ঘরভর্তি মানুষ। তাদের চোখে আছে গল্প, এক আশ্চর্য মাদকতায় ঘেরা গল্প! কারও ডুবে যাবার, আবার কারওবা ভেসে ওঠার গল্প। এ গল্প সম্পর্কের, অথচ আমি আজও একআনাও সম্পর্ককে বুঝতে শিখলাম না। আমি তো আজও কারও উপর ভরসা করতে পারিনি। আজীবন আমি গ্যাসট্রিকের ব্যথাকে উপেক্ষা করার মতোই অবলীলায় 'সম্পর্কে বাঁধতে চাওয়া’ মানুষগুলোকেও এড়িয়ে এসেছি। আমি কি সত্যিই এড়িয়ে এসেছি, না কি আজ অবধি আমি আসলে সেই মানুষটার দেখাই পাইনি?
ওই যে ঘরের কোণে মনেস্টেরা গাছের পাতায় হাত বোলায় উজ্জ্বল বাদামি চোখের মেয়েটি, যে তার বান্ধবীর সাথে তার নিজের মানুষটার গল্প করছে, আমি তো আজও অমন করে বলার মতন তেমন কাউকেই পাইনি! গল্প করার দু-চারজন পরিচিত মানুষ আমার আছে, কিন্তু গল্পটা বলব কার? আমার যে নিজের মানুষ নেই! আর…আর ওই যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছেলেটা, যে তার মানুষটাকে অপেক্ষা করতে বলেছে, এক্ষুনি নাকি সে বেরিয়ে পড়বে তার মানুষটার কাছে ফেরার জন্য…কই, আমাকে তো কেউ ফেরার গল্প শোনায় না।
আশ্বস্ত হওয়ার তৃষ্ণা বড়ো তৃষ্ণা! আমার তো কেবলই ফিরে যাবার প্রহর গুনতে হয়! নইলে আমিও বছরান্তে পাহাড়ঘেঁষা কোনো এক গ্রামে বেড়াতে যাবার প্ল্যান করতাম। আমিও মানুষটার ফেরার অপেক্ষায় লেবুজল হাতে অপেক্ষা করতাম, তারপর সে বাড়ি ফিরলে মোরাল মাছের চচ্চড়ি দিয়ে একসাথে ভাত খেতাম। আমার মুখে একগ্রাস ভাত তুলে দিতে দিতে হয়তো সে-ও বলত, “লেবুপাতা দেওয়াতে চচ্চড়ির স্বাদ বাড়ল, না কি আজ ভালোবাসা একটু বেশিই ছিল?” আমি সলজ্জ মুখে হাসি লুকিয়ে তার পাতে আরও দুইটা মাছ তুলে দিতাম পরম আহ্লাদে।
আমি লক্ষ করেছি, আজ এই বন্ধুমহলে সবাই তার নিজের মানুষের গল্প করছে, এ যেন এক সিরিয়াস মিটিং চলছে, যেখানে সবার অংশগ্রহণ করাটা বাধ্যতামূলক আর এই মিটিংয়ের পূর্বনির্ধারিত একমাত্র অঘোষিত এজেন্ডা হচ্ছে: ‘সম্পর্ক এবং সম্পর্কিত মানুষ’। ব্র্যাকেটে আবার লেখা আছে: ‘উল্লেখ্য, সম্পর্ক বলতে এখানে নিজের ভালোবাসার মানুষকে বোঝানো হয়েছে’। আশ্চর্য, সম্পর্ক না হয়ে এখানে টপিক তো ভালোবাসাও হতে পারত!
ভালো তো আমিও কম বাসিনি। আমি শুধু অপেক্ষা করতে পারিনি, কারণ আমি জানতাম, সে কখনোই আসবে না। তার আসার কথা ছিলও না। সে আর যা-ই হোক, কথা রাখতে জানে। তাই তো আজও কাউকে আর নিজের করে নিতে পারিনি। সে আমার কাছে ফিরে আসার নয়; কথা নিয়েছিল, ভালোবাসা বলতে নাকি আমি শুধুই তাকেই বুঝব। বুঝি, ভালোবাসা বুঝি কি না জানি না, তবে আমি কেবল তাকেই বুঝি।
মনে হচ্ছে, যিনি এই মিটিংয়ের টপিক নির্বাচন করেছেন, তিনি ভীষণ রকমের রেসিস্ট, নয়তো এমনভাবে কেউ…! মামলা ঠুকে দেবো নাকি? আছে এর বিরুদ্ধে কোনো আইন? ধারা কী হবে তার? ৪২০-এর আশেপাশে কিছু? আচ্ছা, ৪২০ ধারার কথা বলতেই আমার ঈশ্বরের কথা কেন মনে হলো? তবে কি টপিকের নির্বাচক তিনিই? না কি তিনি আমার সাথে প্রতারণা করেছেন? হবে হয়তো, নইলে আমার লেবুজল যে অম্লতা হারিয়ে বিষাক্ত হলো, মাছের চচ্চড়িটাও তো টকে গেল, কিন্তু আজও কেউ বাড়ি ফেরার গল্প তো শোনাল না। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না।
আমি তবে মামলাটা করব কোন আদালতে?