আমার শৈশবটা তোমাদের শৈশবের মতো গোছানো কিছু নয়। মায়ের আদর, বাবার স্নেহ আমি কখনও পাইনি। আমি সবসময়ই ওদের ঝগড়া করতে দেখে দেখে বড়ো হয়েছি। আমাকে দেবার মতন সময় আমার বাবা-মা'য়ের সত্যিই কখনও ছিল না। আমি ওদের জিততে দেখেছি। আমি আমাকে হারতে দেখেছি। আজ আমি লক্ষ্যহীন, আমার আচরণটা একটু কর্কশ। আমি বোধ হয় ঠিকভাবে কথা বলতেও জানি না, তাই আমি ভীষণ সংকোচে কুঁকড়ে থাকি। কখনও কখনও, আমিও, তোমাদের মতো করে, আমার চারিদিকে তাকাই। ভাবি, আমি আসলে কী হতে চাই? রাস্তায় যখন কেউ বাঁশি বাজায় কিংবা গান ধরে, তখন তার চারপাশে আমার বয়সি কিছু ছেলে-মেয়ে জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ওরা জানে, তাকে দেবার মতো একটিও পয়সা ওদের পকেটে নেই। তবু ওরা দাঁড়িয়ে থাকে, লোকটার দিকে মুগ্ধচোখে তাকিয়ে থাকে। ওদের মনে হতে থাকে, লোকটা হয়তো জাদুকর! আমিও ওদের দলে থাকতে চাই। আমি সেই ছোট্ট ছেলেটি হয়ে বেড়ে উঠতে চাই, যে তার ব্যাগে সবসময়ই অন্তত এক প্যাকেট বিস্কুট রাখে যাতে রাস্তায় হাঁটার সময় অভুক্ত কুকুর দেখলে বিস্কুট খাওয়াতে খাওয়াতে তার সঙ্গে খেলতে পারে। মৃত্যুর আগে আমি কিছু কুকুরের কৃতজ্ঞতা গভীরভাবে অনুভব করতে চাই। আমি বড়ো হয়ে আমাদের পাড়ার সেলিম চাচার মতন বোকা হতে চাই, যিনি জীবনে কখনও তেমন কিছু করতে না পারলেও আমাদের এবং আমাদের আশেপাশের পাড়ার কয়েক হাজার অসহায় শিশুর জীবন পালটে দিয়েছেন। চাচাকে সবাই শুধু হারতেই দেখেছে, আর চাচাকে আমি শুধু জিততেই দেখেছি। চাচার মধ্যে কোনও কিছু নিয়েই একটুও অভিযোগ নেই, অপ্রাপ্তি নেই। চাচা শুধু হাসেন। আমিও চাচার মতন ওরকম তৃপ্তি নিয়ে হাসতে চাই। আমি বুড়ো হয়ে একজন রমেন দাদু হব, যিনি রোজ ভোরে হাঁটতে বের হন শরীর ফিট রাখতে নয়, সকালের আলো-হাওয়া ছুঁয়ে দেখতে নয়, বিশেষ কোনও জরুরি কাজেও নয়---শুধুই কিছু শিউলিফুল কুড়োনোর লোভে। ফুলগুলি সারারাত ধরে মাটিতে ঝরবে শুধুই আমার জন্য। আমি দু-হাত ভরে শিউলি কুড়োবো, প্রাণভরে ঘ্রাণ নেব, শিউলির স্নিগ্ধতা সারামুখে-সারাচোখে মাখব। এটাই আমার অ্যাম্বিশন। আমি অনেক অনেক গল্পের বই পড়ব। এবং, সবাইকে ধরে ধরে ওসব গল্প শোনাব। আমাকে তো কেউ কোনোদিন গল্প শোনায়নি, তাই আমি জানি, বেঁচে থাকার জন্য কিছু গল্প শুনতে হয়। আমার খুব গল্প শুনতে ইচ্ছে করত। কিন্তু আমাকে দেবার মতো সময় কারও হাতে কখনও ছিল না। সবাই শুধু জিততেই ব্যস্ত হয়ে ছিল। আমি চাই, আমার হাতে যেন গল্প বলার ও শোনার মতো সময় থাকে। তোমরা আমাকে যতটা উদ্ভট ভাবো, ততটা উদ্ভট আমি নই। আমি সত্যিই তোমাদেরই মতন। আমি মিশতে শিখিনি, কিন্তু মিশতে আমারও খুব ইচ্ছে করে। বিশ্বাস করো, আমি অসামাজিক নই। আমি চুপচাপ থাকি, এর মানে এ নয় যে, আমার অনেক রাগ। আমার সঙ্গে কখনও কথা বললে টের পেতে, আমি অনেক শান্ত একজন মানুষ। পুরো পৃথিবীর উপর আমার অনেক অভিমান জমে আছে। আমার সবচাইতে কাছের মানুষগুলি আমাকে কখনও ভালোবাসেনি, সময় দেয়নি, বুঝতে চায়নি। আমাকে ভুল বুঝো না। তোমরা সত্যিই ভাবতেও পারবে না, আমি কীসের মধ্য দিয়ে বড়ো হয়েছি। আমাকে কেউ কখনও ভালোবেসে একটা আইসক্রিম, হাওয়াই-মিঠা কিংবা চকলেট কিনে দেয়নি। আমার শুধু ততটুকু সফল হলেই চলবে, যতটুকু হলে আমি সেইসব শিশুর হাতে অন্তত সস্তা দুটো লজেন্স তুলে দিতে পারি, যাদের শৈশবটা আমার শৈশবের মতন। জীবন থেকে এটাই আমার চাওয়া। আমি আমার বাবা-মা'কে সবসময়ই সফল হতে দেখেছি, কিন্তু কখনও শান্তি পেতে দেখিনি। নিজের জীবন থেকে আমি জানি, বেঁচে থাকার জন্য সাফল্যের চাইতে শান্তি অনেক অনেক বড়ো।