মানুষ তার ভারসাম্য (balance) আর শান্তি (peace) হারিয়েছে নিজের প্রবৃত্তি ও অশাসিত আবেগের কারণে, আর সেই আবেগই আগুনের তলোয়ার হয়ে তাকে আধ্যাত্মিক স্বর্গ থেকে দূরে রাখছে।
মানুষের ইতিহাসে একটি অমর প্রতীক আছে—চেরুবিম, যার হাতে আগুনের তলোয়ার, যে ইডেনের দ্বারে পাহারা দেয়। আমাদের পূর্বপুরুষদের স্বর্গীয় নিবাসে ফেরার পথ রুদ্ধ হয়েছিল তার দ্বারা। কিন্তু এই কাহিনি কেবল অতীতে নয়, এটি প্রতিদিনই পুনরাবৃত্ত হয় আমাদের জীবনে।
ইডেনের উদ্যান হচ্ছে ভারসাম্য ও শান্তির প্রতীক। যখন মানুষ নিজের শরীর-মনকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, যখন তার জীবনীশক্তি ভারসাম্যে থাকে, তখনই সে এক নতুন জগতে প্রবেশ করে—এক অন্তর্গত ইডেনে, প্রভুর উদ্যানের মাঝে।
কিন্তু মানুষ তার কামনা, লালসা, বিভ্রান্তি আর অশুদ্ধতার কারণে সেই উদ্যান থেকে বহিষ্কৃত হয়। ইডেনের আগুনের তলোয়ার মানে হলো আবেগের আগুন, কামনার দহন। এটি মানুষের অশাসিত আবেগদেহ (emotional body), যা তাকে শান্তি ও আনন্দ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
মিথে আছে, ইডেনের দ্বাররক্ষী চেরুবিমের চারটি মাথা ছিল। এগুলো—মানুষের চারটি দেহের প্রতীক: শারীরিক, প্রাণশক্তি, আবেগিক আর মানসিক। তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলো আবেগদেহ—যখন এটি অশাসিত থাকে, তখনই তা জ্বলন্ত তলোয়ার হয়ে দাঁড়ায় মানুষ ও তার আধ্যাত্মিক আদর্শের মাঝে।
আজ পৃথিবীতে অধিকাংশ কষ্ট ও দুঃখের মূল হলো এই অশাসিত আবেগ। যখন মানুষ নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারায়, যখন আবেগ তার জীবন চালায়, তখনই সে অনুভব করে ইডেন থেকে বিতাড়িত হবার বেদনা।
শান্তি ফিরতে পারে একমাত্র তখনই, যখন মানুষ তার নিম্নতর সত্তাকে জয় করে। যখন সে আবেগকে শাসন করে, কামনার আগুনকে রূপান্তর করে আধ্যাত্মিক আগুনে, তখন আগুনের তলোয়ার আর নিচের দিকে থাকে না, বরং উপরের দিকে ওঠে—প্রতীক হয়ে ওঠে আধ্যাত্মিক পুনর্জন্মের। তখন মানুষ আবার প্রবেশ করতে পারে প্রভুর উদ্যানে, তার সত্যিকারের ঘরে।
কিন্তু যতক্ষণ মানুষ নিজের নিম্নপ্রকৃতির দাস, যতক্ষণ সে পশুসুলভ কামনার জালে আবদ্ধ, ততক্ষণ তার সামনে প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে জ্বলন্ত তলোয়ার। তখন মানুষ পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াবে প্রাণীর চামড়ায় মোড়ানো অবস্থায়—অর্থাৎ তার পশুত্ব নিয়েই বাঁচবে।
কেবল তখনই সে মুক্ত হবে, যখন বহু দুঃখ আর শোধনের আগুন পার হয়ে নিজেকে পরিশুদ্ধ আত্মা (purified ego) হিসেবে রূপান্তরিত করবে। তখনই সে অতিক্রম করতে পারবে সেই প্রহরীকে—যে স্ফিংক্সের মতো দাঁড়িয়ে আছে উচ্চতর জগতের দ্বারে।
ইডেনের উদ্যান মানে মানুষের ভেতরের ভারসাম্য ও শান্তি। জ্বলন্ত তলোয়ার মানে অশাসিত আবেগ ও কামনার আগুন। যে পর্যন্ত মানুষ আবেগের দাস, ততক্ষণ সে আধ্যাত্মিক স্বর্গে ফিরতে পারবে না। আত্মসংযম আর আধ্যাত্মিক পুনর্জন্মের মাধ্যমে মানুষই আবার প্রবেশ করতে পারবে সেই উদ্যানের দ্বারে।