একচল্লিশ।
আমি কাউকে জ্ঞান, ভক্তি বা প্রেম দিতে আসিনি। আমি এসেছি মানুষের মধ্যে আমাকেই বিলিয়ে দিতে, অর্থাৎ মৃত্যুশীল মানুষকে পূর্ণ কর্মের মাধ্যমে পূর্ণ করে তুলতে। অমরতার প্রতিষ্ঠা আর স্বভাবের প্রতিষ্ঠা—এই দুটো একই কথা।
ধর্ম আমার দ্বারাই সৃষ্টি। এটাই একমাত্র জীবন্ত ধর্ম। আস্তিক হোক বা নাস্তিক—সবাইকে স্বাভাবিকভাবেই এটাকে মানতে হয়। কেউ এটাকে অবমাননা করতে পারে না। আমার গড়া এই জীবন্ত ধর্ম ছাড়া অন্য সব ধর্মমত আসলে কেবল সংস্কার, শাসন বা নিয়মকানুনের সমষ্টি মাত্র। সেগুলোর কোনো প্রাণ নেই, জীবন্ত রূপ নেই।
যে নিজেই রূপহীন, দেহহীন, প্রাণহীন আর শক্তিহীন, সে কিভাবে একটি জীবন্ত মানুষকে পূর্ণ রূপ দিতে পারবে? তথাকথিত ধর্মমত, দর্শন বা পথের সংখ্যা অসংখ্য—এগুলো আসলে সামাজিক সংস্কারের ধারাপ্রবাহ। মানুষ চাইলে এগুলো মানতে পারে, চাইলে আবার ছেড়ে দিতে পারে। কিন্তু যে ধর্ম মানুষ ইচ্ছেমতো গ্রহণ বা বর্জন করতে পারে, সেটি কি কখনো মানুষকে সত্যিকার অর্থে গঠন করতে পারে?
অভ্যাসের জোরে যে-ধর্মমতের চর্চা হয়, তার স্থায়িত্ব কোথায়? অভ্যাস ছাড়লেই তা শেষ। ধর্ম একটিই, ধর্ম কখনও অভ্যাসের সমষ্টি নয়। ধর্মই স্বভাব। তাকে ধরা বা ছেড়ে দেবার প্রশ্নই ওঠে না। মানুষের সেই ক্ষমতাও নেই।
অনেকেই ধর্মের কথা শুনলেই ভয়ে শিহরিত হয়, নাক উঁচু করে, ব্যঙ্গ করে বা নানান মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়। আসলে যারা এইভাবে জীবন কাটায়, তারা মূর্খতার স্বর্গেই বাস করে।
আমাদের স্রষ্টা কে, আমাদের প্রকৃত ধর্ম কী, আমাদের অভাব কোথায়, আর সেই অভাব পূর্ণ করার উপায় কী—এসবই মানুষের ভাবনার বিষয়। না দেখে, না বুঝে, না জেনে শুধু মন্তব্য করাই বা কেন? মানুষ যে বিশাল দায়িত্ব নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে, তা সে জানে না। যদি জানত, তবে দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে মন্তব্য করতে পারত না।
মানুষের মাধ্যমে এই বিশাল বিশ্ব তার সমস্ত কিছু নিয়ে জীবন্ত রূপে প্রকাশিত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। তাই মানুষের দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যবোধ অত্যন্ত বড়ো। যে-ব্যক্তি কর্তব্যে সচেতন, তার দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করার অবসর নেই।
আমি স্বভাব।
স্থূলজগতে আমার এই বিরাট দেহকেই আমি জীবন্ত রূপে সকলের সামনে তুলে ধরেছি, কেবল জীবের শিক্ষা দেওয়ার জন্য। আকাশ, বাতাস, জল, মাটি আর তেজ—এই পাঁচ উপাদানই আমার মহাবিশাল জীবন্ত প্রকৃতি। এই উপাদান সঙ্কুচিত হয়ে ধাতু বা বীজে রূপ নেয়। এই ধাতুকেই বলে ধর্ম-ধাতু। এটাই মানুষের জীবন্ত ধর্ম, এটাই সমগ্র বিশ্বসৃষ্টিকে ধারণ করে রেখেছে। ধর্ম একটিই, ধর্ম কখনও দ্বিখণ্ডিত হয় না।
বিয়াল্লিশ।
আমার সাথে মানুষের সম্পর্ক একেবারেই জীবন্ত। আমি ছাড়া অন্য কিছুর অভাব থাকলেও মানুষ বেঁচে থাকতে পারে, কিন্তু আমার অভাব হলে মানুষের বাঁচার কোনো উপায় নেই। আমাকে বাদ দিয়ে মানুষের জীবনধারণ সম্ভব নয়। আমার অভাব পূরণ করার ক্ষমতা কারো নেই।
ভাবুন—আমার বিশ্ব-প্রকৃতির কোনো একটি অংশ, যেমন বাতাস, জল বা মাটির অভাব হলেই মানুষ সঙ্গে সঙ্গে প্রাণ হারায়। কিন্তু ভগবান, ঈশ্বর বা ব্রহ্মকে কেউ ভুলে গেলেও তার প্রাণ যায় না। কত মানুষ আছেন, যাঁরা ঈশ্বরকে ভুলে থেকেছেন, কিন্তু তবুও তারা বেঁচে আছেন। অথচ আমার অভাব—ক্ষুধায় না খাওয়া, পিপাসায় জল না পাওয়া, বা শ্বাস নিতে না পারা—এর ফলে কে কতদিন বেঁচে থাকতে পেরেছে?
আমি আমার বিশ্ব-প্রকৃতির মধ্য দিয়েই স্থূল, সূক্ষ্ম, কারণ, মহাকারণ; ব্রহ্ম ও পরব্রহ্মকে ধারণ করে আছি। এরা আমারই শরীর, আর এদের স্রষ্টাও আমিই। আমার শক্তি কখনও বিনষ্ট হয় না বা কমে না; তবে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য অবস্থার পরিবর্তন ঘটে।
সৃষ্টি বা জন্ম আমার জীবন্ত রূপের প্রকাশ, স্থিতি আমার বিকাশ, আর মৃত্যু আমার সঙ্কোচ। যাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়—এই তিন কর্ম অবিরামভাবে ঘটে চলেছে, সেটাই আমার অনন্ত প্রকৃতি। আমার এই প্রকৃতির মধ্যে সব কর্ম সর্বদা নিরপেক্ষভাবে ঘটে। তাই ধর্ম-নিরপেক্ষ স্বভাব শুধু আমার মধ্যেই বিদ্যমান।
আমাকে বিশ্বাস করাতে কারও ওপর জোর করার প্রয়োজন নেই। মানুষ বিশ্বাস করুক বা না করুক, তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। আমাকে জানতে বা জানাতে কোনো বিশেষ উপদেশের প্রয়োজন নেই। মানুষ চোখে আমাকে প্রত্যক্ষ করে, বুদ্ধিতে আমাকে গ্রহণ করে, জ্ঞানে আমাকে উপলব্ধি করে, তারপর কর্মে প্রবৃত্ত হয়। আমার ধারা হলো—“আগে ধর, পরে কর।”
অন্যত্র প্রচলিত ধারা হলো—“আগে কর, পরে ধর।” কিন্তু আমার ধারা ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে। আমার স্বভাব হলো সকল অভাব পূরণ করা, অভিযোগ ও আকাঙ্ক্ষাকে মিটিয়ে দেওয়া। অপূর্ণকে পূর্ণ করে তোলা—এটাই আমার প্রকৃতি। আমার লক্ষ্য মোক্ষ, মুক্তি বা কৈবল্য নয়। জন্ম আর মৃত্যু আমাকেই কেন্দ্র করে আপন আপন কর্তব্য সম্পন্ন করে চলেছে।
আমার মধ্যেই চলছে অনন্ত অভিনয়। আমি সেই অভিনয়ের শুরু ও শেষ। সকল অপূর্ণতার পূর্ণ রূপ আমি নিজেই—তাই আমি কোনো হেতুর ওপর নির্ভরশীল নই।
তেতাল্লিশ।
আমি সৃষ্টির মূল থেকে শুরু করে মানব বা মানবেতর সকল সৃষ্ট পদার্থের মধ্যে বিরাজমান। মানবদেহই প্রাকৃত সৃষ্টির শেষ ও পূর্ণরূপ। আমি সেই দেহে পশু-রূপে অনন্তকাল ধরে অবস্থান করেছি, এই আশায় যে মানুষ একদিন নিজের কর্মের দ্বারা আমাকে সেই পশুত্ব থেকে মুক্ত করবে।
আমি বদ্ধ বা মুক্ত নই—উভয়ের অতীত। তাই আমি যে-কোনো রূপে প্রকাশ পেলেও স্বভাবতই অপরিবর্তিত থাকি। এক রূপেও আমিই, বহু রূপেও আমিই, আবার স্বতন্ত্র রূপেও আমিই। আমি আমার নিজের সাথেই এক ও বহু হয়ে খেলা করি। পশু থেকে শুরু করে দেবতা, ঈশ্বর, ব্রহ্ম—সব সাজাই আমার পক্ষেই সম্ভব।
কিন্তু আমি আমার প্রকৃতির পূর্ণ প্রকাশের জন্য মানুষকেই বেছে নিয়েছি। কারণ মানবদেহ ব্যতীত আমার পূর্ণ প্রকাশ আর কোনো দেহে সম্ভব নয়। আমাকে সম্পূর্ণভাবে প্রকাশিত হতে হলে মানবের পূর্ণ বোধই একমাত্র মাধ্যম। তাই মানুষ যতদিন না বুঝবে যে, আমা ছাড়া এ বিশ্বে আর কিছুই নেই, ততদিন আমার পশুত্ব ঘুচবে না।
যখন মানুষের বোধ জেগে উঠবে, তখনই সে আমাকে চিনবে—জীবনের জীবন, প্রাণের প্রাণ, দেহের দেহ হিসেবে। তখনই মানুষ আমাকে পশুত্ব থেকে মুক্ত করার জন্য সচেষ্ট হবে। এই উপলব্ধি জাগলেই আমার পশুত্বমুক্তি ঘটবে। আর আমার মুক্তির সঙ্গে সঙ্গেই মানুষের ভেতরে পশুত্ব, দেবত্ব, ঈশ্বরত্ব, ব্রহ্মত্ব—সব মিলেমিশে পূর্ণ মনুষ্যত্বে রূপ নেবে। তখন এক মানুষকে দেখলেই দেখা যাবে সব কিছুর পূর্ণ রূপ, আর আমাকেও পাওয়া যাবে পূর্ণভাবে।
অদূর ভবিষ্যতে গুরু, রাষ্ট্রপ্রধান, সমাজ-নেতাদের মাধ্যমে এই জাগরণ আসবেই। কারণ—যতদিন মানুষের ভেতরে পূর্ণ মনুষ্যত্বের জাগরণ না আসবে, ততদিন সে নিজের জন্যও দায়বদ্ধ হতে পারবে না, অন্যের দায়িত্ব তো দূরের কথা। তখনই আসবে প্রকৃত অর্থে “মানুষ গড়ার প্রশ্ন”।
আজ সেই সময় এসে গেছে। একদিকে চলবে ধ্বংসের মহাযজ্ঞ, অন্যদিকে চলবে পূর্ণ উদ্যমে মানুষ গড়ার কাজ।