আত্মার ভেতর থেকে

অন্যের কাছে বা নিজের আছে আমাদের সকল ভুল কাজ আর ঠিক কাজের কৈফিয়ত দিতে দিতে আমাদের সময়গুলি চুরি হয়ে যায়। একসময় কোনো এক বিস্তীর্ণ মাঠে আমার সাথে তার দেখা হয়। যখন দুটো হৃদয় একই সমতলে এসে মেলে, তখন আমাদের ভেতরে আর এমন কিছুই থাকে না, যেটার কৈফিয়ত দিতে হবে। সব ধারণা, ভাষা—এমনকী আমরা ওই দু-জনও, ওই সময়ের জন্য নিরর্থক হয়ে পড়ি। শুধু দুটো আত্মার মধ্যে নীরব কথোপকথন চলতে থাকে। সেখানে কোনো কথা বা ব্যাখ্যা থাকে না, কোনো অভিযোগ থাকে না, কোনো ভুল বোঝাবুঝি থাকে না। এই কথোপকথনের কোনো কালিক বা স্থানিক সীমা নেই। একই অনুরণনে, একই ছন্দে, একই লয়ে, একই মাত্রায় দুটো হৃদয়ের মধ্যে অনুভূতির নিঃশব্দ স্থানান্তর চলতে থাকে।

কোনো এক নির্মল দিনে একজন স্বাভাবিক মানুষ কোনো উঁচু পর্বতের চূড়ায় উঠে যতদূর পর্যন্ত দেখতে পায়, তার চাইতেও বেশি দূর পর্যন্ত নিজের দৃষ্টিসীমাকে পৌঁছে দিতে, এমনকী কালের যে-কোনো সীমানায় নিজেকে সাবলীলভাবে পৌঁছে দিতে, হৃদয়ের সকল শক্তিকে একসাথে জড়ো করে জীবনকে স্বপ্নের চাইতেও সুন্দর করে সাজাতে সময় আর অর্থ ব্যয় করে দূরে কোথাও যেতে হয় না। বরং, নিজের হৃদয়প্রদেশের দুর্জ্ঞেয় দুর্বোধ্য দুর্গম পরমপ্রার্থিত জায়গায় আশ্রয় গ্রহণ করে শান্ত সমাহিত স্থির হয়ে স্রষ্টা বা স্বজ্ঞার ধ্যান করতে হয়। সকল সিদ্ধ মহাপুরুষের সকল প্রজ্ঞা আর উপলব্ধিই আমাদের হৃদয়মন্দিরে প্রোথিত আছে, সেসব ঐশ্বর্যকে গ্রহণ করতে হলে নিজেকে ত্যাগ, শ্রম, বিনয়ের সাহায্যে প্রস্তুত করা প্রয়োজন।

প্রাচীনকালে পারস্যে একধরনের ধ্যানের প্রচলন ছিল। সূর্য ওঠার আগে সবাই মিলে একসাথে ধীর লয়ে গাইতে গাইতে, কিংবা কবিতা আবৃত্তি করতে করতে নাচতে থাকত। এ ধ্যানের নাম ছিল সামা। এই ধ্যানের মাধ্যমে পার্থিব সকল অনুভূতিকে ভুলে নিজেকে স্রষ্টার অনুগ্রহের প্রতি নিবেদন করা হতো, অর্থাৎ নিজের হৃদয়ের রহস্যময় রাজ্যে ঘুরে আসার প্রক্রিয়ায় স্বর্গীয় অনুভূতি লাভ করার চেষ্টা করা হতো। সুর এবং নাচের দ্যোতনায় স্রষ্টার ধ্যান করার মধ্য দিয়ে স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করা হতো, নিজের অনুভূতিকে পরিশুদ্ধ করা হতো। হৃদয়ের নিগূঢ় প্রকোষ্ঠে যা লুকিয়ে আছে, তাকে প্রকাশ করা হতো, মনের সকল সংশয় দূর হয়ে, অসীম আনন্দ নিয়ে পালকের মতো হালকা হয়ে মন স্রষ্টার কাছে পৌঁছে যেত। কখনো কখনো সামা ধ্যানের সময় লোকে বাহ্যিক জ্ঞানশূন্য হয়ে মাতাল অবস্থায় অধ্যাত্ম-সাধনায় মেতে উঠত। এ সময় মানুষের সকল অভিমান, অহংবোধ, অসূয়া-সহ বিভিন্ন কুপ্রবৃত্তি দূরে সরে হৃদয়-মন-আত্মা পরিশুদ্ধ হতো, স্রষ্টার অনুগ্রহ লাভের জন্য উপযুক্ত হতো। ওই সময় স্রষ্টা আর ধ্যানীদের হৃদয় এক হয়ে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়।

ভালোবাসা আসে আত্মার ভেতর থেকে। আমাদের আত্মা হলো ভালোবাসা, আবেগ আর সমবেদনার এক মহাসমুদ্র। আত্মা স্রষ্টার একমাত্র প্রতিরূপ, একমাত্র চিরস্থায়ী আশ্রয়। ভালোবাসা কোনো কাল মানে না, ভালোবাসা কোনো কারণ মেনে চলে না, ভালোবাসায় কোনো শর্ত থাকে না, ভালোবাসা হয় শুধুই ভালোবাসার কারণে, ভালোবাসা অমরত্ব রচনা করে, যা চিরকাল টিকে থাকে। ভালোবাসাই একমাত্র বিশুদ্ধ অনুভূতি, যা আত্মার ভেতর থেকে আসে, হৃদয়ে শান্তি ছড়িয়ে দেয়। জোর করে কিংবা চিন্তাভাবনা করে যে-ভালোবাসা জন্মে, ওতে পাপ ছাড়া আর কিছুই থাকে না।