আত্মার ধন

যা-কিছু আমাদের প্রিয়, তাকে আমরা বলি: আত্মার ধন। যে-মানুষটি আমাদের প্রাণের মানুষ, তাকে বলি: আত্মার আত্মীয়। যে-স্থানটি আমাদের শান্তি দেয়, সে স্থানটির প্রসঙ্গ এলে আমরা বলি: সেখানে গেলে যেন আত্মা জুড়িয়ে যায়! আমাদের সবচাইতে প্রিয় কোনো কিছুকে আমরা আমাদের হৃদয় কিংবা মনে জায়গা না দিয়ে আত্মায় জায়গা দিই, আত্মার সাথে মিশিয়ে পরম আদরে রাখি। যাকে আমরা ভালোবাসি, তার অন্ধকার দিকগুলি যতটা জানি, তার চাইতে অনেক বেশি মাথায় আসে তার আলোকিত দিকগুলির কথা। সে যখনই ভয়ে কাতর হয়, তখন আমরা তার আত্মবিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করার চেষ্টা করি। যখন দেখি, সে দুশ্চিন্তায় আকণ্ঠ ডুবে আছে, তখন তার ভাবনাগুলিকে মুক্ত করে দিই। আমরা তার অক্ষমতাগুলির খোঁজ যেমনি জানি, তেমনি তার অমিত সম্ভাবনার দরোজাগুলি এক এক করে খুলে দিতে যা যা করা দরকার, যে-কোনো মূল্যে সেগুলি করি।

জীবনে চলার পথে আমাদের কাকে সবচাইতে বেশি দরকার? যে আমাদের ভালো পরামর্শ দেয়, আমাদের সমস্যাগুলির সুন্দর সমাধান দেয়, আমাদের ক্ষতগুলি সারিয়ে তোলে, এমন কাউকে। মানুষ যতটা না চায় দুঃখ দূর করতে, তার চাইতে বেশি চায় দুঃখ ভাগ করে নিতে। আমাদের এমন কাউকে দরকার, যে আমাদের কষ্টে সমব্যথী হতে পারে, যে আমাদের অভিন্ন আত্মা হয়ে আমাদের সব আঘাত তার নিজের হৃদয়ে ধারণ করতে পারে। স্রষ্টার ঘরে প্রার্থনা করার সময় যেমনি কিছু প্রার্থনাসঙ্গী আমাদের প্রার্থনা করার কাজে অনুপ্রাণিত করে, তেমনি আমাদের দুর্দশার সময়ে, একাকিত্বের সময়ে, বিষাদের মুহূর্তে, দয়ার্দ্র হৃদয়ে কোমল হাতে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়, এমন কাউকে আমাদের বড়ো বেশি দরকার।

এক দম্পতির বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এর পর পরই স্বামী ও স্ত্রী উভয়ই আবার বিয়ে করে। বিয়ের কিছুদিনের মাথায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামীটি তাঁর দুই পা হারিয়ে পঙ্গু হয়ে যান। এরপর তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে চলে যায়। তাঁকে দেখাশোনা করার কেউ ছিল না। তখন তাঁর প্রথম স্ত্রী আর তাঁর নতুন স্বামীটি সেই পঙ্গু মানুষটির সব ধরনের দেখভাল করার দায়িত্ব নেন। গত ২৬ বছর ধরে এভাবেই চলছে। প্রথম স্ত্রী আর তাঁর স্বামী তাঁদের বিবাহিত জীবনটি পার করে দিলেন পঙ্গু অসহায় মানুষটির সেবা করতে করতে। বন্ধুত্বের এর চাইতে বড়ো উদাহরণ আর কীই-বা হতে পারে? মতের অমিল, কলহ, কিংবা দূরত্বের সূচনা মানেই ভালোবাসার অবসান নয়। বিবাহ-বিচ্ছেদ মানেই চিরজন্মের শত্রুতার শুরু নয়।


ক্রিস নরটন ২০১০ সালে ফুটবল খেলতে গিয়ে মেরুদণ্ডে সুষুম্নায় জখমের ফলে ঘাড় থেকে নিচের দিকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে প্রায় চলৎশক্তিহীন হয়ে যান। তিনি আর কখনও হাঁটতে পারেননি। সেসময় তাঁর সামনে দুটো পথ খোলা ছিল। হাল ছেড়ে দিয়ে নিজেকে পরিস্থিতির হাতে সমর্পণ করা, কিংবা সেই পরিস্থিতির কাছে হার না মেনে নিজের যোগ্যতায় পরিস্থিতিকে হার মানানো। তিনি বিশ্বাস করতেন, তিনি চেষ্টা করলে সেই ট্র্যাজেডিকে সুযোগ হিসেবে প্রমাণ করতে পারবেন এবং তাঁকে দেখে তাঁর আশেপাশের সবাই শিখবে। তিনি অনুপ্রেরণামূলক বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন।

শারীরিকভাবে অক্ষম, এমন মানুষকে তিনি ভালোভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখাতে লাগলেন। প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি, ধৈর্য আর অধ্যবসায়ের জোরে তিনি ২০১৫ সালে গ্রাজুয়েট হন। দুর্ঘটনার ৩ বছর পর তাঁর সাথে এমিলি সামার্সের পরিচয় হয়। যদি তিনি হাল ছেড়ে দিতেন, আর নিজেকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিতেন, তবে নিশ্চয়ই এই অসামান্যা ভালো মানুষটির সাথে তাঁর কখনোই দেখা হতো না। তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে তাঁর বাগদত্তার সহযোগিতায় গ্রাজুয়েশন সেরিমনিতে অতি কষ্টে পায়ে হেঁটে তাঁর সার্টিফিকেটটি সংগ্রহ করেন।

তিনি সবাইকে বলেন, “আমি চাই, আপনারা লড়াই করে যাবার কঠিন পথটিই জীবনে বেছে নিন। আপনার সকল দুর্ভাগ্য, সংগ্রাম আর কষ্টের মধ্য থেকে আপনার জন্য ইতিবাচক দিকগুলিকে আবিষ্কার করুন। আমাদের সবার মধ্যেই জীবনের সম্ভাবনাগুলিকে খুঁজে বের করার ক্ষমতা আছে। যদি আপনি তা করতে পারেন, আর ধৈর্য ধরে নিজেকে সামনের দিকে এগিয়ে নেন, আমি শপথ করে বলতে পারি, অবিশ্বাস্য রকমের ভালো অনেক কিছুই আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।”

ভালোবাসার শক্তি আর বিশ্বাস এভাবেই অসম্ভবকে সম্ভব করে। কারও হৃদয়ের সুন্দর ইচ্ছের মধ্যে স্রষ্টাকে খুঁজে পাওয়া যায়। সত্যিকারের বন্ধুত্ব জীবনের সুন্দর দিকগুলিকে তুলে ধরে, সত্যিকারের বন্ধু পাবার চাইতে বড়ো সৌভাগ্য আর হয় না, আর যদি সে বন্ধুটি জীবনে থেকে যায়, তবে সেটা জীবনকে সার্থক করে। ভালো বন্ধু এক পেয়ালা মদের মতো। সময় যত সামনের দিকে গড়ায়, বন্ধুত্বের বন্ধন তত অপূর্ব হয়। ভালো বন্ধু আমাদের দুর্বল দিকগুলি ধরিয়ে দেবে, যাতে করে আমরা সেগুলিকে শুধরে নিতে পারি। আমাদের দুর্বলতা আমাদের ভালো বন্ধুদেরও দুর্বল করে দেয়, আমাদের দুর্দশা আমাদের ভালো বন্ধুদের কষ্ট বাড়িয়ে দেয়। সুন্দর হৃদয়ের এমন কিছু মানুষ আছে বলেই পৃথিবীটা আজ‌ও সুন্দর—এখানে কয়েক জন্ম হেসেখেলে দিব্যি কাটিয়ে দেওয়া যায়।