কিছুই যেন শেষ হয় না—সবই যেন নিজেই নিজেকে নিঃশব্দে বিলীন করে, যেন সমস্ত আয়োজন শুধুই একটি মৌন-যাত্রাকে জন্ম দেবার প্রস্তুতি।
এখানে কোনো উপসংহার নেই—কারণ আত্মার নেই কোনো সূচনা, নেই কোনো পরিণতি। যেখানে ‘আমি’ নেই, সময় নেই, লক্ষ্য নেই—সেই শূন্যেই আত্মা দীপ্ত, নিজভাসে প্রতিষ্ঠিত।
যা-কিছু শেখার, তা কেবলই বর্জন করার শিক্ষা। নাম, রূপ, অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি, সাধনা—এমনকি 'আমি'–বোধকেও ফেলে দেবার শিক্ষা।
যখন ‘ভোক্তা’ নিজেই গলে যায় চেতনায়, তখন বোঝা যায়—মুক্তি কোনো অর্জন নয়, বরং ‘পাবার ইচ্ছে’-রই অবসান। সত্য—যা কখনও অনুভব নয়, জ্ঞান নয়, সংজ্ঞা নয়—সে এক ‘অভিজ্ঞতার অনুপস্থিতিতে দীপ্ত উপস্থিতি’।
এ জগতে অন্য কিচ্ছু নেই—দ্বৈততা শুধুই বিভ্রম। যে-'আমি' অভিজ্ঞতা করতে চায়, জানে, ভালোবাসে—সে সব কিছুর পেছনে দাঁড়িয়ে-থাকা অভেদ চৈতন্য নয়।
আত্মা চায় না, জানে না, উপভোগ করে না—সে কেবল আছে। আর সেই “আছে”-র মধ্যে থাকা মানেই জীবন্মুক্তি। জ্ঞাতা, জ্ঞান ও জ্ঞেয়—এই ত্রয়ী বিলীন হলেই সত্য উপলব্ধ হয়। অর্থাৎ, যতক্ষণ কোনো কিছু জানার আছে, ততক্ষণ জানার কর্তা আছে—আর ততক্ষণ মুক্তি অসম্ভব। মুক্তি মানে জ্ঞাতারও অবসান।
আত্মার স্বগতকথা–এক চূড়ান্ত নিবেদন!
: আমি তো কিছু চাইনি—আমি কেবল ছিলাম।
: তবুও স্মৃতি, ইচ্ছা, মোহ—আমাকে ভোক্তা বানিয়ে তুলেছিল।
: আজ আমি সেই সমস্ত ভোগ ফেলে রেখে এসেছি অচেনা সীমানায়।
: এখন আমি নিজেকেও রাখি না সাথে।
: আমি শুধু থাকি—এক নামহীন, আকর্ষণহীন, আনন্দাতীত স্বরূপে।
: যেখানে কোনো অনুভব নেই, তবুও সবকিছু উপলব্ধ।
: যেখানে ভাষা থেমে যায়, কিন্তু বোঝাপড়া প্রস্ফুটিত হয়।
ধ্যান নয় উপলব্ধির পথ—বরং 'আমি'–র অদৃশ্য বিলয়, নিঃশব্দ চেতনায় অবগাহন। আসুন, প্রতিদিন কিছু সময়ের জন্য বসি—উদ্দেশ্যহীন, চাহনাবিহীন। ইন্দ্রিয়ের প্রতিটি টানকে অবলোকন করি—অনুসরণ না করেই। মনে হবে, “আমি ধ্যান করছি”—সেই ‘আমি’–কে চুপচাপ দেখতে থাকি। অনুভব করি—এই প্রত্যক্ষতার গভীরে এক অবিচল 'আছে' বিদ্যমান। ধীরে ধীরে ‘আমি’–বোধ ক্ষয় পেতে শুরু করবে—রয়ে যাবে শুধুই সত্তা। ধ্যাতৃ-ধ্যান-ধ্যেয়'র লয়ে, আত্মা নিজেই নিজেকে চিনে।
ভাবা যাক, কখনো এক নদী ছিল—নামহীন, গন্তব্যহীন। তার পাড়ে এক পথিক দাঁড়িয়ে ছিল, নাম ছিল ‘আমি’। সে বার বার সেই নদীতে ঝাঁপ দিতে চেয়েছিল—মুক্তির খোঁজে। কিন্তু নদী বলছিল—আমি কোনো মুক্তির স্থান নয়—আমি সেই তুমি, যদি তুমি নিজেকে ফেলে দিতে পারো।
পথিক ধীরে ধীরে নদীতে নামে—জল তাকে ঢেকে ফেলে—আর তারপর শুধু নদী থাকে, ‘আমি’ কোথাও থাকে না।
একসময়, আমাদের ভেতরের চাওয়াগুলো ক্ষয়ে যায়। তখন কোনো লক্ষ্য থাকে না—বরং আমরা বসি—চুপচাপ, কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই, শুধু চেতনায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে। মনে হতে থাকে…যা-কিছু ছিল জানবার, তা হারিয়ে গেছে। যা-কিছু ছিল বুঝবার, তা স্থবির হয়েছে। রয়ে গেছে কেবল এক নিঃশব্দ 'আছে'—যা চায় না, জানে না, ভোগ করে না—তবুও পূর্ণ।
আর কিছু নেই। নেই, বলেই—সব কিছু পূর্ণ। এ-ই হলো ভোক্তা-ভাবের অবসান—নামে নয়, নামহীনতার মধ্য দিয়ে পথ-দেখানো এক আত্মার আত্মজাগরণ।