চৌষট্টি।
আমরা যখন আমাদের নিজেদের ভেতরে নানা ধরনের ভ্রান্ত ইগো দ্বারা পরিচালিত হই, তখনই বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। পুরো বিশ্ব আজ কেবল দ্বন্দ্ব বোঝে, সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, কেননা অন্যের মতকে মেনে নেওয়ার ব্যাপারটা আমাদের আত্মঅহংকারে আঘাত করে, সুতরাং আমরা যা-ই শুনি, সে কথাটি ভালো হোক অথবা মন্দ, সত্য কিবা মিথ্যা, আমরা একবাক্যেই অন্যের প্রায় সব কথাকেই অগ্রাহ্য করি। আমাদের মন আমাদেরকে বাধ সাধে এই বলে, কেন আমরা অন্যের মতামত মেনে নেব? আমরা আমাদের মতামত, নিজেদের চিন্তাচেতনা, অভিজ্ঞতাকেই সর্বোচ্চজ্ঞান করি। ধর্মের জায়গায় দেখা যাচ্ছে, আমরা একে অপরের ধর্মকে শ্রদ্ধা করতে পারি না। আমরা চাই, আমাদের নিজের ধর্মের নির্ধারিত পথেই সবাই চলবে, লোকে আমাদের কথাই মানবে। পৃথিবীজুড়ে কেবল আমাদের ধর্মজ্ঞানই চিরসত্য, অন্যদের সবকিছু মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন। মূলত এমন আগ্রাসী মনোভাব থেকেই সমস্ত দ্বন্দ্বসংঘাতের সূচনা। কেননা কিছু মানুষ তাদের ইগোকে হেরে যেতে দেখলে সহ্য করতে পারে না।
আমাদের সূক্ষ্ম বোধকে কাজে লাগিয়ে আমরা যদি সচেতনভাবে নিজেকে পুনর্গঠন করতে না পারি, তবে আমরা আজীবনই এমন দ্বন্দ্বের বেড়াজালে আটকে থাকব। যখন আমাদের ভেতরের সকল খণ্ড-আবেগজাত অংশ একত্রিত হতে থাকে, তখন আমাদের মস্তিষ্কের দুটি ভিন্ন অংশ এক হয়ে কাজ করে। অর্থাৎ, আমাদের বিজ্ঞান এবং আধ্যাত্মজ্ঞান একসাথে কাজ করে। আমাদের মস্তিষ্কের এই দুটি অংশকে যদি আমরা গভীরভাবে অনুধাবন করতে পারি, তবে আমরা একে সঠিক উপায়ে কাজে লাগাতে পারব। সেজন্য আমাদের মস্তিষ্কের এই ভিন্ন দুটি অংশের মধ্যে যোগাযোগস্থাপনের জন্য একটি সেতু তৈরি করতে হবে। প্রায় সময়ই আমাদের মস্তিষ্কের এই দুটি অংশ আলাদা কাজ করে বলেই আমরা একই আত্মায় দুটি ভিন্ন রূপ নিয়ে চলি। আমাদের মস্তিষ্কের এই দুটি ভিন্ন অংশ কীরকম ভিন্ন ভিন্ন কাজ করে থাকে? এই যেমন, আমরা যদি কোনও কিছু অধ্যয়ন করি, তখন মস্তিষ্কের একটি অংশ তা পড়ে, অন্যটি আমাদের স্মৃতিতে এই পড়ার অংশটি রক্ষিত রাখে। যদি কোনওক্রমে আমাদের মস্তিষ্কের একটি অংশ নষ্ট হয়ে যায়, অথবা কাজে লাগানো না যায়, তবে সে ওই কাজটি বন্ধ করে দিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায়। তখন দেখা গেল, আমরা কোনও কিছু পড়ছি ঠিকই, কিন্তু কোনওভাবেই সেটিকে আর স্মরণ করতে পারছি না। এটি কেন হয়? কারণ আমাদের মস্তিষ্কের একটি অংশ সেটিকে ধারণ করেছে, কিন্তু অন্য অংশ এটিকে ধারণ করেনি।
আমরা আমদের দুটি হাতকে একই সাথে দুটি ভিন্ন কাজে লাগাতে পারি না। দেখা গেল, দুই হাত দিয়ে দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন কাজ করতে শুরু করার কিছুক্ষণ পর একটি হাত সেটি করা বন্ধ করে দেয়। এটি কেন হয়? কেননা আমাদের মস্তিষ্ক কিছুক্ষণ পর সচেতনভাবে কাজ-করা বন্ধ করে দেয়। আমরা যদি সচেতন থাকি, তবে হাত দুটিকে একই সাথে দুটি ভিন্ন কাজে সচল রাখা সম্ভব। আমাদের মস্তিষ্ক দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতি নিয়ে গঠিত এবং বহুকাল আগে থেকেই একে সচেতনভাবে কিছু নির্দেশিত পথে কাজে লাগানো হয়েছে, যার ফলে সেই পথগুলি আমাদের মস্তিষ্কে সচেতনভাবেই গেঁথে গেছে, যার জন্য আমরা এর বাইরে কোনও চিন্তা অথবা কোনও নতুন কাজ করতে পারি না। যেমন ধরি, আমরা সব সময় আমাদের ডানহাতকে কাজে লাগিয়ে দাঁত ব্রাশ করে আসছি, এখন হঠাৎ যদি আমাদেরকে বামহাত দিয়ে ব্রাশ করতে বলা হয়, তবে আমরা ডানহাতের মতো ততটা সক্রিয়তা নিয়ে সেটি করতে পারব না, কেননা আমাদের মস্তিষ্ক এটি বহুকাল আগে থেকেই সচেতনভাবে গ্রহণ করেছে যে ডানহাত দিয়েই ব্রাশ করতে হয়, অথবা ডানহাত দিয়েই সব কাজ করতে হয়।
যদি আমরা আমাদের মস্তিষ্কের উভয় অংশ সচল রাখতে চাই, তবে আমাদের কিছুদিন পর পর এসব অভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে। যখনই আমরা একটা কাজ কিছুদিন করি, তখন ওই কাজটি আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়। তারপর আমাদের মস্তিষ্ক সেই কাজ করতে গিয়ে বেশি শ্রম দেয় না, ফলে ধীরে ধীরে আমাদের মস্তিষ্ক ওই কাজটি করার ক্ষেত্রে অলস হয়ে পড়ে, এতে করে মস্তিষ্কের ওই ক্ষেত্রে বাড়তি কার্যক্ষমতা হারায়। মস্তিষ্কের উভয় পার্শ্বের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করতে এবং সেটিকে ধরে রাখতে হলে আমাদেরকে আমাদের সব অভ্যাসে কিছুদিন পর পর পরিবর্তন আনতে হবে যেন সেটি আমাদের মস্তিষ্কের কাছে একঘেয়ে হয়ে না যায়। এতে করে আমাদের মস্তিষ্কে প্রতিটি কাজে পুনরায় রপ্ত হতে বেশ কিছুদিন করে সময় লেগে যায়, ফলে মস্তিষ্ককে ওই সময়ে সক্রিয় থাকতে হয়। আমাদের আশেপাশে এমন কতজন মানুষ রয়েছে, যারা একই সাথে তাদের উভয় হাত দিয়েই সব কাজ করতে পারে? অথবা যার ডানহাতের চেয়ে বামহাত বেশি সক্রিয়? ওরা সংখ্যায় খুব কম, কিন্তু তা সত্ত্বেও এমন মানুষ কিছু আছে। তাদের স্মৃতির শক্তিশালী অংশটিই সক্রিয় রয়েছে। ফলে তারা বামহাত দিয়ে বেশি সক্রিয়। জন্মগতভাবেই যারা এ ধরনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মায়, তাদের অনেকেই সাধারণত একজন প্রথমশ্রেণির কবি, চিন্তাবিদ, লেখক, ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক বা দার্শনিক এই ধরনের কিছু হয়ে থাকে।
এদের যদি বিজ্ঞান, গণিত, যুক্তি এগুলির প্রতি জ্ঞানবৃদ্ধির জন্য জন্য জোর করা হয়, তবে তারা সেক্ষেত্রে খুব ভালো কিছু কাজ দেখাতে পারে না। এমন কেন হয়? কেননা প্রাকৃতিকভাবে তাদের সেই বৈশিষ্ট্য নেই, যদি তাকে জোর করা হয়, তবে সে হয়তো সেক্ষেত্রে তৃতীয়শ্রেণির কিছু একটা হয়ে যাবে, কিন্তু প্রথমশ্রেণির কখনও নয়। অনেক সময় আমাদের সমাজ, আমাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্য এ সকল বাঁহাতিদের নিয়ে হাসাহাসি করে থাকে, বাবা-মা এদের জোর করে ডানহাত দিয়ে লিখতে অথবা ডানহাতে কাজ করতে বাধ্য করে। এভাবে যদি তাকে জোর করা হয়, তবে হয়তো নিজেকে প্রমাণ করতে গিয়ে সে একটি খুব ব্যর্থজীবন কাটিয়ে দেবে। সে হয়তো তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে একজন ভালো দ্রষ্টা হতে পারত, কিন্তু সে এখন একজন তৃতীয়শ্রেণির মানুষ (চাকুরে) হয়ে যাবে, কেননা আমরা তাকে তার বৈশিষ্ট্য থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য করেছি। অর্থাৎ মানুষকে তার স্বাভাবিক প্রবণতা থেকে বের করে আনলে তা ভালো কিছু বয়ে আনে না। সে যেমন তেমন করেই রেখে দিয়ে তার মধ্য থেকে তার সেরাটা বের করে আনতে হয়।
আমাদের মস্তিষ্কের দুটি অংশ খুব হালকাভাবে একটির সাথে আর-একটি সংযুক্ত। কিন্তু যদি কেউ সচেতনভাবে এই সংযুক্তি বাড়াতে পারে, তবে সে তার অনন্য বৈশিষ্ট্যে আরও দৃঢ় হতে পারে। মানুষের ভেতরে যার এই দুটিকে সংযুক্ত করে চলার ক্ষমতা যত বেশি, সে তত সুন্দর এবং প্রশংসনীয় গুণ সম্পন্ন। সে এই পৃথিবীর সব চমৎকার জিনিসের সাথে ততটাই সংযুক্ত। সে নারী এবং পুরুষ উভয়ের চরিত্র সম্পর্কে ততটাই ধারণা রাখতে সক্ষম। তার মাঝে স্রষ্টার অস্তিত্ব ততটাই প্রকট। আধ্যাত্মিকতার জগতে এই দুটি মস্তিষ্ককে এক করে এর মধ্যে সক্রিয়তা বৃদ্ধি করা হয়, যেন মস্তিষ্কের এই দুটি ভিন্ন অংশ খুব কাছাকাছি থাকতে পারে, ঠিক এতটাই কাছে যেন তারা অবিচ্ছিন্ন। কিন্তু এই কাজটি খুব সহজ নয়। এর জন্য চাই দীর্ঘ এবং সুকৌশলী চর্চা। যখন আমাদের যুক্তিগুলি ভালোবাসার মতো কাজ করে এবং আমাদের ভালোবাসাগুলি যৌক্তিক উপায়ে কাজ করে, তখন আমরা চিন্তার শীর্ষে উঠে যাই। মূলত এটিই আধ্যাত্মিকতা, যা আমাদের সবকিছুর সাথে সমন্বয় করতে সাহায্য করে।
পঁয়ষট্টি।
যখন পূর্ব-পশ্চিম একত্র হয়, যখন ডানগোলার্ধ-বামগোলার্ধ একত্র হয়, সেই সংযুক্তিই স্বর্গীয়, যখন আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে এরকম দুটি আকাশ একত্রিত হয়, তখন আমরা ধীরে ধীরে অনন্য কেউ হয়ে উঠি। ঠিক যেমন মহাকাশ খণ্ডিত নয়, তেমনি আমরা কী করে নিজেকে খণ্ডিত আকারে ভাবি? কিন্তু যুগ যুগ ধরে পূর্ব এবং পশ্চিমের যে বিরোধ চলে এসেছে, তাকে একত্র করা সহজ নয়, কেননা এটি বরাবর আগ্রাসী, বারেবারে ধ্বংসের মিছিল ডেকে এনেছে এবং এখনও এটি সেভাবেই বিদ্যমান। কিন্তু আজ হয়তো পৃথিবী কিছুটা বদলেছে, আজ হয়তো পৃথিবী কিছুটা কোমল, কিছুটা মানবিক। আমাদের যুগ যুগ ধরে পূর্ব-পশ্চিমের সমন্বয়ের চেষ্টা, কে জানে আজ হয়তো সফল হয়েও যাবে! কেননা পৃথিবী আজ বিজ্ঞানসম্মতভাবে সত্যকে মেনে নেওয়ার জন্য তৈরি। একসময় পূর্ব এবং পশ্চিম যে যার যার জায়গায় অটল ছিল, কিন্তু আজ মানুষ যতই বিজ্ঞানের গভীরে যাচ্ছে, ততই অস্তিত্বের আধ্যাত্মিকতা তার কাছে আরও পরিষ্কার হচ্ছে। বিজ্ঞান এবং আধ্যাত্মিকতার মধ্যে যে গভীর একটা যোগসূত্র রয়েছে, বিজ্ঞান আজ সেটি জানে। মানুষ সব সময় কেবল যৌক্তিকতা খুঁজেছে, কিন্তু সে যৌক্তিকতার সাথে আধ্যাত্মিকতার গভীর সম্পর্ককে অস্বীকার করে আসছে। আমরা যুক্তির বাইরে কিছু মানতে চাই না। আমরা আমাদের তৈরি নিয়ম বা রীতির ব্যতিক্রম কিছু গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক।
পশ্চিম সব সময় পুরুষমনস্ক হয়ে থাকে এবং পূর্ব সব সময় নারীমনস্ক হয়। যেমন আমরা জানি, আমাদের আমাদের ডানমস্তিষ্ক আমাদের বামহাতের সমন্বয়ে কাজ করে এবং আমাদের বামমস্তিষ্ক আমাদের ডানহাতের সমন্বয়ে কাজ করে। তেমনি পশ্চিম এবং পূর্ব উভয়কে পরস্পরের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করতে হবে, যদি আমরা সত্যের পথে শান্তির পথে হাঁটতে চাই, কেননা দূরত্ব বাড়ালেই আমাদের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হবে। পশ্চিমা সব সময় সত্যের রহস্যের খোঁজে সর্বোচ্চ উদ্যোগ গ্রহণ করে, যেখানে পূর্ব সত্যের জন্য ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করে, কেননা পূর্ব আগে থেকেই জানে, সময় হলে সত্য নিজেই নিজেকে উন্মোচিত করবে। কিন্তু পশ্চিম কখনও পূর্বের এই ধারণা মানতে নারাজ, কেননা পশ্চিম হচ্ছে পুরুষমনস্ক আর পুরুষেরা কখনও নারীসুলভ ধ্যানধারণায় বিশ্বাসী নয়। ধরা যাক, কোনও নারী যদি কোনও পুরুষকে ভালোবাসে এবং সে যদি অকপটে তার ভালোবাসার কথা সেই পুরুষটিকে জানায়, তবে সেই মুহূর্তে ওই পুরুষের পুরুষসত্তাটি সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচে। এমন কেন হয়? কারণ একজন পুরুষ একজন নারীর কাছ থেকে এমন পুরুষসুলভ আচরণ আশা করে না এবং যদি কোনও নারী এমন আচরণ করে, তবে তাকে নারীগুণবর্জিত অথবা পুরুষসুলভ ধরে নেওয়া হয়। আর এজন্যেই নারীদের অপেক্ষা করে যেতে হয়। অপেক্ষা করে যেতে হয় যতক্ষণ না কোনও পুরুষ নিজে যেচে এসে তার কাছে নিজের ভালোবাসার কথা প্রকাশ করছে, সে পর্যন্ত।
পশ্চিম এবং পূর্বের পার্থক্যও ঠিক এমনই। পশ্চিম সবকিছুতে উদ্যোগ নিতে পছন্দ করে, কিন্তু পূর্বকে অপেক্ষা করে যেতে হয় ঠিক ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ পর্যন্ত না সত্য নিজে এসে তাদের কাছে আপনাআপনি ধরা দিচ্ছে। পশ্চিম যখনই পূর্বের কাছে আসে এবং এর থেকে কোনও জ্ঞানলাভ করে, পূর্বকে ত্যাগ করার সাথে সাথে সে সেই জ্ঞানকে সেখানেই ফেলে যায়, কেননা পুরুষেরা কখনও নারীজ্ঞানকে গ্রহণযোগ্য মনেই করে না। বিশ্বটা এখন যতটা একে অপরের কাছে এসেছে, আগে এমনটি ছিল না। এখন আমরা পূর্বে থাকি কি পশ্চিমে, আমরা অকপটে একে অপরের ধ্যানধারণা খোলামনে গ্রহণ করি। সত্যের কাছে যাবার এবং সত্যকে জানার এখনই প্রকৃত সময়। কেননা আমাদের মন এখন উন্মুক্ত, সত্যকে গ্রহণ করার জন্যে এখন আমাদের মন উপযুক্ত। আমরা আমাদের দীর্ঘ প্রস্তুতিপর্ব পার করে ফেলেছি। আমরা এখন সেই ক্রান্তিকালে বাস করছি, যখন সত্য নিজেই আমাদের দ্বারে এসে নিজেকে উন্মোচিত করবে, যদি আমরা এখনই সচেতন হই। যার জন্যে আমরা এতকাল অপেক্ষা করেছি, এখন তা-ই হতে চলেছে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আমাদের একে অপরের কাছে আসতে সাহায্য করেছে, আমাদের শারীরিক যত প্রকার দেয়াল এবং বাধা ছিল, সেগুলি সব আজ একে একে খুলতে শুরু করেছে। আমরা খোলামনে, উন্মুক্ত হৃদয়ে একে অপরকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারি। এখন সময় এসেছে আমাদের মানসিক দেয়ালগুলি উপড়ে ফেলার এবং এখনই সেগুলিকে ভেঙে ফেলা সম্ভব। সেজন্য আমাদের সমন্বিত হয়ে কাজ করতে হবে। পরমআনন্দ তখনই আমাদের মাঝে ঘটবে, যখন আমরা বুঝতে সক্ষম হব যে, সমগ্রের কোনও আলাদা উদ্দেশ্য নেই। আমাদের পথের প্রতিটি অংশের এক-একটা উদ্দেশ্য থাকতে পারে, কেননা প্রস্তুতির বিভিন্ন ধাপ রয়েছে আর সেই ধাপগুলি প্রত্যেকটি এক-একটা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য নিয়েই চলে, কিন্তু আমাদের জীবনের, আমাদের সমগ্র অস্তিত্বের উদ্দেশ্য একটাই, আর সেটি হচ্ছে, সত্যের মাঝে নিজেকে বিলীন হতে দেওয়া, সত্যের খোঁজে নিজেকে উৎসর্গ করা এবং কেবল সত্যকেই জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য ভাবা। এর বাইরে সমগ্র অস্তিত্বের আর কোনও উদ্দেশ্য নেই। ‘সমগ্র’ ধারণাটিই উদ্দেশ্যহীন এক পরমঅস্তিত্বের কেন্দ্রে পরিচালিত।
ছেষট্টি।
আমাদের ঘর প্রয়োজন, কেননা এটি আমাদের নিরাপত্তা দেয়; আমরা খাদ্যের জন্য পরিশ্রম করে চাষ করি, কেননা খাদ্য শরীরের জ্বালানি; আমরা সুরে আচ্ছন্ন হয়ে থাকি, কেননা এটি আমাদের মানসিক প্রশান্তি দেয়; আমরা সন্তান জন্ম দিই, কেননা এর ফলে আমাদের মধ্য দিয়ে সেই পরমঅস্তিত্বের মূলঅস্তিত্ব রচিত হয়; আমরা ভালোবাসায় আচ্ছন্ন হই, কেননা ভালোবাসা আমাদের জীবনকে অর্থবহ করে আমাদের অনুভূতিগুলিকে স্নিগ্ধ করে। এই সবকিছু যা আমাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন, তার সবগুলির এক-একটা উদ্দেশ্য আছে, কেবল আমাদের অস্তিত্বেরই কোনও উদ্দেশ্য নেই। আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য সেই পরমঅস্তিত্বের মাঝে, সেই সত্যের মাঝে নিজেকে বিলীন করে দেওয়া, যার কেন্দ্রই আমাদের উৎপত্তি। আমাদের উৎপত্তিস্থলে ফিরে যাওয়াই আমাদের অস্তিত্বের একমাত্র উদ্দেশ্য। আমরা যখন আমাদের সকল প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে উঠে যাই, আমরা তখন সেই এক পরমশক্তির দিকেই ধাবিত হই। আমাদের উদ্দেশ্য, নিজেদের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজের মাঝে বিলীন হয়ে যাওয়া। আমরা হয়তো বলতে পারি, আমাদের উদ্দেশ্য আনন্দলাভ, আমাদের উদ্দেশ্য ভালোবাসা, কিন্তু আমরা যদি নিজেদের একটা ফুলের সাথে তুলনা করি, তবে ভাবা যাক, একটি ফুলের কী উদ্দেশ্য থাকে? কেবল নিজের ভেতরের সর্বোচ্চ সৌন্দর্য সকলের সামনে ফুটিয়ে তোলা, নিজ সুবাসে মানুষকে মোহিত করে যাওয়া, তারপর? তারপর নিজের মাঝেই ফুরিয়ে যাওয়া, নিজেকে বিলিয়ে শেষ হয়ে যাওয়া। এর বেশি কি কিছু?
উদ্দেশ্যহীনতাই আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। সকল উদ্দেশ্য কেবল প্রয়োজনের, কেবল শক্তিরই কোনও উদ্দেশ্য নেই। শক্তি সমগ্রের অস্তিত্বের মাঝে ব্যাপ্ত। আমরা যত সেই সমগ্রের দিকে ধাবিত হই, ততই আমাদের নীতি উদ্দেশ্যহীনতায় ধাবিত হয়। শক্তির উদ্দেশ্য যেমন সমগ্রের দিকেই ধাবিত হওয়া। সমগ্রের কী উদ্দেশ্য? সমগ্র উদ্দেশ্যহীন। কেননা সৃষ্টির উদ্দেশ্য স্রষ্টাকে জানা, অথচ স্রষ্টা বরাবরই উদ্দেশ্যহীন। স্রষ্টা এমন একটি সুর, যার মাঝে নিজেকে বিলীন করে দিতে হয়, স্রষ্টার মাঝে মোহাচ্ছন্ন হয়ে যাওয়াই সৃষ্টির উদ্দেশ্য। সুরের আনন্দ নেওয়া, সুরে হারিয়ে যাওয়া, সুরে আচ্ছন্ন থাকাই আমাদের কাজ। জীবন সেই সুরেরই খেলা। এ এমন একটি খেলা, যা আমাদের সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যহীন হয়ে কেবল খেলে যেতে হবে। এ খেলার কোনও বিনিময় হয় না। যেখানে বিনিময় থাকে, সেটি তখন আর খেলা হয় না, সেটি তখন হয় ব্যবসা। যখন জীবনের খেলা ব্যবসায় পরিণত হয়, তখন আমাদের উদ্দেশ্য থাকে কেবলই অর্থ। সেই অর্থ আমাদের আরও অর্থের দিকে আকর্ষিত করে। তখন আমরা এই জীবনকে এই ব্যবসাকে আরও আঁটবেঁধে খেলতে নেমে যাই। ফলে আমাদের সেই সুর, সেই মোহাচ্ছন্নতা ধীরে ধীরে হারাতে থাকে। এটি আমাদের সেই পরমশক্তির থেকে আলাদা করে প্রয়োজনীয়তার নীতির দিকে ঠেলতে থাকে। ক্রমেই আমাদের জীবন উদ্দেশ্যের জালে জড়িয়ে পড়ে।
যদিও বিজ্ঞান মাধ্যাকর্ষণের নীতি, প্রয়োজনীয়তার নীতি সম্পর্কে নানান কিছু ইতোমধ্যেই আবিষ্কার করেছে, তবু বিজ্ঞান আজও সেই ঐশ্বরিক শক্তি, দয়ার শক্তিকে আবিষ্কার করতে পারেনি। এজন্যেই বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত কার্যকারণের চিন্তায় বুঁদ হয়ে থাকে ও সৃষ্টির সবকিছুর পেছনে একটা-না-একটা কারণ খুঁজতে থাকে। বিজ্ঞান এখনও পর্যন্ত সর্বোচ্চ শক্তির নীতি সম্পর্কে অজ্ঞ। যা বিজ্ঞান আজও উদ্ঘাটন করতে অক্ষম, ধর্ম সেই সর্বোচ্চ শক্তিকে আবিষ্কার করেছে। ধ্যান আমাদের চিন্তার কেন্দ্রে আকর্ষণ করে, ঠিক যেমনি মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আমাদের কেন্দ্রের দিকে আকর্ষিত করছে। পৃথিবীর সবকিছু একটা ভারসাম্যে চলে, এটা জানার জন্যে খুব বেশি চিন্তার প্রয়োজন পড়ে না। ঠিক যেমন জন্ম একটি সত্য, মৃত্যু সেই সত্যের ভারসাম্য রচনা করে, ভালোবাসা ঘৃণার ভারসাম্যে চলে, রাত দিনের ভারসাম্যে চলে, আর পূর্ব পশ্চিম দুটি আলাদা চিন্তার জগতে ভারসাম্য রচিত হয় আপনাআপনিই। আমরা এমন এক শক্তির কথা জানি, যা আমাদের কেন্দ্রের দিকে আকর্ষিত করে, ঠিক তার বিপরীতে এমন এক শক্তি আছে, যা আমাদের ঊর্ধ্বে তুলে ধরে। এটি এমন নয় যে নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির আবিষ্কারের আগে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির অস্তিত্ব বলে কিছু ছিল না। নিউটন মাধ্যাকর্ষণের শক্তিকে উদ্ভাবন করেননি, তিনি কেবল এটিকে আবিষ্কার করেছেন। যদি নিউটন এটি আবিষ্কার না-ও করতেন, তারপরও আপেল মাটিতেই পড়ত। আপেল মাটিতে পড়ার কারণ কোনও বিজ্ঞান জানে না, এটি সত্যের নিয়মেই কেন্দ্রের দিক ধাবিত হয়। সেই সত্যের একটা নাম বিজ্ঞান দিয়েছে এবং সেই নামের পেছনে কিছু রহস্যের ব্যাখ্যা পৃথিবীর সামনে নিয়ে এসেছে। এভাবেই যুগে যুগে বিজ্ঞান বিবিধ দর্শনকে কিছু তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করে, আর কিছু নয়।
এমনকি আমরা মানি আর না মানি, আমরা খুঁজে পাই আর না পাই, সত্য সদাসর্বদা, সর্বত্র বিরাজমান। মাধ্যাকর্ষণের নিয়মে যদি আমরা ঘটতে দিই, তবে এমনই এক অদৃশ্য শক্তি ভারসাম্যের নীতিতে আমাদের ঠিকই ঊর্ধ্বে তুলে ধরবে। যখন থেকে আমরা সহজভাবে কেবল এটা বিশ্বাস করি যে ভারসাম্যের নীতিতেই কোনও শক্তি আমাদের ঠিকই ঊর্ধ্বে তুলে ধরবে, আমরা যদি এই বিশ্বাসে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করতে পারি, তবে অবধারিতভাবে সেটি ঘটবেই, ঠিক যেমনি, আমরা জানি, গভীর ধ্যানের জগতে পিথাগোরাস, বুদ্ধ, মোহাম্মদ, যিশুখ্রিস্ট…এই মানুষগুলি এক অজানা শক্তিতে ঊর্ধ্বে উঠেছিলেন। শারীরিকভাবে নয়, আধ্যাত্মিক উপায়ে ধ্যানের গভীরে এটি আমাদের ঊর্ধ্বে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে থাকে সচেতনতার এমনই এক শীর্ষে। আমরা যখন নিয়মিত ধ্যানের জগতে প্রবেশ করব, আমরা অনুভব করব, এটি আমাদের আনন্দে ভাসিয়ে নিচ্ছে, আমাদের হৃদয়ে সুর তুলে নাচতে চলেছে। এটি এমনই এক অনুভূতি, যা আমরা আগে কখনও অনুভব করিনি। এটিই শক্তির নীতি, ঐশ্বরিক করুণার নীতি। পৃথিবী আজ এক নতুন আলোকিত দিনের অপেক্ষা করে আছে, যেদিন ধর্ম এবং বিজ্ঞান উভয় এক হয়ে যাবে। যেদিন বিজ্ঞান এবং ধর্ম একত্রে সমন্বিত হয়ে কাজ করবে।
সাতষট্টি।
যখন কেউ আমাদের সাথে কোনও বিষয়ে তর্ক জুড়ে দেয় অথবা অযথা যুক্তি খণ্ডন করতে থাকে, আক্ষরিক অর্থেই যার কোনও মূল্য নেই, কিন্তু আমরা বস্তুতই জানি, আমরা যা বলছি অথবা আমরা যে পথ অনুসরণ করছি, সেটি আসলে ভুল নয়, তখন আসলে কেমন লাগে? অন্যরা যখন আমাদের ধারণার সাথে দ্বিমত পোষণ করছে অহেতুকই, তখন আমরা কী করব? আমরা কি তাদের সাথে তর্ক জুড়ে দেবো? আমাদের ধারণাগুলি যে মিথ্যা অথবা বানোয়াট নয়, সেটি প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগে যাব? আমরা এসবের কিছুই করব না। আমরা কারও সাথে তর্কে জড়াব না, আমরা নিজেদের প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লেগে যাব না, আমরা কারও কোনও যুক্তির খণ্ডন করব না। আমরা কেবল নিজের বিশ্বাস, নিজের দর্শনে নিজে অটল থেকে তাদের সব ধরনের মন্তব্য শুনে যাব। আমরা নিজেদের বাক্য ও নিজেদের হাত, দুইই নিজেদের কাছেই রাখব। যখন আমরা যন্ত্রে পরিণত হই, যখন আমরা রোবটের মতো কাজ করি, যেমন আমরা জন্মগ্রহণ করি, তারপর একটা দীর্ঘসময় ধরে নিজেকে অর্থউপার্জনের মেশিনে পরিণত করি, আমরা সম্পর্কে জড়াই, আমরা পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ হই, আমরা অন্যের সাথে নিজেদের সামাজিক, আর্থিক তুলনা করে প্রতিযোগিতায় বা ইঁদুরদৌড়ে লিপ্ত হই, আমরা সাফল্য কিংবা খ্যাতির পিছু ছুটি, তারপর এর মধ্যে দিয়ে আমরা একসময় মৃত্যুর কাছে নত হই। এভাবেই আমরা রোবটমানবে পরিণত হয়েছি, এভাবেই আমরা বাস করছি।
যখন আমরা এমন রোবটমানবে পরিণত হই, তখনই প্রয়োজনীয়তার নীতি আমাদের উপর চেপে বসে। আমরা যত অসচেতন হই, এটি ততই আমাদের উপর কাজ করতে থাকে। সুতরাং আমরা যদি এটির উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাই, তবে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। আমরা যত আমাদের কাজে সচেতন হব, ঠিক ততই প্রয়োজনীয়তার নীতি আমাদের উপর থেকে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকবে এবং একসময় এটি একাই আমাদের ভেতর থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবে। আমরা কীভাবে নিজেদের আরও সচেতন করব? আমাদের ছোটো-বড়ো সকল কাজ পূর্বের তুলনায় আরও সচেতনভাবে করার মাধ্যমে আমরা আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধি করব। আমাদের খাওয়া, হাঁটা, কথাবলা, শ্বাসকার্য, এমনকি ঘুমের মধ্যেও আমরা পূর্ণ সচেতন থাকতে পারি। তবে এর জন্য অনেক ধৈর্য আর নিয়মিত চর্চার প্রয়োজন। আমরা কী করে নিয়মিত সচেতনতার চর্চা বৃদ্ধি করতে পারি? যেমন যখন আমরা হাঁটাহাঁটি করি, সাধারণত আমরা যেভাবে হাঁটি, আমাদেরকে এখন থেকে সেই নিয়মের ব্যতিক্রমী হতে হবে। আমাদের হাঁটার গতি পূর্বের তুলনায় আরও শিথিল করতে হবে, কেননা যখনই আমরা আগের তুলনায় ধীরগতিতে হাঁটতে শুরু করব, তখন আমাদের পূর্বের সেই অভ্যাস আর আমাদের মধ্যে অটল অবস্থায় থাকতে পারবে না, কেননা আমরা সচেতনভাবে আমাদের শরীরকে নতুন কোনও কৌশল অনুসরণ করতে বাধ্য করছি এবং জোরপূর্বক হলেও আমাদের শরীরকে সেটি অনুসরণ করতেই হবে।
এটি অভ্যস্ত হতে সময় নেবে এবং এই অভ্যস্ততা কিছুদিন পর পর পরিবর্তনের মাধ্যমে নিজেদের আরও সচেতন করতে কাজে লাগতে পারি। এটি একপ্রকার ধ্যান। আমরা যখন হাঁটব, এতটা ধীরে হাঁটব যেন আমাদের প্রতিটি চলাচল, গতি, শ্বাসপ্রশ্বাসের ওঠানামা, আমাদের অঙ্গভঙ্গি, আমাদের হাতের ওঠানামা সবকিছুর গতি যেন সর্বোচ্চ শিথিলতা অবলম্বন করে এবং আমরা এই চলাচলগুলিকে সচেতনভাবে লক্ষ করব, এভাবেই আমরা আরও সচেতন হয়ে উঠতে পারি। এভাবে আমরা আমাদের সব কাজে যত বেশি সচেতন হব, তখন প্রয়োজনীয়তার নীতি ধীরে ধীরে আমাদের ভেতর থেকে অদৃশ্য হতে থাকবে এবং এরই সাথে সাথে শক্তির নীতি ধীরে ধীরে কার্যকর হতে থাকবে। শক্তির নীতিতে তখন আমরা না চাইলেও অথবা সেদিকে সচেতন দৃষ্টি না দিলেও সেটি নিজ নিয়মে তার কাজ করেই যাবে। শক্তির অর্থ স্বাধীনতা, একটি পূর্ণ স্বাধীন হৃদয়। আমরা যত সচেতন হব, ততই প্রতিটি মুহূর্তে বাঁচব। আমরা যত সেই শক্তি প্রাপ্ত হব, আমাদের অতীত আমাদের থেকে তত দ্রুত ধুয়ে মুছে যাবে। শক্তির অর্থ, আমরা আর আমাদের অতীত দ্বারা পরিচালিত নই। আমাদের উপর আমাদের অতীতের আর কোনও শক্তি বিরাজ করে না। আমাদের প্রতিটি মুহূর্তের উপর আমাদের স্বনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।
আমাদের প্রতিটি মুহূর্ত হয়ে উঠবে নতুন, সজীব, রঙিন, প্রাণবন্ত তরুণের মতো। আমরা প্রতিটি মুহূর্ত স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকি, কিন্তু আমাদের এই স্বাধীনতা কোনও বাঁধন তৈরি করে না। আমাদের প্রতিটি মুহূর্ত দূষণমুক্ত ও কাচের মতো স্বচ্ছ হয়ে ওঠে, অথচ যখন আমরা শুধুই প্রয়োজনীয়তার নীতিতে বাঁচি, সেটি আমাদেরকে প্রয়োজনের বাঁধনে অবরুদ্ধ করে ফেলে। তখন কর্মের নীতি আমাদের সব কাজে প্রভাব বিস্তার করে। কর্মের নীতিটি হচ্ছে এই, আমরা অতীতে যা-কিছু করে এসেছি, সেই সবকিছু আমাদের ভবিষ্যতে এসে প্রভুত্ব করতে থাকে। আমরা আমাদের অতীতের দ্বারা পরিচালিত হতে থাকি, আমাদের অতীত আমাদের ভবিষ্যতকে নিয়ন্ত্রণ করে। যা-কিছু আমরা অতীতে করে এসেছি, তা-কিছু পর্যায়ক্রমে চক্রাকারে আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতে পুনরায় ঘটে চলছে ও চলবে। আমরা যখন এই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি করি, আমরা আসলে এটিকে আরও সক্রিয় করে তুলি। প্রতিদিন এটি একটু একটু করে শক্তিশালী হতে থাকে এবং প্রতিনিয়ত আমরা যখন কোনও কাজের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে থাকি, তখন এটি আমাদের জীবনের একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে পরিণত হয়ে যায়। তখন আমরা আর এর থেকে বেরিয়ে আসতে পারি না, কেননা ইতোমধ্যেই এটি আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। এভাবেই আমরা একসময় রোবটমানবে পরিণত হই।
সচেতনতার অর্থ জাগরিত হয়ে সজাগ থাকা, অর্থাৎ আমরা যে ঘুমিয়ে আছি, সেই ঘুমন্ত সত্তাটিকে আগে জাগিয়ে তুলতে হবে। প্রকৃতপক্ষে সচেতন মানুষের নির্দিষ্ট চরিত্র বা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বলে কিছু থাকে না। কেননা তার অতীত বলে কিছু থাকে না, যা তাকে কোনও চক্রের মধ্যে আটকে রাখে, এবং অতীতের কোনও ঘটনা বা অভিজ্ঞতা তার উপর প্রভুত্ব করতে পারে না। একজন সচেতন মানুষের কোনও অতীত থাকে না, কেননা সে তার প্রতিটি মুহূর্তই সে সচেতনভাবে কাটায়, যার ফলে সে সর্বদাই বর্তমানে বাঁচে, তার সব কাজে তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের ফলে অযাচিত কোনও কাজ সে করে না সাধারণত, অসচেতনতার বশবর্তী হয়ে সে এমন কোনও কাজে জড়িয়ে পড়ে না, যা ভবিষ্যতে তার উপর প্রভুত্ব খাটাতে পারে। এজন্যেই একজন সচেতন মানুষ সর্বদাই অতীত থেকে মুক্ত, অতীতের বোঝা থেকে মুক্ত এবং পূর্ণাঙ্গভাবে নিরাসক্ত, স্বাধীন ও নিঃস্পৃহ। একজন সচেতন মানুষ নিজেই নিজের প্রতিফলন। সে কোনও কিছুতে প্রতিক্রিয়া ঘটায় না বরং সে কেবলই কাজ করে যায়।
অপরদিকে, একজন অসচেতন মানুষ কেবলই প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে থাকে, কেননা সে তার সব কাজে অজ্ঞ, সে নিজের প্রতিমুহূর্তের কাজ ও সেটির ফলাফল সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে না-ওয়াকিফ বিধায় সে তার কাজের প্রতিফল দেখে নিজেই ঘাবড়ে যায় এবং প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করতে থাকে। কিন্তু একজন সচেতন মানুষ নিজের উপর পূর্ণমাত্রায় নিয়ন্ত্রিত থাকার ফলে তাকে কোনও কাজের ফল ভোগ করতে হয় না, সে কেবলই কাজ করে যায়। আমরা যদি প্রতিনিয়ত আমাদের ভুলগুলি, আমাদের কাজগুলির মধ্যে শুধরে নিয়ে ও নিজেকে যতটা সম্ভব শুদ্ধ করে বাঁচি, তাহলে আমাদের তাড়িয়ে বেড়ানোর মতো কোনও অতীত থাকে না। তখন আমাদের হাতে কাজ করার জন্য কেবল বর্তমানটাই পড়ে থাকে, আর আমরা বর্তমানের কাজে এতটাই নিজেকে ঢেলে দিই, যার ফলে এর ফাঁকে আমাদের কোনও একটা কর্ম, যা আমাদের অতীত হয়ে ভবিষ্যতে আমাদের উপর প্রভুত্ব খাটায়, সেটি তৈরি হবার সময়ই পায় না। সচেতনতার অর্থ, নিজের কাজে পূর্ণমাত্রায় এতটাই সচেতন হওয়া যেন আমরা অসচেতন কিংবা হতজ্ঞান হবার সময়টুকু পর্যন্ত না পাই। যখন আমরা পূর্ণমাত্রায় সচেতন হয়ে বাঁচি, তখন আমরা আমাদের সকল অতীতের ঊর্ধ্বে চলে যাই, ঠিক যেমন করে সাপ তার পুরনো খোলস ছেড়ে যায়।
এরপর আমরা জীবনের প্রকৃত সৌন্দর্য খুঁজে পাই, কেননা তখন আমরা আমাদের পূর্ণ শক্তি নিয়ে চলি। এমন একটি শক্তি, যে শক্তি প্রকৃতপক্ষে আমার নয়, যেখানে নিজের বলে কিছুই থাকে না। এটি প্রকৃতপক্ষে একটি অখণ্ড সমগ্রের শক্তি, যা প্রকৃতি থেকেই আপনাআপনি আমাদের মনে চলে আসে। তখন আমরা মনের শক্তিতে চলি দেহের সমস্ত সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে। এভাবে করে আমরা আমাদের ইগোকে ঝেড়ে ফেলে যে শক্তি পাই, সেটি আমাদের বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। ইগো কেবল অতীতের থেকে আসা একধরনের বিষ। এ এমনই এক বিষ, যা আমাদের বর্তমানে বেঁচে থাকতে বাধার সৃষ্টি করে। মানুষ তার নিজ শক্তির অধিকারে শক্তিশালী নয়, সে কেবল সমগ্র অস্তিত্বের শক্তির একটি বাহন। মানুষ সমগ্র অস্তিত্বের একটি অংশ হয়ে কাজ করে। এখানে মানুষ সর্বোচ্চ মাত্রায় স্বাধীন, যে স্বাধীনতার কোনও দেয়াল নেই, যা অসীম। মানুষের সাথে তার স্থান অথবা সময়ের কোনও সংযোগ নেই। মানুষ স্থান, কালের ঊর্ধ্বে। চরিত্রের ঊর্ধ্বে, ব্যক্তিসত্তার ঊর্ধ্বে, সকল অহমসত্তার ঊর্ধ্বে, এমনি করে সমগ্রের অংশে মিলিয়ে যাওয়াই হলো আলোকিত হওয়া। মানুষ কেবলই এক ক্ষুদ্র সত্তা নয় বরং একটি বৃহৎ শক্তি। সচেতনতার দিকগুলি প্রয়োজনীয়তা এবং শক্তির মাঝে সেতু রচনা করে। সেই সমগ্র শক্তির অভ্যন্তরে প্রবেশ করা, শক্তির আলোক-উৎসারী হয়ে ওঠা মানুষের জন্মগত আধিকার।
আটষট্টি।
বিশ্বজুড়ে যুগ যুগ ধরে আনুগত্যের ভিত্তিতেই ভয়ংকর সব ধর্মযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে, এখনও চলছে। আমাদের আনুগত্য আমাদেরই বিরূদ্ধে যুদ্ধ রচনা করে চলেছে, আমাদেরকেই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনে ছেড়ে দিয়েছে। আনুগত্যের সাথে সেবা করা কোনও উন্নত/উদার মানসিকতার পরিচায়ক নয়। সচেতনতার সাথে সেবা করা যেতে পারে, সচেতনভাবে অনুগত হওয়া যেতে পারে, কিন্তু অচেতনভাবে আনুগত্য কোনও ভালো কাজ নয়। মূলত অসচেনতন আনুগত্যের ফলেই যুগে যুগে ধর্মযুদ্ধের নামে মানবজাতিকে ভয়ংকরভাবে অস্বাভাবিক মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হয়েছে। আনুগত্য যখন অভ্যন্তরীণ হয়, কেবল তখনই এটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে। কিন্তু আমরা সাধারণত বাহ্যিক আনুগত্যের স্বীকার। বাহ্যিক আনুগত্যের ফল নগদ ও দৃশ্যমান, তাই এটাকেই সকলে গ্রহণ করে। বাহ্যিক আনুগত্য ভয়ংকর, কেননা এটি বাইরে ‘হ্যাঁ’ এবং ভেতরে ‘না’-এর জন্ম দেয়। যখন আমরা বাহ্যিক আনুগত্যকে প্রশ্রয় দিই, তখন আসলে আমরা অযাচিত অনেক কিছুকেই ডেকে আনি, কেননা এটি একই সাথে ভালো ও মন্দ দুটিকেই বয়ে আনতে পারে, আমরা জানি না আমরা ঠিক কোনটি ডেকে আনছি।
গণতন্ত্রের নামে নাগাসাকি এবং হিরোশিমায় যে ব্যক্তি বোমা ফেলেছিলেন, তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘কেন আপনি বোমা ফেলেছিলেন?’ তিনি জানালেন, ‘গনতন্ত্রের মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই তিনি বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন।’ অর্থাৎ, এটি ছিল তাঁর কাছে একটি মহৎ কাজ, অথচ যাঁরা ওই দুটি শহরে সেই মুহূর্তে এত বড়ো দুর্ঘটনার স্বীকার হয়েছিলেন, তাঁরা কি জানতেন ঠিক কোন ভুলের কারণে তাঁরা এত বড়ো শাস্তি পেতে যাচ্ছেন! যেখানে একদিন আগেও সবকিছু জীবন্ত ছিল, সেখানে কেবল কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে সর্বত্র ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়েছিল। যে মানুষগুলি, যেসকল বৃদ্ধ, শিশু কিংবা যুবক আক্রান্ত হলো, তারা সকলেই কি নিষ্পাপ ছিল না? যখন আমরা ভাবি, কেবল আমরাই স্রষ্টার নির্বাচিত জাতি, যাদের কাছে সত্যের বাণী প্রেরণ করা হয়েছে, সুতরাং আমাদের জাতিকে আমাদের বাঁচাতে হবে অন্য মানবজাতিকে নিধন করে হলেও, কেননা এটিই আমাদের নিকট মহান স্রষ্টার নির্দেশ, তাহলে আমাদের বিপরীতে যে জাতিগুলি, তাদের স্রষ্টার নির্দেশনার কী হবে? নিশ্চয়ই তাদের স্রষ্টাও তাদেরকে ঠিক একই রকম পথ দেখিয়েছেন এবং এরই প্রেক্ষিতে আমরা একে অপরের বিরূদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হই, তাই তো? এমনি করে আমরা সম্পূর্ণ অচেতনভাবে মানবজাতিকে ধ্বংসে লিপ্ত হই, কেননা আমরা উভয়ই যার যার ধর্মের মর্মে যৌক্তিক অবস্থানে।
অথচ আমরা যদি সচেতনভাবে আমাদের সিদ্ধান্ত বিশ্লেষণ করতাম, তাহলে যুগে যুগে লক্ষকোটি মানুষ এভাবে ভ্রান্ত আনুগত্যের বোধে নিশ্চিহ্ন হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যেত। যখন আমরা সচেতনভাবে বিচারবিবেচনা করে অনুগত হই, সেটি আমাদের ধ্বংসের থেকে দূরে সরিয়ে আনে, অবান্তর চিন্তা থেকে মুক্ত রাখে, কেননা ভ্রান্ত আনুগত্যের যুক্তিতে গণতন্ত্রের আড়ালে আমরা পুঁজিবাদ লুকিয়ে রাখি, সমতার আড়ালে আমরা কমিউনিজমকে লুকিয়ে রাখি। আমরা মুখে যা প্রকাশ করি, আমাদের ভেতরটা ঠিক তার বিপরীত কিছু দিয়েই আবৃত থাকে। যখনই কোনও রাজনীতিবিদ বৃহদার্থে কোনও বাক্য ব্যবহার করে, তখনই বুঝে নিতে হবে এর আড়ালে স্বার্থান্ধ কিছু লুকিয়ে আছে। তখন সেই বাক্যের অনুসরণের চাইতে বরং মৃত্যুও অর্থপূর্ণ। তখন সেই সময় যখন আমাদের বৃহৎ স্বার্থের আড়ালে লুকিয়ে-থাকা এসব ভ্রান্ত আনুগত্যকে ঝেড়ে ফেলে আরও অধিক সচেতন হয়ে উঠতে হবে। আনুগত্য ব্যাপারটি রাজনীতিবিদ এবং ধর্মযাজকের নিজেদের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে কেবল একটি সূক্ষ্ম কৌশলমাত্র। একটি ভালো পৃথিবী গড়ে তোলা তখনই সম্ভব, যখন আমরা সচেতনভাবে সেটি চাইব।
যখন প্রয়োজন পড়বে, যখন আমাদের মন সচেতনভাবে হ্যাঁ-না বিচার করে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবে, কেবল তখনই আমরা আনুগত্যের সাথে হ্যাঁ অথবা না বলতে শিখব। এমনকি যদি মৃত্যুও আসে, এরপরও আমরা সেই হ্যাঁ অথবা না থেকে সরে আসব না। আর এটি কেবল তখনই সম্ভব, যখন আমাদের মন সচেতনভাবে বিচক্ষণ হয়ে থাকে। যখন নাগাসাকি এবং হিরোশিমায় বোমা নিক্ষেপকারীকে পরদিন সকালে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘আপনি কি গতকাল ঘুমুতে পেরেছেন? আপনি কী করে গতকাল ১ লক্ষ মানুষকে পুড়িয়ে রাতে ঘুমুতে গেলেন?’ তখন তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমি গতরাতে বেশ শান্তির ঘুম দিয়েছি, কেননা আমি আমার দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করেছি! জানেনই তো, যখন কেউ তার দায়িত্বে ফাঁকি দেয় না, তখন সে আসলে একটা শান্তির ঘুম কিনে নেয়!’ আনুগত্যের কী ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়া! হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে বোমা বিস্ফোরণের পর আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যনকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘আপনার কেমন অনুভূতি হচ্ছে?’ তিনি উত্তরে জানালেন, ‘এটি একটি চমৎকার অনুভূতি, কেননা ফ্যাসিস্ট ফোর্সের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের জয় হয়েছে!’
সর্বদা আমাদের মনে রাখা উচিত, এসব বড়ো বড়ো অর্থপূর্ণ শব্দমাত্রই ভয়ংকর। এসব বড়ো বড়ো শব্দের অনেক বেশি সম্মোহন শক্তি রয়েছে। এসকল বড়ো বড়ো শব্দগুলি আমাদের মাঝে বৃহৎ অসচেতনতার সৃষ্টি করতে পারে, আমরা এসব শব্দের বশে মানবতার বিরূদ্ধে এমন কিছু করে বসতে পারি, যা আমরা স্বাভাবিকভাবে নিজেদের দিয়ে কল্পনাও করতে পারি না। আমরা মাথায় আনতে পারব না যে এসব বড়ো বড়ো শব্দ আমাদের দিয়ে এমন কাজ করাতে সক্ষম, অথবা আমাদের দ্বারা এমন কোনও কাজ ঘটতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে, এসব আপাতমহৎ কাজের পেছনে এক ধ্বংসাত্মক খেলা লুকিয়ে রয়েছে। প্রত্যেককেই তাদের নিজ নিজ সচেতনতাকে কাজে লাগিয়ে বিচারবিবেচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে দিতে হবে। আনুগত্যের নামে এমন কিছু প্রচার করা অসমীচীন, যা আমাদের পুরো মানবজাতির জন্যেই ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে, কেননা এটিকে আমাদের দায়িত্বের অজুহাতে প্রয়োগ করা সহজ। আমরা সব সময় বলতে পারি, ‘আমি কী করতে পারি? অথবা আমার কি কিছু করার ছিল? আমাকে এটি আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।’ এবং, এরপর যদি আবার তার ঊর্ধ্বতনের কাছে প্রশ্ন করা হয়, তিনিও ঠিক একইভাবে বলে থাকেন, ‘এটি আমার ঊর্ধ্বতনের নির্দেশ!’ এমনকি একজন প্রেসিডেন্টের কাছে এমন প্রশ্ন ছুড়লে তিনিও বলতে পারেন, ‘আমার সেনাপ্রধান আমাকে এমনটিই পরামর্শ দিয়েছিলেন!’ এবং এটি এভাবেই চক্রাকারে ঘুরতে থাকে।
আসলে এর জন্য কেউই দোষী নয়, কেননা দায়িত্ব বোধকরি কেবল অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার জন্যেই তৈরি হয়ে থাকে। কেবল একজন সত্যিকার ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিই দায়গ্রস্ত। কেননা একজন সত্যিকার ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি সর্বদা তার দায়স্বীকার করে থাকেন। একজন প্রকৃত ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি বলে থাকেন, ‘যদি আমি কোনও কিছু করে থাকি, তবে আমিই সে কাজের জন্য দায়ী এবং আমাকে অবশ্যই বারে বারে ভাবতে হবে যে আমি আসলে কী করতে যাচ্ছি, অথবা কাজটি করা কতটা যৌক্তিক। যদি আমার সচেতন মন আমাকে এটি করতে অনুমতি দেয়, তবে আমি সেটি করব, কিন্তু যদি আমার সচেতন মন কাজটি করতে সায় না দেয়, তবে কাজটি না করার ফলে যদি আমার জন্য মৃত্যুও অবধারিত হয়ে থাকে, এরপরও আমি কাজটি করব না, হোক সেটি অনানুগত্য।’ সুতরাং আনুগত্য কোনও মূল্যবান কিছু নয় এবং অনানুগত্যও মূল্যহীন নয়। আমাদের বোধশক্তি মূল্যবান, এটা থাকলে আনুগত্য কিংবা অনানুগত্য উভয়ই ভালো। তবে আফসোসের ব্যাপার, প্রকৃত ধর্মপ্রাণ বা ধার্মিক ব্যক্তি পাওয়া আজকাল খুব কঠিন।
উনসত্তর।
নৈতিকতা কখনও অদৃশ্য হয়ে যায় না, কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি অর্থ লাভ করে। লজ্জা অথবা গৌরব নির্ভর করে একজন তার প্রতিষ্ঠানের প্রতি কতটা পরিপূর্ণতার সাথে, কতটা পর্যাপ্তরূপে কাজ করেছে, তার উপর। নৈতিকতা, দায়িত্ব, আনুগত্য, নিয়মানুবর্তিতা এই ধরনের মূল্যবোধের ক্ষেত্র ও ভাষা হরেকরকম অর্থ প্রদান করে। মাতৃভূমি, পিতৃভুমি, মসজিদ, মন্দির এই ধরনের সকল প্রকার মহৎ অর্থপূর্ণ শব্দ সম্পর্কে আমাদের আরও অধিক সচেতন হতে হবে। আমাদেরকে সেই সব ভাষা, শব্দ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে, যা আমাদের অসচেতন অথবা রোবটমানবে পরিণত করে। যদি আমরা নতুন কোনও মানবতা তৈরি করতে চাই, তবে আমাদেরকে সমগ্র মানবমস্তিষ্ককে পুনর্বিবেচনা করতে হবে। কেননা আমাদের অতীত আমাদের মাঝে খুব সুন্দর একটা খামে, একটি মিষ্টি হাসি এঁকে, একটা পশুত্বের আড়ালে ভীষণ নোংরা মানসিকতা তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমরা যদি এই নোংরা কুরুচিপূর্ণ মানসিকতার আবর্ত থেকে বের হতে চাই, তবে আমাদের সমাজকে ধর্মের প্রকৃত দর্শনের ভিত্তিতে তৈরি করতে হবে এবং সমস্ত দাসত্ব ভেঙে পুরো গোষ্ঠীকে স্বাধীন হতে হবে।
আমাদেরকে সচেতনতার ঊর্ধ্বে সচেতন হতে হবে। যখন আমরা এই সচেতনতাকে আমাদের আত্মার গভীরে প্রতিস্থাপন করতে পারব, কেবল তখনই এটি আমাদের ভালো ফল দেবে। আনুগত্য ভালো, তবে আনুগত্যকে অবশ্যই সচেতন আনুগত্য হতে হবে। আমাদের সচেতনতার ঊর্ধ্বে আনুগত্য অথবা অনানুগত্য উভয়ই খারাপ এবং সচেতনভাবে উভয়ই ভালো। আনুগত্য অথবা অনানুগত্য যে-কোনওটির আবরণে বিবেকবহির্ভূত সকল কাজই আমাদের জন্যে খারাপ। আমাদেরকে সকল সিদ্ধান্ত সচেতনভাবে গ্রহণ করতে হবে এবং ক্ষুদ্র কিংবা বৃহৎ সকল কাজ সচেতনভাবে করে যেতে হবে। আমরা যখন আমাদের সকল কাজের দায়দায়িত্ব আমাদের নিজেদের কাঁধে নেব, তখনই আমরা সচেতনভাবে আমাদের বুদ্ধিমত্তাকে কাজে প্রয়োগ ঘটাতে সক্ষম হব। আমরা সকলেই আমাদের কাজের জন্য দায়ী। এজন্যেই আমাদেরকে আমাদের কাজের পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। আমাদেরকে চিন্তা, ধ্যান এবং কাজ করে যেতে হবে। আমরা যা-কিছু করি না কেন, আমাদেরকে নৈতিকভাবে সদ্গুণ সম্পন্ন হতে হবে। যদি আমরা পূর্ণাঙ্গ নৈতিক হতে পারি, তাহলেই এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি নৈতিকতায় রূপ নেবে।
কোনও বিষয়ে অধিক গুরুত্ব অথবা গাম্ভীর্য একপ্রকার অসুস্থতা, কেননা এটি একপ্রকার অতিআবেগ-প্রবণতা। এটি একপ্রকার ভান এবং কৃত্রিম অভিব্যক্তি। আমরা কেবল আমাদের হৃদয়ের প্রবলতা থেকেই আন্তরিক হয়ে কাজ করতে পারি। শারীরিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক সবকিছুর জন্যই হাসি খুব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আমরা কোথাও যেন আমাদের হাসিগুলিকে আড়াল করে না রাখি। আমরা ভাবি, হাসি বোধহয় আমাদের অন্যের সামনে তুচ্ছ প্রমাণ করবে। এজন্য আমরা নিজেদের হাসি লুকিয়ে গাম্ভীর্যে মুড়ে রাখি, এই কারণে যেন আমাদের আশেপাশের সবাই আমাদের গুরুত্ব দেয়। আমরা অনেকগুলি মুখোশ পরে থাকি, কেননা আমাদের ভুল শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। আমরা ভাবি, যুগে যুগে যাঁরা সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, তাঁরা তো কখনও হাসতেন না! একজন পথপ্রদর্শক কী করে হাসি ঠাট্টায় মেতে থাকতে পারেন! অবশ্যই আমাদের পথপ্রদর্শককে প্রবলভাবে গম্ভীর হতে হবে। সত্যটা হলো এই, যাঁরা আমাদের সত্যের পথ দেখিয়ে গেছেন, তাঁদের কেউই স্বাভাবিক আচরণের ঊর্ধ্বে ছিলেন না, কিন্তু আমাদেরকে কখনও এগুলি জানতে দেওয়া হয়নি, আমাদের ক্রমান্বয়ে ভুল শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।
হাসি আমাদের একটি বিশেষ গুণ। কেননা কেবল মানুষ ছাড়া আর অন্য কোনও প্রাণী হাসতে জানে না। আমরা যদি হঠাৎ কোনও মহিষকে রাস্তায় হাসতে দেখি, তবে আমরা পাগল হয়ে যাব। কেন? কারণ এটি তার স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের বাইরে। এটি মানুষের গৌরব যে মানুষ হাসতে পারে। হাসির মধ্যে আধ্যাত্মিকতা রয়েছে। এটি কেবল বুদ্ধিমত্তার উচ্চতর স্তরেই বিদ্যমান। আমরা যত বুদ্ধিদীপ্ত হব, আমাদের ভেতর ততই হাসির যোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে, আমরা তখন কেবল আমাদের আশেপাশের জিনিসেই নয় বরং আমরা আমাদের নিজেদের নিয়েও হাসতে শিখব। আমরা আমাদের জীবনের অর্থহীনতা, জীবনের হাস্যকর দিকগুলি চিনতে শিখব। জীবনের সকল তুচ্ছ আন্তরিকতার মাঝে এক বিশেষ রঙ রয়েছে। একটি নির্ভার, গুরুত্বহীন, মহৎ, আশীর্বাদপূর্ণ সৌন্দর্য রয়েছে। সুতরা হাসি-তামাশা, ছেলেমানুষিপূর্ণ কাজ, আনন্দ এগুলি নিয়ে অধিক চিন্তিত হবার কিছু নেই, বরং এসবই জীবন। জীবন এতটাই ছেলেমানুষিপূর্ণ।
এ বিষয়ে ইহুদিদের মধ্যে একটি কৌতুক প্রচলিত আছে। ফ্রাংক তাঁর ছেলে ইযরাকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত ছিলেন। কারণ ইযরা নিষিদ্ধ পশুর রান খেত এবং অন্য ইহুদি মেয়ে দেখলেই তাদের সাথে শুতে চলে যেত, যা তার বাবার কাছে সম্পূর্ণ অপছন্দনীয় ছিল। সুতরাং ফ্রাংক এ নিয়ে নালিশ করতে এক ইহুদি আইনজ্ঞের কাছে গেলেন এবং তার কাছে ইযরার বিষয়ে সবকিছু খুলে বললেন। আইনজ্ঞ ইযরাকে ডেকে সব জিজ্ঞেস করায় ইযরা আইনজ্ঞের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলল, ‘আমি পাগল।’ তখন আইনজ্ঞ ইযরাকে বললেন, ‘মূর্খ, তুমি যদি কোনও মেয়েকে কামড়ে দিতে এবং পশুর রানে চুমু খেতে, তবেই তুমি পাগল হতে! এছাড়া তুমি পাগল নও।’ বিষয়টি এমন যে, সেই ছেলের প্রতি তাঁর বক্তব্য ছিল---এটিই আমার নির্দেশনা যে তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ, শুধু এসব কাজ আর কোরো না! অজ্ঞতা, ছেলেমানুষি, কৌতুক, হাসিতামাশা, আনন্দ এই সবকিছুই জীবনের স্বাভাবিক অঙ্গ। এগুলিকে লুকিয়ে রাখার কিছু নেই, বরং আমরা এগুলি নিয়ে হাসিতামাশা করতে পারি। এটি একপ্রকার উৎসব। তাই আমাদের অন্যায় লুকিয়ে রেখে নয়, বরং সেটিকে স্বীকার করে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে হবে। তবে তার আগে এই নিশ্চয়তা জরুরি যে আমি অপরাধ স্বীকার করে নিলে আমি আর শাস্তিপ্রাপ্ত হব না, আমাকে প্রথমবারের মতো শাস্তি থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। হ্যাঁ, এখানে অপরাধের মাত্রা ও অন্যকে ক্ষতির দিকটিও বিবেচনায় আনতে হবে।
সত্তর।
যা-কিছু জন্মলাভ করেছে, সেই সবকিছুকে মৃত্যুর স্বাদ পেতে হবে। যে ফুলটি সকালে অপার সৌন্দর্য আর সুবাস ছড়িয়েছে, তাকেও সন্ধ্যে নামার সাথেই ফুরিয়ে যেতে হয়। এটি প্রকৃতির নিয়ম যে, কোনও কিছুই চিরদিনের জন্যে নয়। সবকিছুই একটা সময় পর্যন্তই দৃশ্যমান হয়, আবার সময়ের আবর্তে অদৃশ্য হয়ে যায়। সবকিছুই সমুদ্রেফেনার মতো। এজন্য আমরা সাঁঝের ফুলকে দোষী করতে পারি না, অথবা তার নিন্দা করতে পারি না এই বলে যে কেন তার পাপড়িগুলি সন্ধ্যে নামতেই ক্ষয়ে আসে! আমরা সূর্যোদয়কে দোষারোপ করতে পারি না, কেন সেটি সন্ধ্যা হলে সূর্যকে গিলে খায়, কেননা একবার সূর্য উদিত হলে তাকে অস্তমিত হতেই হয়, তারপর আর-এক সূর্যোদয়ের সময় হয়ে আসে, এটিই প্রাকৃতিক নিয়ম। যুগে যুগে যে সকল মহৎ মানুষ এসেছিলেন, তাঁরা সকলে যতই আলোকিত, দীপ্তিমান হোন না কেন, তাঁদের সকলকেই প্রকৃতির নিয়মেই ঝরে যেতে হয়েছে। এদের মাঝে কিছু ধূর্ত, স্বার্থান্বেষী মানুষও আসে; তারা একত্রিত হয় এবং সবকিছু নিয়ে ব্যবসা জুড়ে দেয়, এগুলিও প্রকৃতির একটি অংশ। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, এসব আলোকিত মানুষ যাঁরা আলোর সন্ধান পেয়েছিলেন, তাঁরা তাঁদের প্রাপ্ত জ্ঞান বিতরণ করা ছেড়ে দেবেন। এমনকি তাঁরা সকলেই জানতেন, তাঁদের সব বাক্য, তাঁদের দেখানো সেইসব পথ একসময় ধ্বসে পড়বে, তা জানা সত্ত্বেও তাঁরা তাঁদের সমস্ত হৃদয় দিয়ে কাজ করে গিয়েছিলেন, তাঁদের প্রাপ্ত জ্ঞানালোক, ভালোবাসা, তাঁদের সবকিছুকে সর্বস্তরে বিলিয়ে দিয়েছিলেন, এবং যাঁরা গ্রহণের যোগ্য, তাঁরা অচিরেই সেগুলিকে দিয়ে তাঁদের শূন্য হৃদয় পূর্ণ করেছিলেন।
তাঁদের মধ্যে যাঁরা বুদ্ধিমান ছিলেন, তাঁরা এসকল আলোকিত মানুষের শক্তিকে নিজেদের ভেতর শুষে নিয়েছিলেন। তাঁরা কখনও এটা মাথায় আনেননি, এগুলি নিজের ভেতরে শুষে নিলে কী কী বিপর্যয় ঘটতে পারে, কেননা তাঁদের মনে বিপর্যয়ের কোনও আশঙ্কা ছিল না। যদি আমরা তাঁদের পথ অনুসরণ করি, যদি আমরা সকল ধর্মের আশ্রমগুলিকে অনুসরণ করি এবং ভয় পাই যে এটি হয়তো একটি ব্যবসা, আমাদের ভবিষ্যতে কী হবে, তবে আমি বলব, আমাদের আসলে ভবিষ্যতের কোনও ভয় নেই, কেননা আমাদের মাঝে থেকেই সেই সকল আলোকিত মানুষের মতো মানুষ বেরিয়ে আসবেন, যাঁরা যুগে যুগে মানবসমাজকে পথ দেখিয়েছেন, দেখাবেন। সুতরাং যাঁরা আলোর খোঁজ করছেন, তাঁদের সকলকেই জানতে হবে, পৃথিবীর সর্বত্র সেসকল মহৎ মানুষের আলোকশোভা আজও ছড়িয়ে আছে, আজও পৃথিবীর সর্বত্র যিশু, বুদ্ধ, মোহাম্মদ, কৃষ্ণ সকলের আলো ছড়িয়ে আছে, কেননা তাঁরা সকলেই এক আলোয়ই আলোকিত।
আমাদের যাঁদের মাঝে সেই তৃষ্ণা আছে, আমরা চাইলেই তাঁদের খুঁজে পাব। কিন্তু আমাদের মাঝে এমন কিছু মানুষ রয়েছে, যারা প্রকৃতপক্ষে তৃষ্ণার্ত নয়, কিন্তু তারা বাইরে দেখায় যে তারা তৃষ্ণার্ত। সেই সকল লক্ষ লক্ষ মানুষ যারা দেখায়, তারা ধার্মিক, সত্যান্বেষী, তৃষ্ণার্ত, কিন্তু তারা তা নয়, কেননা তারা কিছু ধূর্ত সাধু, যাজক, পীর, পুরোহিতের শিকার, তাদের এসকল যাজকসম্প্রদায় সফলভাবে কাজে লাগাতে পেরেছে, কেননা এরা সেই মানুষ, যারা নিজেরাই অন্ধ থাকতে চায়, যারা স্বেচ্ছায় নিজেদের শোষিত রাখতে চায়। এটি একটি সুপরিকল্পিত আয়োজন, কেননা যাজকসম্প্রদায় জানে যে ধর্মের বাইরে ব্যবসা করা অসম্ভব। যদি তাদের মাঝে কোনও প্রকৃত তৃষ্ণার্ত থেকে থাকত, তবে তারা এসব মানুষ দ্বারা প্রতারিত হতো না। প্রকৃতপক্ষে আমাদের মাঝে লক্ষ লক্ষ মানুষ রয়েছে, যারা প্রকৃত সত্য জানতে অনিচ্ছুক, তারা এখনও প্রকৃত সত্যগ্রহণের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত নয়; সবচেয়ে যেটি কষ্টদায়ক, সেটি হচ্ছে, তারা আসলে জানতেই চায় না, প্রকৃত সত্য কী! এসকল মানুষের জন্যে প্লাস্টিকের ফুল কাম্য। এদের প্লাস্টিকের সত্য প্রয়োজন, কেননা প্লাস্টিকের ফুল কখনও পচে যায় না, প্লাস্টিকের সত্য কখনও হারিয়ে যাবার ভয় নেই, এটি কখনও প্রাণশক্তি হারায় না, কেননা যার মাঝে প্রাণ নেই, তাকে কখনও প্রাণশক্তি হারাতে হয় না, কোথাও-না-কোথাও এটি তেমন অক্ষতই পড়ে থাকে।
এর থেকে আমাদের বেশ কিছু শেখার আছে…সত্যের চাইতে মিথ্যার জীবন দীর্ঘ, কেননা মিথ্যা সময়ের সেই প্রক্রিয়ার সাথে নিজেকে অভিযোজিত করে নিজের কিছু গুণাগুণ তৈরি করে ফেলেছে, সেকারণে সে অনায়াসে যুগযুগ প্রাণহীন অবস্থায় টিকে থাকতে পারে এবং এটি সময়েরই একটি অংশে পরিণত হয়। সত্য সর্বদা সবকিছু অতিক্রম করে আসে, এটি কখনও সময়ের অংশ হতে পারে না, এটি কেবল মরণোত্তরকালের অংশ। সত্যকে সময়ের সাথে চলতে হয় না, বরং এটি আগন্তুক হয়ে সময়ের মাঝে প্রবেশ করে। সময় এটিকে শোষণ করতে পারে না, এটি কেবল একটি মুহূর্ত, যখন আমরা আলোকিত হই এবং কিছুক্ষণ পর আবার সে আলোকসত্তা অদৃশ্য হয়ে মিলিয়ে যায়। এটি কেবল একমুহূর্তের জন্যে হয়ে থাকে, যখন অমরত্ব পৃথিবীকে সময়ের একটি ঝলক দেখায়, সত্যের একঝলক হঠাৎ সামনে তুলে ধরে। এজন্যেই ফুল ঝরে যায়, এমনকি যতই প্রাণবন্ত, যতই উজ্জ্বল, জীবন্ত, সৌন্দর্যমণ্ডিত অথবা সুবাসিত হোক না কেন, এটিকে ঝরে যেতে হয়।