আমাকে আপনারা চিনবেন না। আমি অবনি। ভিকারুন্নিসায় পড়ি, ফার্স্টইয়ার। অনেক দিন হলো, বাবা রিটায়ার্ড; আগে কলেজে পড়াতেন। আমার খুব কথা পায়, বলতে পারি না, আটকে যায় শুধু। সরাসরিই বলি, আসলে আমি তোতলা। বললাম এজন্যই, যাতে আমার সাথে কখনও দেখা হলে আপনারা আমাকে বোবা না ভাবেন। এটা তো আর অসুখ নয় যে অসুখটা সেরে ওঠা অবধি এটা সেটা বলেটলে পাশ কাটিয়ে যাব। অবশ্য, পাশ কাটাতে আমি চাইও না। বিশ্বাস করুন, আমি সত্যিই বোবা নই। কথা আমি বেশ ভালোই বলতে পারি। আমার বইপত্র, ড্রয়িংয়ের আর লেখার খাতা, অ্যাকুরিয়ামের মাছগুলি, আমার পোষা টিয়াটা… ওদের সাথে আমি অনেক কথা বলি…প্রচুর আবোলতাবোলও বকি, ওরা আমাকে চেনে। এই বাসাতে, আমাকে নিয়ে, সম্ভবত, শুধু ওদেরই কোনও অভিযোগ নেই। জানেন, আমার বেস্টফ্রেন্ড হচ্ছে টিয়াপাখিটা। আমি তোতলা, এই ব্যাপারটা সে ঠিকমতো বোঝে না, কিংবা বুঝেও কিছু বলে না। বাকিরাও এমন করে। এমনও হতে পারে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সাথে আমি যে ভাষায় গল্প করি, সে ভাষাতেই আমি অনায়াসে ওদের কাছে চলে যাই…মাছ, পাখি, বই, ছবি, লেখা…! ‘এত মিষ্টি একটা মেয়ে, অথচ ঈশ্বর ওকে এমন করে রাখল… কথা আটকায়, পা-টাও খোঁড়া…আহা, কী কষ্ট!’ …আমার মুখস্থ হয়ে গেছে একদম! আমি খুব ভালো করেই জানি, আমাকে দেখার পর কী বলতে হয়। এটা মাথায় রেখেই আমি মানুষের সামনে যাই, এবং অসহায় চোখে চুপচাপ তাকিয়ে থাকি। এই অসহায়ত্বই আমার নিয়তি এবং আমি এতে অভ্যস্ত। অবনি জানে, সে একটা মিষ্টি - তোতলা - খোঁড়া মেয়ে। ছোটোবেলায় আমার পোলিও হয়। তখন থেকে আমি খুঁড়িয়ে হাঁটি, মানে আমাকে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয় আরকি! এই পৃথিবীতে কোন মানুষটা ইচ্ছে করেই…তোতলায়, খুঁড়িয়ে হাঁটে…আপনারাই বলুন? ঈশ্বরের কাছ থেকে, এই আশ্চর্য যুগলবন্দিত্ব, আমাকে অর্জন করে নিতে হয়নি, হাত না পাততেই পেয়ে গেছি, যেমনি পেয়েছি মানুষের উপেক্ষা, করুণা…! …আমার গল্পটা পড়তে যে আপনাদের খারাপ লাগছে না, এটা আমি জানি। মানুষ সুন্দরকেও অসুন্দর দেখতেই পছন্দ করে, নিখুঁত সৌন্দর্য ঠিক সহ্য করতে মানুষ পারে না। আর অবনি তো সত্যি সত্যিই…! গল্পই বলুন, আর কবিতাই বলুন, মানুষ কখন ওটা আগ্রহ নিয়ে পড়ে, জানেন? যখন ওখানে কিছুটা অন্ধকারও মেশানো থাকে, তখন! আপনারা এসব জানেন, বোঝেন। সাথে এ-ও জানেন, গল্প থেকে বাস্তবতায় ফিরে এলে একজন অবনির দিকে… আপনারা কখনও ফিরেও তাকাবেন না। বাস্তবের অবনিকে একপৃষ্ঠাও পড়ার সময় আপনাদের নেই। বিশ্বাস করুন, আমি এখনও পর্যন্ত, এর বাইরে গিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করতে পারিনি। আমাকে নিয়ে গল্প লিখুন, বেশ জমে যাবে,…যদিও, আমাকে নিয়ে মাত্র একটা বিকেলের আড্ডাও জমানোর ক্ষমতা ঈশ্বর আপনাদের দেননি! আড্ডা বাদ দিন, আড্ডা তো অনেক বড়ো ব্যাপার, এই হতচ্ছাড়া জীবনে, একটিও বন্ধু অবনি আজ অবধি জোটাতে পারেনি! বন্ধু বলতে, আমি মানুষের কথা বলছি! বাস্তবের অবনিকে নিয়ে ঠাট্টা করতেই আপনাদের ভালো লাগে! অবশ্য, আমি নিজেও করি…! অবনি একজন অষ্টাদশী সুন্দরী…! তার অষ্টাদশী তোতলামি, তার অষ্টাদশী খোঁড়াত্ব! আসুন, আমরা অবনিকে দেখে সবাই মিলে হাসি। হাসলে হার্ট ভালো থাকে। হা হা হা! …পাড়ার ভাইয়াদের সাথে সুর মিলিয়ে আমিও হেসে উঠি, আর ঈশ্বরকে বলি, হে ঈশ্বর! তুমি ওদের হৃৎপিণ্ডের সুস্থতার দায়িত্ব নিলে, অথচ আমার এ দুচোখের সমস্ত অশ্রুর পুরো দায়িত্ব আমার কাঁধেই ছেড়ে দিলে? আজ মা থাকলে মায়ের সাথে অনেক কথা বলতে পারতাম। আচ্ছা, সত্যিই কি পারতাম? মায়েরা কেমন হয়? মায়েরা কি নিজের তোতলা মেয়ের সাথেও গল্প করে? না কি দূরে রেখে দেয়? জন্মের পর থেকে মাকে তো দেখিনি, তবে ওদের মুখে শুনেছি, মায়েরা নাকি খুব ভালো হয়, অনেক আদর করে করে কথা বলে। যে তোতলা মেয়েটা খুঁড়িয়ে হাঁটে, তার মা-ও কি তাকে খোঁড়াই দেখে? …থাক ওসব, যদিও জানি, আমার ব্যথায় ব্যথিত হবার সময় আপনাদের নেই! মুখের মধ্যে মার্বেল রেখে দেওয়া, জিহ্বার হাজারো ব্যায়াম, ডাক্তারবাড়ি দৌড়োনো… চেষ্টার কণামাত্রও ত্রুটি বাবার ছিল না। তবু কোনও লাভ হয়নি। আমি জানি, লাভ আর হবারও নয়! অবশ্য, বাবা এটা আমাকে বলেননি। বাবা ভাবেন, ‘আমার মেয়েটা এখনও অনেক ছোটো, ও কিচ্ছু বোঝে না!’ বাবারই-বা কী দোষ! বাবা যে আমাকে কেবল আঠারোই দেখেন…কিংবা আরও কম! বাবারা সত্যিই বড্ড ছোটোমানুষ! আসলে কী জানেন, ছোটো হয়ে থাকতে আমিও চাই। কিন্তু পারছি আর কই, বলুন! একটা তোতলা - খোঁড়া মেয়ের বয়সকে ঈশ্বর সব সময়ই অন্তত দুই দিয়ে গুণ করেন! তার বাইরের পৃথিবীটা প্রতিদিনই এক বার করে বদলে যায়। তার কখনও বন্ধু হয় না। ঠিকমতো কথাই বলতে পারে না যে, তার বন্ধু হয়েও-বা কী লাভ? ক্লাসের টিচাররা অনেক ভালো, আমাকে কখনও পড়া জিজ্ঞেস করেন না। ক্লাসের মেয়েরা তার চাইতেও ভালো, অবনিকে কখনও প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে না। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তিনি আমাকে মানুষের সমস্ত ঈর্ষার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন! ভালো কথা, আমাদের পাশের বাসায় একটা অমিত ভাইয়া আছেন। স্কুলে যখন ছিলাম, তখন থেকেই ভাইয়াকে আমার খুব ভালো লাগে। ওঁর হাত নেড়ে নেড়ে কথাবলার ধরন, চুলের স্টাইল, দাঁড়িয়ে থাকা, ক্রিকেট খেলতে যাওয়া,… এমনকি, ভাইয়া যখন জোরে জোরে শব্দ করে পড়েন, বাইরে থেকে ঘরে ফিরে চিৎকার করে মা মা ডাকেন,…তখনও দেখতে দারুণ লাগে! হ্যাঁ, আমি ভাইয়াকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখি…পর্দার ফাঁক দিয়ে…অনেক বছর ধরে! ভাইয়া অবশ্য আমার এসব পাগলামির কথা জানেন না। কারও কাছে পাগলামি দেখাবার সাহসটা অবনির নেই। আমি ভাবি,…এইসব হাসি, খুশি, চিন্তা, অনুভূতি…ভালোবাসা নয়? না কি অবনিদের মনে ভালোবাসা থাকতেই নেই? অমিত ভাইয়া সাহিত্যের ছাত্র। জীবন পড়েন, ভালোবাসা পড়েন। কিন্তু ওসব তো পাঠ্যবিষয়, পড়তেই হয়। আচ্ছা, ভাইয়া কি আমাকে বোঝেন? একটুও? ‘অবনি, কোথায় যাও?’ এই কথাটা ভাইয়া আমাকে অনেক দিন বলেন না। আমি চাই, ভাইয়া আমাকে দেখুক, আমার দিকে তাকিয়ে হাসুক, একটু কথা বলুক… তাই মাঝেমধ্যে, ইচ্ছে করেই, অমিত ভাইয়ার সামনে গিয়ে পড়ি! তখন তিনি, একধরনের মসৃণদৃষ্টিতে, আমার দিকে তাকিয়ে…একটুখানি হাসি ছুড়ে দেন, আর অমনিই, আমার ভেতরটায় তোলপাড় শুরু হয়ে যায়! বার বারই মনে হয়, যাঁকে এতগুলি বছর ধরে ভালোবাসি, যাঁকে নিয়ে সারাক্ষণই এত এত ভাবি, তবে কি তিনি আমাকে মেনে নিচ্ছেন…আমার মতো করে? সত্যি সত্যিই, আমার পাগলামিকে আশ্রয় দেবেন…অমিত ভাইয়া? পরক্ষণেই নিজেকে বোঝাই…এই অবনি! এত পাগলি হলে চলে, বল? এটা ভালোবাসা নয় রে, বোকা! এটার নাম…সহানুভূতি!