অবিদ্যা-বিদ্যা: ৮৯



কাশ্মীর শৈব দর্শনের সূক্ষ্মতম ও গভীরতম প্রকাশ পাওয়া যায় শিবসূত্র (Śiva Sūtra)-এ, যা এই পরম্পরার মৌলিক শাস্ত্র হিসেবে বিবেচিত। নবম শতাব্দীতে আচার্য বসুগুপ্ত এই সূত্রসমূহ প্রকাশ করেন, যা স্বয়ং শিবের “আত্মোদ্ঘাটিত জ্ঞান” হিসেবে পরিগণিত। প্রতিটি সূত্র এক-একটি দার্শনিক বিস্ফোরণ, যা আত্মা ও চেতনার অভিন্নতাকে অভিজ্ঞতায় রূপান্তরিত করে।

প্রথম সূত্র—“চৈতন্যম্ আত্মা।” (Caitanyam Ātmā, Śiva Sūtra 1.1)—কাশ্মীর শৈববাদের মূল ঘোষণা। এর অর্থ, “চৈতন্যই আত্মা”, বা চেতনা নিজেই আত্মার প্রকৃতি। এটি শুধু এক দার্শনিক উক্তি নয়, বরং এক গভীর আধ্যাত্মিক উপলব্ধি।

বসুগুপ্ত এখানে বলেন যে, জীবাত্মা কোনো মন, বুদ্ধি বা দেহসীমাবদ্ধ সত্তা নয়; তার প্রকৃত রূপ অসীম, স্বয়ং-প্রকাশিত চেতনা। এই চেতনা-চিদানন্দ পরমশিবেরই প্রতিফলন। ব্যক্তির অন্তর্নিহিত আত্মা (microcosm) এবং বিশ্বজনীন চেতনা বা পরমশিব (macrocosm) একই বাস্তবতার দুই অভিব্যক্তি। শিবসূত্র তাই একেবারে শুরুতেই দ্বৈততার ভিত্তি ভেঙে দেয়—জীব ও ঈশ্বরের কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই; পার্থক্য কেবল সীমাবদ্ধ দৃষ্টির কারণে।

এই সূত্রেই মুক্তির নীতি নিহিত। মুক্তি কোনো নতুন অবস্থা নয়, কোনো অনুপস্থিত বাস্তবতা অর্জনের প্রক্রিয়া নয়—এটি কেবল নিজের মধ্যের চেতনার স্বরূপকে স্বীকৃতি দেওয়া, অর্থাৎ প্রত্যভিজ্ঞা। যখন অনুসন্ধানকারী উপলব্ধি করে যে, তার চৈতন্যই পরমশিবের চৈতন্য, তখন বন্ধন বিলীন হয়।

শিবসূত্রের (১.৫) সূত্র—“উদ্যমো ভৈরবঃ।” (Udyamo Bhairavaḥ)—এই চৈতন্যের গতিশীল স্বরূপকে প্রকাশ করে। এখানে “উদ্যম” মানে কেবল মানসিক চেষ্টা নয়, বরং সেই চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত, প্রথম স্ফুরণ, যা চিন্তা বা সংকল্পের আগের স্তরে উদ্ভূত হয়। এটি চেতনার অন্তর্গত স্পন্দন, সেই প্রথম তরঙ্গ, যা শূন্য নীরবতা থেকে প্রকাশের দিকে গতি পায়। এই উদ্যমই “ভৈরব”—অর্থাৎ পরমশিবের জীবন্ত, সৃষ্টিশীল দিক।

“ভৈরব” শব্দটি ধ্বংস বা ভয়ের দেবতা নয়, বরং সেই সত্তা, যিনি ভয়কে দূর করেন—যিনি সীমা, অন্ধকার ও ভ্রমের পারাপার ঘটান। তাই “উদ্যমো ভৈরবঃ” অর্থ দাঁড়ায়—চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত উন্মীলনই পরমশিব। সাধকের কোনো ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টার প্রয়োজন নেই; যখন চেতনা নিজেই নিজের মধ্যে জেগে ওঠে, তখনই ভৈরব প্রকাশিত হন।

কাশ্মীর শৈব দর্শনের তিনটি পথ বা উপায়—শাম্ভবোপায়, শাক্তোপায়, ও আণবোপায়—এর মধ্যে এই সূত্রটি শাম্ভবোপায়ের প্রতিনিধিত্ব করে। এখানে মুক্তি আসে কোনো ক্রিয়ার মাধ্যমে নয়, বরং সেই নিঃশব্দ মুহূর্তে, যখন চেতনা নিজের উৎসে জেগে ওঠে। এই “উদ্যম” হলো সেই ক্ষণ, যেখানে প্রকাশ ও বিমর্শ, শিব ও শক্তি, চেতনা ও তার আত্মসচেতনতা—এক অনির্বচনীয় ঐক্যে মিশে যায়।

এইভাবে, “চৈতন্যম্ আত্মা” প্রকাশ করে চেতনার অস্তিত্বমূলক দিক, আর “উদ্যমো ভৈরবঃ” প্রকাশ করে চেতনার স্পন্দনমূলক দিক। প্রথমটি নীরব, অচল, স্বয়ং-প্রকাশিত; দ্বিতীয়টি গতিশীল, সৃজনশীল, আত্ম-উন্মীলিত। এই দুই একত্রে কাশ্মীর শৈব দর্শনের চূড়ান্ত সত্য প্রকাশ করে—চেতনা নিজেই আত্মা, এবং তার স্পন্দনই বিশ্ব। যা নীরব, তা-ই স্পন্দিত; যা শূন্য, তা-ই পূর্ণ; যা আত্মা, তা-ই শিব। এভাবে, প্রকাশ ও বিমর্শের ঐক্যই শিব ও শক্তির একত্ব, যা কাশ্মীর শৈব দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু। প্রকাশ ছাড়া বিমর্শ অন্ধ, বিমর্শ ছাড়া প্রকাশ নিঃসচেতন—তাদের যুগল ঐক্যেই চেতনার পূর্ণতা।

স্বাতন্ত্র্য (Svātantrya) বা শিবের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি এই ঐক্যের তৃতীয় দিক। এই শক্তি শিবকে চিরসক্রিয় রাখে—তিনি নিজের ইচ্ছায় সৃষ্টি করেন, নিজের ইচ্ছায় লয় করেন, তবুও কোনো পরিবর্তনে আসক্ত নন। অভিনবগুপ্ত বলেন (তন্ত্রলোক, ১.৮৬): “স্বাতন্ত্র্যাদ্ এব সর্বস্য নিয়মঃ শাশ্বতঃ শিবঃ”, অর্থাৎ, "স্বাতন্ত্র্য (পরম স্বাধীনতা) দ্বারাই সমস্ত কিছুর শাশ্বত নিয়ম, তিনিই শিব।" শিবের স্বাতন্ত্র্যের কারণেই সব কিছু নিয়ন্ত্রিত, অথচ তিনিই চিরমুক্ত। এই সূত্রটি কাশ্মীর শৈববাদের অদ্বৈত নীতিকে একটি শক্তিশালী উপপত্তি (যৌক্তিক প্রমাণ) দ্বারা প্রতিষ্ঠা করে:

১. স্বাতন্ত্র্য (Svātantrya): এটি হলো পরমশিবের (Paraśiva) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং মৌলিক গুণ—তাঁর সম্পূর্ণ স্বাধীনতা বা ইচ্ছাশক্তি। এই স্বতন্ত্রতা হলো শিবের বিমর্শ (Vimarśa) শক্তিরই সারমর্ম। এই স্বাধীনতা কারও দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়।

২. সর্বস্য নিয়মঃ শাশ্বতঃ (সমস্ত কিছুর শাশ্বত নিয়ম): মহাবিশ্বের সমস্ত নিয়ম, শৃঙ্খলা, কার্যকারণ এবং বিধান—যা জগৎকে সুশৃঙ্খলভাবে চালায়—তা এই স্বতন্ত্রতা থেকেই উদ্ভূত।

৩. তিনিই শিব (Śivaḥ): এই শাশ্বত নিয়ম বা বিধান কোনো বাইরের বা তৃতীয় কোনো সত্তা দ্বারা সৃষ্ট নয়; এই নিয়ম ও স্বাধীনতা অভিন্ন এবং তা স্বয়ং শিব।

শিব কেবল নিয়ম সৃষ্টি করেননি, বরং নিয়ম নিজেই। জাগতিক নিয়মাবলি শিবের স্বাধীন ইচ্ছারই প্রকাশ। জীব যখন এই পরম সত্য উপলব্ধি করে যে, তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা 'আমি' (যা অণুরূপে সীমাবদ্ধ) এবং মহাবিশ্বের পরম ইচ্ছাশক্তি, যা শিবের স্বতন্ত্রতা (পরমাত্মা বা ব্রহ্মের অবিভাজ্য অংশ) রূপে প্রকাশিত, তা আসলে অভিন্ন ও একাত্ম (প্রত্যভিজ্ঞা), তখনই সে মায়ার বন্ধন ও সীমিত বোধ থেকে চিরতরে মুক্তি লাভ করে। এই উপলব্ধি কেবল বৌদ্ধিক জ্ঞান নয়, বরং এক গভীর আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা, যা জীবের চেতনার স্তরকে সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তিত করে দেয়।

এই প্রত্যভিজ্ঞা দর্শনের মূল কথা হলো, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে যে আত্মসত্তা বিদ্যমান, তা ব্রহ্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা সাধারণত নিজেদেরকে একটি পৃথক সত্তা হিসেবে দেখি, যা শরীর, মন ও ইন্দ্রিয় দ্বারা সীমিত। এই বিচ্ছিন্নতাবোধই হলো আমাদের দুঃখ ও বন্ধনের মূল কারণ। কিন্তু যখন জীব এই ভুল ধারণা ত্যাগ করে এবং জানতে পারে যে, তার ভেতরের 'আমি' এবং পরম 'আমি' এক ও অভিন্ন, তখনই সে অবিদ্যা থেকে মুক্ত হয়।

এই মুক্তির পথ হলো স্ব-স্বরূপের জ্ঞান অর্জন করা। যখন জীব উপলব্ধি করে যে, তার ইচ্ছা কোনো স্বতন্ত্র ক্ষুদ্র ইচ্ছা নয়, বরং পরম ইচ্ছাশক্তিরই একটি স্পন্দন, তখন সে তার সকল সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে অসীমত্বের স্বাদ গ্রহণ করে। এই অবস্থায় জীব নিজেকে আর দেহ-মনের কারাগারে আবদ্ধ মনে করে না, বরং অনুভব করে যে, সে মহাবিশ্বের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যেখানে কোনো পৃথক অস্তিত্বের ধারণা নেই।

এই প্রত্যভিজ্ঞা, বা আত্ম-পরিচিতি, জাগতিক আকাঙ্ক্ষা, ভয় এবং সকল দ্বৈততার অবসান ঘটায়। জীব তখন বুঝতে পারে, তার জন্ম, মৃত্যু, সুখ, দুঃখ—এগুলো সবই মায়ার খেলা, যা পরম সত্যের উপরে একটি আবরণ মাত্র। এই আবরণ সরে গেলেই জীব তার প্রকৃত, অমর ও অসীম স্বরূপ উপলব্ধি করে, যা শিবের সাথে তার একাত্মতা। এই অবস্থাকেই মোক্ষ বা নির্বাণ বলা হয়, যেখানে জীব সকল প্রকার বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে পরম শান্তির সাগরে বিলীন হয়ে যায়। এই স্বাধীনতাই জীবের অন্তর্নিহিত শিব-স্বরূপ। এই সূত্রটি বলে যে, মহাবিশ্বের সমস্ত নিয়ম-শৃঙ্খলার মূলে রয়েছে শিবের অসীম, অপ্রতিহত এবং স্বতঃস্ফূর্ত ইচ্ছা বা স্বাধীনতা।

এইভাবে পরমশিব হলেন একই সঙ্গে নীরব আত্মা ও সৃষ্টিশীল শক্তি—প্রকাশ ও বিমর্শের মিলিত চেতনা। জীবাত্মা আসলে এই পরমচেতনারই সীমিত প্রতিফলন, কিন্তু মায়া বা অবিদ্যা সেই প্রতিফলনে আচ্ছাদন ফেলে, ফলে জীব নিজেকে দেহ-মন বলে ভুল চিনে। মুক্তি আসে প্রত্যভিজ্ঞা (Pratyabhijñā)-র মাধ্যমে—অর্থাৎ নিজের শিবস্বরূপকে স্বীকৃতি দিয়ে। এটি কোনো নতুন অর্জন নয়; এটি স্মরণ—“আমি সেই চেতনা, আমি সেই শিব।”

কাশ্মীর শৈবধর্মের ত্রিক দর্শনে মুক্তি বা পরমশিবতত্ত্বে প্রত্যাবর্তনের জন্য তিনটি আধ্যাত্মিক উপায় বর্ণিত হয়েছে—আণবোপায় (Āṇavopāya), শাক্তোপায় (Śāktopāya) এবং শাম্ভবোপায় (Śāmbhavopāya)। এই তিনটি উপায় মূলত মানুষের চেতনার তিনটি শক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত—ক্রিয়া (Kriyā-śakti), জ্ঞান (Jñāna-śakti) এবং ইচ্ছা (Icchā-śakti)। এগুলি কোনো পৃথক মতবাদ নয়; বরং একই চেতনা-সোপানের তিনটি ধাপ, যেখানে নিম্নতর শক্তি ধীরে ধীরে উচ্চতর চেতনায় রূপান্তরিত হয়।

আণবোপায় শব্দটি এসেছে ‘অণু’ শব্দ থেকে, যার অর্থ ‘ক্ষুদ্র’ বা ‘সীমিত’। এটি সেই সাধকের পথ, যিনি দেহ ও মনের সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ, নিজের চেতনার অসীম সম্ভাবনা এখনো উপলব্ধি করতে পারেননি। এখানে সাধক ধীরে ধীরে নিজের শরীর, মন ও ইন্দ্রিয়কে শুদ্ধ ও সংযত করতে শেখেন। শিবসূত্রের প্রথম সূত্রে বলা হয়েছে—“Caitanyam ātmā”—চেতনা-ই আত্মা, কিন্তু এই চেতনার উপলব্ধি তখনই সম্ভব, যখন মন প্রশান্ত, স্থির ও শুদ্ধ হয়। অভিনবগুপ্ত তাঁর তন্ত্রালোক-এ বলেন, “কায়-বাক্-বুদ্ধি-সংযোগঃ ক্রিয়া সাণবিকী মতা”—শরীর (কায়), বাক্য (বাক্) এবং বুদ্ধি (মন)-এর সংযোগই হলো সেই ক্রিয়া, যা আণবোপায় বলে মনে করা হয়। দেহ, বাক ও বুদ্ধির নিয়ন্ত্রণই আণবোপায় নামে পরিচিত। এই সূত্রটি আণবোপায়কে (মোক্ষলাভের সর্বনিম্ন পথ) সংজ্ঞায়িত করে। যেহেতু সাধক নিজেকে অণু (সীমিত জীব) মনে করে, তাই তাকে তার সীমিত উপকরণ—অর্থাৎ শরীর, কথা এবং মন—ব্যবহার করে আধ্যাত্মিক পথে প্রচেষ্টা করতে হয়।

কায় (Body): যোগাসন, মুদ্রা বা দৈহিক ক্রিয়া।

বাক্ (Speech): মন্ত্র জপ বা উচ্চার (Uccāra)।

বুদ্ধি (Intellect): নির্দিষ্ট বস্তুতে ধ্যান বা ভাবনা (Dhyāna/Bhāvanā)।

আণবোপায় হলো দেহ, বাক্য ও মন-এর সক্রিয় প্রচেষ্টা নির্ভর যোগিক পথ। এই পথে মুক্তির সাধনা ধীর ও ক্রমান্বিত। সাধক উচ্চার বা মন্ত্রজপ, ধ্যান, করণ বা যোগিক মুদ্রা, ভাবনা বা ঈশ্বরচিন্তা ইত্যাদি অনুশীলনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে চেতনার গভীরে প্রবেশ করেন। মনকে বহির্মুখ থেকে অন্তর্মুখ করে, ইন্দ্রিয়কে সংযত করে, শ্বাস ও চিন্তার প্রবাহকে নিয়ন্ত্রিত করে সে আত্মার অন্তঃলোকের দিকে অগ্রসর হয়। আণবোপায়ে মুক্তি হঠাৎ কোনো জ্যোতির্ময় অভিজ্ঞতা নয়; এটি প্রস্তুতির ধাপ—যেখানে মন ও দেহকে শুদ্ধ করে চেতনার প্রতিফলনের জন্য উপযোগী করে তোলা হয়।

এই শুদ্ধ মনই পরবর্তী স্তরে প্রবেশ করে—শাক্তোপায়ে। এখানে শরীর বা শ্বাসের কোনো ভূমিকা নেই; বরং এখানে প্রধান ভূমিকা নেয় চিন্তা, জ্ঞান এবং মনন। এটি জ্ঞানশক্তিনির্ভর পথ, যেখানে মুক্তি আসে চিন্তার মধ্য দিয়েই। শক্তি বা জ্ঞানশক্তি এখানে চেতনার অনুধ্যানের মাধ্যম। আবিনবগুপ্ত বলেন—“শাক্তোপায়ঃ স বিজ্ঞেয়ঃ যত্র চিন্তালয়ো ভবেৎ”—শাক্তোপায় তাকেই জানবে, যেখানে চিন্তার লয় ঘটে (বা মন চিন্তামুক্ত হয়)। যেখানে চিন্তাই ধ্যানের আসন, সেটিই শাক্তোপায়। এই সূত্রটি শাক্তোপায় (শিবকে উপলব্ধির মধ্যবর্তী পথ) সংজ্ঞায়িত করে। এটি আণবোপায় (যা শারীরিক ক্রিয়া ও মনকে ব্যবহার করে) থেকে উচ্চতর, কারণ এখানে যোগীর প্রধান কাজ হলো চিন্তাকে দমন করা নয়, বরং তাকে লীন করে দেওয়া (চিন্তা-লয়)।

এটি শক্তির (Śakti) বা জ্ঞানশক্তির পথ। সাধক এখানে বুদ্ধি ও মনকে ব্যবহার করে অদ্বৈত জ্ঞান নিয়ে গভীরভাবে মনন করেন, যার ফলে সমস্ত বৈচিত্র্যময় চিন্তা ধীরে ধীরে একত্বে বিলীন হয়ে যায়। যখন চিন্তার লয় হয়, তখন বিশুদ্ধ চেতনা বা শিব-স্বরূপ প্রকাশিত হয়। এই লয় কোনো জোর করে করা কাজ নয়, বরং মনন (যুক্তি ও জ্ঞানের মাধ্যমে চিন্তা করা) দ্বারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অর্জিত স্থিরতা। এই পথে সাধক বাহ্যিক অনুশীলন নয়, বরং অন্তর্দৃষ্টি ও বিচারের মাধ্যমে আত্মাকে চিনে নেয়। সে ক্রমাগত আত্মানুসন্ধানে নিযুক্ত থাকে—“কে আমি?”—এই প্রশ্ন তার কেন্দ্রবিন্দু। মন যখন সব দ্বন্দ্ব ও ধারণা ভেঙে ফেলে এবং সত্য-মিথ্যা, শুদ্ধ-অশুদ্ধ, সুখ-দুঃখের ভেদরেখা অতিক্রম করে, তখন চেতনা নিজের দীপ্তি উপলব্ধি করে।

এটি কোনো হঠাৎ উদ্‌ভাস নয়; বরং জ্ঞানের গভীরে স্থিত হয়ে মিথ্যা ধারণাগুলিকে পরিত্যাগ করা—একধরনের নিঃশব্দ মানসিক ধ্যান, যেখানে চিন্তা নিজেই চিন্তার উৎসে বিলীন হয়ে যায়। এই স্তরে সাধক প্রত্যভিজ্ঞা লাভ করে—নিজের চেতনা-স্বরূপকে চিনতে পারে এবং উপলব্ধি করে যে, “আমি দেহ বা মন নই, আমি সেই শিবচেতনা।”