আত্মা ও পদার্থের রহস্য: ১



যে-শক্তি বাইরে প্রবাহিত হয়, প্রাণ দেয়, আলো জ্বালায়, গতি সৃষ্টি করে—তাকে বলা হয় আত্মা বা স্পিরিট—আদি বা পিতৃ-প্রতিনিধি। এটি প্রতীকীভাবে পরিচিত ‘পিতা’ নামে। কারণ, এই আত্মা মানসিক, শারীরিক ও আধ্যাত্মিকভাবে প্রকাশশীল। আত্মা নিজে থেকেই প্রকাশিত হয়, অবাধে বেরিয়ে আসে, আর একে বলা হয় Father-ray।

এর বিপরীতে আছে সেই চেতনারই মন্থর স্পন্দন, যা হলো পদার্থ—মাতৃ-প্রতিনিধি। যখন আত্মার কম্পন ধীর হয়ে যায়, অথবা কোনো বাধার কারণে থেমে যায়, তখন সেটিই জমাট বেঁধে হয়ে ওঠে পদার্থ। তাই পদার্থ হলো ঘুমন্ত জীবন—যেখানে জীবনের বীজ আছে, কিন্তু তা প্রকাশিত হতে পারে না, যতক্ষণ না বাইরের শক্তি এসে তাকে জাগিয়ে তোলে। এই কারণে প্রাচীনেরা পদার্থকে বলেছিলেন মাতা বা Mother Principle। সূর্য হলো জ্বলন্ত পিতা, আর পৃথিবী হলো স্নিগ্ধ, পুষ্টিদায়ী মাতা।

আত্মা ও পদার্থের মিলন

প্রত্যেক পদার্থের ভেতরে জীবনের বীজ লুকোনো। পদার্থ যেন এক আবরণ বা খোলস, যা জীবনের বীজকে রক্ষা করে, যতক্ষণ না তা জেগে ওঠে। আত্মা হলো বাদ্যযন্ত্রের বাদক, আর পদার্থ হলো বাদ্যযন্ত্র। যেমন একজন শিল্পী বেহালা বাজালে সুর ওঠে, তেমনি আত্মা পদার্থের শরীরকে বাজিয়ে তোলে জীবনের সুরে।

বাদ্যযন্ত্র যেমন হয়, সুরও ঠিক তেমন হয়। একই কম্পন ভালো কোনো বাদ্যযন্ত্রে সৃষ্টি করে সুমধুর সুর, আর অন্য একটি খারাপ যন্ত্রে সৃষ্টি করতে পারে কর্কশ শব্দ। ঠিক তেমনি এক আত্মিক প্রবাহ একজনকে সাধু বানায়, অন্যজনকে পাপীও করতে পারে—সব কিছু নির্ভর করে তার "যন্ত্র" বা দেহ-মন কতটা পরিশুদ্ধ, তার ওপর।

আত্মা (Spirit) হলো চিরন্তন প্রকাশশক্তি—সৃষ্টি, আলো ও প্রাণের উৎস। পদার্থ (Matter) হলো সেই শক্তির ঘুমন্ত রূপ—প্রকাশের অপেক্ষায় থাকা। মানুষের শরীর ও মন হলো বাদ্যযন্ত্র, যার ভেতর আত্মা বাজায় জীবনের সংগীত। সুর সুন্দর হবে কি হবে না, তা নির্ভর করে যন্ত্রের মানের ওপর—অর্থাৎ আমাদের চরিত্র, চিন্তা ও কর্মের ওপর।

আত্মা হলো স্রষ্টার প্রাণশক্তি, পদার্থ হলো তার ধারক। আত্মা বাজায়, পদার্থ বাজে—আর মানুষই সেই বাদ্যযন্ত্র, যেখানে সুর ওঠে... সুমধুর কিংবা কর্কশ।

আমাদের দৈনন্দিন জীবন আসলে একটি দৃশ্যমান প্রমাণ—যা অদৃশ্য জগতে বিদ্যমান চিন্তা, অনুভূতি ও শক্তির বহিঃপ্রকাশ। অনেক সুন্দর ভাবনা কখনও প্রকাশিত হয় না, কারণ চিন্তাশীল ব্যক্তি ভাষায় তা প্রকাশ করতে পারে না। অনেক মহিমান্বিত সুর কখনও পৃথিবী শোনে না, কারণ সুরকারের পক্ষে তা সংগীতে রূপ দেওয়া সম্ভব হয়নি।

মানুষের শরীরই হলো তার প্রকাশের যন্ত্র। যন্ত্রটি যেমনভাবে তৈরি, তেমনিই সীমিত হবে আত্মার প্রকাশ। একজন মানুষ আজীবন সুন্দর স্বপ্ন দেখতে পারে, কিন্তু যদি তার যন্ত্র (শরীর-মন) সঠিকভাবে সুরে বাঁধা না থাকে, তাহলে সেই স্বপ্ন শুধু তার ভেতরেই থেকে যাবে, পৃথিবীতে প্রকাশ পাবে না।

কম্পনের রহস্য

কম্পন সৃষ্টি হয় পদার্থকে প্রাণিত করার মাধ্যমে। যেমন বাতাস বা ইথারকে কম্পিত করালে শব্দ জন্মায়। আমাদের মুখ থেকে যে-শব্দ বের হয়, তা দাঁতের গঠন, জিভের অবস্থান, মুখগহ্বর ও বক্ষগহ্বরের আকারে বদলে যায়। যন্ত্রের ভেতরে কোনো বাধা থাকলে স্বর বেসুরো হয়, কিন্তু সঠিকভাবে সুর করা হলে স্বর মধুর হয়ে ওঠে।

যেমন—একই শ্বাস বা বায়ুর স্পন্দন ট্রাম্পেটের ভেতরে একরকম শব্দ সৃষ্টি করে, আবার বাস হর্নে গিয়ে একেবারে ভিন্ন ধ্বনি তোলে। বেহালা আর চেলো—দুটোতেই একই ধরনের সুরতন্ত্রী আছে, কিন্তু আকার ও গঠনের পার্থক্য তাদের সুরকে আলাদা করে।

আত্মা ও শরীরের সম্পর্ক

এমনিভাবেই আত্মা (Spirit) ঈশ্বরীয় সুর তোলে—কিন্তু মানুষের শরীর-মন সেই সুরের যন্ত্র মাত্র। যন্ত্রটি যেমন মানসম্পন্ন হবে, সুর ততটাই সুন্দর বা কর্কশ হবে। এ কারণেই দুইজন মানুষ কখনোই সম্পূর্ণ একরকম নয়। প্রত্যেকের চিন্তা, আকাঙ্ক্ষা আর কাজ ভিন্ন। এসবই তার যন্ত্রকে (দেহ-মন) গড়ে তোলে আলাদা রূপে। ফলেই সৃষ্টি হয় ব্যক্তিত্বের স্বাতন্ত্র্য।

আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। আত্মার তরঙ্গ (spiritual vibration) সবসময় নিজের যন্ত্রকে গড়ে তোলে, আর যন্ত্র আবার সীমাবদ্ধ করে আত্মার প্রকাশকে।

ঈশ্বরীয় সৃষ্টিশক্তি

আত্মা বা ঈশ্বর এক সৃজনশীল শক্তি। তাই যেখানেই আত্মা প্রকাশ পায়, সেখানে সৃষ্টির ক্ষমতাও অর্পিত হয়। মানুষ যখনই সক্রিয় হয়—চিন্তায়, কথায় বা কাজে—তখনই সে স্রষ্টা হয়ে ওঠে। কারণ প্রতিটি চিন্তা, প্রতিটি কথা, প্রতিটি কাজ একটি নতুন কম্পন-তরঙ্গ সৃষ্টি করে, যা মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

ঈশ্বরীয় আত্মা হলো বাদক, আর আমাদের দেহ-মন হলো বাদ্যযন্ত্র। যন্ত্র যেমনভাবে সুরে বাঁধা, তেমনভাবেই প্রকাশ পায় আত্মার সংগীত। প্রতিটি মানুষ আলাদা যন্ত্র, তাই কারও প্রকাশ কারও মতো হয় না। আমাদের প্রতিটি চিন্তা, কথা ও কাজ—আসলে কম্পন, যা বিশ্বে নতুন কিছু সৃষ্টি করে।

দেহ: আত্মার বাদ্যযন্ত্র

প্রকৃতির বিভিন্ন স্তরে কম্পন মানুষের শরীরকে এমনভাবে গড়ে তোলে, যাতে তা আত্মার ভেতরের ভাবনা আর স্পন্দনের প্রকাশ ঘটাতে পারে। এই দেহগুলো আসলে মানুষের অন্তর্নিহিত আদর্শের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু আত্মা (যা হলো: “আমি আছি”) দেহের মাধ্যমে প্রকাশ পেতে গিয়ে বার বার সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে—কারণ আমাদের চিন্তা, কাজ আর আকাঙ্ক্ষা নিজের দেহের বিকাশে বাধা তৈরি করে।

দেহ হলো সাউন্ডিং-বোর্ড। যেমন কোনো বাদ্যযন্ত্রের সাউন্ডিং-বোর্ড তার সুর ঠিক করে, তেমনি আমাদের চিন্তা, কাজ আর আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে দেহের সাউন্ডিং-বোর্ড। এই সাউন্ডিং-বোর্ডই নির্ধারণ করে—মানুষের মধ্যে ঈশ্বর কতটা সুন্দরভাবে প্রকাশ পাবে।

আমাদের তিনটি দেহ (শারীরিক, মানসিক, আবেগিক) আলাদা আলাদা সচেতনতার নিয়ন্ত্রণে থাকে। এরা দুইভাবে কাজ করতে পারে—স্বার্থপরভাবে বা নিঃস্বার্থভাবে।

যদি প্রতিটি দেহ শুধু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তাহলে মানুষ হয়ে ওঠে ভারসাম্যহীন—ভাবনা, আবেগ বা কাজের ওপর নিজেরই নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কিন্তু যদি এই দেহগুলো নিঃস্বার্থভাবে আধ্যাত্মিক সচেতনতার অধীনে থাকে, তাহলে তারা আত্মার প্রকাশে বাধা দেয় না, বরং সুরেলা সমন্বয় ঘটায়। তখন দেহ হয়ে ওঠে ঈশ্বরের হাতে কলম, যা দিয়ে লেখা হয় এক সুরেলা সংগীত।

দেহ ও বাদ্যযন্ত্রের তুলনা

একজন প্রকৃত শিল্পী জানেন—কেবল কোম্পানি বা দাম নয়, বাদ্যযন্ত্রের প্রকৃত মান নির্ভর করে তার সুরের ওপর। আমাদের শরীরও তা-ই—আত্মা এই শরীর নামক বেহালাই বাজায়। যতক্ষণ না তা সঠিকভাবে সুরে বাধা হয়, সংগীত মধুর হবে না। যেমন বেহালার মান নির্ভর করে কোন উপকরণ দিয়ে বানানো হয়েছে, তার ওপর, তেমনি মানুষের দেহ নির্ভর করে সে মানসিক, শারীরিক ও আধ্যাত্মিকভাবে কী দিয়ে নিজেকে গঠন করছে, তার ওপর।