আজ আসি

  
 আমি তরী। ঠিক ষোলো বছর বয়সে আমি প্রেমে পড়লাম উনত্রিশ বছরের এক ছেলের। নাম ধ্রুব। হ্যাঁ, আমার চাইতে গুনে গুনে তেরো বৎসরের বড়ো একজন মানুষ। আমার হিসেবে যদিও বারো হয়, কিন্তু তিনি বলতেন, তেরো। আমি সবেমাত্র কলেজ শুরু করি তখন, আর তিনি ইংরেজি পড়াতেন একটা প্রাইভেট কলেজে। খুব সুন্দর করে বাংলা বলতেন উনি। একেবারে আবৃত্তির ঢংয়ে। ওই বয়সে আমি ভেবেই পেতাম না, যে মানুষ ইংরেজি পড়ান, তিনি এত সুন্দর করে বাংলা বলেন কী করে! তাহলে তার ইংরেজি বলার ধরনটা না জানি কতই-না সুন্দর হবে!
  
 বান্ধবীরা ওঁকে দেখিয়ে ‘বুড়ো প্রেমিক’ ‘বুড়ো প্রেমিক’ বলে যখন খেপাত, তাঁর প্রতি আমার নেশাটা সেসময় কেন জানি আরও বেড়ে যেত। আমি বয়সে ছোটো বলে তিনি কখনও আমাকে ছোটো করে দেখতেন না, যথেষ্ট ভালোবাসতেন, আর আমিও বাসতাম। আমার কত কত অহেতুক, আজগুবি কথা তিনি পৃথিবীর সমস্ত মনোযোগ এক করে দিয়ে শুনতেন।
  
 তাঁকে আমি আপনি বলেই সম্বোধন করতাম। তাঁর সাথে মিশে অনেক কিছু জানতে পেরেছি, শিখতে পেরেছি। আমরা একসাথে বেশ ভালো সময় কাটিয়েছি। বান্ধবীরা যখন তাঁদের সমবয়সি প্রেমিকদের প্রেম শেখাত, সুনীল ভালো না শীর্ষেন্দু…সেটা নিয়ে কথা কাটাকাটি করত, প্রেমিকের শার্টের কলার ঠিক করে দিত, নতুন কলেজে-ওঠা ছেলেগুলিকে টাই বাঁধতে শেখানোর জন্য নিজেরা লুকিয়ে লুকিয়ে বাসায় প্র্যাকটিস করত, একসাথে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আড্ডা দিত, আর আমাদের বয়সের তফাৎ নিয়ে ঠাট্টা করত, সেসময় ধ্রুব আমাকে শেখাতেন কী করে শিখতে হয়, শেখার শুরুটা কী করে শুরু করতে হয়। তিনি আমাকে বলতেন, সুনীল কিংবা শীর্ষেন্দুর সমালোচনা করার আগে মাথায় রেখো, ওঁদের দুজনের লেখা দুরকম। একই পাল্লায় দুজনকে মাপতে যাওয়াটাই বোকামো।
  
 আমি আমার অন্য বান্ধবীদের মতন ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কখনওই দেখা করতে পারতাম না তাঁর সাথে, তিনি করতেই দিতেন না এমন কিছু। আর লোকে আমাদের নিয়ে কে কী বলছে, তা নিয়ে তাঁকে কখনওই মাথা ঘামাতে দেখিনি। তিনি আমাকে লালনের গান গেয়ে শোনাতেন, ইংরেজি কবিতা পড়ে শোনাতেন। তাঁর কাছ থেকেই জেনেছি, ইংরেজিসাহিত্য কী জিনিস। তিনি কখনও আমাকে বই ছাড়া কিছু উপহার দিয়েছেন বলে তো মনেও করতে পারি না। ঘর ভরে যেত বই দিয়ে। আবার পরে উনি জিজ্ঞেস করতেন, কতটুকু কী পড়লাম, কী বুঝলাম। তবে তাঁর শেখানোর মধ্যে কোনও টিচার টিচার ভাব ছিল না, প্রেম ছিল। হ্যাঁ, সত্যিই তা-ই, আমি দেখেছি খেয়াল করে। আমার বান্ধবীদের মাথায় এসব আসতই না। তিনি নিজেও যে মাঝেসাঝে পাগলামো করতেন না, সেটা কিন্তু না। কখনও কখনও খুব জরুরি তলব করে ডেকে পাঠাতেন, আর যাবার পরে বলতেন, তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করল, তাই ডাকলাম। দেখেছি, এবার যেতে পারো চাইলে।
  
 এরপর আমার হাত ধরে বলতেন, অ্যাই তরু! (আমাকে খেপিয়ে দেওয়ার জন্য)
 আমি হাত ছাড়িয়ে দিয়ে বলতাম, আমার নাম তরী।
 - ওই একই হলো!
 - না, মোটেও না। এক কী করে হয়?
  
 একেবারেই সাদামাটা প্রেম। এভাবে আমাদের দিন কাটছিল। খুব সুখে, স্বস্তিতে। প্রতিটি দিনই নতুন নতুন অনুভূতির স্বাদ পেতে থাকলাম আমি, চিন্তায় ও মননে। দেখতে দেখতে কেটে গেল তিন বছর। তখন আমার উনিশ, আর তাঁর বত্রিশ।
  
 আমি ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম, গণিতে। একদিন ক্লাস থেকে ফেরার পথে তাঁর ফোন পেলাম। তখন আমি সবেমাত্র মোবাইল কিনেছি। আগে তো এর ওর ফোন থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে যোগাযোগ করতাম। তিনি আমাকে বললেন…কী নাকি জরুরি কথা আছে, আমাকে দেখা করতে হবে। আমি হাসলাম মনে মনে। আগেও এরকম অনেক হয়েছে। তিনি আমাকে ‘জরুরি ভিত্তি’তে ডেকে বলেছেন, ‘বিরাট সর্বনাশ হয়ে গেছে।’ আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করতাম, ‘কী হয়েছে?’ তিনি বলতেন, ‘তোমায় খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল।’ হ্যাঁ, এটাই ছিল তাঁর বিরাট সর্বনাশ!
  
 যা-ই হোক, ফোন পেয়ে সেদিন আবারও গেলাম, আর মনে মনে ভাবলাম, নিশ্চয়ই আগের মতনই কিছু একটা শুনব। গেলাম। তিনি আমাকে চেয়ার এগিয়ে দিয়ে একদম ঠান্ডাগলায় বললেন, ‘আমার বাসায় বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে, মেয়ের পড়াশোনা শেষ, সে-ও আমার মতোই কলেজে পড়াতে আগ্রহী। দেখো, তোমার তো মাত্র উনিশ চলছে, এখনও টিনএজার তুমি। বয়সে কত ছোটো, আর আবেগীও। তোমাতে আমাতে কি আর সংসার হবে, বলো? ক্ষমা কোরো আমায়। ভুলে যেয়ো যা-কিছু হয়েছিল আমাদের মধ্যে। ভালো থেকো।’
  
 …এই ধরনের আরও অনেক কিছুই বললেন তিনি। আসলে আমার কান পর্যন্ত পৌঁছুতেই পারেনি অত কথা। আমি স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলাম না ওসব শোনার সময়। আমি শুধু বললাম, ‘যাবার আগে আমার দোষটা তো বলে যান!’ তিনি বললেন, ‘তোমার বয়স কম, আমার পরিবারের কাছে এটাই তোমার একমাত্র দোষ।’
  
 সেদিন আমি বলতে চেয়েছিলাম, ‘আপনার বয়স বেশি হওয়াটাও কি তবে দোষের মধ্যে পড়ে না, যা নিয়ে সেই কবে থেকে পৃথিবীসুদ্ধ লোকের কথা শুনে শুনে সেসবকে এক-ফুঁতে উড়িয়ে দিয়ে দিয়ে এতগুলি দিন আমি থেকে গেলাম আপনার সাথে?’
  
 কিছুই বলতে পারিনি, তাঁর মুখের উপর বলতে আমি পারতামই-বা কবে! সেদিন কীভাবে বাড়ি ফিরেছিলাম, আজও মনে করতে পারি না। বাড়ি ফিরেই বিছানায় পড়ে যাই। উঠতে পারি না, খেতে পারি না, কথা বলতে পারি না, কারও কথা সহ্য করতে পারি না। একেবারে ভেঙেচুরে গেলাম।
  
 এরপর ধীরে ধীরে টিনএজ শেষ করলাম। তরুণী হবার পথে যাত্রা শুরু করলাম। সময়ের সাথে সাথে পালটে যেতে লাগল অনেক অনুভূতিই। আমি এখন মাঝেমধ্যে শাড়ি পরি, তা-ও একা একাই পারি। চুল আর সেই ববকাটেই রেখে দিইনি, যত্ন করে করে চুল বড়ো করেছি। এতই যে, কোমর ছাড়িয়ে যায়। আমি এখন ছোট্ট একটা টিপ পরি কপালে, সেটার রং থাকে হয় লাল, নয় কালো। সময়সুযোগ বুঝে মাঝারি আর বড়ো টিপও পরা হয়।
  
 কবিতা আবৃত্তি করার সময় বড়ো টিপ না পরলে তো আমার মনেই হয় না যে আমি কবিতা পড়ছি। বাইরে বেরুনোর সময় পাউডার মাখি নিয়ম করে, কাজল কিংবা মাসকারা যে-কোনও একটা থাকে সাথে। ডানহাতে ঘড়ি আর বাঁহাতে কাপড়ের সাথে রং মিলিয়ে রেশমি চুড়ি পরি। রবীন্দ্রসংগীত গাই টুকটাক। ইংরেজিতেই হেমিংওয়ে পড়ি, আবার জেমস বন্ডও; আর বাংলা-বই তো আছেই! টুকিটাকি রান্না করি, আমি আচার বানাতেও শিখেছি। মা বলেন, ‘যে আচার বানাতে জানে, সে যে-কোনও রান্নাই অনায়াসে করতে পারবে।’ আমি শুনি, হাসি।
  
 এভাবেই কেটে যাচ্ছিল সময়, সময়ের নিয়মে। ধ্রুবকে যে আমি ভুলে গিয়েছিলাম, তা নয়। প্রথমপ্রেম ভোলা যায় না। প্রথমদিকে খুব মনে পড়ত। খুব কাঁদতাম তখন। ধীরে ধীরে তিন দিনে এক বার, তারপর সাত দিনে এক বার। এরপর ছ’মাসে কিংবা বছরে এক বার! একই বিষয় নিয়ে চাইলেও একই রকম করে রোজ রোজ চোখের জল ফেলা যায় না। কত নতুন বিষয় উঠে আসে, সেগুলির উপর ওই চোখের জলের মায়া জন্মায়। ডায়েরির নতুন পাতায়, নতুন কোনও সিনেমায়, অন্য কোনও ঘটনায় দাগ লেপটে থাকে চোখের নোনাজলের।
  
 এরপর আনুমানিক সাড়ে তিন বছর পর একদিন বাসস্ট্যান্ডে দেখা হলো ধ্রুবর সাথে। হাতে পায়ে কাঁপুনি দিল আমার। তবুও নিজেকে সংযত করে রাখলাম। তিনি বললেন, খুঁজেছি তোমায় অনেক!
 - কেন?
 - কী যেন কারণে, ঠিক বলতে পারি না। (কথা বলার সময় ধ্রুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিচ্ছিলেন আমাকে।) তা, কেমন কাটছে জীবন?
 - খুব ভালো। আর আপনার বিবাহিত-জীবন? (মুখ ফসকে ‘বিবাহিত’ কথাটা বেরিয়ে গেল, যদিও বলতে চাইছিলাম না ওসব নিয়ে কিছুই।)
 - আমার সাথে আরতির বিয়েটা হয়নি শেষঅবধি।
 - ওহ্‌! আচ্ছা, যাই। আমার বাসের সময় হয়ে গেছে।
  
 …এইটুকু বলে চলে এলাম। বাড়ি ফিরে দেখি, মেসেজ পাঠিয়েছেন ধ্রুব। ‘ঠিক সাহস করতে পারছি না বলার। তবুও বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, একদিন আসবে ‘ব্লু স্কাই’ কফিশপে? এখনও কি কফি ভালোবাসো? এখানকার কোল্ডকফিটা খুব ভালো। আসবে?’
  
 আমার নতুন নম্বরটা কোথা থেকে জোগাড় করলেন ধ্রুব, ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমি রিপ্লাই দিলাম, ‘ভেবে দেখি।’
  
 চারদিন পর। আবারও ধ্রুবর টেক্সট।
 - ভাবা হলো?
 - ক্লাস শেষ করে আগামীকাল বিকেল পাঁচটা নাগাদ ওখানে পৌঁছে যাব।
  
 গেলাম। গিয়ে দেখি, আগে থেকেই দাঁড়িয়ে আছেন ধ্রুব, একটা হালকা গোলাপিরঙের পাঞ্জাবি পরে। আমরা বসলাম। আবারও। মুখোমুখি।
  
 - তরী, বাসা থেকে তোমার কথা বলে প্রায়ই।
 - আপনি ঠিক বলেছেন তো! এখানকার কফিটা সত্যিই খুব ভালো। আমার আগে কেন আসা হয়নি, বুঝতে পারছি না।
 - সেদিন মা নিজে থেকেই আগ্রহ করে তোমার কথা জানতে চাইলেন।
 - বান্ধবীদের নিয়ে এখানে কফি খেতে আসব এর পরে।
  
 আলতো করে ধ্রুব হাত রাখলেন আমার বাঁহাতে। আমার পুরো শরীর কেঁপে উঠল রীতিমতো!
  
 - কেন এড়িয়ে যাচ্ছ, তরী?
 - বলে দিন, কী বলব!
 - যাবে না? দেখা করবে না মায়ের সাথে?
 - আমার বয়স বেড়ে গেল দেখছি হঠাৎ করে!
 - এখনও রেগে আছ?
 - হুটহাট রাগ করলে চলে নাকি? বয়স বেড়েছে তো আমারও!
  
 …এই বলে উঠে পড়লাম আমি। এগুতে লাগলাম সামনের দিকে, ধ্রুবও পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বললেন, ‘আমি জানি, ব্যাপারটা ক্ষমা করার মতন না। তবুও আমি ক্ষমা চাইছি, মন থেকেই ক্ষমা চাইছি। আমি সেসময় সত্যিই অসহায় ছিলাম। অবাধ্য হতে পারিনি মায়ের, আর…’
  
 ওঁকে শেষ করতে না দিয়েই বললাম, ‘আমি আর টিনএজার নই এখন। তাই এখন আর কোনও ভুলের জন্য কাউকে হুটহাট ক্ষমা করতে পারি না। ক্ষমা করতে এখন যুক্তি লাগে আমার, সেই যুক্তিকে আবার বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে দেখতে হয়। এখন আমার বাইশ, জানেন তো?’ বলেই দ্রুত হাঁটতে লাগলাম সামনের দিকে।
  
 তিনি বললেন, ‘একটু দাঁড়াও। শোনো…’
  
 দাঁড়ালাম না। চলে আসার আগে হাঁটতে হাঁটতেই বললাম, ‘আমি আজকাল লেখার চেষ্টা করি। কবিতা লিখেছি, গতকাল। দুলাইন শোনাই?’
 - হ্যাঁ, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই! প্লিজ…!
  
 প্রিয়, আজও কেন আসছে মনে…
 আবেগের সেই নৌকোয়…আমি এখনও ভাসি?
 খেলার বয়স…সে যে নেই বেঁচে আর!
 থেমে যাও এবার, আমি তবে আজ আসি…।
  
   
Content Protection by DMCA.com