বাইশ। আমাদের সবার মধ্যেই আত্মার বসবাস ধ্রুব। আত্মার কান আছে, আত্মা শুনতে পায়; আত্মার চোখ আছে, আত্মা দেখতে পায়। আমাদের মন যা বোঝে না, আমাদের আত্মা তা বুঝতে পারে। আমাদের হৃদয় যে ঠিকানার খোঁজ কোনোদিনই পাবে না, আমাদের আত্মা সেখানেই বসতি গড়ে। মানুষের জীবন চারটা স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে: শারীরিক বুদ্ধিমত্তা, মানসিক বুদ্ধিমত্তা, আবেগজাত বুদ্ধিমত্তা এবং আধ্যাত্মিক বুদ্ধিমত্তা। এই চারটি ঘরের প্রথম দুটিতে আমাদের মনের যাতায়াত, হৃদয়ের যাতায়াত পরেরটিতেও, আর আত্মার অবাধ যাতায়াত চারটি ঘরেই; তবে আত্মার সুষম বিকাশ হয় চতুর্থ ঘরটিতে। আত্মার বৃদ্ধি কিংবা ক্ষয় কিছু স্বতন্ত্র নিয়মকানুন এবং বিশ্বাসের ভিত্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, এর কোনো ব্যাখ্যা নেই, কোনো কথার মাধ্যমেই একে পুরোপুরি পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করা যায় না। এর প্রভাব একমাত্র সে ব্যক্তিই বুঝতে ও অনুভব করতে পারেন, যার আত্মার সাথে ঐশ্বরিক সত্তার সংযোগ রয়েছে। আমরা যখন কারও বাহ্যিক অবয়বকে ভালোবাসি, সে ভালোবাসা একসময় হারিয়ে যায়, কারণ অবয়বের মোহ ক্ষণিকের। আর আমরা যদি কারো আত্মার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে ভালোবাসি, তবে সে ভালোবাসা চিরস্থায়ী, কারণ আত্মার সৌন্দর্য চিরস্থায়ী। আত্মাই একমাত্র অবিনাশী সত্তা, মনের ঐশ্বর্য কোনো পরিস্থিতির শিকার হয়ে বা বাহ্যিক কারণে ফ্যাকাসে হয়ে যেতে পারে, হৃদয়ের দাবি একসময় ফুরিয়ে যাবে, শরীর একসময় ক্ষয়ে যাবে, শুধুই আত্মাই অজর অক্ষয় অমর হয়ে টিকে থাকবে। আত্মা এক দেহ ত্যাগ করে আরেক দেহে তার নতুন আশ্রয় খুঁজে নেয়। এই জায়গাবদল চিরন্তন, তাই আত্মার বন্ধনে কাউকে বাঁধলে সে বাঁধন কখনোই ছিঁড়ে যায় না। এক আত্মা যখন সাদৃশ্য ও সাযুজ্য বিচার করে আরেক আত্মাকে খুঁজে নেয়, তখন সেখানে কোনো ভুল থাকে না। আত্মার সতীর্থের প্রতি আত্মার ভালোবাসাই একমাত্র নিখাদ ভালোবাসা। একজনের সাথে আরেকজনের নিঃশ্বাস, বিশ্বাস, ভাবনা, কাজ—এ সবকিছুই যখন একই ধরনে একই বলয়ে আবর্তিত হয়, তখন দুজনের মধ্যে দৃঢ়তম বন্ধন রচিত হয়। জীবনের সুন্দরতম অর্থ এর মধ্যেই নিহিত। অনেকসময় দেখা যায়, চিনি না, জানি না, এমন কাউকে প্রথমবারের মতো দেখলেও মনে হতে থাকে, আমরা যেন কত জন্মের চেনা। সেই অপরিচিতকে কাছে টেনে নিতে ইচ্ছে করে, পাশে বসিয়ে গল্প করতে ইচ্ছে করে, তাকে আন্তরিক বন্ধু বানাতে ইচ্ছে করে। এরকম কেন হয়? কেন আমাদের অবচেতন মন এমন সম্পূর্ণ অচেনা মানুষকেও আপন ভেবে ফেলে? আবার কখনো-কখনো দেখা যায়, পরিচিত কিছু মানুষকে আমরা সচেতনভাবেই এড়িয়ে চলি, তারা নিজ থেকে গল্প করতে এলেও আমরা দৌড়ে পালাই। আমরা কেন এমনটা করি? সে মানুষটি তো আমার কোনো ক্ষতি করেনি। তবু কেন? এই দুই ধরনের ঘটনার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা নেই। প্রথম ক্ষেত্রে সেই অপরিচিতকে দেখামাত্রই কী একটা যেন আমাদের ভেতর থেকে বারবার বলে দিচ্ছিল, এ মানুষটি দূরের কেউ নয়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সেই পরিচিতকে দেখলেই আমাদের মনে হতে থাকে, এ মানুষটির সংস্পর্শে থাকলে আমি কোনভাবেই স্বস্তিতে থাকতে পারবো না। দুই ক্ষেত্রেই দুটি আত্মা পরস্পরকে কাছে টানতে বা দূরে ঠেলতে চেয়েছে বলেই আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের দুইটি ভিন্ন রকমের সংকেত পাঠিয়েছে। এমনি করেই কোনো এক রহস্যময় উপায়ে দুটি আত্মা পরস্পরের সাথে সংযুক্ত বা বিযুক্ত হয়। কার সাথে মিশবো, কাকে এড়িয়ে চলবো, এটা ঠিক করার ক্ষেত্রে আত্মার এই নির্বাচন প্রক্রিয়া বেশ কাজের। একই ব্যক্তিকে কারো হয়তো ভাল লাগে, আবার কেউ হয়তো তাকে সহ্যই করতে পারে না। যার যাকে ভাল লাগে, তার সাথেই মিশতে সে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে; অর্থাৎ দুই আত্মার মধ্যে এক অদৃশ্য সংযোগ স্থাপন হলে তখন সে দুইটি আত্মা মিলতে চায়। এক ছেলে হাঁটতে পারতো না, কিন্তু খুব ভাল গাইতে পারতো। এক মেয়ে ঠিকমতো কথা বলতে পারতো না, কিন্তু বেশ শক্তসমর্থ ছিল। একদিন তাদের দেখা হয়। তারা পরস্পরকে পছন্দ করে ফেলে, এবং তারা বিয়ে করে। ছেলেটা হুইলচেয়ারে বসে গান গাইতে থাকে, মেয়েটা সে চেয়ার ঠেলতে-ঠেলতে তাকে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যায়। লোকে খুশি হয়ে ওদেরকে যা দেয়, তা দিয়েই ওদের সংসার চলে। দুটো আত্মা এক হয়ে এক আত্মার স্বয়ংসম্পূর্ণতা নিয়ে সুন্দরভাবে বেঁচে রইলো। আত্মার একাত্মতা মানুষকে সুন্দরভাবে ভাবতে ও ভাবনার প্রতিফলন ঘটাতে উদ্বুদ্ধ করে। কাছে আসার কিংবা দূরে সরে যাওয়ার কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। একেকজন একেকভাবে নিজস্ব নিয়মে ভালোবাসে, নিজেকে প্রকাশ করে, বা গুটিয়ে রাখে। যে নিয়ম যার মনে ধরে, সে ওই নিয়মের মানুষকে কাছে টানতে চায়। পথের সঠিকটা একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকমের। যে পথটি আমার জন্য সঠিক, সে পথটিই অন্যকারো ক্ষেত্রে চরম ভুল পথ হতে পারে। সচেতনভাবেই হোক, আর অবচেতনভাবেই হোক, আমাদের আত্মা আমাদের যে পথের সন্ধান দেয়, সে পথই আমাদের জন্য সঠিক পথ।
তেইশ। বেঁচে থাকার সময়টাতে আমরা যাদের সংস্পর্শে আসি, তাদের সবার মধ্যেই এমনকিছু মানবিক দিক আছে, যেগুলি নিজের জীবনে গ্রহণ করতে পারলে সেগুলির নিয়মিত চর্চায় জীবন সুন্দর হয়ে ওঠে। আমরা যখন কারো সম্পর্কে ভাবি, তখন সে ভাল নাকি মন্দ, এটা বিচার করতে এতোই ব্যস্ত হয়ে পড়ি যে, তার সুন্দর দিকগুলি আমাদের মাথায়ই আসে না। ফলে আমরা তাকে আমাদের মনের মতো করে বিচার করে তার সম্পর্কে একটা মীমাংসায় পৌঁছে যাই। আমাদের এই ধরনের স্বেচ্ছা-আরোপিত আত্মতৃপ্তি ভীষণ রকমের আত্মঘাতী। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে এই, কেউই আসলে খারাপ হৃদয় নিয়ে বাঁচে না, পারিপার্শ্বিকতা এবং বাহ্যিক নানান প্রবৃত্তির কারণে মানুষ তার ভেতরের সুন্দর চিন্তাভাবনা থেকে ক্রমশ দূরে সরে যায়। কোনোকিছু পাওয়ার আশায় মানুষ যখন তার ভেতর ঘুমিয়েথাকা নিষ্ঠুর প্রবৃত্তিকে প্রশ্রয় দেয়, তখন মানুষের পশুত্ব জেগে ওঠে। সেসময় তার মস্তিষ্কও নির্দয়তা আর নির্মমতার পক্ষে তার ভাবনা ও কাজকে পরিচালিত করে। মজার বিষয় হলো, বেশিরভাগ সময়ই আমাদের কথা ও লেখা অন্যদেরকে আমাদের সম্পর্কে ভুল ধারণা দেয়। হয়তো কোনো এক কারণে, কিংবা অকারণেই আমরা কোনো এক মুহূর্তে কিছু একটা বলে ফেলি, লিখে ফেলি। অথচ, অন্যরা সে কথা বা লেখাটিকেই ধারণ করে ভুল বুঝে আমাদের সম্পর্কে এমন সব সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায়, যা তাদের শান্তি দেয়, স্বস্তি দেয়। মানুষ সে সিদ্ধান্তটিই নেয়, যে সিদ্ধান্তটি তার নিতে ইচ্ছে করে, কিংবা যে সিদ্ধান্তটি অন্যদের কাছে তাকে অধিক গ্রহণযোগ্য করে তোলে—হোক সেটি ভুল বা ঠিক। প্রকৃত ঘটনা বা সিদ্ধান্তের সঠিকটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা বর্জনের ক্ষেত্রে তেমন কোনো ভূমিকা রাখে না। সাময়িক নীরবতা অনেক সমস্যার সমাধান করে দেয়, এমনকি প্রায়ই, সমস্যা তৈরি হতেই দেয় না। সুখী হওয়ার মূলমন্ত্র ৪টি: কোনকিছু সম্পর্কেই নিজের মতো করে একটা রায় না দেয়া, রায় দেয়ার কাজটা বরং আদালতের উপরেই ন্যস্ত থাকুক না; যাকিছু আমাদের কষ্ট দেয়, তাকিছু ভুলে যাওয়া; মহত্ত্ব দেখানোর জন্য নয়, নিজেকে স্বস্তিতে রাখতে অন্যকে ক্ষমা করে দেয়া; সবকিছুকে সহজভাবে নেয়া, কারণ আমরা কোনোকিছু সহজভাবে নিতে পারি বা না পারি, এতে কিছু এসে যায় না, যাকিছু যেমন আছে এবং থাকবে, তাকিছু তেমনই আছে এবং থাকবে। কার সম্পর্কে কে কী ভাবছে, এমনকি নিজের সম্পর্কে কে কী বলল, সেটা নিয়ে ভাবার তেমন কোনো মানে নেই। গোলাপকে কে কাঁটা বলল, আর কে জুঁই নামে ডাকল, এতে গোলাপের কী এসে যায়? গোলাপ তার নিজের সুবাসটাই ছড়াবে, আর গোলাপের কাঁটা বিদ্ধ করবেই। কারো কথায় তো আর গোলাপ বদলে গিয়ে ফুলকপি হয়ে যাবে না! সাধারণ চোখ মানুষকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে দেখে। ও মুসলিম, ও হিন্দু, ও বৌদ্ধ, ও খৃষ্টান, ও ফর্সা, ও কালো, ও লম্বা, ও খাটো—এরকম করে ভাগ করে ফেলে। আর অসাধারণ চোখ মানুষের মনুষ্যত্বটাই দেখে। হৃদয়ের দিকে তাকাতে জানলে মানুষের বাইরের খোলসটা আর চোখে পড়ে না। ওই তাকানোই আসল তাকানো। মানুষের বাহ্যিক যাকিছু, তাকিছু অর্জন করা যতোটা সহজ, হারিয়ে ফেলা তার চাইতেও সহজ। কিন্তু মানুষের হৃদয়টা যেমন, তেমনই থেকে যায় সবসময়। সেই হৃদয়টাকে চেনার মাধ্যমেই প্রকৃত মানুষটাকে চেনা যায়। যখন আমরা কাউকে তার ভাল দিকগুলিকে চিনতে সাহায্য করতে চাই, তখন যদি আমরা শুরুতেই তাকে বলতে থাকি, তুমি এমন, তুমি তেমন, তোমার এটা খারাপ, ওটা খারাপ, তাহলে সে কিন্তু যেকোনো উপায়ে হোক, আত্মপক্ষ সমর্থন করে যাবে, এমনকি যদি সেটা ভুলও হয়, তবুও সে ভুলটাকেই আঁকড়ে ধরে থাকবে, সে শুরু থেকেই আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে থাকবে। সে আমাদের কোনো কথাই কানে নেবে না। তার চাইতে ভাল উপায় হলো, যদি ও কেমন, সেটা নিয়ে ওকে আহত না করে, ও কেমন হলে ভাল হয়, সেটা ওকে কৌশলে বুঝিয়ে দিতে পারি, তবে ও আমাদের সম্পর্কে খারাপ কিছু ভাববে না, এবং আমাদের সকল পরামর্শও সাদরে গ্রহণ করবে। মানুষ যখন কারো কোনো পরামর্শ গ্রহণ করে, তখন যতটা না পরামর্শের গুণে গ্রহণ করে, তার চাইতে বেশি গ্রহণ করে পরামর্শদাতার গুণে। যাকে আমাদের ভাল লাগে না, আমরা সাধারণত তার কোনো কথাকেই গ্রহণ করতে চাই না, সে কথা যতো ভালোই হোক না কেন। কারো আক্রমণাত্মক সমালোচনা করে তার কোনো উপকার করা দূরে থাক, তার কাছে গ্রহণযোগ্যও হওয়া যায় না। যে আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, আমি কেন তার কথা শুনবো? কারো কাছে আসতে চাইলে, কাউকে নিজের মতো করে সাজাতে চাইলে, কারো জীবন সুন্দর করতে চাইলে, আমি যদি মহাসমুদ্রও হই, তবুও তাকে ভাবতে হবে জল, যা ছাড়া আমার কোনো অস্তিত্বই নেই। সে যদি জল হয়, তবে আমার নিজেকে তার জন্য তৃষ্ণার্ত করে তুলতে হবে, বিশ্বাস করতে হবে, তাকে ছাড়া আমার অস্তিত্ব সংকটাপন্ন। কাউকে ভালোবাসা আগুন নিয়ে খেলার মতো, সে খেলায় সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, ধোঁয়াটুকুও অবশিষ্ট থাকবে না। আর স্রষ্টাকে বা নিজের আত্মাকে ভালোবাসার অর্থই হল, হয় আমি আমার ভালোবাসার বস্তুকে নিজের মতো করে পাবো, নতুবা নিজেই সে ভালোবাসার দহনে একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাবো। অমন নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার মধ্যেই জীবনের সমস্ত সুখ আর স্বস্তি নিহিত।
চব্বিশ। কীভাবে অন্যদের সাথে যোগাযোগ করতে হয়, কথা বলতে হয়, কী বলা যায়, কী বলা যায় না, তা শেখা প্রয়োজন। নিজে কথা বলার লোভ সংবরণ করে কীকরে অন্যদের কথা শুনতে হয়, অন্যদের কথা বলতে দিতে হয়, সে আর্টটা রপ্ত করা দরকার। কারো সাথে মিশতে হলে প্রথমেই যা জরুরি, তা হলো ধৈর্য। কারো সম্পর্কে ঠিকমতো না জেনে, বা কোনো বিষয় সম্পর্কে ভালোভাবে ধারণা না নিয়ে, কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়া, মন্তব্য করে ফেলা মূর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়। আমার আচরণ, আমার কথা, আমার সিদ্ধান্ত আমাকে অন্যদের চোখে সন্তও করে দিতে পারে, শয়তানও করে দিতে পারে। বাহ্যিক পর্দাটা সরিয়ে দেখতে পারলে প্রকৃত মানুষটাকে দেখা যায়। আমরা যদি কারো বাহ্যিক দিকটাই শুধু দেখি, তবে আমরা তার সম্পর্কে যা জানবো, সে আসলে ওরকম নয়। কারো হৃদয়ের দিকে তাকাতে হলে নিজের হৃদয়ের চোখ দিয়ে তাকাতে হয়। যার হৃদয় অন্ধ, সে অন্যের মধ্যে স্রষ্টার অস্তিত্ব বুঝতে পারে না। কারো ভালকিছু অনুভব করলে, কারো ভালকিছুকে গ্রহণ করতে জানলে নিজের অনুভূতি সুন্দর হয়, শুদ্ধ হয়। এতে যে আনন্দ পাওয়া যায়, সে প্রাপ্তির কৃতিত্ব নিজের হৃদয়-ঐশ্বর্যের। যার নিজের হৃদয় যতো রিক্ত, সে ততো অন্যের হৃদয়ের রিক্ততার খোঁজ পায়। আপনি কারো চাইতে কতটা ভাল, সে বিচার করবেন না। আপনি ধরেই নিন, আপনি সবার চাইতে খারাপ, আর বিশ্বাস রাখুন, আপনি খারাপ হয়ে থাকার জন্য পৃথিবীতে আসেননি। ভাল হয়ে থাকার সকল যোগ্যতাই আপনার আছে—এই আত্মবিশ্বাসকে আপনার ইচ্ছাশক্তির সাথে সঠিকভাবে সমন্বয় করতে পারলে আপনি এখন যেমন আছেন, তার চাইতে অনেক উন্নত মানুষে পরিণত হবেন। আত্মতুষ্টি মানুষকে পঙ্গু করে দেয়। স্বর্গ কেমন, নরক কেমন, কে খারাপ, কে মন্দ, কে দেখতে সুন্দর, কে দেখতে কুৎসিত, কে সৌভাগ্যবান, কে দুর্ভাগা, কে সাধু, কে পাপী, সে চরিত্রবান, কে দুশ্চরিত্র—এসবকিছু বিচার করার অধিকার বা দায়িত্ব আমাদের দেয়া হয়নি। আমাদের নিজেদের সম্পর্কেই আমরা ঠিকমতো জানি না, অন্যদের সম্পর্কে কীভাবে জানবো? কে স্রষ্টার প্রিয়, আর কে অপ্রিয়, কে বলতে পারে? এটা কীভাবে আমাদের মাথায় আসে, আমিই শুদ্ধ, আমিই ঠিক, আর অন্যরা সবাই ভ্রান্ত? অন্যের বিচার করা আমাদের কাজ নয়। আমরা যতো বেশি অন্যের সমালোচনা করি, আমরা ততো বেশি নিজেদের অসুন্দর দিকগুলির প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ি। যদি বিবেচনা করতেই হয়, তবে আমরা মানুষের উন্নত দিকগুলি নিয়ে ভাববো, সেগুলিকে বিচার করবো। আমাদের সে বিচারে বেরিয়ে আসবে, অন্যদের মতো করে বাঁচতে চাইলে আমাদের নিজেদের কতটা বিকশিত করতে হবে। আমাদের জন্য কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ, সেটার খোঁজ আমাদের কেউই কখনো দিতে পারবে না; কোনো বন্ধু, কোনো পিতামাতা, কোনো শিক্ষক, কোনো ধর্মগুরু—কেউই না। আমাদের ভেতরে যে আমি’টা বাস করে, তার কথা মন দিয়ে শুনতে হয়। আমাদের হৃদয়ের কণ্ঠস্বরটা কখনোই ভুল কিছু বলে না। জলের খোঁজে জীবনটা নষ্ট না করে, কতটা তৃষ্ণার্ত হয়ে জলের খোঁজে মরছি, যদি হৃদয়কে তা বোঝানো যেত, তবে জলের অফুরান উৎস আপনিই আমাদের চোখের সামনে দেখতে পেতাম। হৃদয়ঘরে জলভর্তি কলসিটা অসীম ঔদাসীন্যে এক কোণায় ফেলে রেখে এক ফোঁটা জলের খোঁজে সারা পৃথিবী বৃথা ছুটে মরি।
পঁচিশ। জীবনটা ঠিকভাবে কাটানোর জন্য দুটো জিনিস বোঝা জরুরি: কখন ধরে রাখতে হবে, কখন ছেড়ে দিতে হবে। জীবনে এই দুইয়ের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারলে, জীবনটা একেবারে খারাপ না। মৃত্যুর পর কোনো এক স্বর্গে অনন্ত সুখভোগ কিংবা নরকে নিরন্তর কষ্টযাপন—এই বিশ্বাসে যখন আমরা বেঁচে থাকি, তখন মৃত্যুর পর সে স্বর্গসুখ পেতে আমরা যা যা করি, তাতেই মৃত্যুর আগেই সে সুখ আমাদের পাওয়া হয়ে যায়। ভালকাজের সুখ অনুভব করতে মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না, খারাপ কাজের যন্ত্রণা অনুভব করতেও মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না। এ মৃত্যু পরবর্তী জীবনের দিকে যাত্রাপথটা শুরু হয় মৃত্যুর অনেক আগেই, সে পথের শুরুতেই আমাদের খুব ভালোভাবে বুঝে নিতে হয়, কখন, কোথায়, কীভাবে, কোন বস্তুর মায়া ত্যাগ করার যথার্থ সময় কোনটি। বাঁচতে হলে ধরতে যতোটা জানতে হয়, তার চাইতে ঢের বেশি জানতে হয় ছাড়তে। যখন কোনোকিছু ধরে রাখতে গিয়ে নিজের জীবনটাই অর্থহীন হয়ে পড়তে থাকে, তখন ওটা ছেড়ে দেয়াই ভাল। ভাল এবং মন্দ, ভালোবাসা ও ঘৃণা, ক্ষমা ও প্রতিশোধ—এমন পরস্পর বিরোধী সত্তার সহাবস্থানই জীবন। আমার নিজের ও অন্যদের প্রতি দায়িত্ব বুঝে না চললে জীবনে অহেতুক কিছু ঝামেলা এসে ভিড় করে, যা কেবল যন্ত্রণাই দেয়। আমরা যদি এমনকিছুকে ছেড়ে দিই, যা না রাখাটাই বড্ডো ভুল, তবে তা আমাদের অনেক ভোগায়। আমরা যদি এমনকিছুকে রেখে দিই, যা ছেড়ে দিলেই বরং বেঁচে যেতাম, তবে তা কখনো-কখনো আমাদের একেবারে নিঃশেষ করে দেয়। আমরা কী ধরে রাখছি, কী ছেড়ে দিচ্ছি, তা নির্ভর করে আমরা কোনটাকে প্রাধান্য দিচ্ছি, আর তার ব্যাপারে আমাদের সিদ্ধান্তটা কী, এই দুটো বিষয়ের উপর। আমাদের সিদ্ধান্ত যা-ই হোক না কেন, যদি শেষ পর্যন্ত সে সিদ্ধান্তে অটল থাকার প্রস্তুতি ও ক্ষমতা থাকে, তবে যোগবিয়োগে আমাদের তেমন কোনো ক্ষতি হয়ে যায় না। যতো কষ্টই হোক না কেন, সবকিছুকে মেনে নিয়ে কখন ছাড়তে হবে, কিংবা কখন রাখতে হবে—এই সময়জ্ঞান রপ্ত করাটা বেশ কঠিন। অনেকসময় এই আর্টটা শিখতে সারাজীবন লেগে যায়। জীবন একবার মৃত্যুকে প্রশ্ন করলো, “লোকে কেন আমাকে ভালোবাসে, আর তোমাকে ঘৃণা করে?” মৃত্যু হেসে উত্তর দিল, “কারণ, লোকে তোমায় দেখে মনভোলানো দারুণ সব মিথ্যের যাদুতে, আর আমায় দেখে এক যন্ত্রণাদায়ক সত্য রূপে।” সুখ কী, তা বোঝার জন্য প্রথমেই দরকার অসীম দুঃখের আবাহন। যন্ত্রণা কমাতে যন্ত্রণা বাড়াতে হয়, স্বস্তির খোঁজ মেলে অস্বস্তির মহাসমুদ্রে ডুবসাঁতার কেটে। যে কোলাহল চেনে না, সে কখনো নীরবতা চিনতে পারে না। জীবনের কঠিনতম কাজগুলির একটা হল, কোনোকিছুকে যেতে দেয়া। হোক সেটা ভালোবাসা কিংবা ঘৃণা, রাগ কিংবা অভিমান, লাভ কিংবা ক্ষতি, বন্ধু কিংবা শত্রু, কাজ কিংবা আলস্য—অবস্থা ও অবস্থানের পরিবর্তন অতো সহজ নয়। কোনোকিছুকে ধরে রাখতে, ছেড়ে দিতে—দুটো কাজেই আমাদের নিজের সাথে যুদ্ধ করতে হয়। অনেকদিন পরও আমাদের মনে হয়তো একটাই আফসোস থেকে যাবে: হায়! যা আঁকড়ে ধরে এতদিন কাটিয়ে দিলাম, তা আসলে আমার ছিল না। অহেতুকই কিছু সময় চুরি হয়ে গেছে মিথ্যে মায়ায়। ভুল কিছু নিয়ে বাঁচার চাইতে বরং শূন্যহাতে বাঁচাও ভাল।
ছাব্বিশ। চলে যেতে দেয়ার মানে কিন্তু ভুলে যাওয়া নয়। চলে যেতে দেয়ার মানে, যা হয়েছে, তা আমায় অনেককিছুই শিখিয়েছে, সে শিক্ষাটা আমি গ্রহণ করছি। জীবনে বাঁচতে গেলে কিছু সুন্দর স্মৃতি ধরে রাখতে হয়, সে স্মৃতির সাথে যে ঘটনাগুলি জড়িয়ে আছে, সেগুলিকে তো ধরে রাখা যায় না। এর নামই জীবন। যা আমাদের কষ্ট দেয়, তা থেকে শিখতে হয়, এতোটাই শিখতে হয় যাতে সে শিক্ষাটা কাজে লাগিয়ে নিজের জীবনকে সাবধানে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। একই কষ্ট দুইবার পাওয়ার মানেই হলো, আসলে জীবনের সময়টাকে আমরা কাটাচ্ছি না, নষ্ট করছি। এমন জীবনের সত্যিই কোনো অর্থ নেই। জীবন কাটে ভালোবাসায়। এ ভালোবাসা হতে পারে মানব-মানবীর ভালোবাসা, প্রিয় কাজটির প্রতি ভালোবাসা, প্রিয় সময়টির জন্য ভালোবাসা, প্রিয় জিনিসটার মধ্যে লুকানো ভালোবাসা। ভালোবাসার কোনো সংজ্ঞা হয় না, কোনো স্তর হয় না, কোনো সীমারেখায় ভালোবাসাকে বাঁধা যায় না। ভালোবাসা ছাড়া জীবন নিরর্থক, স্থবির, অচল হয়ে পড়ে। যা আমাদের উদ্বিগ্ন শঙ্কিত বিহ্বল করে রাখে, তা থেকে নিজেকে মুক্ত করার সবচাইতে ভাল পন্থাটি হলো, তাকে নিজের মধ্যে ধরে না রেখে চলে যেতে দেয়া, নিজের ভেতর থেকে বের করে দেয়া বা নিজেকেই সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে আসা, সেটি ঘটার ধরনের প্রতি নিরাসক্ত হয়ে থাকা। এ এক কঠিন যুদ্ধ। যতবার চলে যেতে দিই, ততবার তার স্মৃতি এসে এলোমেলো করে দেয়। চলে যেতে দিলে নতুন কিছু এসে সে শূন্যস্থান পূরণ করে, এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপারটা ঘটে তা হলো, দিনের শেষে জয়টা আমারই হয়। প্রকৃত অর্থে ভালথাকার রাস্তা সামনে থাকা সত্ত্বেও সেটাকে দূরে সরিয়ে রেখে খারাপথাকার দর্শন জীবনদর্শন নয়, মৃত্যুদর্শন। যাকিছু ধরে রাখলে কষ্ট বারে, তাকিছুকে ছেড়ে দেয়াই বাঁচার একমাত্র পথ। মানুষ ক্ষমা করে দিতে পারে, কিন্তু কখনোই ভুলে যেতে পারে না। স্মৃতি কখনো না কখনো এসে কষ্ট দেবেই দেবে। কী দরকার ধরে রেখে কষ্ট বাড়ানোর? যেতে দিন, ছেড়ে দিন, ভাল থাকুন, ভাল থাকতে দিন; এখনো সময় আছে। নতুন সম্পর্কের জন্ম মানেই পুরনো সম্পর্কের অদৃশ্য মৃত্যু। সম্পর্কের দোহাই দিয়ে জীবনকে টেনে নিয়ে যাওয়ার মানেই হলো, দুঃখকে সঙ্গী করে জীবনে ভারসাম্য আনার চেষ্টা; কিছু জটিলতা, কিছু কঠিন পরিস্থিতি, কিছু কান্না আর নিরাশাকে জীবনে নিমন্ত্রণ করে আনা। অতো সহজ নয় এতো সহজে সবকিছু সহজ করে নেয়া। জানি, নতুন পদক্ষেপ সবসময়ই ভীতি জাগায়। এটাই নিয়ম। অচেনা রাস্তা সবসময়ই শঙ্কা তৈরি করে। এটাই হয়। যা ঘটেনি, তা গ্রহণ করার চাইতে যা ঘটছে, তাকেই কাছে রেখে দিতে বেশি ইচ্ছে করে। এটাই মানুষের প্রবৃত্তি। ভাবুন তো, আপনি আজকে যেমন আছেন, যেমন আছেন বলে আপনি ভাল আছেন, কালকে তো তেমন ছিলেন না। কালকে এমন কিছু করেছিলেন, যা পরশু আপনি করেননি। এবং তা করার সময় আপনি আজকের মতোই দুশ্চিন্তিত হয়ে গিয়েছিলেন। তাই বলে যদি কালকে অজানাকে বরণ করে না নিতেন, তবে কি আজকের ভালথাকাটা আপনার জীবনে আসত? আজকের ভয়ই আগামীকালকের অভ্যস্ততা—এর নামই জীবনযাপন। জীবনে কারো জন্য, কোনোকিছুর জন্য কখনো থেমে থাকে না। ছোট্ট একটা পদক্ষেপ দরকার জীবনকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার, আর কিছু নয়। নতুন পথে হাঁটার রাস্তাটা আমাদের হৃদয়ই আমাদের চিনিয়ে দেবে। অতো ভাবনা কীসের? জীবনের শিক্ষা, আত্মার মুক্তি, হৃদয়ের ভালোবাসা—এ সবকিছুই সম্ভব, যদি আমরা বর্তমানের বাজে অবস্থাটাকে আঁকড়ে ধরে না রাখি। জীবন মানে পেছন ফিরে কষ্টের হিসেব কষা নয়, জীবন মানে সামনে তাকিয়ে সুখের খোঁজ করা। বন্ধু আর প্রিয়জন যখন নিজের পথে হাঁটতে চায়, সে পথে হেঁটে সুখ খুঁজে পায়, তখন আমার ভালথাকার আর ভালবাঁচার দর্শন তার উপর চাপিয়ে না দেয়ার মানসিক পরিপক্বতার নামই যাপিত জীবন।
সাতাশ। আমরা যাকিছুকে ঠিক বলে জানি, তাকিছু যে আদৌ ঠিক তার নিশ্চয়তা কী? যা ভুল বলে জানি, তা যে ভুল তার নিশ্চয়তাই বা কী? আমাদের নিজেদের কাছে আমাদের চিন্তার ব্যাখ্যা আমাদের চারপাশের পৃথিবীকে ঠিক বা ভুল করে দেয়। একেকজনের পৃথিবীর রূপ একেকরকমের। কেউ যখন আমাদের কোনো কটু কথা বলে, তখন আমরা কষ্ট পাই। কেন পাই? আমাদের অনার্সে একটা কোর্স ছিল: Numerical Analysis. সে কোর্সে একটা থিওরি আমাদের পড়ানো হয়েছিলো, নাম রাঙ্গে-কুত্তা থিওরি। বলা বাহুল্য, দুজন গণিতবিদের নামে সে থিওরির নামকরণ। জন্মের পর যার নাম রাখা হয়েছিলো কুত্তা, তার দেশে নিশ্চয়ই কেউ কাউকে কুত্তা বলে গালি দেয় না। কুত্তা নামে ডাকলে যে কষ্ট পেতে হয়, এই অভিজ্ঞতাই সে দেশে কারো হয়নি। একইভাবে আমরা যখন কোনো কথা বা আচরণে কষ্ট পাই, তখন সে শব্দ বা ব্যবহার আমাদের মস্তিষ্কে অতীতের কোনো অভিজ্ঞতার অনুরণন সৃষ্টি করে, যা আমাদের আগেও কষ্ট দিয়েছিল। আসলে কারো কথা বা আচরণ আমাদের কষ্ট দেয় না, আমাদের কষ্ট পাওয়ার ক্ষমতা বা তার কথায় আর আচরণে নির্লিপ্ত থাকার অক্ষমতাই আমাদের কষ্ট দেয়। আমরা নিজেরা না চাইলে আমাদের কষ্ট দেয়ার কোনো ক্ষমতাই পৃথিবীর কোনোকিছুর নেই। আপনি তো ভাই গাছের মতো শান্ত। আপনাকে কোনোকিছু বলা আর গাছকে বলা, একই কথা।—এই দুটো অভিব্যক্তি লক্ষ্য করুন। একই গাছের সাথে তুলনা প্রথম ক্ষেত্রে শান্তি দিচ্ছে, আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে অশান্তি দিচ্ছে। এক্ষেত্রে শব্দের শক্তির চাইতে শব্দ আমাদের মনের মধ্যে ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক ভাবনা উদ্রিক্ত করে, সেটাই আমাদের মনের উপর শব্দের প্রভাবটা কীরকম, সেটা নির্ধারণ করে দেয়। কষ্টের স্থায়িত্ব কতক্ষণ? কষ্টের তীব্রতা কতটুকু? এর কোনোটাই কষ্ট নিজে ঠিক করে দেয় না, বরং সে কষ্টকে আমরা কীভাবে গ্রহণ বা বর্জন করছি, সেটাই ঠিক করে দেয়। কাউকে আমাদের জীবন থেকে চলে যেতে দেয়া বা নিজেকেই তার জীবন থেকে সরিয়ে আনার অর্থ এই নয় যে, যে দুঃখ, যন্ত্রণা, কষ্টটা আমি তার কাছ থেকে পেয়েছি, সেটা আমি ভুলে গেছি। বরং, এর মানে এই, আমি তাকে এবং আমার নিজেকে সময় ও সুযোগ দিচ্ছি শোধরানোর বা বদলানোর; যদি সত্যিই তার বা আমার নিজের কখনো মনে হয়, নিজেকে শোধরানো বা বদলানো প্রয়োজন, তখন যেন সে পথটা খোলা থাকে। এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্ব মুহূর্তে সরে না আসলে বা সরিয়ে না দিলে, সে মুহূর্তের অসীম কষ্ট সম্পর্ককে চিরতরে শেষ করে দিতে পারে। সম্পর্কটা আবার গড়ুক, বা একেবারেই শেষ হয়ে যাক, যা-ই ঘটুক না কেন, তার সিদ্ধান্ত নিজে দূরে সরে বা তাকে দূরে সরিয়ে নেয়ার পর নিলেই দুজনের জন্যই সুখকর ও মঙ্গলজনক। সময় আশ্চর্য যাদুকর। সময়টাকে যেতে দিতে হয়। সময়ই সবকিছু ঠিক করে দেয়। এই কাজটিই আমরা করতে পারি না। আমরা সময়কে ধরে রাখতে চাই। আমরা ভুল করে সময়কে ততক্ষণই ধরে রাখতে চাই, যতক্ষণ পর্যন্ত না সময় সবকিছুকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। আমাদের সবচাইতে বড় দুর্বলতা, আমরা সময়ের রহস্যময় খেলাটা ধরতে পারি না। যেতে দেয়াটা সহজ নয়। যেতে দিতে অনেক যন্ত্রণা হয়। বর্তমানের যন্ত্রণাটা আরো বাড়ে। তবু কখনো-কখনো যন্ত্রণাকে বাড়তে দেয়া ভাল। যন্ত্রণা কমানোর একমাত্র উপায় হলো, যন্ত্রণাকে বাড়তে দেয়া। সুখের দেখা সুখের রাস্তায় মিলে না, সুখের দেখা মিলে দুঃখের রাস্তায়। আনন্দে পৌঁছনোর সবকটা রাস্তাই কষ্ট দিয়ে তৈরি। যদি এমন হয়, ছেড়ে দেয়াটা কিছুতেই সম্ভব হয়ে উঠছে না, তবে খুব সাবধানে প্রমিত আবেগে কী হচ্ছে, কী হচ্ছে না, এই দুটো বিষয়ের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। যা ঘটছে, তার ফলে আমাদের মানসিক অবস্থা এবং অবস্থানের যে ইতিবাচক বা নেতিবাচক পরিবর্তন, তাকে সহজভাবে নেয়া শিখতে হবে। এরকম করতে-করতে একসময় আমরা পুরনো ‘আমি’ থেকে বের হয়ে নতুন ‘আমি’তে পরিণত হবো, যে ‘আমি’কে কোনো অলীক স্বপ্ন বা সুখ মোহাবিষ্ট করে রাখতে পারে না। ভুল কোনোকিছুর প্রতি মায়া, মুগ্ধতা, নেশা থেকে নিজেকে মুক্ত করার মধ্যে দিয়েই প্রকৃত সুখের সন্ধান মেলে। দিনের শেষে নিজের সাথে একমাত্র নিজে ছাড়া আর কেউই থাকে না, কিছুই থাকে না। সেই নিজেকে ভুল জায়গায় আটকে রাখা মৃত্যুর সমান। হৃদয়ের ঐশ্বর্য যার যতো কম, হারানোর ভয় তার ততো বেশি। বিত্তের চিত্ত মানুষের আত্মায় যে শৃঙ্খল পরিয়ে দেয়, চিত্তের বিত্ত মানুষকে সে শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে। তখন সুখের ঝর্ণা হয়ে ওঠে অফুরান, চিরন্তন, ধ্রুব। নিজের হৃদয়ের খেয়ালে নয়, বরং নিজের হৃদয়ে যে জ্ঞানের অধিষ্ঠান, সে জ্ঞানের অনুশাসনে জীবন কাটালে জীবনে আনন্দ, সুখ, শান্তি আর স্বস্তির সহাবস্থান ঘটে।
আটাশ। স্বপ্নছোঁয়ার রাস্তায় হাঁটার কাজটি আরামের নয়, সুখকর নয়। কখনো-কখনো, যেখানে বাঁচতে গেলে ভয় এসে বিহ্বল করে, সেখানে বাঁচার চর্চা করতে হয়। বিচক্ষণতা নয়, জীবনে ভালকিছু পেতে চাইলে পাগলামি লাগে। যে স্বপ্নে বেঁচে আছি, সে স্বপ্নকে নিজের অস্তিত্বের মধ্যে ধারণ করে বাকি সব ‘আমার’ ‘তোমার’ ‘তার’কে কিছু সময়ের জন্য হলেও জীবন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। যা পেতে চাই, যা হতে চাই, তার মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে মিলিয়ে মানিয়ে নেয়ার নামই স্বপ্নের জন্য বাঁচা। আমি এখন যেমনটা আছি, সেই আমি’কে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে না পারলে, স্বপ্নের আমি’র সাথে আর কোনোদিনই দেখা হবে না। এক আমি’র মৃত্যুতে আরেক আমি’র নবজন্ম ঘটে। ডান হাতে পুরনো আমি’কে ছেড়ে দেয়ার সময় বাম হাতে নতুন আমি’কে ধরতে হবে। বাম হাতে পুরনো আমি’কে ছেড়ে দেয়ার সময় ডান হাতে নতুন আমি’কে ধরতে হবে। যদি আমরা দুই হাত দিয়েই ছাড়ি, তবে এমনও হতে পারে, আমরা যা ছাড়ছি, তা আমাদের পুরোপুরি ছেড়ে গেলে আমাদের পক্ষে নতুন কোনোকিছুকে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। যদি আমরা দুই হাত দিয়েই ধরি, তবে এমনও হতে পারে, আমরা যা ধরছি, তা আমাদের পুরোপুরি অধিকার করে ফেললে আমাদের পক্ষে পুরনো কোনোকিছুকে ত্যাগ করা সম্ভব নয়। অপ্রয়োজনের শূন্যতা অনেকসময়ই প্রয়োজনকে গ্রহণ করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তেমনি প্রয়োজনের উপস্থিতিও কখনো-কখনো অপ্রয়োজনকে বর্জনকে করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এমন হিসেবের নামই জীবনের সমীকরণগুলির সাথে বোঝাপড়া করে বাঁচা। পৃথিবীকে ভালোবাসতে হয়, মায়ার বাঁধনে বেঁধে নিতে জানতে হয়। যদি তা করতে পারি, তবে এমন পৃথিবীতে আমরা বাঁচতে পারবো, যে পৃথিবীটা ভালোবাসায় তৈরি। ভালোবাসার পৃথিবী সবচাইতে নিরাপদ, নিশ্চিন্ত, নিরুদ্বেগ; সে পৃথিবীতে জীবন সবচাইতে সুন্দরভাবে যাপিত হয়, স্বাদিত হয়। আমরা আমাদের জীবনের গল্পে এমনকিছুকে প্রকটভাবে রাখবো না, যাকিছু আমাদের ভাল থাকতে দেয় না, যাকিছু আমাদের স্মৃতির ডায়রিতে কান্নার পাতাগুলিই বাড়াতে থাকে। জীবনের গল্পে অনেকগুলি অধ্যায় থাকে। গল্পে কষ্টের অধ্যায় যতো বেশি বাড়বে, গল্পের ঝুড়িটা ততো বেশি ভারি হয়ে উঠবে, আর সে ঝুড়িকে আমাদের বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাওয়ার মানেই হলো, আমরা এমন একটা জীবন কাটালাম, যা ক্লান্ত, শ্রান্ত, বিমর্ষ, এবং ব্যর্থ। কোনো মানে হয়? জীবনে যাকিছুই আসুক, আনন্দ কিংবা কষ্ট, সবই সাময়িক। সবকিছুকে পেছনে ফেলে রেখে জীবন সামনের দিকে বয়ে চলে। এমনভাবে বাঁচতে হয়, যাতে বর্তমানের আনন্দ যেন ভবিষ্যতের আশংকাকে আড়াল না করে, বর্তমানের কষ্ট যেন ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে প্রচ্ছন্ন না রেখে দেয়। সত্যিকারের বিপদ আর দেয়াল, দুটোর অবস্থানই আমাদের হৃদয়ের ভেতরে। যখন অতীতের কোনো ঘটনা কিংবা অভিজ্ঞতা বর্তমান সম্পর্কে আমাদের ভয়ে আচ্ছন্ন করে, তখন প্রথমেই যে কাজটি করা প্রয়োজন তা হলো, সে ভয়ের ব্যাপার বা ধারণার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল আবেগকে নির্মোহভাবে একপাশে সরিয়ে রাখা। এরপর ভেবে দেখা, আমাদের ভয়ের উৎসটা আসলে কোথায়? প্রায়ই দেখা যায়, আমাদের ভয়টা সেসবকিছু নিয়েই, যেসবকিছু আমাদের ভাবনা এবং দৃষ্টির অগোচরে। যে কম্পিউটারে কোনো ভাইরাস নেই, সে কম্পিউটারটি খুব সম্ভবত অব্যবহৃত কিংবা অচল। ভাইরাস কম্পিউটারের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। ভাইরাস ছাড়া যেমনি কম্পিউটার হয় না, তেমনি শঙ্কা ছাড়াও মন হয় না। ভয়কে বাদ দিলে মানসিক গঠন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। পৃথিবীর সবচাইতে নির্ভীক মানুষটির হৃদয়েও হয়তো তার স্ত্রীর জন্য ভালোবাসার পাশাপাশি অনেকখানি ভয় নিহিত আছে। ভাইরাস দূর করতে অ্যান্টি-ভাইরাস লাগে, ভয় দূর করতে আত্মার উদ্বোধন জরুরি। আমাদের জীবনটা একতারার ওই একটিমাত্র তারের মতো, যা ঠিক মাত্রায় টেনে ধরলে সুন্দর সুর সৃষ্টি করা সম্ভব। অন্যথায়, বেসুরই একমাত্র নিয়তি। ওই মাত্রাজ্ঞানটা সঠিক সময়ে বোঝার নামই প্রজ্ঞা, স্বজ্ঞা, প্রতীতি। বাইরের আমি এবং ভেতরের আমি—সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটো সত্তা। আমাদের চৈতন্য এই দুইয়ের মধ্যে সংযোগ ঘটায়। এই দুইয়ের মধ্যে সুসংহত মিথস্ক্রিয়া জীবনের চলার পথকে আনন্দময় করে। নৈরাশ্যের পাখিরা আমাদের মাথার চারপাশে উড়ে বেড়াবেই, কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, তারা যেন আবার আমাদের চুলের মধ্যে বাসা বেঁধে না ফেলে। জীবনকে অর্থপূর্ণ করতে হলে দুটো কাজ করতে হয়। এক। যে গহ্বরকে অস্তিত্বের মতো দেখায়, সে গহ্বরকে খুব সাবধানে এড়িয়ে বাঁচা। দুই। যে অস্তিত্বকে গহ্বরের মতো দেখায়, সে অস্তিত্বকে খুব যত্নে আলিঙ্গন করা। আমাদের সকল স্বপ্নের চাইতে জীবন বড়, আমাদের সকল দুঃস্বপ্নের চাইতে জীবন ধ্রুব। স্বপ্ন ছুঁতে পারি না পরি, দুঃস্বপ্ন এড়াতে পারি না পারি, এতে তেমন কিছুই এসে যায় না; তবে জীবন যেন কোনোভাবেই তার রঙটা হারিয়ে না ফেলে। স্বপ্নের সাথে সহবাসের শিক্ষা, কিংবা দুঃস্বপ্নের সাথে বসবাসের দীক্ষা—জীবনে এই দুইয়ের চাইতে বড়ো আর্টটি হলো: জীবন যেমন, জীবনটাকে ঠিক তেমনভাবেই গ্রহণ করা।