খুব ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। জানলা দিয়ে তাকিয়েছিলেম বাইরের দিকে, কুয়াশার পর্দা-ঘেরা একফালি চাঁদ জেগেছিল তখনও শেষরাতের প্রহর গুনতে, অজস্র শিউলিফুল ওদের আসন বিছিয়েছিল মাটির বুকে; সে সময় শিশির ঝরে পড়ার শব্দ শুনছিলেম টুপ টুপ।
চলে এসেছিলেম বাইরে; ভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে পা ফেলে ফেলে শিউলি গাছের পাশ দিয়ে এসে দাঁড়ালেম দেবদারু বনে। ভোরের মিষ্টি আলোতে পাগল-করা গানে অভিনন্দন জানাল ছোট্ট একটি হলদে রঙের পাখি, ডানায় তার নীল বিদ্যুতের আলিম্পন। ভগবানের আশীর্বাদ বয়ে এনেছিল সেদিন চন্দনা, তাই জীবনকে করিয়েছিল প্রত্যুদ্গমন। চন্দনাকে ভালোবাসলেম আর ভালো লাগল তার গানকে। তরুণ সূর্যের সঙ্গে ছিল যার মিতালি, শুভেচ্ছাবার্তা পৌঁছে দেবার সেই ছোট্ট প্রতিনিধিটিকে নিজ-অন্তরে আমি আমন্ত্রণ জানালেম।
বলেছিলেম, ওগো প্রাণের দূত, আজ আলোকের এই ঝরনাধারায় ধুইয়ে দাও। তোমার জীবনপাত্র নিঃশেষ করে যে মাধুরী দান করেছ, তারই ধারাস্নানে সিক্ত হোক আমার বক্ষতল। বরণ করো আমায় তোমার অন্তরে। গৃহকর্মের অবসানে দিনান্তের গোধূলিবেলায় দাঁড়িয়ে ছিলেম বাতায়নে। এমনি সময়ে আবার শুনলেম গান।
দেবদারু বন থেকে বেরিয়ে এল একটি মানুষ; গায়ে তার অদ্ভুত পোশাক, কাঁধে ঝুলছে তীর-ধনুক, মাথায় তার রক্তিম পালক গোঁজা। গান গাইছিল লোকটি।
উল্লাসের গান। হঠাৎ চমকে দেখলেম, তার হাতে রয়েছে আমার ছোট্ট পাখি চন্দনা, রক্ত ঝরছে ওর পিঠ থেকে, চোখ রয়েছে বোজা—নিঃশেষ হয়ে গেছে সকালবেলার প্রাণ, অন্ধকার হয়েছে আলো।
গুনগুন করে গান গাইছিল শিকারি। জিঘাংসার গান, হত্যার গান। প্রত্যেক পদক্ষেপে ছিল তার জয়ের আনন্দ।
একা দাঁড়িয়ে দেখছিলেম এ দৃশ্য। চোখ ভরে গিয়েছিল অশ্রুতে। আরও একটি গান আমায় শুনিয়ে গেল আমার চন্দনা, ওর অন্তিম নিঃশ্বাসে—সে গান মৃত্যুর, প্রাণের দ্বারে যে পৌঁছে দিয়ে গেল মৃত্যুর অনুরণন।
মনে মনে প্রার্থনা জানালেম, ওগো আমার চন্দনা, মৃত্যুর শীতলতাকে সইবার শক্তি আমি তোমার কাছ থেকেই কামনা করছি, মরণ যখন তার নূপুর বাজিয়ে আসবে আমার দ্বারে, তখন আমার জীবনরাগিণীকে জাগিয়ে দিয়ো চরম তানে, সে গানে মুক্তির আভাস যেন আমি পাই।
ওগো চন্দনা, আমার ব্যথা-বিদীর্ণ বুকের ভেতর থেকে অশ্রুসিক্ত আনন্দকে তুমি আজ নিয়ে এসেছ অনির্বচনীয় মাধুর্যের মাঝখানে। তাই তো দুঃখের মন্থনবেগে পেয়েছি আজ অমৃতের দুর্লভ স্পর্শ।