আত্মা ও পদার্থের রহস্য: ২



মানুষের সীমাবদ্ধতা

শরীর হলো মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। কিন্তু যদি যন্ত্রটি (শরীর) দুর্বল বা খারাপভাবে গড়া হয়, তাহলে ভেতরে প্রতিভা থাকলেও মানুষ কখনোই পূর্ণতা পাবে না। ফল হবে কর্কশ সুর—যা কেবল গায়ককেই নয়, পরিবেশকেও অশান্ত করবে।

মানুষের চারটি দেহের কেন্দ্রগুলো হলো তার বেহালার তার। আধ্যাত্মিক সচেতনতা এই তারগুলোয় বাজায়। যদি তারা সঠিকভাবে সুরে বাঁধা থাকে, তাহলে সেখান থেকে উঠে আসে গির্জার বা মন্দিরের ঘণ্টার মতো নির্মল সুর।

একজন মহান সংগীতজ্ঞও যদি খারাপ যন্ত্র হাতে পান, তাহলে তিনি সত্যিকারের সংগীত প্রকাশ করতে পারবেন না। ঠিক তেমনি, মানুষের আত্মা যত মহানই হোক না কেন, যদি শরীর-মন নামের যন্ত্রটি দুর্বল হয়, তাহলে সংগীত বিকৃত হবে। সুতরাং—দেহকে যত্নে গড়ে তুললে, মনকে সুরে বাঁধলে, আবেগকে শুদ্ধ করলে—তাহলেই আত্মা বাজাবে চিরন্তন সুরেলা সংগীত।

আমাদের দেহ হলো ঈশ্বরপ্রদত্ত বাদ্যযন্ত্র। যন্ত্র যদি সুরে বাঁধা থাকে, আত্মার সংগীত হবে সুমধুর। যন্ত্র যদি ভাঙা বা কর্কশ হয়, আত্মার সংগীতও বেসুরো হয়ে যাবে।

শরীর হলো আত্মার বেহালা। ভাবুন—আপনার হাতে বেশ দামি একটি বেহালা, কিন্তু বাজাতে জানেন না। তাহলে কি বেহালার দাম আপনাকে সংগীতজ্ঞ করে তুলবে? না। প্রকৃতিতে সব জায়গায় একই নিয়ম—দুটি জিনিস দরকার: বাদ্যযন্ত্র আর বাদক। এদের মধ্যে সুর মেলানো না হলে শুধু অমিল আর বেসুরো সুরই জন্মাবে।

একটি শক্তিশালী শরীরও, অচেতন আত্মার হাতে সমর্পিত হলে, সেটি হবে একটি দামি বেহালা... একজন অপটু বাজনিয়ার হাতে। আবার এক মহৎ আত্মা যদি বেসুরো, দুর্বল শরীর পায়, তাহলে সেটি হবে এক মহান শিল্পীর হাতে সস্তা, খারাপ যন্ত্র তুলে দেওয়া। দুই ক্ষেত্রেই ফল একটাই—অসামঞ্জস্য।

যন্ত্রনির্মাতা ও মানুষের তুলনা

যেমন বাদ্যযন্ত্রের কারিগর দুই রকমের—১. যারা কেবল বিক্রির জন্য যন্ত্র বানায়, দিনে ডজনখানেক তৈরি করে। তাদের যন্ত্র দেখতে ভালো হলেও তাতে প্রাণ থাকে না। ২. আরেক দল আছে, যারা শ্রম দেয় আনন্দের জন্য, যন্ত্র তৈরি করে ভক্তি-প্রেম মিশিয়ে, যেন সেটি তাদের আত্মার সন্তান। তাদের বানানো যন্ত্রে সুরের সাথে থাকে এক রহস্যময় প্রাণ।

ঠিক একইভাবে মানুষও দুই রকমের—কেউ কাজ করে শুধু বাধ্য হয়ে, খাওয়ার জন্য। কেউ আবার আধ্যাত্মিকতায় যায় শুধু কষ্ট এড়াতে। তাদের ভেতরে প্রাণের সেই সৌন্দর্য অনুপস্থিত।

কিন্তু যাঁরা কাজ করেন সেবার আনন্দে, সৃষ্টির আনন্দে, তাঁদের প্রতিটি সৃষ্টি হয়ে ওঠে তাঁদের আত্মার প্রকাশ। কাজ নিখুঁত না হলেও, তাতে প্রাণ থাকে।

মানবদেহও দুইভাবে গড়ে ওঠে—কেউ যেন জোড়াতালি দিয়ে তৈরি শরীর নিয়ে জন্মায়, আবার কারও শরীর হয় বহু জন্মের অভিজ্ঞতায় ধাপে ধাপে গড়া, যেখানে আত্মার মহৎ বাসনা তাকে গড়ে তোলে। আত্মাকে উন্মোচন করার চেয়ে বড়ো কাজ হলো শরীরকে এমনভাবে গড়ে তোলা, যাতে আত্মা তার মাধ্যমে প্রকাশ পেতে পারে।

কারণ দেহ ছাড়া আত্মা কিছু জানতেই পারে না। শরীরই হলো আত্মার মন্দির। দেহই হলো মস্তিষ্ক, যার মাধ্যমে মন ভাবে। মনই হলো সেই মাধ্যম, যার মাধ্যমে আত্মা কথা বলে। যদি পদার্থকে সরিয়ে ফেলেন, আত্মা নিজেকেও চিনতে পারবে না।

ভাবুন একটি বাঁশির কথা—যা শতাব্দীর পর শতাব্দী টিকে আছে, যার বুকে বহু দুঃখী মানুষের অশ্রু ঝরেছে, যার প্রতিটি রন্ধ্রে বহু একাকী মানুষ তার স্বপ্ন ঢেলেছে। স্ট্রাডিভেরিয়াস—বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বেহালা নির্মাতা—একবার বলেছিলেন: “ঈশ্বর আমাকে সৃষ্টি করেছেন শুধুই বেহালা বানানোর জন্য।” কিন্তু দুঃখজনক হলো—মানুষ খুব কমই নিজের শরীরকে তেমন ভালোবাসে, যেমন সংগীতজ্ঞ তার প্রিয় যন্ত্রটিকে ভালোবাসে।

শরীর হলো আত্মার বেহালা। যন্ত্র ভালো হলে এবং বাদক জাগ্রত হলে সুরেলা সংগীত জন্মায়। আত্মা যত মহৎই হোক, শরীর যদি অবহেলিত হয়, তবে সুর বেসুরো হবে। তাই শরীরকে যত্ন করা, শুদ্ধ করা, গড়ে তোলা—এটাই আত্মার সংগীতের প্রথম শর্ত।

আত্মা ও দেহ: বেহালার মতো পরিণতি

ভালো বেহালা তৈরি হয় শুকনো কাঠ দিয়ে। যেখানে পানি বা আর্দ্রতা থাকে, সেখানে সুর বিকৃত হয়। তাই যন্ত্রকে হতে হয় পরিণত ও seasoned। সব সংগীতজ্ঞই জানেন—বেহালা বয়সের সাথে সাথে মধুর হয়। একটি পুরোনো যন্ত্র শত বছর পরেও একটি নতুন যন্ত্রের তুলনায় অনেক বেশি গভীর ও মিষ্টি সুর দেয়। নতুন বেহালায় দক্ষ শিল্পী বাজালেও তাতে সেই মাধুর্য থাকে না, কারণ সুর এখনও পরিপক্ব হয়নি।

মানুষেরও একই নিয়ম। আমরা কারও দিকে তাকিয়ে ভাবি—তার সুর বেসুরো, সে তেমন কিছু নয়। কিন্তু হয়তো ভবিষ্যতে, সময় ও অভিজ্ঞতার সাথে তার আত্মা হয়ে উঠবে অপূর্ব সুরের যন্ত্র।

প্রত্যেকের মধ্যেই একটি বেসুরো নোট আছে। কিন্তু যুগের পর যুগ অভিজ্ঞতা, শিক্ষা ও দুঃখ-কষ্ট সেই খসখসে দিকগুলোকে মসৃণ করে দেয়। শেষে শরীর ও স্বার্থপরতা ম্লান হয়ে যায়, আত্মার নির্যাসই থেকে যায়—যা হয়ে ওঠে ঈশ্বরীয় বাদ্যযন্ত্র, যার তারে বাজে আকাশের সুর।

পৃথিবীতে আমরা এমন অনেককে পাই, যাদেরকে আমাদের কাছে বিরক্তিকর বা মাধুর্যহীন মনে হয়। কিন্তু হয়তো তাদের দেহ-মন একসময় ভেঙে গেছে, যন্ত্রটি অকেজো মনে হলেও শতবছর পর তা আবার বের করে বাজালে অপূর্ব সুরে ভরে যায়।

এখানেই শিক্ষা: তুমি আর আমি, আমরা সবাই বেহালানির্মাতা। ঈশ্বর আমাদের সৃষ্টি করেছেন শরীর নামের বাদ্যযন্ত্র তৈরি করার জন্য। প্রতিটি দেহ হলো এক জটিল সৃষ্টিকর্ম, যা আত্মাকে প্রকাশ করার জন্য গড়ে তোলা হয়। আমাদের কর্তব্য হলো—নিজের দেহ-মনকে এমনভাবে গড়ে তোলা, যাতে আত্মার প্রতিভা সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ পায়।

যেমন একটি দামি বেহালা ভেঙে গেলে তার সুর নষ্ট হয়ে যায়—কিন্তু মেরামতের পর কখনো কখনো তার সুর আরও সুন্দর হয়ে ওঠে; ঠিক তেমনি, যদি একটি শিশু বা দুর্বল মানুষ যখন জীবনের আঘাতে ভেঙে যায়, তাহলে তার অন্তরের সুর হারিয়ে যায়। সেই আঘাত সারতে অনেক যুগ লেগে যেতে পারে।

শরীর হলো বেহালা, আত্মা হলো সংগীতজ্ঞ। বয়স, অভিজ্ঞতা, দুঃখ-কষ্ট আমাদের যন্ত্রকে মোলায়েম করে তোলে। সবার ভেতরে কোথাও-না-কোথাও বেসুরো ভাব আছে, কিন্তু সময় তা মুছে দেয়। আমাদের কর্তব্য হলো নিজের শরীর-মনকে এমনভাবে গড়ে তোলা, যাতে আত্মা তার পূর্ণ সুর প্রকাশ করতে পারে।