এই দার্শনিক উক্তিটি কাশ্মীর শৈবদর্শনের প্রত্যভিজ্ঞা (Pratyabhijñā) ধারার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞা, যা মোক্ষ বা মুক্তির স্বরূপকে বর্ণনা করে। এই সূত্রটি মূলত আচার্য অভিনবগুপ্তের অন্যতম প্রধান শিষ্য ক্ষেমরাজ (Kṣemarāja) রচিত প্রত্যভিজ্ঞা দর্শনের একটি সংকলন ও ভাষ্য গ্রন্থ ‘প্রত্যভিজ্ঞাহৃদয়ম’ (Pratyabhijñāhṛdayam)-এ পাওয়া যায়। ক্ষেমরাজ তাঁর গ্রন্থে উক্তিটি ব্যবহার করেছেন মোক্ষের স্বরূপ ব্যাখ্যা করার জন্য। এই উক্তিটি কাশ্মীর শৈববাদের মূল বক্তব্যকে সংক্ষিপ্ত ও স্পষ্ট করে তোলে।
মোক্ষ আর কিছু নয় (নৈবান্যঃ): মোক্ষ বা মুক্তি কোনো দূরবর্তী স্থান বা নতুন অবস্থা নয়, যা অর্জন করতে হয়।
স্বরূপ-প্রাপ্তিস্তু ততঃ: এটি হলো কেবল নিজের স্ব-স্বরূপের (অর্থাৎ নিজের প্রকৃত শিব-চেতনার) পুনরায় প্রাপ্তি বা স্বীকৃতি (Recognition)।
যেহেতু জীবাত্মা (অণু) মূলত স্বয়ং শিব, তাই তার মুক্তি হলো কেবল বিস্মৃত সত্যকে স্মরণ করা এবং তাকে স্বীকৃতি দেওয়া। এই সূত্রটি কাশ্মীর শৈবধর্মের অদ্বৈতবাদী প্রকৃতিকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে।
এই দৃষ্টিভঙ্গিতেই রচিত হয়েছিল উৎপলদেবের অমর গ্রন্থ ‘ঈশ্বর-প্রত্যভিজ্ঞা-কারিকা’ (Īśvara-Pratyabhijñā-Kārikā)—যেখানে তিনি যুক্তি ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে দেখাতে চেয়েছেন যে, আত্মার প্রকৃত জ্ঞান মানে আত্মারই স্মরণ। এই দর্শনের সারকথা একই—জ্ঞান মানে নিজেকে পুনরায় চিনে ফেলা; মুক্তি মানে নিজেরই সত্যে ফিরে যাওয়া; আর এই স্মরণের মুহূর্তেই সীমিত জীব চিরন্তন শিবচেতনার সঙ্গে এক হয়ে যায়।
প্রতিটি অনুভূতি চেতনার স্পন্দন: অভিনবগুপ্ত তাঁর বিজ্ঞান-ভৈরব তন্ত্র (Vijñānabhairava Tantra)-এর ব্যাখ্যায় বলেন, চেতনা কখনও স্থির নয়; তা সর্বদা স্পন্দমান, নিজেকে নানা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে প্রকাশ করছে। প্রেম, ভয়, ক্রোধ, আকাঙ্ক্ষা—সবই সেই এক চেতনার ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গ। “ভৈরবঃ সর্বভাবানাম্ ভাবনাত্বম্”—"ভৈরবই সমস্ত অস্তিত্বের (বা সমস্ত বস্তুর) অন্তর্নিহিত স্বরূপ বা ভিত্তি।" অথবা "সমস্ত কিছুর অস্তিত্বের মূল কারণ বা চেতনা হলেন ভৈরব।" অর্থাৎ, ভৈরব বা শিব সেই চেতনা, যিনি সকল ভাবের অন্তর্নিহিত সত্তা (তন্ত্রলোক, ১.৫৪)। তাই Krama দর্শনে কোনো অভিজ্ঞতাকে অগ্রাহ্য করা হয় না; বরং প্রতিটি অনুভূতি একটি দরজা—যার মাধ্যমে চেতনা নিজেকে নতুনভাবে উপলব্ধি করে।
উক্তিটির শব্দভিত্তিক অর্থ হলো—
ভৈরবঃ (Bhairavaḥ): ভৈরব; কাশ্মীর শৈবধর্মের দর্শনে, এটি শিবের একটি রূপ হলেও মূলত পরম চৈতন্য (Ultimate Consciousness) বা পরম সত্তা-কে বোঝায়।
সর্বভাবানাম্ (Sarvabhāvānām): সমস্ত ভাব বা অস্তিত্বের (সমস্ত জিনিস, সমস্ত অবস্থা, সমস্ত সৃষ্টি)।
ভাবনাত্বম্ (Bhāvanātvam): ভাব বা অন্তর্নিহিত স্বরূপ বা সৃষ্টির প্রক্রিয়া। এটি এখানে 'ধারণা', 'চেতনা' বা 'বাস্তবতার ভিত্তি' অর্থে ব্যবহৃত।
অদ্বৈতবাদ (Non-dualism)-ই শৈব-অদ্বৈতবাদের মূলকথা। এর মানে হলো, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যা-কিছু আছে (বস্তু, প্রাণী, চিন্তা, অনুভূতি—অর্থাৎ সর্বভাব), তার সব কিছুর মৌলিক সার বা চেতনা একই। সেই পরম চেতনা বা ভিত্তিই হলো ভৈরব।
অভিন্নতা (Identity)—সৃষ্টিকর্তা (ভৈরব) এবং সৃষ্টি (সমস্ত ভাব) আলাদা নয়। আমরা যা দেখি, অনুভব করি বা চিন্তা করি, সবই সেই পরম চৈতন্যেরই প্রকাশ। আমাদের নিজেদের ভেতরের চেতনাও সেই ভৈরব।
ধ্যানের লক্ষ্য (Goal of Meditation)—বিজ্ঞানভৈরব তন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য হলো উক্তির অন্তর্নিহিত সত্যটি উপলব্ধি করা। এই বাক্যটি নির্দেশ করে যে, সাধকের উচিত কোনো বাহ্যিক দেবতার পূজা না করে, বরং সমস্ত অস্তিত্বের মূলে থাকা চেতনা-স্বরূপ ভৈরবকে নিজের ও জগতের স্বরূপ হিসেবে ধ্যান করা।
চৈতন্যই বাস্তবতা (Consciousness is Reality)। উক্তিটি ঘোষণা করে যে, বিশ্বের সমস্ত বস্তুর স্থূল রূপটি ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু তাদের ভেতরকার যা—তাদের সমস্ত কিছুকে অস্তিত্ব দেয় (অর্থাৎ তাদের 'ভাবনা'-ত্ব), তা চিরন্তন চৈতন্য বা ভৈরব।
এই উক্তিটি কাশ্মীর শৈবদর্শনের মূল মন্ত্র: যা আছে, তা-ই শিব বা পরম চৈতন্য। এজন্য তিনি বলেন, সাধকের কাজ হলো নিজের চেতনাকে কোনো নির্দিষ্ট রূপে স্থির না করে প্রত্যেক রূপের মধ্যেই চেতনার উদ্ভাস দেখা। প্রেমের উচ্ছ্বাসে, ভয়ের অন্ধকারে, কামনার জ্বরে, মৃত্যুর নীরবতায়—সব জায়গাতেই সেই এক চেতনা কাজ করছে। Krama পথ এই উপলব্ধিকে জীবনের অভ্যন্তর থেকে উদ্ভাসিত করতে শেখায়, কোনো বিমূর্ত চিন্তায় নয়, বরং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায়।
মুক্তি একটি নিত্য অভিজ্ঞতা। বেদান্তের দৃষ্টিতে মুক্তি হলো অবিদ্যা-নাশের পর এক স্থিতাবস্থা—‘ব্রহ্মজ্ঞানের পর জীবন্মুক্তি’। কিন্তু Krama-তে মুক্তি কোনো সমাপ্তি নয়; এটি অভিজ্ঞতার ধারাবাহিক উদ্ভাস। অভিনবগুপ্ত বলেন—মোক্ষো হি নাম চিত্তস্য স্বাতন্ত্র্যম্ এব—"মোক্ষ বস্তুত চিত্তের স্বাতন্ত্র্য (বা স্বাধীনতা) ছাড়া আর কিছুই নয়।" (মোক্ষো (Mokṣo): মোক্ষ (মুক্তি, স্বাধীনতা)। হি (Hi): নিশ্চয়ই, অবশ্যই। নাম (Nāma): নামে পরিচিত, বস্তুত। চিত্তস্য (Cittasya): চিত্তের, মনের। স্বাতন্ত্র্যম্ (Svātantryam): স্বাতন্ত্র্য, স্বাধীনতা। এব (Eva): কেবল, শুধু।) অর্থাৎ, মুক্তি মানে চেতনার স্বাতন্ত্র্য বা স্বাধীনতা (তন্ত্রলোক, ৬.৫০)। যখন চেতনা কোনো অভিজ্ঞতার দ্বারা আবদ্ধ নয়, বরং প্রতিটি অভিজ্ঞতাকে নিজের প্রকাশ হিসেবে দেখে, তখনই তা মুক্ত। কাশ্মীর শৈবদর্শন (বিশেষত প্রত্যভিজ্ঞা দর্শন) অনুসারে এই উক্তিটির গভীর তাৎপর্য হলো—
মোক্ষের স্বরূপ: সাধারণত হিন্দুধর্মে মোক্ষকে স্বর্গপ্রাপ্তি, জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি বা দেহের বিনাশের পর প্রাপ্তি হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু অভিনবগুপ্তের মতে, মোক্ষ কোনো ভবিষ্যৎ অবস্থা বা স্থান নয়। এটি হলো বর্তমান অবস্থায় মনের (চিত্তের) পূর্ণ স্বাধীনতা।
বন্ধন হলো পরাধীনতা: জীব যখন নিজেকে সীমিত বা খণ্ডিত ('অণু') মনে করে এবং দেশ-কাল, কার্য-কারণ ও মায়ার দ্বারা আবদ্ধ হয়, তখন সে নিজেকে পরাধীন মনে করে। এই পরাধীনতাই হলো বন্ধন।
স্বাধীনতা হলো মোক্ষ: যখন জীব তার আত্মস্বরূপকে ('শিব') হিসেবে উপলব্ধি করার ফলে উপলব্ধি করে যে, সে অপরিমেয়, সর্বব্যাপী এবং সমস্ত সৃষ্টির কারণ—তখন চিত্ত মায়া, সীমিত জ্ঞান ও সীমিত ইচ্ছাশক্তির বন্ধন থেকে মুক্ত হয়। এই মুক্তি, অর্থাৎ চিত্তের আপন মহিমায় স্থিত হওয়াই হলো মোক্ষ।
জীবন্মুক্তির ধারণা: এই দর্শন অনুসারে, একজন ব্যক্তি শরীর ধারণ করেও মোক্ষ লাভ করতে পারে (জীবন্মুক্ত)। বাইরের কোনো পরিবর্তন প্রয়োজন নেই, কেবল চিত্তের (মনের) দৃষ্টিভঙ্গি ও ইচ্ছাশক্তির পরিবর্তনই যথেষ্ট। নিজের ইচ্ছাকে পরম শিবের ইচ্ছার সঙ্গে এক করে দেওয়াই হলো স্বাতন্ত্র্য।
Krama দর্শনের এই ভাবনা যে—মুক্তি কোনো ভবিষ্যৎ লক্ষ্য নয়, বরং প্রতিটি মুহূর্তের অন্তর্গত সত্য—জেন দর্শনের “nowness” বা “এই মুহূর্তের পূর্ণতা”-র ধারণার সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত। উভয় দর্শনই বলে, মুক্তি কোনো ঘটনার পরে ঘটে না, কোনো যোগফলের মতো অর্জিত হয় না; এটি সেই চেতনার নিজের মধ্যেই বিদ্যমান, যা প্রতিটি অনুভূতিতে, প্রতিটি নিশ্বাসে, প্রতিটি অভিজ্ঞতায় নিজেকে প্রকাশ করছে।
যেমন জেন বলে—“When you wash the bowl, wash the bowl.” অর্থাৎ, সম্পূর্ণ উপস্থিত থাকো বর্তমান ক্রিয়ায়; কোনো অতীতের চিন্তা, কোনো ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষা নয়—শুধু এই মুহূর্তের পূর্ণতায় নিজেকে মেলে ধরো। Krama দর্শনও একইভাবে বলে, চেতনা নিজেই সেই “এখন”-এর প্রাণ। এই “এখন” কোনো ক্ষণ নয়; এটি চেতনার নিত্যতা—যেখানে সময় আর ক্রম বিভাজিত নয়।
Krama-র সাধক তাই প্রত্যেক মুহূর্তকে আত্ম-প্রকাশের সুযোগ হিসেবে দেখে। প্রেম, ভয়, কামনা, মৃত্যু—সবই তার কাছে চেতনার প্রকাশ। প্রতিটি আবেগ, প্রতিটি ক্রিয়া, প্রতিটি নীরবতা তার কাছে শিবের স্পন্দন। তাই মুক্তি এখানে কোনো “অবস্থা” নয়, বরং একটি দৃষ্টিভঙ্গি—দেখা, অনুভব করা, ও থাকা—যেখানে সমস্ত কিছুই এক অখণ্ড চৈতন্যের খেলা।
জেন ভাষায়, এই অভিজ্ঞতাই “Suchness” বা “Thusness”—যা-কিছু ঘটছে, সেটিই ব্রহ্মের প্রতিফলন। অতীত বা ভবিষ্যৎকে প্রত্যাখ্যান না করে, বরং তাদের অনিত্যতার ভেতরেই এক নিত্য উপস্থিতি অনুভব করা। Krama দর্শনে এই নিত্য উপস্থিতিই হলো চেতনার আত্মদর্শন—যেখানে চেতনা নিজেরই প্রতিটি অভিজ্ঞতার মধ্যে নিজেকে চিনে নিচ্ছে।
সাধক যখন সম্পূর্ণভাবে বর্তমান মুহূর্তে স্থিত হয়—না আকাঙ্ক্ষায়, না অনুতাপে, না প্রত্যাশায়—তখন সে বুঝে ফেলে যে, এই মুহূর্তটাই অনন্ত। তখন ভয়, লালসা, মৃত্যু—সবই তার কাছে কেবল তরঙ্গমাত্র, আর সে সেই সাগরের চেতনা, যা কখনও নড়ে না। এখানেই মুক্তি: ‘এখন’-এর পূর্ণ জাগরণে।
Krama দর্শনের বৈশিষ্ট্য—জীবনকে উপাসনা: অভিনবগুপ্তের মতে, Krama পথের শ্রেষ্ঠত্ব এই যে, এটি জীবন ও মুক্তির মধ্যে কোনো দ্বৈততা রাখে না। তাঁর ভাষায়—“সর্বং শিবময়ম্ ইতি দৃষ্টির্ এব মুক্তিঃ”—(সর্বং (Sarvaṃ): সব কিছু, সমস্ত কিছু। শিবময়ম্ (Śivamayam): শিব দ্বারা পূর্ণ, শিবের স্বরূপে গঠিত। ইতি (Iti): এইরূপ, এই প্রকারে। দৃষ্টির্ (Dṛṣṭir): দৃষ্টি, উপলব্ধি, জ্ঞান বা দৃষ্টিভঙ্গি। এব (Eva): কেবল, শুধু। মুক্তিঃ (Muktiḥ): মুক্তি, মোক্ষ।) "সব কিছুই শিবময়, এই বোধ বা উপলব্ধিই হলো মুক্তি।" অর্থাৎ, যখন দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে যায়, “সবই শিব,” তখন সেটিই মুক্তি। এই দৃষ্টি কোনো বিচ্ছিন্ন ভাব নয়; এটি ক্রিয়াশীল চেতনার অবস্থা, যা প্রতিটি কর্ম, প্রতিটি চিন্তা, প্রতিটি স্পন্দনকে পবিত্র করে তোলে।
কাশ্মীর শৈবদর্শন (যা একটি অদ্বৈতবাদী দর্শন) অনুযায়ী, এই উক্তিটির তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর এবং মোক্ষের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করে—
মোক্ষ একটি মানসিক অবস্থা। উক্তিটি মোক্ষকে কোনো পারলৌকিক বা ভবিষ্যতের ফল হিসেবে না দেখে, একটি দৃষ্টিভঙ্গি বা উপলব্ধির পরিবর্তন হিসেবে তুলে ধরে। এর মানে হলো, মুক্তি লাভ করতে গেলে সাধকের নতুন কিছু অর্জন করার প্রয়োজন নেই, কেবল তার বর্তমান বাস্তবতাকে দেখার ভঙ্গিটি পরিবর্তন করতে হবে।
জগতের স্বরূপ—এই দর্শন অনুসারে, জগৎ শিব (পরম চৈতন্য)-এরই স্ব-প্রকাশ। এটি মিথ্যা নয়, বরং সত্য এবং চৈতন্যময়। জগতের প্রতিটি বস্তু, প্রাণী, ঘটনা এবং চিন্তা—সবই সেই একমাত্র শিব-সত্তা দ্বারা পরিব্যাপ্ত ও গঠিত।
বন্ধন আসে, যখন আমরা জগৎকে শিব থেকে ভিন্ন বা "অ-শিব" বলে মনে করি। মুক্তি তখন আসে, যখন সাধক বুঝতে পারেন যে, তার চারপাশের সব কিছু, এমনকি তার নিজের শরীর, মন, সুখ-দুঃখ, সবই সেই পরম, পবিত্র ও পূর্ণ শিবের খেলা বা প্রকাশ। যখন "সব কিছুই শিবময়" এই জ্ঞান দৃঢ় হয়, তখনই জীবন্মুক্তি লাভ হয়।
এটি হলো ভেদের (দ্বৈততা বা পার্থক্য) অবসান ঘটিয়ে অভেদের (অদ্বৈততা বা একত্বের) জ্ঞান প্রতিষ্ঠা করা। যিনি এই "সর্বং শিবময়ম্" দৃষ্টিতে জীবনযাপন করেন, তিনি সব কিছুর প্রতি সমান দৃষ্টি পোষণ করেন এবং তার সমস্ত কর্ম শিবের পূজা রূপে পরিণত হয়।
Krama পথ তাই সেই তত্ত্ব, যেখানে সাধক দর্শনকে জীবনের ভেতরে এনে বাস্তবায়িত করে। এটি দর্শনের ব্যাবহারিক রূপ—অদ্বৈতবোধ-এর প্রয়োগ (advayajñāna-prayoga)—যেখানে জ্ঞান কেবল চিন্তা নয়, জীবনযাপন।
এভাবে দেখা যায়, অভিনবগুপ্তের Krama দর্শন একদিকে বেদান্তীয় অদ্বৈত জ্ঞান-এর ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আছে, আবার অন্যদিকে তন্ত্রীয় অভিজ্ঞতা ও যোগসাধনা-কে একীভূত করেছে। এখানে চেতনা (Cit) ও শক্তি (Śakti) কোনো দুটি পৃথক নীতি নয়; তারা একে অপরের প্রতিফলন। জ্ঞান হলো স্থিতির দিক, সাধনা হলো তার স্পন্দন। এই দুইয়ের মিলনেই সাধক নিজের চেতনার নিত্য স্বরূপে জাগ্রত হয়—যেখানে প্রতিটি অভিজ্ঞতা একেকটি দর্পণ, আর সেই দর্পণে প্রতিফলিত হচ্ছে একটিই সত্য: “আমি চেতনা নিজেই, আমি শিব, আমি চিরমুক্ত।”