আটত্রিশ।
আমার বিশাল দেহ, যেটা বিশ্ব-প্রকৃতিরূপে পরিচিত, সেটা পাঁচ ভাগে বিভক্ত—মাটি, জল, আগুন/তেজ, বায়ু আর আকাশ। এগুলোর আসলে মৃত্যু নেই, তবে অবস্থাভেদে পরিবর্তন হয়—যেমন সৃষ্টি, স্থিতি আর লয়। আমার এই বিরাট দেহের মাধ্যমেই সূক্ষ্মতম মহাকারণ-দেহ রূপ নেয়।
মাটির অংশে আছে ধারণশক্তি,
জলের অংশে আছে সংগ্রহশক্তি,
তেজে আছে পাক বা রূপান্তরশক্তি,
বায়ুতে আছে ব্যূহ বা বিস্তারশক্তি,
আর আকাশে আছে প্রতিঘাতহীনতা।
এগুলোই ঋতুর মতো পরিবর্তিত হয়। কিন্তু একটি পূর্ণ জীবন্ত রূপ তৈরি করতে হলে স্থূল, সূক্ষ্ম আর কারণ—এই তিনের সমান সমন্বয় প্রয়োজন। এই মিলনেই একটি পূর্ণ জীবন্ত অবয়ব গড়ে ওঠে। আর সেই অবয়ব থেকেই কর্ম, জ্ঞান, ভক্তি আর প্রেমের পূর্ণ বিকাশ ঘটে। স্থূল দেহ ছাড়া কোনো জীবন্ত মূর্তি বা প্রকাশই সম্ভব নয়।
জীবন্ত আধার ছাড়া বোধের জন্ম হয় না। জীবন্ত রূপ ছাড়া জীবন্ত প্রমাণ দেওয়ার উপায়ও নেই। মানুষ সব কিছুতেই জীবন্ত প্রমাণ চায়। তাই “শরীর” বাদ দিয়ে কোনো প্রমাণ সম্ভব নয়। শাস্ত্র, বেদ, বেদান্ত, সাধু-মহাপুরুষ সবাই বলেন—মানুষের আত্মা অমর। কিন্তু মানুষকে বাদ দিয়ে আত্মা অমর—এ কথা কতজন বিশ্বাস করবে? মানুষ কি আত্মার সমষ্টি নয়? তাহলে মানুষ মরে আর আত্মা বেঁচে থাকে—এটা তো সংশয় জাগায়।
আত্মা অমর—এ প্রমাণ করতে সাধনা-ভজনের দরকার নেই। যদি সত্যিই আত্মা অমর হয়, তবে যতদিন পর্যন্ত দেহ মরণশীল, ততদিন সেই অমরতাকে প্রমাণ করা যাবে না। কারণ অমর আত্মা যদি মরণশীল দেহে প্রকাশ পায়, তবে সেই দেহেরও অমরত্ব থাকা উচিত। তাই আসল বিষয় হলো—আত্মার সাহায্যে কিভাবে মৃত্যুশীল মানবদেহকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। আত্মার অমরত্বর প্রমাণ সেই দিনই হবে, যেদিন মানুষ দেখবে আত্মাসহ মৃত্যুশীল দেহ অভিন্ন হয়ে উভয়েই একসাথে বেঁচে আছে।
কারণ মানুষের স্থূল, সূক্ষ্ম আর কারণ দেহের উপাদান—মাটি, জল, আগুন, বাতাস আর আকাশ—সবই অমর। তাহলে এগুলো দিয়ে তৈরি দেহ কেন অমর হবে না? উপাদান অমর, অথচ তার দ্বারা তৈরি দেহ মরণশীল—এটাই খুঁজে বের করার মতো বিষয়।
মানুষ চায়—যা মরে, তারই অমর রূপ দেখতে। যতদিন পর্যন্ত সূক্ষ্ম, কারণ আর মহাকারণ স্থূল দেহের মাধ্যমে প্রকাশ না পাবে, ততদিন অমরত্ব সম্ভব নয়। স্থূল দেহ ছাড়া পূর্ণ বোধসহ পূর্ণ প্রকাশের অন্য কোনো মাধ্যম নেই। তাই একদিন-না-একদিন সূক্ষ্ম, কারণ আর মহাকারণকে এই স্থূল দেহের মাধ্যমেই প্রকাশ পেতে হবে। এটাই আসল “গুরু” কর্ম।
উনচল্লিশ।
শিষ্যরা যখন শ্রীগুরুর কাছে মুক্তি, মোক্ষ, কৈবল্য প্রার্থনা করে, তখন গুরু তাঁদের ইচ্ছানুরূপ কিছু নির্দেশ দেন, এমনকি নিজের আত্মশক্তি দিয়ে তাঁদের অন্ধকার থেকে আলোয় পৌঁছে দেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—এভাবে কি পৃথিবী থেকে অন্ধকার দূর হয়? যদি চারপাশে অন্ধকার রয়ে যায়, তবে একজন শিষ্য আলোর রাজ্যে গেলেও সেই আলো তো একক থাকে, পূর্ণ হয় না।
গুরুর প্রকৃত কর্ম হলো—পৃথিবীর অন্ধকারকে আলোর রূপে পরিণত করা। শুধু একজন শিষ্যকে অন্ধকার থেকে আলোয় পাঠানো গুরুর কাজ নয়। আর শিষ্যের কর্ম হলো—এই মহৎ কর্মে গুরুকে সাহায্য করা।
আসলে আলো নিজে বুঝতেই পারে না যে, অন্ধকার বলে কিছু আছে। তেমনি অন্ধকারও জানে না, আলো কাকে বলে। তাই আলোক-অন্ধকারের সংঘর্ষের প্রশ্নই ওঠে না। কেবল মানুষই বুঝতে পারে, আলো কী আর অন্ধকার কী। তাই অন্ধকারকে আলোয় রূপান্তর করার ক্ষমতাও মানুষের হাতেই নিহিত।
যতদিন আলো আর অন্ধকার আলাদা থাকবে, ততদিন গুরুর কর্ম শেষ হবে না। আর যেহেতু স্থূল দেহ ছাড়া বোধের উন্মেষ সম্ভব নয়, তাই মানবদেহই একমাত্র মাধ্যম। সূক্ষ্ম, কারণ কিংবা মহাকারণকে উপলব্ধি করতে হলেও মানবদেহের প্রয়োজন। সাধন, ভজন, তপস্যা, যোগ—সবই দেহের মাধ্যমেই সম্ভব। এই দেহকে মন্থন করেই ৮৪ লক্ষ যোনির বোধ ও উপলব্ধি লাভ করা যায়।
অতএব, স্থূল দেহই হলো কর্মের ভিত্তি; এবং সব কর্মের ফল, উপলব্ধি ও ভোগও এই মানবদেহেই সম্পূর্ণ হয়। মানুষের দেহকেই কেন্দ্র করে বোধের শুরু এবং বোধের শেষ সাধিত হয়।
চল্লিশ।
ঈশ্বর, ভগবান, আত্মা, পরমাত্মা—এসবের উপলব্ধি, পূর্ণ আর অপূর্ণের উপলব্ধি, “আমি কে” বা “জগৎ কী”—এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর কেবল মানবদেহকে কেন্দ্র করেই জাগে। সাকার হোক বা নিরাকার—সবকিছুরই অবলম্বন হলো এই দেহ। এই দেহ ছাড়া তাদের অস্তিত্বকে বোঝার কোনো উপায় নেই।
আমি স্বভাব-বোধ—আমাকে পেতে সাধন-ভজনের প্রয়োজন নেই। আমি মনের মাধ্যমে প্রকাশিত হলেও, আমি মনের বাধ্য নই। আমি স্বভাবত স্বাধীন। মন আমাকে আশ্রয় করেই ভালো-মন্দ, সৎ-অসৎ নিয়ে খেলা করে; শেষে আবার আমাতেই বিশ্রাম নেয়। আমি সবসময় একই রকম—আমার কোনো অভাব নেই, তাই আমার কোনো পরিবর্তন নেই। ব্যতিক্রম ঘটে শুধু তাদের মধ্যেই, যারা আমাকে বাদ দিয়ে আলাদাভাবে থাকতে চায়।
আমার অভাবই আসলে সব অভাবের মূল। আমি স্থূল দেহেই পূর্ণভাবে প্রকাশিত। আমাকে পেতে হলে কর্ম পূর্ণ করতে হবে। জীবন্ত মানবদেহের মাধ্যম ছাড়া আমাকে সত্যিকারভাবে জানা যায় না। সূক্ষ্ম বা কারণদেহ দিয়ে আমার পূর্ণ উপলব্ধি সম্ভব নয়—এটাই আমার বিশেষত্ব। তাই আমাকে সবাই চিনতে পারে না। আমি জ্ঞান, ভক্তি, প্রেমের দ্বারা আবদ্ধ নই। আমি স্বভাবতই সকলকে ভালোবাসি—কোনো শর্ত ছাড়াই।
আমার কাছে পাপ-পুণ্যের প্রশ্ন নেই, সাধু-অসাধুর পার্থক্য নেই, ভক্ত-অভক্তের ভেদ নেই। কারণ, এসব ভেদের পেছনে কোনো-না-কোনো হেতু থাকে, আর হেতু থাকলেই বোঝা যায়, অভাব আছে। কিন্তু আমি অভাবহীন, তাই হেতুরও ঊর্ধ্বে।
মানুষ যেমন ঈশ্বর বা ভগবানকে প্রয়োজন মনে করে, তেমনি ঈশ্বর-ভগবানেরও মানুষকে প্রয়োজন হয়। উভয়েই পরস্পরের পরিপূরক। ঈশ্বর-ভগবান মানুষের বোধ ছাড়া প্রকাশ পেতে পারে না। মানুষের বোধই হলো প্রকাশের একমাত্র পথ।
কিন্তু মানুষ মনের দ্বারা বিভ্রান্ত। তাই আমার উপস্থিতি সর্বত্র থাকা সত্ত্বেও সে আমাকে চিনতে পারে না। আসলে মনও আমাকেই চায়, কিন্তু সে জানে না যে, তার চাওয়া আমি-ই। মন চায় পূর্ণ ও স্থায়ী শান্তি, চায় আনন্দ—আর সেই স্থায়ী আনন্দ আমি ছাড়া আর কেউ নই।
এতকাল মানুষ মরদেহে অমর হওয়ার জন্য কঠোর সাধনা করেছে, ভগবান-ঈশ্বর-আত্মা-ব্রহ্মের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু তারা কেউ সেই অমরতা দিতে পারেনি, কারণ অমরতা দেবার অধিকার তাদের নেই। অমরতা একমাত্র আমার স্বভাবেই বিদ্যমান।