যখন চিন্তা ও মনন উভয়ই শেষ হয়ে যায়, তখন সাধক প্রবেশ করে শাম্ভবোপায়ে—যা তিনটির মধ্যে সর্বোচ্চ এবং দ্রুততম পথ। “শাম্ভব” এসেছে “শম্ভু” শব্দ থেকে, যার অর্থ শিব—অর্থাৎ, এটি শিবেরই পথ, শিবের দিকে সরাসরি যাত্রা। শাম্ভবোপায়ে কোনো ধ্যান, মন্ত্র, যোগচর্চা বা কল্পনার প্রয়োজন হয় না। এখানে মুক্তি ঘটে ইচ্ছাশক্তির এক স্বতঃস্ফূর্ত ঝলকে—চেতনার নিজস্ব উদ্যমে। শিবসূত্রে বলা হয়েছে—“উদ্যমো ভৈরবহ্”—চেতনার আকস্মিক উদ্যমই ভৈরব। এই ‘উদ্যম’ কোনো বাহ্যিক প্রচেষ্টা নয়; এটি অন্তরচেতনার এক স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণ, যেখানে সাধক আকস্মিকভাবে উপলব্ধি করে—“আমি সেই চেতনা, আমি সেই পরমশিব।” এটি এমন এক অভিজ্ঞতা, যেমন অন্ধকার ঘরে হঠাৎ আলো জ্বলে ওঠে—কোনো প্রস্তুতি নেই, কোনো ধাপ নেই; কেবল এক মুহূর্তের ইচ্ছা-স্পন্দন, আর সেই স্পন্দনেই পরম সত্যের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি। এখানে চিন্তা ও কর্ম উভয়ই লুপ্ত হয়, কেবল চেতনার স্বয়ংপ্রকাশ থাকে। এটি শাম্ভবোপায়ের মূল কথা—সর্বোচ্চ স্তরে, মুক্তি হলো কোনো ক্রিয়া নয়, বরং চেতনার একটি স্বতঃস্ফূর্ত স্বীকৃতি (প্রত্যভিজ্ঞা)।
এই তিন উপায়—আণবোপায়, শাক্তোপায় ও শাম্ভবোপায়—আসলে তিনটি পৃথক পথ নয়; এগুলি একই চেতনার তিনটি ক্রমবিকাশ। অভিনবগুপ্ত তাঁর তন্ত্রালোক-এ লিখেছেন—“ত্রয়োঽপি ভৈরবো’পায়াঃ শরীরস্যৈব ভেদতঃ”—তিনটি ভৈরবোপায়ও (শিবকে উপলব্ধির পথ) কেবল শরীরের (বা চেতনার) ভেদের (পার্থক্যের) কারণেই [আলাদাভাবে দেখা যায়]। এই সূত্রটি কাশ্মীর শৈবধর্মের তিনটি প্রধান উপায়—আণবোপায়, শাক্তোপায় ও শাম্ভবোপায়—এর মধ্যেকার সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে।
তিনটি উপায়, একটিই লক্ষ্য: এই তিনটি পথকে যদিও ভিন্ন মনে হয়, আসলে তারা চরম বাস্তবতা ভৈরব (পরমশিব)-কে উপলব্ধির জন্যই নির্ধারিত। এই ভেদাভেদ বা পার্থক্যগুলি সৃষ্ট হয়েছে সাধকের চেতনার স্তরের ভিন্নতা বা শরীরের উপাধির (দেহ, মন, বুদ্ধি) কারণে। যে-সাধক স্থূল শরীরের স্তরে আছেন, তাঁর জন্য আণবোপায়; যিনি মনের স্তরে আছেন, তাঁর জন্য শাক্তোপায়; আর যিনি বিশুদ্ধ ইচ্ছাশক্তির স্তরে আছেন, তাঁর জন্য শাম্ভবোপায়। এই শ্লোকটি বোঝায় যে, মোক্ষের পথ মূলত এক, কিন্তু সাধকের মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতির ভিন্নতার কারণেই পথে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়।
এই তিন উপায় একই পরমচেতনার ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ মাত্র। আণবোপায় শরীর ও মনের শুদ্ধি ঘটায়, শাক্তোপায় চিন্তার জগৎকে পরিশুদ্ধ করে, আর শাম্ভবোপায় সমস্ত ভেদকে লঙ্ঘন করে চেতনার নিঃশব্দ দীপ্তিতে স্থিত করে। প্রথমটি প্রস্তুতি, দ্বিতীয়টি উপলব্ধি, তৃতীয়টি সেই উপলব্ধির তাৎক্ষণিক দীপ্তি। ক্রিয়া-শক্তি, জ্ঞান-শক্তি এবং ইচ্ছা-শক্তি—এই ত্রিশক্তির সংহতিই মুক্তির পূর্ণ পরিণতি।
এভাবে দেখা যায়, আণবোপায় সীমিত জীবের দেহ-মন নিয়ন্ত্রণের ধীর পদ্ধতি, শাক্তোপায় বুদ্ধি ও জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে অন্তর উপলব্ধি, আর শাম্ভবোপায় ইচ্ছাশক্তির এক স্বতঃস্ফূর্ত ঝলকে পরমশিবের প্রত্যক্ষ স্বীকৃতি। এই তিনটি উপায়ের সংহতিই কাশ্মীর শৈবধর্মের মুক্তিদর্শনের মূল। যখন সাধক আণবিক সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে চিন্তাময় স্তরেও অনাসক্ত থাকে এবং ইচ্ছাশক্তির স্বতঃস্ফূর্ত স্রোতে নিজেকে বিলিয়ে দেয়, তখন সে উপলব্ধি করে—“নাহং দেহঃ, নাহং চিন্তা; চিন্তাময়োঽহম্”—"আমি এই দেহ নই, আমি এই (ক্ষণস্থায়ী) চিন্তা নই; আমি হলাম চৈতন্যময় (জ্ঞানস্বরূপ)।" আমি সেই চেতনা, যেখানে চিন্তা ও কর্ম উভয়ই বিলীন—এই অবস্থাই সত্য ভৈরবত্ব—শিবভাবের পূর্ণ অভিজ্ঞতা—যেখানে জানা, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় সব এক চিরন্তন চেতনার অনন্ত আলোর মধ্যে লীন।
এই বাক্যটি হলো অদ্বৈত বেদান্ত এবং আত্ম-অনুসন্ধানের (Self-Inquiry) দর্শনের একটি গভীর সারাংশ। এটি সরাসরি কোনো শাস্ত্রীয় শ্লোক না হলেও, এটি আত্মার স্বরূপ বর্ণনা করে। বাক্যটি তিনটি ভাগে বিভক্ত, যা আত্মার স্বরূপ থেকে অনাত্মাকে পৃথক করে:
নাহং দেহঃ (আমি দেহ নই): এটি অনাত্মা (দেহ) থেকে নিজেকে পৃথক করার প্রথম ধাপ। আত্মা শরীর, জন্ম-মৃত্যু বা বিকারের অধীন নয়।
নাহং চিন্তা (আমি চিন্তা নই): এটি মন (চিন্তা) থেকে নিজেকে পৃথক করা। আত্মা হলো মনের কার্যকলাপের সাক্ষী (দ্রষ্টা), কিন্তু চিন্তা বা মন নয়।
চিন্তাময়োঽহম্ (আমি চৈতন্যময় বা জ্ঞানময়):এটি আত্মার স্বরূপের ঘোষণা। 'চিন্তাময়' এখানে জ্ঞানস্বরূপ (Consciousness) অর্থে ব্যবহৃত—অর্থাৎ, আমি বিশুদ্ধ চৈতন্য বা জ্ঞান-আধার।
এই উক্তিটি হলো আত্ম-বিচারের (Self-Inquiry) মূল প্রক্রিয়া, যা রমণ মহর্ষির 'আমি কে?' (Who am I?) অনুসন্ধানের সঙ্গে যুক্ত। এর লক্ষ্য হলো অহংকার এবং অধ্যাস (ভ্রান্ত আরোপ) দূর করে জীবাত্মাকে তার বিশুদ্ধ চৈতন্যময় স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত করা।
অদ্বৈত বেদান্তে ব্রহ্মকে নিস্ক্রিয়, অব্যক্ত সত্য হিসেবে দেখা হয়, জগৎকে মায়া বলা হয়। কিন্তু কাশ্মীর শৈব দর্শনে, পরমশিব একই সঙ্গে শিব ও শক্তি—জগৎ কোনো বিভ্রম নয়, বরং সেই চেতনারই স্পন্দন, এক স্বতঃস্ফূর্ত লীলা (Vilāsa)। তাই এখানে মায়া আচ্ছাদন নয়, বরং সৃজনের প্রকাশ।
যখন এই চেতনার উপলব্ধি ঘটে, তখন আর কোনো বিভেদ থাকে না। ভালো-মন্দ, সৃষ্টি-লয়, শুদ্ধ-অশুদ্ধ—সবই এক অনন্ত চেতনার ভিন্ন ভিন্ন কম্পনমাত্র। সেই অবস্থায় জীব বুঝে যায়—“আমি দেহ নই, মন নই; আমি সেই পরমশিব, যিনি নিজেই জ্ঞান, জ্ঞেয় ও জ্ঞাতা।”
এই উপলব্ধিই মুক্তি—কোনো ভবিষ্যৎ ফল নয়, বরং বর্তমানেই জাগ্রত চৈতন্যের সত্য। সেই অবস্থায় সমস্ত অনুসন্ধান থেমে যায়, সমস্ত দ্বন্দ্ব বিলীন হয়, এবং আত্মা উচ্চারণ করে—“শিবোহম্—আমি সেই এক, চিরন্তন, অদ্বিতীয় চেতনা—পরমশিব।”
“শিবোহম্” (Śivoham)—এই সংক্ষিপ্ত অথচ সর্বব্যাপী মন্ত্রটি অদ্বৈত বেদান্ত ও কাশ্মীর শৈব দর্শনের সারসত্যকে এক বিন্দুতে সঙ্কলিত করে। এটি কেবল উচ্চারণের একটি শব্দ নয়, বরং আত্মা ও পরমাত্মার অভিন্নতার প্রত্যক্ষ উপলব্ধি—এক অন্তর্দৃষ্টিগত প্রজ্ঞা (Pratyabhijñā), যার মাধ্যমে মানুষ নিজের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে নিজের চিরন্তন শিবত্বে জাগ্রত হয়।
“শিবোহম্”—দুটি সংস্কৃত পদের সমন্বয়ে গঠিত: শিব (Śiva) অর্থাৎ কল্যাণ, চিরচেতনা, নিঃশর্ত পূর্ণতা; এবং অহম্ (Aham) অর্থাৎ আমি—ব্যক্তিগত অস্তিত্বের স্বীকৃতি। এই দুই শব্দের মিলনে প্রকাশ পায় এক অতীতাত্মক সত্য—প্রত্যভিজ্ঞায় জাগরণ—“আমিই সেই শিব”—অর্থাৎ, আমার আত্মা আর পরমশিবের মধ্যে কোনো ভেদ নেই।
এই ঘোষণা নিছক এক ভাববাদী ধ্বনি নয়; এটি হলো চেতনার অন্তর্নিহিত সনাক্তি (Intrinsic Identity of Consciousness), যেখানে ব্যক্তি নিজের মধ্যেই আবিষ্কার করে মহাজাগতিক সত্তাকে। এটি হচ্ছে চেতনার সেই মৌলিক এবং অপরিবর্তনীয় স্বরূপ, যা বাহ্যিক অভিজ্ঞতা, চিন্তা বা উপাধির (যেমন দেহ, মন, সামাজিক ভূমিকা) পরিবর্তন সত্ত্বেও সর্বদা একই থাকে এবং যা হলো তার প্রকৃত পরিচয়। এই ধারণার দুটি প্রধান দিক রয়েছে:
১. অন্তর্নিহিত (Intrinsic): সনাক্তিটি বাইরে থেকে অর্জিত বা চাপানো নয়। এটি চেতনার নিজের মধ্যেই (Inherent) বিদ্যমান এবং এটিই তার মৌলিক প্রকৃতি।
2. সনাক্তি (Identity): এটি হলো 'আমি কে?' এই প্রশ্নের চূড়ান্ত উত্তর। এটি আমাদের সেই জ্ঞান দেয় যে, আমি আমার ক্ষণস্থায়ী চিন্তা, আবেগ বা শরীর নই; আমি হলাম সেই স্থির, বিশুদ্ধ দ্রষ্টা (সাক্ষী)।
অদ্বৈত বেদান্তে এই সনাক্তিটি হলো আত্মা বা ব্রহ্মের সঙ্গে একত্ব। চেতনার অন্তর্নিহিত সনাক্তি হলো 'সৎ-চিৎ-আনন্দ' বা 'চৈতন্যম্ আত্মা' (শিবসূত্র ১.১)। এই সনাক্তিই প্রমাণ করে যে, জীব এবং ব্রহ্ম অভিন্ন। কাশ্মীর শৈবধর্মে এটি হলো স্ব-স্বরূপ বা শিব-স্বরূপ। এই সনাক্তিকে স্বীকৃতি দেওয়াই হলো প্রত্যভিজ্ঞা। চেতনার অন্তর্নিহিত সনাক্তি হলো সেই অপরিবর্তনীয় 'আমি', যা অজাত, অচল, ও নির্ভ্রান্ত চেতনা, এবং যা সমস্ত জাগতিক বন্ধনের ঊর্ধ্বে নিত্য-মুক্ত।
বেদান্তে এই অভিজ্ঞতা হলো “অহং ব্রহ্মাস্মি” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ১.৪.১০)—“আমি ব্রহ্ম”—এর সমার্থক; আর কাশ্মীর শৈব দর্শনে এটি “প্রত্যভিজ্ঞা” বা “স্ব-চৈতন্যের পুনরাভিষেক”—যেখানে জীব উপলব্ধি করে যে, সে কখনও শিব থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না।
দার্শনিক দৃষ্টিতে, “শিবোহম্” মানে চেতনার সেই অভিন্ন ঐক্য, যেখানে ব্যক্তিগত চৈতন্য (jīva-caitanya) এবং সর্বজনীন চৈতন্য (śiva-caitanya) অবিভাজ্য। এই অবস্থায় কোনো ভেদ থাকে না—কর্তা-ভোক্তা, কারণ-কার্য, জীবন-মৃত্যু—সব দ্বন্দ্ব মিলিয়ে যায় এক অখণ্ড নীরবতায়। সাধক তখন উপলব্ধি করেন যে, তাঁর দেহ, মন, ইন্দ্রিয়, এমনকি চিন্তাও কেবল উপাধি; প্রকৃত ‘আমি’ সেই চিরসাক্ষী চেতনা, যা কখনও জন্মে না, মরে না, পরিবর্তিত হয় না।
কাশ্মীর শৈবদর্শনের ভাষায়, এই উপলব্ধিই হলো “চৈতন্যম্ আত্মা” (Śiva Sūtra 1.1) সূত্রের জীবন্ত প্রতিফলন। এখানে “চৈতন্য”—অর্থাৎ আত্ম-আলোকিত সত্তা—নিজেকে “অহম্” রূপে অনুভব করে, আর সেই অনুভবের গভীরে আবিষ্কার করে নিজের অসীমতা। যখন সাধক এই জ্ঞানকে শুধু বুদ্ধিতে নয়, অন্তরের অভিজ্ঞতায় ধারণ করেন, তখন তাঁর সমস্ত অবিদ্যা—“আমি দেহ”, “আমি মন”, “আমি কর্তা”—এই সমস্ত ভ্রম স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিলীন হয়।
তখন “শিবোহম্” উচ্চারণ আর একটি বাক্য থাকে না; এটি হয়ে ওঠে এক স্থিতি (avasthā)—যোগারূঢ় হওয়া—অর্থাৎ, মনকে সমস্ত চাঞ্চল্য থেকে বিরত করে আত্মাতে স্থির করে রাখা। এই স্থিরতাই হলো চেতনার উচ্চতর স্থিতি। এ এক জীবন্ত চেতনা। সেই অবস্থায় সমস্ত ভয়, আকাঙ্ক্ষা ও দ্বৈততা নিঃশেষে মুছে যায়; থাকে কেবল সেই অখণ্ড চিদানন্দ, যেখানে শিব আর “আমি” এক অবিভাজ্য তরঙ্গে মিলিত।
এ কারণেই, “শিবোহম্” কোনো দেবতার আহ্বান নয়, বরং আত্মার স্বীকৃতি—এক আত্মনিবেদিত জাগরণ, যা ঘোষণা করে: “আমি শিব—আমি সেই চিরন্তন চেতনা, যার মধ্যে সমগ্র বিশ্ব উদ্ভাসিত।”
শূন্যতা শিবের অব্যক্ত ও অচঞ্চল দিক, যা তাঁর দ্বৈত উন্মোচন—প্রকাশ (Prakāśa) ও বিমর্শ (Vimarśa)—উভয়ের ঊর্ধ্বে অবস্থান করে। প্রকাশ হলো জ্ঞানের আলো, বিমর্শ হলো সেই আলোর আত্ম-চেতনা; এই দুইয়ের স্পন্দনে বিশ্ব প্রকাশিত হয়। কিন্তু এই গতিময় প্রকাশের গভীরে থাকে এক অচল নীরবতা—যেখানে চেতনা নিজেই নিজের সাক্ষী। অভিনবগুপ্ত ‘তন্ত্রালোক’-এ এই শূন্যতাকে বলেন চিদাকাশ (Cit-Ākāśa)—চেতনার অসীম আকাশ, যা সমস্ত রূপকে ধারণ করে অথচ নিজে রূপহীন। সেখানে কোনো গতি নেই, কোনো ভাব নেই, কেবল এক চিরন্তন উপস্থিতি—যা সমস্ত অভিজ্ঞতার মূলে নীরবভাবে জেগে থাকে।
তন্ত্রালোক-এর প্রথম আহ্নিক, যেখানে শাম্ভবোপায় (শিবের পথ) বর্ণনা করা হয়েছে, সেখানে পরমশিব-এর স্বরূপের কথা বলতে গিয়ে এই অসীম চেতনার গর্ভের কথা বলা হয়েছে: "সেই পরমশিবের (ভৈরবের) স্বরূপ হলো চিদাকাশ, যা হলো অসীম প্রকাশ (Prakāśa) এবং বিমর্শ (Vimarśa) শক্তির মিলনক্ষেত্র।"
এটি হলো চেতনার অসীম স্থান বা আকাশ, যা স্থান বা কালের দ্বারা সীমিত নয়। এটি হলো সেইশাশ্বত আধার (Substratum), যা সব কিছুকে ধারণ করে। অভিনবগুপ্তের মতে, এই চিদাকাশই হলো শূন্যতা। কিন্তু এই শূন্যতা কোনো অভাব বা অনস্তিত্ব (যেমন বৌদ্ধ মাধ্যমিক মতের শূন্যতা) নয়, বরং এটি হলো—সম্ভাবনার গর্ভ—সেই 'পূর্ণ নীরবতা' (Plenum of Consciousness), যেখানে সমস্ত নাম-রূপ বিলীন থাকে। এই বিলীন অবস্থা থেকেই আবার সমস্ত সৃষ্টি উন্মোচিত (manifested) হতে পারে। এই শূন্যতাই হলো অদ্বৈত চেতনা—যেখানে কোনো দ্বৈততা বা ভেদাভেদ নেই।
শৈব দর্শনের এই শূন্যতা বৌদ্ধ শূন্যতার (Śūnyavāda) থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বৌদ্ধ মধ্য্যমক মত বলে—সব কিছু অনিত্য, পারস্পরিকভাবে নির্ভরশীল এবং স্বভাবশূন্য; তাই অস্তিত্ব মানেই সম্পর্কের জাল, কোনো অন্তর্নিহিত সত্তা নয়। কিন্তু শৈব ত্রিক মতে, শূন্যতা কোনো অনস্তিত্ব নয়, বরং চেতনার নিখাদ পূর্ণতা, যেখানে সব উপাধি ও সীমা লুপ্ত হয়েছে। চেতনা নিজেই বাস্তবতা, এবং শূন্যতা হলো সেই চেতনার অনন্ত নীরব দীপ্তি।