অরূপের আরতি: ৫




বিশ।

যদি প্রচলিত ধর্ম-সংস্কারগুলি সত্য ও নিত্যধর্ম হতো, তবে মানুষ ইচ্ছানুযায়ী হিন্দু থেকে মুসলমান, মুসলমান থেকে খ্রিস্টান প্রভৃতি রূপে ধর্মান্তরিত হতে পারত না।

ধর্ম মানে যা ধারণ করে, যা নিজে থেকেই মানুষকে ধারণ করে। মানুষ তাকে ধরুক বা না ধরুক, ধর্ম থেকেই মানুষের সৃষ্টি। আর এই অলঙ্ঘনীয় ধর্ম হলো জীবন। জীবনই মহাশক্তিধর নিত্যধর্ম। জীবন থাকলেই মানুষ মানুষ। যতক্ষণ জীবন মানুষকে ধারণ করে আছে, ততক্ষণই সে রাজা বা বাদশাহ সাজছে, হিন্দু বা মুসলমান হচ্ছে, জ্ঞানী বা মূর্খ হচ্ছে, ইংরেজ বা রাশিয়ান হচ্ছে। কিন্তু যে-মুহূর্তে জীবন তাকে ত্যাগ করে, সেই মুহূর্তে তার সব পরিচয়—হিন্দুত্ব, মুসলমানত্ব, ফরাসিত্ব, জার্মানত্ব—সব লুপ্ত হয়ে যায়। সে তখন শব। শবের আর কোনো বিকার নেই, কোনো জাতিও নেই। তখন সে শব বা শিব রূপে পরমহংসের ধরন ধারণ করে।

এই জীবনধর্মেই নিহিত আছে মানুষের সমতা ও একতা—সমগ্র জীবজগতের সঙ্গে। ব্যাঘ্রের স্বভাব, মূষিকের স্বভাব, পক্ষীর স্বভাব, বৃক্ষের স্বভাব, মানুষের স্বভাব—প্রত্যেক জীবের ধর্ম বা স্বভাব কেবল ততক্ষণই প্রকাশমান, যতক্ষণ জীবন আছে। জীবন ব্যতিরেকে সবাই শব, আর এক জাতির শবের সঙ্গে অন্য জাতির শবের কোনো ভিন্নতা নেই।

মানবজীবনে যেমন জীবন এক, শবেও জীবন এক—আদিতে এক, অন্তেও এক। অথচ এত বড়ো প্রত্যক্ষ মহাসত্যের প্রতিও মানুষ সংস্কারের আচ্ছাদনে উদাসীন হয়ে আছে। এই নিত্যসত্য ধর্মকে ভুলে গিয়েই মানুষ খণ্ড খণ্ড ধর্ম-সংস্কার নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিরোধ ও হানাহানিতে লিপ্ত।

তবু নিঃসংশয় ও অমোঘ যে—এই স্বভাবধর্মের প্রতিষ্ঠার সময় আসন্ন। যে-মুহূর্তে স্বভাবজাত জাতীয়তাবোধ প্রতিষ্ঠিত হবে, সেই মুহূর্তেই স্বভাবধর্মও প্রতিষ্ঠিত হবে।

প্রশ্ন জাগে: এ তো সবসময়ই ছিল, আছে এবং থাকবে, তবে আবার প্রতিষ্ঠার কথা কেন?
উত্তর হলো—এটি চিরন্তনভাবে বিদ্যমান হলেও মানুষের বোধে এর জাগরণই আসল প্রতিষ্ঠা। আজ হোক বা কাল, মানুষকে এই সত্য মানতেই হবে।

মানবতাই মানুষের একমাত্র জাতীয়তা, আর জীবনই মানুষের একমাত্র ধর্ম। এটাই মানুষের স্বভাবজাত জাতীয়তা এবং স্বভাবধর্ম।

মানুষ তার এই স্বাভাবিক জাতীয়তা থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে কেবল এজন্য যে—সে প্রথম থেকেই স্বভাবের পথ না ধরে মনের ও সংস্কারের পথে পা বাড়িয়েছে। সংস্কারাবদ্ধ মনের রুচি অনুযায়ী চলতে গিয়ে সর্বত্র ও সর্বদা ভুল করেছে। তাই আজ প্রয়োজন শিশুসুলভ সরলতা নিয়ে স্বভাবের আশ্রয়ে ফিরে যাওয়া এবং স্বভাবকর্মে নিযুক্ত হওয়া। কেবল স্বভাবকর্মের মাধ্যমেই সম্ভব দেহ, মন, প্রাণ ও বোধের স্থায়ী ও পূর্ণ গঠন।

কিন্তু এই স্বভাবধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে মানবসমাজ এতদিন পথভ্রষ্ট হয়ে চলেছে। তাই শিক্ষা, জাতীয়তা, অনুশাসন, ধর্ম কিংবা কর্ম—কোনো ক্ষেত্রেই মানব সঠিক গঠন বা স্থায়ী কল্যাণ লাভ করতে পারেনি।

একুশ।

সত্য ও স্বভাব

যা সত্য, তা সবসময় নিজের মতো করেই প্রকাশিত হয়। ওটা প্রকাশের জন্য কারও সাহায্যের দরকার পড়ে না। এই যুগে মানুষের প্রকৃতি আর কাজকর্ম দেখে মনে হয়—বড়ো রকম ধ্বংস ছাড়া সমাজের সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। মানুষের বানানো ভ্রান্ত শিক্ষা আর শাসন-পদ্ধতির এটাই যেন শেষ সময়।
জন্ম, মৃত্যু আর স্বভাব মানুষ প্রকৃতির হাতে একেবারে বাধ্য। জন্মের সময় সে মানুষের বানানো জ্ঞান-বুদ্ধির পথে চলে না, চলে স্বভাবের টানে। মৃত্যুও ঘটে সেই স্বভাবের নিয়মে, যা মানুষের জ্ঞানের বাইরে। মানুষ কোনো শক্তি দিয়েই মৃত্যু ঠেকাতে পারে না।

জন্ম আর মৃত্যুর মাঝের সময়টুকুতে মানুষ নিজের ইচ্ছে মতো চলতে গিয়ে স্বাভাবিক ধারা হারিয়ে ফেলে। অথচ জন্ম, সৃষ্টি আর মৃত্যু—সবই যেখানে স্বভাবের ভেতর নিহিত, সেখানে অপূর্ণ মানুষের অপূর্ণ জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে কীভাবে পূর্ণ পথ তৈরি করা সম্ভব? স্বভাবের পথেই সব মত আর পথের সমন্বয় আছে, অন্য কোথাও নয়।

মানুষ আর শিক্ষার সীমাবদ্ধতা

মানুষ আজও শিক্ষার আসল ভিত্তি খুঁজে পায়নি। বর্ণমালা কোথা থেকে এসেছে, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য কী—এসব প্রশ্নের উত্তর বিদ্যা দিতে পারে না। যে-বিদ্যা মানুষকে নিজের উপর আস্থা দিতে পারে না, সেই বিদ্যারই-বা মূল্য কী? ফলে মানুষ নৈতিকতা হারিয়ে উচ্ছৃঙ্খল, দায়িত্বজ্ঞানহীন, স্বার্থপর আর অবিশ্বাসী হয়ে পড়েছে। এখন মানুষের কাছে জীবনের আসল লক্ষ্য অর্থ-উপার্জন—কারণ সমাজে মূল্যায়নের একমাত্র মানদণ্ডই হচ্ছে টাকা। তবে এটাও মনে রাখা দরকার—যেখানে ভ্রান্তি আছে, সেখানেই ভ্রান্তি সংশোধনের সুযোগও আছে।

প্রচলিত বিদ্যার ব্যর্থতা

ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্য আর দর্শনের মতো বিষয় নিয়ে অনেক পণ্ডিত অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে জ্ঞান দেওয়া আর মানবকল্যাণ সাধন। কিন্তু আসলেই কি স্থায়ী কল্যাণ হয়েছে? মানুষ কি সত্যিকারের জ্ঞানের আলোতে আলোকিত হয়েছে? যদি হতো, তবে অজ্ঞতার অন্ধকার আজ এত ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়ত না। তাই মনে হয়, তাদের অনেক শ্রমই শেষ পর্যন্ত পণ্ডশ্রমে পরিণত হয়েছে।

কিছু মৌলিক প্রশ্ন

তাহলে প্রশ্ন আসে—সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান বা দর্শন রচনা করার অধিকার কার? কে এগুলো পড়বে, আর কেন পড়বে? যখন আমরা নিজেরাই জানি না মানবকল্যাণের জন্য এসব আসলেই কতটা জরুরি, তখন এসব রচনায় সমাজের প্রকৃত কল্যাণ কীভাবে সম্ভব?

উপসংহার

মানুষ আসলে মনুষ্যত্বের উপাসক। সেই মনুষ্যত্বকে পেতে হলে কর্ম, সাধনা আর যোগ-তপস্যার মধ্য দিয়েই এগোতে হবে। ব্যক্তিগত দেহ আর সমাজ—দুটোরই স্বাভাবিক চাহিদা এই মনুষ্যত্বের বিকাশ। তাই আসল কল্যাণ নিহিত আছে স্বভাবের ভেতরেই, মানুষের বানানো খণ্ডিত জ্ঞান আর বুদ্ধির মধ্যে নয়।

বাইশ।

মানুষ ও অনুশাসন

মানুষকে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, জৈন বা জাতিগতভাবে বাঙালি, মাদ্রাজি ইত্যাদি সীমাবদ্ধ করে দেখতে হলে বিশেষ কিছু করতে হয় না—শুধু অনুকরণই যথেষ্ট। কিন্তু মানুষকে সত্যিকার অর্থে পূর্ণ মানুষ করে তুলতে হলে খুঁজতে হবে তার ভেতরে থাকা স্বাভাবিক পথ। অস্বাভাবিক পথে মানুষ খণ্ডিত পরিচয় নিয়েই দাঁড়ায়—হিন্দু, মুসলমান, বাঙালি বা অন্য কোনো গোষ্ঠীর সীমায় আবদ্ধ হয়ে।

মানুষের পরিচয়

মানুষ বললে স্বাভাবিকভাবে পুরো মানবজাতিকেই বোঝায়। কিন্তু হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান বা ইংরেজ, বাঙালি, মাদ্রাজি বললে মানবজাতিকে বোঝায় না—শুধু একটি খণ্ডচিত্রকেই বোঝায়। যদি এতদিন মানুষ বিশ্বাস করত যে, এসব পরিচয়ও আসলে মানবজাতিকেই নির্দেশ করে, তবে তারা নিশ্চয় প্রচলিত ধর্মের ভেতরেই জীবন্ত সমন্বয় আর স্বাভাবিক সমাধান খুঁজে পেত। কিন্তু জ্ঞানের কোনো শুরু নেই, তার শেষও নেই—এই সত্য উপলব্ধি তারা হারিয়ে ফেলেছে।

মানুষের পতন

দুঃখের বিষয়, মানুষের নিজের ভেতরেই সব সমস্যার স্বাভাবিক সমাধান লুকিয়ে থাকলেও মানুষ তা খুঁজে পাচ্ছে না। আজ মানুষ নিজের কাছেই ভিখারি—চরিত্র নেই, আত্মবিশ্বাস নেই, সততা নেই, নেই মনুষ্যত্বের সঠিক ঠিকানা, নেই সত্যের প্রতি দৃঢ় সংকল্প। বরং যে অর্থ আর সম্পদ মানুষ নিজেই সৃষ্টি করেছে, তার কাছেই আজ সে বিক্রি হয়ে গেছে—স্বেচ্ছায় লিখে দিয়েছে চিরদিনের দাসত্বের অঙ্গীকার।

অর্থ ও জড়তার দাসত্ব

যে অর্থ আর সম্পদ একসময় সমাজকল্যাণে ব্যবহৃত হতো, আজ সেই সম্পদই মানুষকে তার নিজের ক্রীতদাস বানিয়ে রেখেছে। অর্থলোভী মানুষ, জ্ঞান আর বিবেকহীন জড় দেহের মতো আচরণ করছে। বিদ্যা মানুষকে মুক্ত করার বদলে মোহিত করে নরকের কীটে নামিয়ে এনেছে—এ যন্ত্রণা কেবল ভুক্তভোগীরাই বুঝতে পারে।

যুগ-সন্ধিক্ষণ

আজকের যুগে জড়ের মহিমা বেশি। আগের যুগে মানুষ করেছিল চেতনার সাধনা, আর এখন করছে জড়ের সাধনা। এ যুগই জড়-সাধনার চরম সময়। তবে এটিই একই সঙ্গে চেতন ও জড়—দুই সাধনার সন্ধিক্ষণ। কারণ, যে জায়গায় চরমে পৌঁছানো যায়, সেখানেই পরমের ইঙ্গিত মেলে।

তেইশ।

ভবিষ্যতের চিত্র

মানবজাতির অদূর ভবিষ্যৎ যেন দুই ধারের তলোয়ার। একদিকে মানুষ এগোচ্ছে পূর্ণ ধ্বংসের দিকে, অন্যদিকে শুরু হয়েছে নতুন সৃষ্টির প্রস্তুতি। তাই এ সময়টাকেই বলা যায় যুগ-সন্ধিক্ষণ। আগামী বিশ বছর ধরে মানুষের জীবনে চলবে ধ্বংসের ভয়াবহ খেলা।

অমানবিক আচরণ

মানুষ অমানুষের মতো আচরণ করবে, মানুষ মানুষকে গ্রাস করবে। মানুষই হবে মানুষের সবচেয়ে বড়ো শত্রু। নির্মমতা, নৃশংসতা আর অমানবিকতায় ভরে উঠবে জীবন ও সমাজ। এতে কারও মনে অনুশোচনা বা বেদনা জাগবে না। প্রায় বারোআনা মানুষ লিপ্ত থাকবে উচ্ছৃঙ্খলতায়, ব্যাভিচারে, অসত্যতায় আর বিশৃঙ্খলায়। এটাই হবে ধ্বংসযজ্ঞের চরম সময়।

সমাজের পতন

ছোটো-বড়ো, জাত-ধর্ম, মান-ইজ্জত সব ভেদাভেদ মুছে যাবে। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে মানুষ উন্মাদের মতো আচরণ করবে। সমাজে থাকবে না কোনো শৃঙ্খলা, রাষ্ট্রের কোনো অস্তিত্বও থাকবে না। যানবাহন, স্থলপথ, জলপথ, আকাশপথ মুহূর্তেই বন্ধ হয়ে যাবে। শুধু একটি দেশ নয়, বিশ্বজুড়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহ ধ্বংসের সীমায় পৌঁছাবে। মানুষ নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান, নিয়ম, প্রকল্প সব কিছু ভেঙেচুরে ফেলতে উদ্যত হবে।

দায়িত্বহীন নেতৃত্ব

এ সময়ের একদল মানুষ হবে নির্বাক দর্শক, আরেকদল খুঁজবে কারণ, কিন্তু যাদের হাতে সমাজ পরিচালনার দায়িত্ব, তারা জড়িয়ে পড়বে আত্মকলহে। নিজের স্বার্থই হবে সব দ্বন্দ্বের মূল। ফলে সমাজের সব স্তর ভেসে যাবে উচ্ছৃঙ্খলতার স্রোতে।

অভিনব ইতিহাসের সূচনা

আজ হয়তো মানুষ কল্পনাও করতে পারছে না। কিন্তু শিগ্‌গিরই যখন এই দৃশ্য সামনে আসবে, তখন বোঝা যাবে, মানবইতিহাস এক নতুন রূপ নিতে চলেছে। এই কলিযুগে যেমন অসত্য, উচ্ছৃঙ্খলতা, বর্বরতা আর অমানবিকতা চরম রূপ নেবে, তেমনই অন্যদিকে আসবে সত্যিকারের স্থায়ী গঠনের ইঙ্গিত ও জাগরণের আভাস। তাই এ যুগকে বলা যায় অভিনব যুগ—এমন যুগ পৃথিবীতে আর কখনও আসেনি।

ধ্বংসযজ্ঞের রূপ

মানুষ দেখবে যা তার দেখার নয়, শুনবে যা তার শোনার নয়, করবে যা তার করার কথা নয়। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে মানুষ ভুলে যাবে জাতীয়তা, ঐক্য আর ঐতিহ্য। মুছে যাবে পূর্বপুরুষদের গৌরবগাথা, ভেঙে পড়বে মন্দির, ধর্মাশ্রয়, দেবালয়—সবই ধূলিসাৎ হবে। বিশ্বজুড়ে চলবে অশান্তির কলরোল, মানুষের হৃদয় থেকে হারাবে দয়া, মায়া, প্রেম, ভক্তি আর জ্ঞান।

প্রকৃতির ভয়াল আঘাত

এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে এই ধ্বংসনাটক। দায়িত্বহীনতা, কর্তব্যবোধহীনতা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হবে প্রকৃতির ভয়াবহ আঘাত—অতিবৃষ্টি আর প্লাবনে দেশ ডুবে যাবে, আগ্নেয় শিলা গলতে গলতে নদীর মতো বইবে, নানা মহামারী, বিষাক্ত বায়ু, অগ্নিকাণ্ড, ঝড়-ঝঞ্ঝা মানুষকে দিশাহারা করে দেবে। একের পর এক প্রাণহানি ঘটবে কালের করাল গ্রাসে।

উপসংহার

এই ভবিষ্যতের ছবি কল্পনা করলেই শরীর শিহরিত হয়, হৃদয় কেঁপে ওঠে। সত্যিই মানব-ভবিষ্যৎ যেন ভয়াবহ ধ্বংস আর নতুন জাগরণের এক অদ্ভুত মিশ্রণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।