুঃখযাপনের সময়টাতে।
শুধু হঠাৎ…একদিন রাতে, হয়তো বৃষ্টি হবে,
সেদিন মন খুউব আনচান করবে আমার পাগল পাগল কথাগুলোর জন্য,
আলোকচিত্র দিয়ে দিয়ে গল্পবলাগুলো ফিরে ফিরে আসবে…দেখো!
সুরে-বেসুরে গেয়ে গেয়ে শুনিয়ে আনন্দ-খুঁড়ে-এনে-দেওয়া সেই আমিকে, আর তার তোমাকে
খুব কাছে পেতে চাওয়াগুলো
তোমাকে সেদিন খুউব করে আঘাত করতে চাইবে হয়তো।
তবে আমি তো সেদিন আসতেই দেবো না আমার এই অদ্ভুত প্রহরগুলোতে,
আমার হৃদয়ের কথা আমি ধামাচাপা না দিয়ে সেগুলোকে উদ্যাপন করে দিই
…প্রতিটি দিন।
তাদের আর কষ্ট দেবার ক্ষমতা থাকে না,
বরং তারাও আমার উদ্যাপনে শামিল হয়ে যায়,
বন্ধু হয়ে পাশে থেকে যায়।
তিন। এই যে…অ্যাই স্বপ্ন!
শোনো! জানো, আমার ইদে নিজেই নিজেকে কেমন করে উপহার দিয়ে ভুলিয়ে রেখেছি?
তোমার প্রিয় হুমায়ূন আহমেদের দশটি উপন্যাসের সংকলন…এত সুন্দর সুন্দর নাম যে, কিনেই ফেললাম।
ভালোবেসে যদি সুখ নাহি…হি হি হি…কী কী উপন্যাস আছে?
তুমি এখন অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে পালিয়ো না…আরে, দাঁড়াও একটু, নামগুলো শোনো। নামগুলো একেকটি কল্পনাজগতের চাবিকাঠি। আমি শুধু নাম পড়ি একেকটি উপন্যাসের আর হারিয়ে যাই আমার নিজের বানানো একেকটি গল্পে। এই দ্যাখো…তুমি নিজেই হারিয়ে যাবে…
তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে…
এই যা! গেলুম হারিয়ে!
ওই যে একবার ডেকেছিলে? এরপর আবার কবে…?
আরেহ্ আরেহ্! সব বই কোলে ফেলে রেখেই হারিয়ে যাচ্ছি আমার কল্পনার দেশে…
আচ্ছা, ফিরছি…ফিরছি…ফিরছি…
‘চোখ’
…এলিয়ে আসছে,
‘প্রিয়তমেষু’
…এই যে, মনে মনে এখন চিঠি লেখা শুরু করলাম এইবার তোমাকে, উফফফ্!
‘আমার আছে জল’
…হা হা হা…বিদ্যা সিনহা মিমের নেচে নেচে এই গানটি গাওয়া মনে পড়ছে। মনে পড়ছে, জাহিদ হাসানের সাথে কথোপকথন...আমারও, যখন আমি র্যাম্পে হাঁটতাম। নিজের প্রেমের গল্প বলা শুরু করলেন হঠাৎ—কীভাবে তাঁর স্ত্রীর সাথে পরিচয়, আর তাঁরও মডেলিং করা নিয়ে ঘরে বোঝাপড়া করতে হয়, ইত্যাদি ইত্যাদি…
‘একজন মায়াবতী’
‘পাখি আমার একলা পাখি’
‘তিথির নীল তোয়ালে’
…হায় রে, আমার ন্যাংটাকালের একমাত্র বান্ধবী তিথি! ও নিজেই একটা উপন্যাস। এখন বুঝি, ওর বেঁচে থাকার উপায়টা গ্রহণ করতে পারি এখন…দু-হাতে আলিঙ্গন করেই, আমার বড়ো ভাইয়ার সাইন তিথির ছিল…সে-ও তো বিজয়ী, যোদ্ধা…উফফ্!
আচ্ছা, পরের নামটি…’তোমাকে’! ইয়া আল্লাহ, স্বপ্ন! কত-শত গান গাইতে মন চাইছে এখন…সব গানেই তো ‘তোমাকে’ আছে!
বাদ…বাদ! ওকে! পরেরটা…
‘পেন্সিলে আঁকা পরী’
…আমার স্কেচবুক তোমাকে দেখিয়েছিলাম না?
আমি কলেজে থাকতে পোর্ট্রেইট আঁকতেম, বিভিন্ন সেলেব্রিটির। আমার রুমমেটের ছোটোবোন চেয়ে নিয়ে গিয়েছে সব। এখন মনে হয়, রেখে দিলেই পারতাম নিজের কাছে!
‘নবনী’
…নাহ্, শুধু নামটিই সুন্দর! একটি মেয়ে ও তার নাম ব্যস্!
‘মেঘ বলেছে যাব যাব’
…আমি কিন্তু গত করোনায় জানালার ধারে বসে বসে বর্ষার প্রথম বৃষ্টির ঠিক পরেই প্রথম রংধনুটি ধরে তোমাকে মুঠো করে পাঠিয়েছিলাম। অবাক আমি নিজেই, শুধু সময় পেলেই, রাজ্যের সব কিছুই জীবনে এনে আনন্দ নেওয়া যায় আকাঙ্ক্ষার অভিজ্ঞতাগুলো থেকেও!
যাক বাব্বাহ্! বাঁচা গেল! সবকটা নাম অন্তত তোমাকে বলে যেতে পারলাম!
আচ্ছা, আসি। কফি খেয়েছি, হাতের বইটা শেষ করি?
আবার আসব।
এই যে তুমি,
তোমার বুক,
আমি তো আসবই
মাথা গুঁজতে।