প্রিয় ঋভু,
আমি শুধু চাইতে শিখিনি বলে সব কিছুই আমার সামনে এসেও কীভাবে যেন চলে যায়! আমি জানি, আমার কথাগুলি শোনার সময় আপনার নেই। তবুও আমি বলব। একটাই অনুরোধ, প্লিজ, বিরক্ত হবেন না। ও ভালো কথা, আপনাকে ‘প্রিয়’ ডেকেছি বলে রাগ করেননি তো? কী করব, বলুন! আমি আপনাকে শুধুই আপনার নাম ধরে ডাকতে পারি না যে! অবশ্য, আপনার হাতে এখনও, আমার কথায় রাগ করার সময়টুকুও আছে, এটা বিশ্বাস করার স্পর্ধা এখন আর আমার হয় না।
‘বিয়ে’ শব্দটাই কেমন জানি অদ্ভুত, জীবনকে একেবারে অতিষ্ঠ করে দেয়! একটা মেয়ের মেয়ে হয়ে থাকাটা বন্ধ হয়ে যায় কখন, জানেন? যখন ওর বিয়ের বয়স হয়, কিংবা যখন ওকে বাড়ির সবাই অন্য ঘরে দেখতে চায়। আমাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার সকলের সকল আয়োজন আর ভীষণ তাড়া আমাকে বার বারই মনে করিয়ে দিচ্ছে, আমি কেবলই মেয়ে না, আমি কালো মেয়ে আমি কালো মেয়ে! কালো মেয়ে হয়ে জন্মানোর অর্থই হচ্ছে, তুমি কাউকে অপছন্দ করতে পারবে না। কালো মেয়ের আবার পছন্দ-অপছন্দ কীসের? কালো মেয়েকে কেউ পছন্দ করছে, এ-ই তো বেশি! কী এক উদ্ভট সমাজে আমরা বাস করছি, না?
আমি কেন আমার কল্পনার রাজ্যে আর থাকতে পারছি না? আমি ঠিক করেছি, পালিয়ে যাব। কেউ সাথে যাবে না, জানি; তবুও যাব। দূরে, অনেক দূরে। ওই দূর পাহাড়কোণের এক আশ্রমে। আমি শকুন্তলার মতো থাকব। আচ্ছা, ওরা কি কালো মেয়ে রাখবে না? ওরাও কি ফিরিয়ে দেবে আমাকে?
আচ্ছা ঋভু, আপনি কি শুনতে পান না আমি আপনাকে প্রায়ই চিৎকার করে বলি, “আমাকে একটু সময় দাও, আমি ঠিক ঠিক তোমার যোগ্য হয়ে উঠব। তুমি শুধু আমার পাশে থাকো . . . এই নিষ্ঠুর মানুষগুলির হাত থেকে আমাকে বাঁচাও।” আপনি আমাকে প্রশ্রয় দিতে না পারেন, আশ্রয় তো দিতে পারেন। কী? পারেন না? একটুখানিও? মানুষ রাস্তায় কুকুরছানা কুড়িয়ে পেলে কি ছুড়ে ফেলে দেয়? ওইটুকু সামর্থ্য বিধাতা তো আপনাকে দিয়েছেনই। আমার বেলায় যতটা, আপনার বেলাতে অতটা কৃপণ তো তিনি নন। এই সাধারণ মেয়ের জন্য আপনি কি পারবেন না অন্তত কার্পণ্যে হলেও বিধাতাকে হারিয়ে দিতে?
হায় রে স্বপ্ন! আমি এখন আর স্বপ্নকে স্বপ্ন বলি না, পাপ বলি। হ্যাঁ, ওটা পাপ। মা বললেন, সেদিন নাকি জ্বরের ঘোরে আমি ‘ঋভু ঋভু’ বলে কাঁদছিলাম। ওটা কি স্বপ্ন, আপনিই বলুন? পাপই তো, না? সাধারণ মেয়েরা পাপকে স্বপ্ন ভেবে নিয়ে ভুল করে। আমার স্বপ্ন দেখতে বড্ড বেশিই কষ্ট হয়। আমি আর স্বপ্ন দেখব না। যে স্বপ্ন মৃত্যুর ঠিকানা দেয়, সে স্বপ্নের কী অর্থ?
এই মুহূর্তে হাতের সেলফোনটা যদি ভেঙে টুকরো টুকরো করতে পারতাম! ঋভু, তুমি কি বুঝতে পারছ না যে তোমার অস্তিত্ব আমাকে প্রতিটি মুহূর্তেই অস্তিত্বহীন করে দিচ্ছে? ইদানীং ভগবানের সাথেও আর অভিমান হয় না। যে অভিমান ভাঙায় না, তার সাথে আবার কীসের অভিমান? আমার ভগবানের কাছে কিছু চাইতেও সংকোচ হয়। এত বার খালিহাতে ফিরে গেলে আর চাইবই-বা কীভাবে, বলুন? যে রূপের আশ্রয় ভগবানও দিতে পারেন না, আপনিই-বা তা কীভাবে দেবেন? আপনার প্রতি আমার আর কোনও অভিযোগ নেই।
শুক বলে, আমার কৃষ্ণ জগতের প্রাণ। শারী বলে, আমার রাধা জীবন করে দান; থাকে কি আপন প্রাণ? . . . গোবিন্দ অধিকারীর লেখা গান। গাওয়া গানটা একটু অন্য রকম, কিছুটা এদিক ওদিক আছে। শুনেছেন? না শুনলে লোপামুদ্রার কণ্ঠে শুনবেন। কণিকার কণ্ঠেও আছে, লোপারটাই বেশি মিষ্টি। বিশ্বাস করুন, মন ভরে যাবে। একটু কষ্ট করে ভোরবেলায় শুনতে পারবেন না? ভয় পাবেন না, এই কালো মেয়েটা আপনাকে ফোন করে ঘুম ভাঙাবে না।
আজ পূর্ণিমা, জানেন তো? ছাদে যাবেন? যান না! কী সুন্দর জোৎস্না উঠেছে! আমি আর ছাদে জ্যোৎস্না দেখতে যাই না। তাই নরোম আলোর চাদরে আমার ঘর ঢেকে যায়। প্রকৃতি কখনওই অসুন্দরের সৌন্দর্যকে ঈর্ষা করে না।
জানেন ঋভু, আমার না ছোটোবেলার কথা মনে পড়ছে। এরকম জ্যোৎস্নায় কারেন্ট চলে গেলে বাবা বলতেন, “রেবা, কেয়া, লতা! হারমোনিয়ামটা নিয়ে আয় তো মা।” আমরা বুঝতাম, আজ আর পড়তে হবে না। কী যে খুশি হয়ে উঠতাম! হারিকেনটা নিভিয়ে দিয়ে দোতলার ছাদে ছুটে যেতাম। বাবা কখনও শুধু এক জনকে ডাকতে পারতেন না, অথবা ডাকতেন না, সবাইকেই একসাথে ডাকতেন। বড়দি আমার চেয়ে এগারো বছরের আর ছোড়দি নয় বছরের বড়ো ছিল, ওরা যখন অনার্সে পড়ত, তখন আমি ফাইভ কি সিক্সে পড়ি। এখন প্রায়ই আকাশের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি, বাবা, তুমি যদি আমাকে ফেলে চলেই যাবে, তবে আমাকে ভালোবাসার দায়িত্বটুকু কাউকে দিয়ে যাওনি কেন? ভালোবাসায় বাঁচতে শিখিয়ে দিয়ে এমন ভালোবাসাশূন্য করে রেখে গেলে, বাবা!
হাসছেন, না? ভাবছেন, ভালোবাসাটাও কি একটা দায়িত্ব নাকি? অধিকার দিয়ে অনুভব করা কাকে বলে জানেন? বোঝেন? আমি জানি। বাবাকে দেখে দেখে আমি ভালোবাসা শিখেছি, ভালোবাসতে শিখেছি। ছোড়দির হারমোনিয়ামটা নিয়ে আমরা ছাদে শীতলপাটি বিছিয়ে চাঁদের কোমল আলোয় ছড়িয়ে বসতাম। আমি এখন আমার পুরনো দিনের মা’কে খুব মিস করি। মা তখনও আমার আহ্লাদ-আদিখ্যেতাকে ঢং বলতে শিখে যাননি। আমি গাইতাম, “চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে . . .” এটা থাকতই। বাবা চাইতেন, এটা থাকুক। আমি গাইতাম, আর বাবা হাত বাড়িয়ে যেন সেই পুরনো সন্ধ্যার ঠান্ডা হাওয়া, দুধের সাদা সরের মতো আলোয় ভরা হাসনাহেনার মিষ্টি ঘ্রাণ ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতেন। মা আঁচলে বেলি ফুলের মালা নিয়ে বাবার বাহুতে মাথা রেখে পাশে বসে কীরকম যেন শান্ত হয়ে শুনতেন। আমার মনে হতে থাকত, আমি যেন এক চাঁদের আলোয় ভরা মেয়ে!
বাবা বলতেন, রেণুকা, তুমি দেখো, আমাদের লতা যে ঘরে যাবে, সে ঘরে রোজ রোজ পূর্ণিমা হবে। হায় রে নিয়তি! বাবা, তুমি কি দেখতে পাচ্ছ, তোমার কালো মেয়ে লতা আজ কতটা অসহায় হয়ে ঘর খুঁজে ফেরে? এ পৃথিবীতে লতাদের কোনও ঘর নেই, বাবা! ছোড়দি গাইত, “পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায় . . .” মা-ও সাথে গলা ধরতেন। ছোট্ট আমি গুটিসুটি মেরে বাবার কোলে লুকিয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতাম, বাবার চোখের মণিতে সন্ধ্যাতারারা খেলছে। মুখের উপর ছড়িয়ে থাকা মায়ের চুলগুলি আঙুল দিয়ে সরিয়ে বাবা তাঁর কালো মোটা ফ্রেমের চশমাটা মায়ের আঁচল দিয়ে মুছে নিতেন। এখন আমি গুন গুন করি, “দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না . . .”
ওই কোলটাকে আজ খুব মিস করি। অতটা নিরাপদ নির্বিঘ্ন নিরুদ্বিগ্ন নিশ্চিন্ত আশ্রয় আরও আছে, এটা অবিশ্বাস করতে শিখে যাওয়ার মতো আজ যথেষ্ট বড়ো হয়ে গিয়েছি বোধ হয়। ঋভু, আপনাকে বলছি না এইসব। কিছুতেই না! এইসব আমার প্রিয় কিছু প্রলাপ। আপনি শুনছেন না তো এইসব কিছু?
আজকের দিনে বাবা ‘আমাকে’ ছেড়ে গিয়েছিলেন। আমার এখন আর ‘আমাদের’ বলতে ইচ্ছে হয় না, তাই ‘আমাকে’ বলেছি। আমার যে কেউই নেই! আমি কাউকে আপন ভাবতেও পারি না আর। ভালোবাসাহীনতা মানুষকে বড়ো বেশি স্বার্থপর করে দেয়। যাকে কেউই ভালোবাসে না, সে-ই সব থেকে বেশি নির্ভার। স্বার্থপর হতে হলে নির্ভার হতে হয়। আমার মরে যেতেও ইচ্ছে হয় না। যার বাঁচারই মানে নেই, তার মরে যাওয়ারই-বা কী মানে? মরে যেতে হলেও তো অভিমান করার জন্য কাউকে-না-কাউকে লাগে। হ্যাঁ, লাগেই . . .!
জানেন, বাবার সেই কালো ফ্রেমটা এই মুহূর্তে আমার টেবিলে রবি ঠাকুরের উপরে রাখা। আমি ফ্রেমের ভেতর দিয়ে বাবার সরল চোখদুটো দেখতে পাচ্ছি! আজ এতদিন পর বুঝতে পারছি, এত এত গান থাকতে ওই দুটো গানই কেন বাবা গাইতে বলতেন! জ্যোৎস্না মনে হয় অনেক কিছু মনে করিয়ে দেয়!
এইসব আপনাকে কেন বলছি! আমি জানি না! আমি সত্যিই জানি না!
আগের মতো ভাবতে আর পারি না। ভাবিও না। যা হচ্ছে হোক না! কতটুকুই-বা হবে? কতটুকুই-বা হতে পারে? কতটুকুই-বা হয়? মাঝেমধ্যে চারপাশের সমস্ত কিছুকে মিথ্যা মনে হয়। এই যেমন এখন আপনাকে লিখছি, একটু পরেই হয়তো ভাবনাগুলি অন্য রকম হয়ে যাবে। কী অদ্ভুত, না? কেন এমন হয়? আমি ভাবতেও পারি না। আমার মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা হয়। হাত-পা সমস্ত শরীরমন অবশ হয়ে আসে। ইদানীং আমার কিছুই ইচ্ছে হয় না, অনুভূতিও হয় না। ভাবি, কী দরকার? সবাই যা বলে, তা-ই নিষ্কামভাবে করে যাই। এটাই তো ঠিক, না, . . . বলুন? আমি আর অত ভাবনা ভাবব না, মন খারাপ করে থাকব না। আই ডোন্ট কেয়ার অ্যাবাউট অ্যানিথিং! লেট ইট গো! লেট ইট গো ফরএভার!
শুধু মাঝেমধ্যে মনে হয়, কী যেন একটা করার ছিল, কী যেন একটা করার ছিল! দু-দিন থেকে আউট অব স্টাডিজ, আউট অব এভরিথিং। আমার মন যে কীসের গতিতে চলে, ঠিক বুঝি না। এই যে আপনাকে লিখছি, লিখতে লিখতেই মনে হচ্ছে, কী একটা ফালতু কাজ করছি! কতদিন যে এভাবে লিখে-টিখেও আপনাকে আর পাঠাইনি, আপনি তা কোনওদিন জানতেও পারবেন না। . . . জানি, এটাও আপনার কাছে যাবে না। পাঠানোর কথা মনে হলেই আমি ভাবতে থাকি, কী দরকার এইসবের! কী ভাববেন আমাকে! উফফফ! আর পারছি না! যা ইচ্ছে ভাবুন তো . . . এই কালো মেয়েটাও নাকি আবার ভাববার কিছু!
কাউকে ভালোবেসে ফেললে কখনও সে মানুষটির কাছে যেতে নেই। আমি নাহয় তাকে ভালোবাসি, কিন্তু সে যদি আমাকে ভালো না বাসে, তখন?
অনেক কাজ পড়ে আছে। যাই . . .