আত্মার মন্দির নির্মাণ




মানুষ চিরকালই এক কর্মী। জন্মের পর থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত, এমনকি জন্ম-মৃত্যুর পরেও, তার জীবন এক অবিরাম নির্মাণযাত্রা। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এত শ্রম, এত দুঃখ, এত সংগ্রামের প্রতিদান কী? জীবনের দীর্ঘসাধনার পুরস্কার কোথায়?

উত্তর একটাই—মানুষ আসলে এক মন্দিরনির্মাতা। চিন্তা, কর্ম, আকাঙ্ক্ষা দিয়ে, আনন্দ, অশ্রু আর দুঃখ দিয়ে, সে গড়ে চলেছে নিজের ভেতরে এক পবিত্র বেদীপীঠ।

প্রাচীন ভারতে যেমন স্বর্ণ আর রত্নে অলঙ্কৃত মন্দির গড়ে তোলা হয়েছিল—অসাধারণ কারুকাজে পূর্ণ সব অট্টালিকা, তেমনি প্রতিটি মানুষ গড়ে তুলছে নিজের আত্মার অভ্যন্তরে এক অলৌকিক মন্দির।

এ মন্দিরের দেয়াল পাথরের নয়—এটি গড়ে উঠছে আমাদের চিন্তা দিয়ে, অলঙ্কৃত হচ্ছে আমাদের শব্দ দিয়ে, আর পূর্ণতা পাচ্ছে আমাদের কর্ম দিয়ে। পৃথিবীর প্রতিটি সম্পর্ক, প্রতিটি অভিজ্ঞতা, প্রতিটি কষ্ট, আমাদের হাতে দিচ্ছে নির্মাণসামগ্রী। কঠিন শিলাখণ্ড থেকে আমরা খোদাই করি স্তম্ভ, প্রেম দিয়ে বসাই রত্নখণ্ড, সহমর্মিতায় আঁকি কারুকাজ, আনন্দ দিয়ে ভরে তুলি মন্দিরের শূন্য প্রাঙ্গণ।

কোনো মন্দিরই তৈরি হয় না অপরিশোধিত পাথর দিয়ে। পাথরকে ঘষতে হয়, কাটতে হয়, ভেতরের সৌন্দর্যকে প্রকাশ করতে হয়। তেমনি মানুষের জীবনও—দুঃখ, যন্ত্রণা, অভিজ্ঞতা, ব্যর্থতা আর সংগ্রামের আগুনে দিন দিন শোধিত হয়। যেমন কাঠ শুকোলে বেহালার সুর মধুর হয়, তেমনি বয়স আর অভিজ্ঞতা মানুষকে করে তোলে পরিণত, আত্মার বাদ্যযন্ত্রকে করে তোলে সুরেলা।

প্রথমে আমাদের সুর হয় কর্কশ, আমাদের যন্ত্র বাজে বেসুরো তানে, কারণ ভেতরে থাকে অশুদ্ধি, থাকে শিশুসুলভ অপরিপক্বতা। কিন্তু যুগের পর যুগের সাধনায়, অসংখ্য অশ্রু, অগণিত আঘাত, অভিজ্ঞতার চাপে আত্মার সুর ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে নির্মল, মধুর, শান্ত, ঈশ্বরীয়।

আমরা প্রত্যেকে যেন এক মহান নির্মাতা, ঈশ্বর আমাদের হাতে দিয়েছেন সুর-যন্ত্র গড়ার কাজ। কিন্তু সেই যন্ত্র আর কিছু নয়—আমাদের নিজের দেহ, মন আর আত্মার সংযোগস্থল।

প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব—নিজেকে এমনভাবে গড়ে তোলা, যাতে তার আত্মার ভেতরের প্রতিভা, তার ভেতরের ঈশ্বর সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হতে পারে। কতজন আছে, যারা নিজের শরীরকে, নিজের মনকে, নিজের জীবনকে সেই ভালোবাসায় রক্ষা করে, যেভাবে এক সংগীতজ্ঞ রক্ষা করে তার প্রিয় বেহালাটিকে? অথচ দেহই তো আত্মার মন্দির, মনই তো আত্মার যন্ত্র, আত্মাই তো সেই সংগীতজ্ঞ—যিনি বাজাচ্ছেন চিরন্তন সুর।

যুগের পর যুগের সাধনায়, মানুষ যখন সমস্ত অশুদ্ধি, স্বার্থপরতা আর অহংকার ত্যাগ করে, তখন তার ভেতরে জন্ম নেয় Pearl of Great Price, অর্থাৎ সর্বোচ্চ জ্ঞানের রত্ন। তখন সে খুঁজে পায় Philosopher’s Stone, যা হলো চিরন্তন রূপান্তরের প্রতীক। এবং, তখন তার আত্মা ও দেহ মিলিত হয়ে গড়ে ওঠে ঈশ্বরের সত্যিকারের মন্দির।

মানুষের জীবন কোনো অর্থহীন যাত্রা নয়। প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি দুঃখ, প্রতিটি আনন্দ আমাদের গড়ে তুলছে এক নির্মাণশিল্পী হিসেবে। আমরা প্রত্যেকে গড়ে তুলছি এক মন্দির, যেখানে বাস করে চিরন্তন আলো। তাই মনে যেন রাখি—আমরা এক-একজন মন্দিরনির্মাতা। আমাদের প্রতিটি চিন্তা এক-একটি ইট, আমাদের প্রতিটি কাজ এক-একটি অলঙ্কার, আমাদের প্রতিটি প্রেমের প্রকাশ এক-একটি রত্ন। আর আমাদের সম্পূর্ণ জীবন—এক মহাশ্রদ্ধার মন্দির।

মানুষ তো মানুষই—অধীর, অচিন্তনশীল, আর নিজের অস্তিত্বের আসল কারণ নিয়ে অনিশ্চিত। তাই সে একটি গুরুতর ভুল করে। ভুলটি দুঃখজনক, কখনো কখনো ভয়াবহ—তবুও সেটি প্রায় 'দেবতুল্য', কারণ এমনকি মহান সাধকেরাও কখনোবা এ ভুল করেন।

মানুষ তার জীবনের মন্দির গড়ে তোলে, কিন্তু ভুলে যায়—এই পবিত্র স্থানে বসানোর মতো যোগ্য আসন একটিই আছে। সে ভুল করে মন্দির পূর্ণ করতে চায় কোনো প্রিয়জন দিয়ে, কোনো প্রিয় ভাবনা বা পার্থিব আকাঙ্ক্ষা দিয়ে, যাকে সে ভালোবেসেছে, পূজা করেছে, এবং ভেবেছে—এটাই তার ঈশ্বর।

কিন্তু মাটির দেবতা কি সোনার মন্দির পূর্ণ করতে পারে? উত্তর লুকিয়ে আছে ভাঙা হৃদয়ের কাছে। যখন সেই প্রিয়জন ভেঙে পড়ে মানুষের চোখের সামনে, যখন পূজিত রূপ ধুলোয় মিশে যায়, তখন সে বুঝতে পারে—ঈশ্বরের স্থানে মানুষ বা বস্তু রাখা যায় না। যে-মানুষ তার মন্দির পূর্ণ করেছে পৃথিবীর কোনো প্রিয়জন দিয়ে, তার পরিণতি হলো—ভাঙা প্রতিমার পাদদেশে পড়ে-থাকা ভাঙা হৃদয়।

সুতরাং মানুষ শিখে নেয়—মন্দির কেবল সর্বোচ্চের—ঈশ্বরের আসন। এখানে অন্য কোনো দেবতা থাকতে পারে না। প্রিয়জনদের অবশ্যই হৃদয়ের কাছে রাখতে হবে, তাদের জন্য হৃদয়ের ভেতরে আলাদা স্থান রাখতে হবে; কিন্তু আত্মার মন্দিরে স্থান পাবে কেবল জীবন্ত ঈশ্বর, অন্য কেউ নয়।

মানুষ যুগের পর যুগ এই মন্দির গড়ে তুলবে, কিন্তু এটি পূর্ণ করার দায়িত্ব তার নয়। তার কাজ হলো শুধু নির্মাণ করা—ভালোবাসা, সৌন্দর্য, মহিমা দিয়ে অলঙ্কৃত করা।

মন্দিরের সেই শূন্য নিভৃত আসন, যা যুগের পর যুগ খালি থাকবে, শেষমেশ পূর্ণ হবে—ঈশ্বরের আলোকপ্রবেশে। এ আলো মানুষ নিজে বানাতে পারে না, পৃথিবীর কিছুই এই আলো এনে দিতে পারে না। এ আলো কেবল আসে ঊর্ধ্বলোক থেকে।

যে-মুহূর্তে মন্দির সম্পূর্ণ হয়, যে-মুহূর্তে নির্মাতা সমস্ত শ্রম শেষ করে নতজানু হয়, সেই মুহূর্তে মন্দিরে নেমে আসে মহাজ্যোতি। তখনই মানুষ উপলব্ধি করে—তার মন্দিরনির্মাণ বৃথা যায়নি, এটি ছিল আত্মায় ঈশ্বরের আগমনের প্রস্তুতি।

আমরা সবাই জীবনভর আত্মার মন্দির গড়ে তুলি। ভুল হলো—পার্থিব প্রেম, মানুষ বা বস্তু দিয়ে মন্দির পূর্ণ করতে চাওয়া। মন্দির পূর্ণ হয় না মাটির প্রতিমায়, বরং শেষমেশ পূর্ণ হয় কেবল ঈশ্বরের আলোকপ্রবেশে।

যখন মানুষের নির্মিত মন্দিরে ভেতরের আলো জ্বলে ওঠে, তখন আর প্রতিমা ভাঙে না, তখন আর হৃদয় ভেঙে পড়ে না। কারণ তখন মন্দির পূর্ণ হয়েছে কেবল ঈশ্বরীয় উপস্থিতিতে। যে-আলোকস্তম্ভ রাতের অন্ধকারে আগুনের স্তম্ভ হয়ে দাঁড়ায়, দিনে ধোঁয়ার স্তম্ভ হয়ে পথ দেখায়, সেই আলো এখন হয়ে ওঠে নির্মাতার চিরস্থায়ী রক্ষক। এই উপস্থিতি আর কখনও বিলীন হয় না।

মন্দিরনির্মাণ—এ এক সর্বজনীন সাধনা। মানুষের কর্তব্য ও সৌভাগ্য হলো এই রহস্যময় মন্দির গড়ে তোলা—জীবন্ত ঈশ্বরের জন্য জীবন্ত মন্দির। এই সত্য কোনো এক ধর্মের নয়—সকল ধর্মের মর্মে আছে, মরমি প্রার্থনায় আছে।

তাই যারা সত্যের সন্ধানী, তাদের উচিত আলোর পথে তীর্থযাত্রা করা। আমাদের উচিত নিজের আত্মায় পবিত্র মন্দির নির্মাণ করা—যেখানে ঈশ্বর চিরকাল বাস করবেন। ঈশ্বরের কাছে আমরা যেন প্রার্থনা করি—শীঘ্রই এমন দিন আসুক, যখন আমরা সত্যিই গড়ে তুলতে পারব তাঁর আসনভূমি, যেখানে তিনি নিজেই নেমে আসবেন আমাদের আত্মার ভেতরে।

প্রতিমা ভেঙে যায়, প্রিয়জন ভেঙে পড়ে—কিন্তু ঈশ্বরের আলো ভেঙে যায় না। আমাদের কাজ হলো এক রহস্যময় মন্দির গড়ে তোলা, যেখানে ঈশ্বর চিরকাল থাকবেন। ধর্ম যা-ই হোক, মন্দির গড়ার আহ্বান সবার ভেতরে একই—আত্মাকে ঈশ্বরের আসন করে তোলা।