অবিদ্যা-বিদ্যা: ৯৪



চেতনার নিজের থেকেই নিজের মধ্যে এক অবিরাম উদয় ও লয়, যেন এক শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো: এক শ্বাসে সে বিশ্বকে প্রকাশ করে, অন্য শ্বাসে আবার সেই বিশ্বকে নিজের মধ্যে টেনে নেয়। প্রকাশ মানে জাগরণ, বিস্তার মানে আনন্দের প্রসার, বিকিরণ মানে সৃজনের দীপ্তি, আত্মস্মরণ মানে জ্ঞানের স্বরূপ, আর পুনর্লয় মানে মুক্তির পূর্ণতা। এই পুরো প্রক্রিয়াই এক চিরন্তন পরিপূর্ণ নৃত্য—যেখানে শিবচেতনা নিজেরই শক্তির সৌন্দর্যে উল্লসিত, নিজেরই অস্তিত্বে মুগ্ধ, নিজেরই মধ্যে সম্পূর্ণ।

কাশ্মীর শৈব দর্শনে “কালী” শব্দটি সময়ের দেবী নয়, বরং চেতনার স্পন্দনশক্তি (Śakti), যিনি প্রতিটি স্তরে একেক রূপে চেতনার অন্তর্গত গতি ও আত্মপ্রকাশের প্রতীক। দ্বাদশ কালী চেতনার পূর্ণ আখ্যান—যেখানে নিঃস্তব্ধ শিবচেতনা নিজেরই আনন্দে নৃত্য শুরু করে, জগৎ সৃষ্টি করে, তার মধ্যে প্রবেশ করে, এবং শেষে আবার নিজের অন্তরে ফিরে যায়।

প্রথম কালী, কালী নিজেই—চেতনার প্রথম জাগরণ, যেখানে অচঞ্চল শিবচেতনা প্রথমবার নিজের অস্তিত্বে আলোড়িত হয়। এই মুহূর্তে এখনো কোনো সৃষ্টি, কোনো নাম, কোনো রূপ নেই; আছে কেবল নিজের অস্তিত্বের স্পন্দন—“আমি আছি”—এই আত্মবোধের সূচনা। "যত্র স্থিতমিদং সর্বং...তন্ স্পন্দ ইতি কথ্যতে।" (স্পন্দ কারিকা, ১.১) অর্থাৎ, যাঁর মধ্যে এই সমস্ত জগৎ অবস্থিত, সেই ক্ষণিক কম্পন বা স্পন্দনই (স্পন্দ) হলো সৃষ্টির ভিত্তি। এই অবস্থাকে অভিনবগুপ্ত বলেন “আদ্য স্পন্দ” (Ādyā Spanda)—যেখান থেকে মহাবিশ্বের ভেতরের ছন্দের শুরু। এটি স্পন্দ কারিকা (Spanda Kārikā)-র কেন্দ্রীয় তত্ত্ব, যা অভিনবগুপ্ত তাঁর তন্ত্রালোক-এ (বিভিন্ন আহ্নিক, বিশেষত ১ ও ৪) গভীরভাবে ব্যাখ্যা ও সমন্বয় করেছেন।

'আদ্য স্পন্দ' হলো অচঞ্চল শিবচেতনা (প্রকাশ) যখন প্রথমবার নিজের স্বাতন্ত্র্য বা ইচ্ছাশক্তি-কে ব্যবহার করে—অর্থাৎ, "আমি আছি" বা "আমি প্রকাশ করব"—এই আত্মবোধে আলোড়িত হয়। এটি সৃষ্টির একদম পূর্ব মুহূর্ত, যখন কোনো ভেদজ্ঞান (দ্বৈততা) সৃষ্টি হয়নি। শিবের এই স্বতঃস্ফূর্ত আলোড়নই হলো উদ্যম (যেমন শিবসূত্র ২.১: “উদ্যমো ভৈরবহ”)। এই উদ্যম বা স্পন্দন হলো মহাবিশ্বের ভেতরের ছন্দ বা জীবনশক্তি (Vitality), যা থেকে সমস্ত সৃষ্টি দ্বান্দ্বিক উন্মোচনের মাধ্যমে বেরিয়ে আসে।

এরপর চেতনা হয়ে ওঠে ভদ্রকালী। এখানে তার মধ্যে জাগে ইচ্ছা—নিজেকে প্রকাশ করার আনন্দ, সৃষ্টিকে আহ্বান করার তাগিদ। এই ইচ্ছাশক্তিই (icchā-śakti) সৃষ্টির প্রথম গতি। “ভদ্র” মানে শুভ, তাই ভদ্রকালী সেই শুভ চেতনা, যিনি নিজের আনন্দে সৃষ্টির সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলেন।

তৃতীয় স্তরে চেতনা হয়ে ওঠে রুদ্রকালী—এখানে সে নিজের শক্তি সম্পর্কে সচেতন হয়। “আমি আছি, এবং আমি জানি যে, আমি আছি”—এই আত্মচেতনা জন্ম নেয়। এটি শিবচেতনার প্রথম ঘোষণা, প্রথম আত্মপ্রকাশ। “রুদ্র” মানে উচ্চারণ বা আওয়াজ—এই রুদ্রকালী সেই চেতনার উচ্চারণ, যা নিঃশব্দ শিবকে ধ্বনিতে রূপ দেয়।

চতুর্থ ধাপে চেতনা প্রবেশ করে নিজের গভীরে, হয়ে ওঠে গুহ্যকালী। “গুহ্য” মানে লুকানো; এখানে চেতনা নিজের প্রকাশকে সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করে নিজের মধ্যে সঞ্চিত করে রাখে। এটি সেই গর্ভাবস্থা, যেখানে সম্ভাবনা সঞ্চিত থাকে কিন্তু এখনো উদ্ঘাটিত হয়নি—চেতনার নিঃশব্দ গর্ভ।

এরপর আসে তাম্রকালী—এখানে চেতনা দীপ্তি লাভ করে। “তাম্র” মানে তেজস্বিতা বা উজ্জ্বলতা। এখন চেতনা নিজের ভেতর থেকে বাইরে বিকিরণ শুরু করে—শব্দ, রূপ, ভাব, ইন্দ্রিয়, অভিজ্ঞতা—সবই তার অন্তর্গত শক্তির তরঙ্গ। এটি প্রকাশ (prakāśa)-এর পূর্ণ বিকাশ, যেখানে চেতনা নিজের আলোয় মহাবিশ্বকে উদ্‌ভাসিত করে।

ষষ্ঠ স্তরে চেতনা হয় কালিকা। এখানে সে সময়ের ছন্দে নিজের প্রকাশ ঘটায়। “কাল” মানে সময়, আর “কালিকা” সেই সময়ের গতি, যেখানে সৃষ্টি ও বিলয় একসঙ্গে ঘটছে। চেতনা এখন সময়ের স্রোতে নৃত্যরত, কিন্তু তার নৃত্যকেন্দ্রে আছে এক অনন্ত স্থিরতা—এটাই কালিকার রহস্য।

এরপর আসে মহাকালী—যেখানে চেতনা সমস্ত সীমা ভেঙে অসীমতায় প্রসারিত হয়। এখন সে কেবল একটি সত্তা নয়, সমগ্র অস্তিত্বের মূলে বিরাজমান এক সর্বশক্তি। মহাকালীর স্তরে জ্ঞান, ইচ্ছা ও ক্রিয়া একাকার হয়ে যায়; চেতনা নিজেই হয়ে ওঠে সৃষ্টির কেন্দ্র ও প্রান্ত উভয়।

অষ্টম ধাপে চেতনা রূপ নেয় রক্তকালী। “রক্ত” মানে প্রাণ বা জীবনীশক্তি। এখন চেতনা নিজের প্রকাশে মগ্ন, নিজের সৃষ্টির উন্মত্ততায় নিমগ্ন। সে জীবনকে রক্তের মতো প্রবাহিত করে; সে আনন্দে কাঁপছে, রূপান্তরে উল্লাসিত। রক্তকালী চেতনার উচ্ছ্বাস, জীবনের পরিপূর্ণ কম্পন।

নবম স্তরে চেতনা হয়ে ওঠে সিদ্ধকালী। এখন সে জানে—সবই তারই খেলা। সে আর বিভ্রান্ত নয়, বরং আত্মজ্ঞান লাভ করেছে। এখানে জন্ম নেয় প্রত্যভিজ্ঞান—নিজেকে পুনরায় চিনে ফেলা। সিদ্ধকালী সেই চেতনার দেবী, যিনি জানার সমস্ত প্রক্রিয়া অতিক্রম করে জানার মূল উৎসে পৌঁছে যান।

এরপর আসে মর্ত্যকালী—এখানে চেতনা মৃত্যু ও ক্ষয়কে অতিক্রম করে। “মর্ত্য” মানে ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু এই স্তরে চেতনা বুঝে ফেলে যে, ক্ষণস্থায়িতার ভেতরেই নিত্যতা নিহিত। মৃত্যু তার কাছে আর সমাপ্তি নয়, বরং আত্ম-চেতনার এক গভীর রূপান্তর।

একাদশ ধাপে চেতনা রূপান্তরিত হয় সিদ্ধঅঘকালী রূপে। এখন সব বিপরীত একে অপরের মধ্যে দ্রবীভূত—সৃষ্টি ও লয়, শিব ও শক্তি, জ্ঞান ও কর্ম। এটি সেই অবস্থান, যেখানে চেতনা নিজেকে দেখে, জানে, এবং নিজের মধ্যে পরিপূর্ণ হয়। এটি Camatkāra, চেতনার নিজেরই উপস্থিতিতে মুগ্ধ হয়ে ওঠার বিস্ময়।

“সিদ্ধঅঘ (Siddhaugha)” শব্দটি কাশ্মীর শৈব দর্শনের ক্রমতত্ত্বে (Krama Doctrine) ব্যবহৃত একটি তান্ত্রিক সংযোজিত পরিভাষা, যা দুটি মূল উপাদান থেকে গঠিত—‘সিদ্ধ’ এবং ‘অঘ’ (Agha)। ‘সিদ্ধ’ মানে সিদ্ধ, পূর্ণ, সিদ্ধিলাভী বা সম্পূর্ণ আত্মজ্ঞানপ্রাপ্ত; আর ‘অঘ’ মানে ‘অশুভ নয়’, অর্থাৎ যা সমস্ত সীমা ও দ্বৈততার ঊর্ধ্বে, যা সব রূপ, ধর্ম, ভালো-মন্দ, পুণ্য-পাপের ভেদকে অতিক্রম করেছে। শৈব তন্ত্রে “অঘ” বা “অঘোর” শব্দটি শিবের এক বিশেষ দিককে বোঝায়—যিনি সর্ববিধ বৈপরীত্যের ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন, যাঁর চেতনা সমস্ত বিপরীত শক্তিকে একত্র করে এক অখণ্ড ঐক্যে রূপান্তরিত করে।

“সিদ্ধঅঘ” মানে সেই চেতনা, যিনি সম্পূর্ণ সিদ্ধ, কিন্তু সেই সিদ্ধতা কোনো একপাক্ষিক বা নিষ্ক্রিয় অবস্থা নয়; এটি এমন এক মুক্ত অবস্থা যেখানে সমস্ত বিপরীত—শুভ-অশুভ, সৃষ্টি-লয়, আনন্দ-বেদনা—সব এক চেতনার মধ্যেই একত্রিত ও লীন। এই স্তরে চেতনা আর কিছু প্রত্যাখ্যান করে না, কিছু গ্রহণও করে না; সে প্রত্যেক অভিজ্ঞতাকে নিজেরই রূপে চিনে নেয়।

কাশ্মীর শৈব ক্রমপন্থার পরিভাষায়, সিদ্ধঅঘকালী সেই চেতনার প্রতীক, যিনি পরম ঐক্যের মধ্যে অবস্থান করেন—যেখানে সৃষ্টির সব দ্বন্দ্ব মিলিত হয়েছে, এবং চেতনা এখন নিজেরই পূর্ণ স্বরূপে আত্মভোগে মগ্ন। এই অবস্থায় শিব ও শক্তি, প্রকাশ ও বিমর্শ, জানা ও জানন—সব এক হয়ে যায়। এটি “চৈতন্যময় বিস্ময় (Camatkāra)”-এর চূড়ান্ত পর্যায়, যেখানে চেতনা নিজের উপস্থিতিতেই মুগ্ধ, নিজের পূর্ণতাতেই সিদ্ধ।

সিদ্ধঅঘ তাই—“অদ্বৈত সিদ্ধ চেতনা”—যিনি সম্পূর্ণ আত্মজ্ঞানপ্রাপ্ত, এবং যাঁর মধ্যে সব বিপরীত, সব সৃষ্টিশক্তি, সব রূপ ও সব সময় এক হয়ে গেছে। এই অবস্থাই চেতনার আত্মভোগ, যেখানে সে জানে—“আমি সব কিছু, আর সব কিছুই আমার মধ্যে।”

সবশেষে দ্বাদশ স্তরে প্রকাশিত হন কালাসঙ্কর্ষিনী—যিনি সমস্ত সময়, স্থান ও অভিজ্ঞতাকে নিজের মধ্যে টেনে নেন। এখন চেতনা ফিরে আসে নিজের মূল অবস্থায়—নির্গুণ, নিরাকার, কিন্তু পূর্ণ। এখানে আর কোনো গতি নেই, কোনো বিভাজন নেই, কোনো দ্বন্দ্ব নেই—কেবল অবিভক্ত চৈতন্য। সব কাল, সব রূপ, সব ধ্বনি লীন হয়ে যায় এক পরম নীরবতায়।

এইভাবে দ্বাদশ কালীর তত্ত্ব আসলে এক অস্তিত্বচক্রের উপাখ্যান—চেতনা নিজের থেকেই শুরু করে, নিজের মধ্য দিয়েই চলে, এবং নিজের মধ্যেই লীন হয়। এখানে সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় কোনো আলাদা ঘটনা নয়; সবই চেতনার নিত্য নৃত্য, তারই আত্মভোগ। প্রতিটি কালী সেই চেতনার এক একটি রূপ—একটি ছন্দ, একটি কম্পন, একটি উদ্‌ভাস। সাধক এই বারো স্তর অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যায় সেই পরম শিবচেতনার নিত্য পূর্ণতায়, যেখানে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না—শুধু এক অখণ্ড সত্য, চেতনার চিরন্তন নীরব দীপ্তি।

Krama পথ—অভিজ্ঞতামূলক অদ্বৈত: অভিনবগুপ্তের মতে, বেদান্ত যেখানে জ্ঞানকে মুক্তির একমাত্র উপায় বলে, সেখানে Krama তন্ত্র সেই জ্ঞানকে অভিজ্ঞতায় পরিণত করে। তিনি বলেন, জ্ঞান যদি কেবল বুদ্ধিগত থাকে, তবে তা সীমিত; কিন্তু যখন জ্ঞান নিজেই চেতনার অভ্যন্তর থেকে ফেটে ওঠে—যেখানে জানার বিষয়, জানন, ও জানা একাকার হয়ে যায়—তখন সেটিই প্রকৃত মুক্তি। এইজন্য তিনি Krama-কে বলেন “প্রত্যভিজ্ঞা-সিদ্ধান্ত-প্রয়োগঃ”—"প্রত্যভিজ্ঞা (স্ব-স্বরূপকে স্বীকৃতি) সিদ্ধান্তের ব্যাবহারিক প্রয়োগ (বা অনুশীলন)।" অর্থাৎ প্রত্যভিজ্ঞান তত্ত্বের জীবন্ত প্রয়োগ।

এই শব্দগুচ্ছটি কাশ্মীর শৈবধর্মের প্রত্যভিজ্ঞা (Pratyabhijñā) শাখার ব্যাবহারিক দিককে নির্দেশ করে—প্রত্যভিজ্ঞা (Pratyabhijñā): স্বীকৃতি বা আত্ম-উপলব্ধি ("আমিই শিব")। সিদ্ধান্ত (Siddhānta): স্থিরীকৃত মতবাদ বা দার্শনিক মত। প্রয়োগঃ (Prayogaḥ): প্রয়োগ, অভ্যাস বা ব্যাবহারিক অনুশীলন।

কাশ্মীর শৈবধর্ম কেবল দার্শনিক তত্ত্ব (সিদ্ধান্ত) দিয়ে থেমে থাকে না, বরং সেই জ্ঞানকে জীবনের প্রতিমুহূর্তে সক্রিয়ভাবে প্রয়োগ করার উপর জোর দেয়। এই প্রয়োগের মাধ্যমে জীবাত্মা তার অন্তর্নিহিত শিব-স্বরূপ বা অসীম চৈতন্যকে সচেতনভাবে স্বীকৃতি দেয় এবং বন্ধন থেকে মুক্ত লাভ করে।

এখানে প্রত্যভিজ্ঞান (Pratyabhijñā) মানে ‘নিজেকে পুনরায় চেনা’। উৎপলদেবের ঈশ্বর-প্রত্যভিজ্ঞা-কারিকা গ্রন্থের সূত্রে, “জ্ঞান মানে স্মরণ”—আমরা শিবচেতনা, কিন্তু তা ভুলে গেছি; Krama পথ সেই ভুলে যাওয়া চেতনার পুনঃস্মরণ প্রক্রিয়া, ধাপে ধাপে, অনুভব থেকে অনুভবে, মুহূর্ত থেকে মুহূর্তে। এর মর্মার্থ কাশ্মীর শৈব দর্শনের মূল শব্দ ‘প্রত্যভিজ্ঞা’ (Pratyabhijñā)-তেই নিহিত। এই শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এটি তিনটি অংশে গঠিত—প্রতি (Prati) অর্থাৎ ‘পুনরায়’ বা ‘ফিরে যাওয়া’, অভি (Abhi) অর্থাৎ ‘ঘনিষ্ঠভাবে’, এবং জ্ঞা (Jñā) অর্থাৎ ‘জানা’। ফলে ‘প্রত্যভিজ্ঞা’ মানে “পুনরায় জানা”, “পুনরায় চেনা” বা “Re-cognition”—যেখানে জ্ঞান মানে নতুন কিছু আবিষ্কার নয়, বরং পূর্বে জানা সত্যকে আবার স্মরণ করা, নিজের মধ্যেই ফিরে পাওয়া।

কাশ্মীর শৈব দর্শনের মতে, জীবাত্মা আসলে পরমশিবেরই চেতনার প্রকাশ—কিন্তু মায়া বা অবিদ্যার কারণে সে নিজের প্রকৃত স্বরূপকে ভুলে যায়। এই বিস্মৃতি থেকেই সমস্ত সীমাবদ্ধতা, দুঃখ ও জন্ম-মৃত্যুর চক্রের সৃষ্টি। সাধনার উদ্দেশ্য তাই নতুন কোনো জ্ঞান আহরণ নয়; বরং এই বিস্মৃত আত্মস্বরূপকে পুনরায় স্মরণ করা, নিজের মধ্যেই সেই শিবচেতনার উজ্জ্বলতা চিনে ফেলা। যখন কোনো সাধক শাস্ত্র, ধ্যান বা সদ্গুরুর কৃপায় এই স্মরণ জাগিয়ে তোলে—যখন সে হৃদয়ের গভীরে উপলব্ধি করে “অহম্ শিবঃ”—“আমিই সেই শিব”—তখনই মায়ার মোহ ভঙ্গ হয়, এবং তার মধ্য দিয়ে চেতনার পূর্ণ জাগরণ ঘটে।

এইজন্যই কাশ্মীর শৈব তত্ত্বে জ্ঞানকে বলা হয় “স্মরণাত্মক জ্ঞান”—যা নতুন কিছু শেখা নয়, বরং যা চিরকাল জানা ছিল, তারই স্বীকৃতি। এই দর্শনের ভাষায় মুক্তি (মোক্ষ) মানে কোনো নতুন অর্জন নয়; বরং নিজের প্রকৃত স্বরূপের পুনরুদ্ধার। উৎপলদেবের গুরু সোমানন্দের পরম্পরায় এই কথাটিই ধ্বনিত হয়েছে বিখ্যাত সূত্রে—“মোক্ষো হি নাম নৈবান্যঃ স্বরূপ-প্রাপ্তিস্তু ততঃ।” অর্থাৎ, “মুক্তি আর অন্য কিছু নয়, তা কেবল নিজের স্বরূপে ফিরে আসা, বিস্মৃত আত্মাকে পুনরায় চেনা।”