অবিদ্যা-বিদ্যা: ৯৮



এই তিন শক্তি একে অপরের সঙ্গে প্রবাহিত ও অবিচ্ছেদ্য, এবং তাদের মিলিত একত্বই পূর্ণ চেতনা (śūnya-pūrṇatā)—এক অনন্ত পরিপূর্ণতা, যা শূন্যও বটে, আবার সব কিছুর আধারও। এই অবস্থাকেই Krama দর্শন “কালিকা” নামে প্রতীকায়িত করেছে—চেতনার সেই নিত্য-উন্মীলিত গর্ভ, যেখান থেকে সময়, সৃষ্টি ও বিলয় এক অখণ্ড প্রবাহে উদ্ভূত হয়।

Krama সাধনায় এই চেতনার বিকাশ বারোটি দেবী রূপে কল্পনা করা হয়—যাঁদের বলা হয় বারো কালিকা। প্রতিটি কালিকা চেতনার এক নির্দিষ্ট স্তরের প্রতীক: প্রথমে সৃষ্টি (utpatti), পরে স্থিতি (sthiti), এরপর লয় (saṃhāra), এবং সর্বশেষে মহাকালিকা বা কালসংকর্ষিণী—যিনি সময়ের সীমা অতিক্রম করেন।

অভিনবগুপ্ত তন্ত্রালোক (৬.১৫০)-এ লিখেছেন—“কালসংকর্ষিণী দেবী সর্বকালস্বরূপিণী।” অর্থাৎ, "কালসংকর্ষিণী দেবীই সমস্ত কালের (অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের) স্বরূপ।" কালসংকর্ষিণী দেবী সে-ই, যিনি সমস্ত সময়েরও ঊর্ধ্বে, এবং যিনি নিজেই সকল কালের রূপ। এই মহাকালিকা চেতনার সেই রূপ, যিনি সৃষ্টিকে ধারণ করেন, আবার লয়ের মাধ্যমে সমস্ত কিছুকে নিজের মধ্যে টেনে নেন। উক্তিটি তন্ত্রে দেবীর কালী বা মহাকালী রূপের চরম ও দার্শনিক অবস্থানকে তুলে ধরে।

দেবী একই সাথে কালসংকর্ষিণী (কালকে গ্রাস করে লয়কারী) এবং সর্বকালস্বরূপিণী (কালের মূর্ত প্রতীক)। এর তাৎপর্য হলো, দেবী একদিকে যেমন সমস্ত সৃষ্টিকে কালের মধ্যে লীন করে দেন (সংহার), তেমনি অন্যদিকে তিনি নিজে কালের ঊর্ধ্বে (Transcendent) স্থিত। অর্থাৎ, তিনি কালকে সৃষ্টি করেন, কালকে ধারণ করেন এবং শেষে কালকে নিজের মধ্যেই টেনে নেন।

দেবীকে নিছক ধ্বংসকারী রূপে না দেখে, তাঁকে সময়ের চূড়ান্ত বাস্তবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে এই শব্দগুচ্ছ। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ—এই ত্রিকালই দেবীর স্বরূপে বিদ্যমান। সাধনার প্রেক্ষাপটে, কাল হলো বন্ধন ও সীমাবদ্ধতার প্রতীক। যিনি দেবীকে কালসংকর্ষিণী রূপে ধ্যান করেন, তিনি কাল বা সময়ের চক্র থেকে মুক্তি (Moksha) লাভ করেন। কারণ, দেবী নিজেই কালের বন্ধন মুক্ত।

Krama tradition তাই কালিকাকে কোনো ধ্বংসশক্তি হিসেবে নয়, বরং চেতনার রূপান্তরমূলক প্রবাহ হিসেবে দেখে—তিনি সেই শিব-চেতনার গতিশীল দিক, যিনি প্রতিটি বিনাশকে নতুন সৃষ্টিতে রূপান্তরিত করেন। তাঁর নৃত্যই হলো সময়ের নৃত্য—যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত জন্ম ও বিলয়ের সমবায়।

তন্ত্রের চূড়ান্ত উপলব্ধি হলো চেতনার অন্তর্গত পূর্ণতা। এখানে দেহ, মন, কামনা, অনুভূতি—কিছুই পরিত্যাজ্য নয়; সবই পরমচৈতন্যের প্রকাশ। অভিনবগুপ্তের ভাষায়—“সর্বং শিবময়ম্”—সবই শিবময়। মুক্তি মানে তাই কোনো গমন নয়, বরং স্বরূপে প্রত্যাবর্তন—চেতনার সেই অবস্থায় পৌঁছানো, যেখানে ব্যক্তি জানে, “আমি শিব”—“শিবোহম্”।

এই উপলব্ধি তন্ত্রকে ভারতীয় চিন্তার ইতিহাসে অনন্য করে তোলে—এখানে দর্শন ও সাধনা, ব্রহ্ম ও শরীর, জ্ঞান ও শক্তি, সময় ও নিত্যতা—সব এক অবিচ্ছিন্ন চেতনার প্রবাহে মিশে যায়। সেই প্রবাহেই সৃষ্টি ও লয়, প্রকাশ ও নীরবতা, শিব ও শক্তি—সব অবশেষে এক মহাসংগীতে লীন হয়, যেখানে থাকে কেবল এক নিত্য উচ্চারণ—“অহম্”—আমি আছি, আমি চিরন্তন, আমি সেই শিব-চেতনা।

প্রথমত, ইচ্ছা (Icchā) মানে ‘চাওয়া’, ‘উদ্দেশ্য’ বা চেতনার আত্ম-আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু এটি সাধারণ মনুষ্য-ইচ্ছার মতো কোনো অভাবজনিত চাওয়া নয়; এটি চেতনার নিজস্ব আনন্দের স্ফুরণ। চেতনা স্বয়ংপূর্ণ, কিন্তু সেই পূর্ণতা নিজেরই প্রকাশে আনন্দ পায়—নিজেকে দেখতে, অনুভব করতে, রূপে প্রকাশ করতে চায়। এই অভ্যন্তরীণ স্পন্দনই ইচ্ছাশক্তি। শৈব দর্শনে বলা হয়—“আনন্দঃ স্পন্দঃ ইচ্ছাশক্তিঃ”—অর্থাৎ, আনন্দের স্পন্দনই ইচ্ছাশক্তি। এই তিনটি ধারণা কাশ্মীর শৈবদর্শনের, বিশেষ করে স্পন্দ (Spanda) এবং প্রত্যভিজ্ঞা (Pratyabhijñā) দর্শনের মূল আধ্যাত্মিক এবং দার্শনিক ভিত্তিকে নির্দেশ করে। সৃষ্টির মূল এই আকাঙ্ক্ষা, যেখানে শিবচেতনা নিজের আনন্দে প্রকাশিত হতে চায়।

দ্বিতীয়ত, জ্ঞান (Jñāna) হলো সেই চেতনার স্ব-প্রকাশিত আলোক বা উপলব্ধি। ইচ্ছা যখন উদ্‌ভাসিত হয়, তখন চেতনা নিজেরই সম্ভাবনাকে চিহ্নিত করে, জানে, চিনে—এবং এই জানা-চেনাই জ্ঞানশক্তি। এটি কেবল তথ্য বা ধারণার জ্ঞান নয়; বরং চেতনার নিজের অস্তিত্বের আত্মবোধ। তন্ত্রদর্শনে জ্ঞান মানে প্রকাশ (Prakāśa)—চেতনার স্বপ্রভা, যেখানে শিব নিজেকে নিজের আলোয় জানে।

তৃতীয়ত, ক্রিয়া (Kriyā) হলো সেই জ্ঞানের প্রকাশ বা সৃজনশীল ক্রিয়া। যখন চেতনা নিজের জানা সত্যকে রূপে, কাজে, স্পন্দনে প্রকাশ করে, তখন সেটিই ক্রিয়া। এটি কোনো বাহ্য ক্রিয়া নয়, বরং চেতনার নিজেরই স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ—যেখানে জানা ও হওয়া একই। তাই বলা হয়, “জ্ঞান-ক্রিয়াভ্যাম্ ইচ্ছা পরিপূর্ণা ভবতি”—"জ্ঞান এবং ক্রিয়া—এই দুইয়ের দ্বারাই ইচ্ছা পরিপূর্ণ বা সফল হয়।" অর্থাৎ, ইচ্ছা তখনই পূর্ণ হয়, যখন জ্ঞান ও ক্রিয়ার মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করে।

কাশ্মীর শৈবদর্শন অনুসারে, পরম চৈতন্য বা শিবের তিনটি মৌলিক শক্তি আছে, যা সৃষ্টির কারণ: ইচ্ছাশক্তি (Will), জ্ঞানশক্তি (Knowledge), এবং ক্রিয়াশক্তি (Action)। এই শব্দগুচ্ছটি এই তিনটি শক্তির মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে—শিবের সংকল্প বা সৃষ্টি করার প্রথম ইচ্ছা; সেই জ্ঞান, যা ইচ্ছার বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেয় (কী সৃষ্টি করতে হবে); সেই শক্তি যা বাস্তবে ইচ্ছাটিকে কার্যকর করে তোলে।

শুধু ইচ্ছা করলেই হবে না। ইচ্ছা তখনই পরিপূর্ণ হয়, যখন তা সঠিক জ্ঞান দ্বারা পরিচালিত হয় (অর্থাৎ, কী করতে হবে তা স্পষ্ট জানা) এবং ক্রিয়া দ্বারা বাস্তবে রূপান্তরিত হয় (অর্থাৎ, কাজ করা)। এই তিনটি শক্তি একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, বরং একটি অখণ্ড প্রক্রিয়ার অংশ। পরমেশ্বর তাঁর ইচ্ছা-কে প্রথমে জ্ঞান দ্বারা নির্দিষ্ট করেন এবং তারপর ক্রিয়া দ্বারা তা প্রকাশ করেন। ব্যক্তির ক্ষেত্রেও এই নীতি প্রযোজ্য। কোনো লক্ষ্য (ইচ্ছা) তখনই অর্জিত হয়, যখন সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর সঠিক জ্ঞান থাকে এবং সেই অনুযায়ী প্রচেষ্টা বা কাজ করা হয়।

এই তিন শক্তি আসলে এক চেতনার তিন ছন্দ—ইচ্ছা হলো চেতনার অন্তর্মুখী আকাঙ্ক্ষা, জ্ঞান তার আত্ম-আলো, এবং ক্রিয়া তার প্রকাশমান তরঙ্গ। তারা আলাদা নয়; যেমন আগুনের উষ্ণতা, আলো, ও জ্বালন একে অপর থেকে পৃথক নয়, তেমনি চেতনার এই তিন দিকও এক অবিচ্ছিন্ন প্রবাহ।

যখন এই তিন শক্তি একে অপরের মধ্যে নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রবাহিত হয়—কোনো ভেদ, কোনো সীমা, কোনো অগ্র-পশ্চাৎ ছাড়াই—তখন সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় একত্র হয়ে যায়। এই পূর্ণ সমন্বিত চেতনা-অবস্থা, যেখানে ইচ্ছা জ্ঞানে রূপান্তরিত হয়, জ্ঞান ক্রিয়ায়, এবং ক্রিয়া আবার ইচ্ছায় ফিরে যায়—এই চক্রাকৃতি ঐক্যই পরম চৈতন্য (Parama-caitanya)। শৈব ক্রমদর্শন একে বলে পূর্ণ শূন্যতা (Śūnya Pūrṇatā)—যেখানে শূন্যতা মানে শূন্য নয়, বরং সর্ববস্তুতে পরিপূর্ণ এক নিত্য সম্ভাবনা; এটি এমন এক অবস্থা, যা একই সঙ্গে শূন্য (কোনো নির্দিষ্ট রূপে সীমাবদ্ধ নয়) এবং পূর্ণ (সমস্ত রূপকে ধারণ করে)।

এই পূর্ণ শূন্যতার চিত্রই Krama দর্শনে কালিকা—যিনি চেতনার নিত্য উন্মীলিত গর্ভ, সেই চেতনার গতি, যা কখনও থামে না। এখানে “কালিকা” কোনো পৃথক দেবী নয়; তিনি চেতনার সময়স্বরূপ সৃষ্টিশক্তি, যিনি একাধারে সৃষ্টি (উন্মেষ), স্থিতি (প্রকাশ), ও লয় (নিমজ্জন)—এই তিন গতিকে একই ধারায় বহন করেন। কালিকা তাই সেই পরম মুহূর্ত, যেখানে সময় নিজেকে ছাড়িয়ে যায়—যেখানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এক অনন্ত প্রবাহে মিশে যায়।

এই ত্রিশক্তির ঐক্যই চেতনার চূড়ান্ত রূপ—যেখানে চেতনা নিজের মধ্যেই নিত্যভাবে স্পন্দিত, জাগ্রত ও সম্পূর্ণ। সেখানে আর কোনো ভেদ থাকে না; থাকে কেবল এক অবিচ্ছিন্ন চেতনার প্রবাহ, এক অনন্ত কালিকা-অবস্থা, যেখানে সৃষ্টি, সময় ও শূন্যতা এক হয়ে যায় চিরন্তন চৈতন্যে।

Krama সাধনায় চেতনার বিকাশকে বারো কালিকা (দেবী) রূপে কল্পনা করা হয়, যেখানে প্রতিটি দেবী চেতনার এক নির্দিষ্ট পর্যায়ের প্রতীক। প্রথম দেবী প্রকাশ করেন সৃষ্টির সূচনা (Utpatti), দ্বিতীয় বিকাশ (Sthiti), তৃতীয় লয় (Saṃhāra), এবং শেষ রূপে মহাকালিকা বা কালাসঙ্কর্ষিনী—তিনি সেই শক্তি, যিনি সময়কেও অতিক্রম করে সব কিছুকে নিজের মধ্যে টেনে নেন। অভিনবগুপ্ত বলেন (তন্ত্রলোক, ৬.১৫০): কালসংকর্ষিণী দেবী সর্বকালস্বরূপিণী—"কালকে সংহার করেন যে দেবী, সেই দেবীই সমস্ত কালের (সময়ের) স্বরূপ।" (কালসংকর্ষিণী (Kālasaṃkarṣiṇī): যিনি কালকে সংহার করেন, অর্থাৎ সময়ের প্রবাহকে নিজের মধ্যে টেনে নিয়ে বিলীন করেন। 'সংকর্ষণ' শব্দটি লয় বা বিলীন করার ক্ষমতা নির্দেশ করে। দেবী (Devī): পরমা শক্তি বা দেবী। সর্বকালস্বরূপিণী (Sarvakālasvarūpiṇī): যিনি সমস্ত কালের (অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের) স্বরূপ বা মূর্ত প্রতীক।) অর্থাৎ, কালাসঙ্কর্ষিনী দেবী হলেন সেই, যিনি সমস্ত সময়েরও ঊর্ধ্বে, তবু সময়ের মধ্যেই প্রকাশিত। এই উক্তিটি দেবী কালীর স্বরূপের গভীর দ্বৈততাকে তুলে ধরে, যা তন্ত্রের মূল কথা।

দেবী শুধু সময়ের মধ্যে কাজ করেন না, তিনি কালকে নিয়ন্ত্রণ করেন। যখন তিনি "কালসংকর্ষিণী", তখন তিনি মহাবিশ্বের সব কিছুর লয় ঘটান, সময়কে নিজের মধ্যে গ্রাস করেন। যখন তিনি "সর্বকালস্বরূপিণী", তখন তিনি নিজেই অনাদি, অনন্ত সময় হিসেবে বিরাজ করেন। অর্থাৎ, তিনি কাল এবং কাল-অতীত উভয়ই। সাধনার দৃষ্টিকোণ থেকে, কাল (সময়) হলো মায়ার একটি প্রধান বন্ধন, যা মানুষকে জন্ম-মৃত্যুর চক্রে বেঁধে রাখে। দেবীর এই স্বরূপ ধ্যান করলে সাধক কালের বন্ধন মুক্ত হয়ে ত্রিকালের (অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ) অতীত মোক্ষ অবস্থা লাভ করেন। দেবীই মহাবিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি এবং লয়ের মূলে স্থিত অবিনশ্বর শক্তি (Śakti)।

এইভাবে, Krama tradition কালিকাকে কেবল ধ্বংসশক্তি নয়, বরং চেতনার অন্তর্গত রূপান্তরমূলক প্রবাহ হিসেবে দেখে—তিনি শিবের নীরব আত্মায় লীন মহাশক্তি, যিনি প্রত্যেক বিনাশকে নতুন উদ্‌ভাসে রূপান্তরিত করেন।

তন্ত্রের দর্শন—পূর্ণতায় লয়: তন্ত্রশাস্ত্রের মূলসার হলো, চেতনার অন্তর্গত পূর্ণতা উপলব্ধি করা। এখানে কোনো কিছু বর্জন নয়—দেহ, মন, কামনা, অনুভূতি—সবই সেই এক চেতনার স্পন্দনের অংশ। অভিনবগুপ্তের ভাষায়, “সর্বং শিবময়ম্”—সবই শিবময়। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু অস্তিত্বশীল, তার সব কিছুই পরম চৈতন্য (শিব) দ্বারা গঠিত এবং সেই চৈতন্যেরই প্রকাশ। এখানে শিবকে কোনো নির্দিষ্ট দেবতা হিসেবে না দেখে, চূড়ান্ত বাস্তবতা বা ব্রহ্মাণ্ডের আত্মা হিসেবে দেখা হয়। এটি অদ্বৈতবাদের চরম প্রকাশ—যেখানে সৃষ্টিকর্তা এবং সৃষ্টির মধ্যে কোনো ভেদ নেই। তাই তন্ত্রে মুক্তি মানে কোনো গমন নয়, কোনো পরিত্যাগ নয়; এটি কেবল চেতনার বিস্তার—যেখানে ব্যক্তি বুঝতে পারে যে, সে-ই সেই পরম স্পন্দন, যে সৃষ্টি ও লয়ের মধ্য দিয়ে নিজের নিত্য দীপ্তি প্রকাশ করছে।

তন্ত্র এইভাবে ভারতীয় চিন্তার এক অনন্য ঐতিহ্য—যেখানে দর্শন ও সাধনা, ব্রহ্ম ও শরীর, জ্ঞান ও শক্তি, সব এক অবিচ্ছিন্ন স্রোতে মিশে যায়। আর এই ঐক্যের গভীরতম অভিজ্ঞতাই হলো “শিবোহম্”—“আমিই সেই শিব”—অর্থাৎ, চেতনা নিজেকে চেনে, নিজের মধ্যেই নিজের মুক্তি সম্পন্ন করে। কাশ্মীর শৈবদর্শন, ভারতীয় দর্শনের এক সমৃদ্ধ এবং গভীর শাখা, মুক্তি বা মোক্ষকে কোনো বাহ্যিক দেবতার আরাধনা বা কঠোর ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রাপ্তব্য ফল হিসেবে দেখে না। বরং, এই দর্শনের মহান আচার্য অভিনবগুপ্ত এবং উৎপলদেব, যাঁদের চিন্তাধারা এই ঐতিহ্যের ভিত্তি স্থাপন করেছে, তাঁরা মুক্তির এক অভ্যন্তরীণ এবং আত্ম-উপলব্ধিমূলক ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তাঁদের মতে, মুক্তি কোনো ঐশ্বরিক অনুগ্রহ নয়, বরং নিজের সত্তার গভীরে নিহিত 'কালিকা-চেতনার' জাগরণ।