অবিদ্যা-বিদ্যা: ৮৫


অদ্বৈত বেদান্তের ভাষায় এই মহাজাগতিক শারীরস্থান তিনটি সমান্তর স্তরে প্রকাশিত—স্থূল শরীর, সূক্ষ্ম শরীর, ও কারণ শরীর। এগুলি কেবল ব্যক্তির (microcosm) অভ্যন্তরে নয়, সমগ্র মহাবিশ্বের (macrocosm) প্রতিরূপেও বিদ্যমান। ব্যক্তির শরীর যেমন অন্ন, প্রাণ, মন ও বুদ্ধির দ্বারা গঠিত, তেমনি ব্রহ্মাণ্ডও গঠিত পঞ্চভূত, প্রজাপতি, দেবশক্তি ও মহৎ-তত্ত্ব দ্বারা। তাই, Puruṣa ও Prakṛti, Ātman ও Brahman—এই দুইয়ের মধ্যে কোনো বিচ্ছেদ নেই; ব্যক্তির চেতনা হলো মহাজাগতিক চেতনার প্রতিফলন, যেমন ঘটাকাশ মহাকাশেরই এক ক্ষুদ্র প্রতিচ্ছবি।

অদ্বৈত দৃষ্টিতে ব্যক্তি (পিণ্ড) এবং বিশ্ব (ব্রহ্মাণ্ড) দুটি পৃথক সত্তা নয়; তারা একই চেতনার দুই স্তর—একটি সীমিত প্রতিফলন, অন্যটি সীমাহীন ঐক্য। যেমন এক আকাশ অসংখ্য ঘট বা পাত্রে বিভক্ত হয়ে “ঘটাকাশ” রূপে দেখা দেয়, কিন্তু আসলে আকাশ কখনও বিভক্ত হয় না—তেমনি আত্মা ও ব্রহ্ম, পুরুষ ও প্রকৃতি, ব্যক্তি ও বিশ্ব—সবই এক চিদাকাশের বিভিন্ন প্রতিফলন।

ব্যক্তির শরীর গঠিত অন্ন (দেহ), প্রাণ (শক্তি), মন (চিন্তা), ও বুদ্ধি (বিচার)-এর দ্বারা—এই চার স্তরই মাইক্রো-কসমিক চেতনার স্থাপত্য। এগুলি কেবল মানসিক বা শারীরিক উপাদান নয়; এগুলি চেতনার ঘন থেকে সূক্ষ্মতর স্তরে প্রকাশ। অন্নময় স্তর ভৌত—খাদ্য, উপাদান ও জৈব প্রক্রিয়ার সমন্বয়। প্রাণময় স্তর সেই জীবনশক্তি, যা দেহে গতি ও সঞ্চালন ঘটায়। মনোময় স্তর অনুভূতি ও চিন্তার ক্ষেত্র, যেখানে ইচ্ছা ও দ্বন্দ্বের উদ্ভব হয়। বিজ্ঞানময় স্তর হলো বিচার ও বোধের কেন্দ্র—যেখানে “আমি জানি”, “আমি করি” এই অহংবোধ জন্ম নেয়। এই সমস্ত স্তরের আভ্যন্তরীণ দীপ্তি হলো চেতনা—যা আত্মার প্রতিফলন।

এভাবে গঠিত ব্যক্তিগত শরীর আসলে মহাজাগতিক স্থাপত্যেরই প্রতিরূপ। মহাবিশ্বও গঠিত—পঞ্চমহাভূত, প্রজাপতি, দেবশক্তি ও মহৎ-তত্ত্ব দ্বারা। পঞ্চভূত (পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ) হলো ভৌত স্তর; প্রজাপতি বা সৃষ্টিশক্তি হলো সেই প্রাণময় প্রবাহ, যা জীবনের গতি ঘটায়; দেবশক্তি হলো মনোময় স্তরের প্রতিরূপ—যেখানে প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তি বুদ্ধির প্রতীকী রূপে প্রকাশ পায়; আর মহৎ-তত্ত্ব হলো সেই cosmic intelligence—বিজ্ঞানময় স্তরের সমান্তরাল—যার মধ্য দিয়ে ব্রহ্ম নিজেকে জগৎ হিসেবে জানে।

এই সমান্তরাল বিন্যাসই পুরুষ ও প্রকৃতির চিরন্তন সম্পর্কের মূল। পুরুষ (Puruṣa) হলো চেতনা, প্রকৃতি (Prakṛti) হলো তার প্রকাশ—নির্জীব নয়, বরং চেতনার শক্তি। যখন পুরুষ নিজেকে প্রকৃতির প্রতিফলনে দেখে, তখন জন্মায় “জগৎ”—যেমন আয়নায় মুখ প্রতিফলিত হয়ে মুখকেই দেখতে দেয়। এই সম্পর্ক কোনো কারণ-কার্যের নয়, বরং অভিজ্ঞতার; পুরুষ প্রকৃতিকে দেখে, কিন্তু তাতে লিপ্ত নয়।

আধুনিক অদ্বৈত দর্শনে এই সম্পর্ককে বলা যায় বৃহৎ ব্রহ্মাণ্ডের চেতনার ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ডিক প্রতিফলন (microcosmic reflection of macrocosmic consciousness)। ব্যক্তি আসলে মহাবিশ্বেরই সংক্ষিপ্ত অনুবাদ। যেমন ঘটাকাশ মহাকাশেরই ক্ষুদ্র সীমা, তেমনি ব্যক্তিচেতনা ব্রহ্মচেতনারই প্রতিফলন। রমণ মহর্ষি বলেছিলেন, “The body is in the Self; the Self is not in the body.” নিসর্গদত্ত মহারাজ আরও যোগ করেন, “The universe exists because of consciousness, not consciousness because of the universe.”

এই ধারণাটি দুটি প্রধান সত্তার মধ্যেকার সম্পর্ককে নির্দেশ করে—

১. ম্যাক্রোকসমিক চেতনা (Macrocosmic Consciousness): এটি হলো বৃহৎ ব্রহ্মাণ্ড বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সামগ্রিক চেতনা। ভারতীয় দর্শনে একে ব্রহ্ম (Brahman), ঈশ্বর বা মহাজাগতিক মন (Hiraṇyagarbha) বলা হয়। এটি অসীম, সর্বব্যাপী, এবং অখণ্ড।

২. মাইক্রোকসমিক প্রতিফলন (Microcosmic Reflection): এটি হলো ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ড বা মানবদেহের মধ্যেকার আত্মা (Ātman) বা জীবাত্মা। এটি ম্যাক্রোকসমের চেতনারই একটি সীমিত, কিন্তু অভিন্ন প্রতিবিম্ব।

মানবদেহের (Microcosm) মধ্যে যে চেতনা, জ্ঞান এবং জীবনশক্তি বিদ্যমান, তা বাইরের সমগ্র মহাবিশ্বের (Macrocosm) চেতনারই একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ বা প্রতিফলন। এই ধারণাটি "ব্রহ্মাণ্ডে যা, পিণ্ডাণ্ডে তা"—এই নীতিকে প্রতিষ্ঠা করে—

১. অদ্বৈতের ভিত্তি: এই তত্ত্বটি অদ্বৈত বেদান্তের মূল দর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ: "ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা, জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ" (জীব এবং ব্রহ্ম এক ও অভিন্ন)। যদিও জীবাত্মা (প্রতিফলন) উপাধির (দেহ-মন) কারণে সীমিত মনে হয়, তার মৌলিক স্বরূপ পরম চেতনার (ব্রহ্ম) থেকে আলাদা নয়।

২. মুক্তির পথ: যদি বৃহৎ চেতনার জ্ঞান লাভ করতে হয়, তবে বাইরে না খুঁজে নিজের ভেতরেই (মাইক্রোকসমের মধ্যে) সেই চেতনার প্রতিফলনকে জানতে হবে। যোগ এবং ধ্যানের লক্ষ্য হলো এই প্রতিফলনের সীমা (যেমন—অহংকার, ভ্রম) অতিক্রম করে অখণ্ড ম্যাক্রোকসমিক চেতনার সঙ্গে একীভূত হওয়া।

৩. জ্ঞান-ব্যাপার: মানবদেহের চেতনা (জ্ঞান-ব্যাপার) হলো সেই জানালা, যার মাধ্যমে সীমিত জীবাত্মা তার অসীম উৎসকে জানতে পারে।

এই ধারণা ঘোষণা করে যে, মানব-সত্তা কোনো বিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব নয়, বরং এটি হলো অসীম চেতনার একটি সীমিত প্রকাশ বা আয়না, যা মহাবিশ্বের সমস্ত সত্যকে তার নিজের মধ্যে ধারণ করে।

এই দৃষ্টিতে, ব্যক্তির সমস্ত শারীরস্থান—অন্ন, প্রাণ, মন, বুদ্ধি—মহাজাগতিক নকশারই প্রতিফলন। ব্যক্তির মধ্যে যা সূক্ষ্মভাবে বিদ্যমান, মহাবিশ্বে তা বিস্তৃতভাবে প্রকাশিত। ব্যক্তির দেহ যেমন খাদ্যে নির্ভর, তেমনি পৃথিবী উপাদানে পূর্ণ; ব্যক্তির প্রাণ যেমন শ্বাসে প্রবাহিত, তেমনি বায়ু বিশ্বে গতি দেয়; ব্যক্তির মন যেমন ধারণা ও স্বপ্ন রচনা করে, তেমনি মহাজাগতিক মন অসংখ্য জগৎ সৃষ্টি করে; ব্যক্তির বুদ্ধি যেমন সিদ্ধান্তগ্রহণ করে, তেমনি মহৎ-তত্ত্ব মহাবিশ্বের বিধান স্থির করে।

"মহৎ-তত্ত্ব মহাবিশ্বের বিধান স্থির করে" বলতে বোঝানো হয় যে, সমগ্র সৃষ্টি এবং তার কার্যপ্রণালীর মূলনীতি ও কাঠামো একটি একক, প্রাথমিক মহাজাগতিক বুদ্ধি (Cosmic Intelligence) দ্বারা নির্ধারিত ও পরিচালিত হয়। এই ধারণাটি মূলত সাংখ্য দর্শন এবং বেদান্ত-এর সৃষ্টিতত্ত্বে (Cosmology) পাওয়া যায়। 'মহৎ' (Mahat) সংস্কৃত শব্দ, যার আক্ষরিক অর্থ 'বিশাল' বা 'বৃহৎ'। সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় এর ভূমিকা নিম্নরূপ:

১. প্রথম প্রকাশিত শক্তি: এটি প্রকৃতির (Prakriti)—অর্থাৎ, জড় বা মূল-উপাদানের—প্রথম অভিব্যক্তি। পরম পুরুষ (Puruṣa) বা চেতনার সান্নিধ্যে আসার পরই অচেতন প্রকৃতিতে যে প্রথম আলোড়ন সৃষ্টি হয়, তাই এই মহৎ-তত্ত্ব।

২. সমষ্টি-বুদ্ধি: মহৎ-তত্ত্ব হলো সমগ্র মহাবিশ্বের সমষ্টিগত বুদ্ধি বা মহাজাগতিক মন (Cosmic Mind)। এটিকে হিরণ্যগর্ভ বা সূত্রাত্মা নামেও অভিহিত করা হয়। এটি কোনো একক জীবের মন নয়, বরং সমস্ত সম্ভাব্য জ্ঞান, নিয়ম এবং কার্যকারণ সম্পর্ককে ধারণ করে।

৩. বিধান স্থাপন: যেহেতু মহৎ হলো এই সমগ্র বিশ্ব-ব্যবস্থার প্রথম বুদ্ধিগত কাঠামো, তাই এটিই মহাবিশ্বের সমস্ত নৈতিক, ভৌত ও প্রাকৃতিক নিয়মাবলীকে (বিধান) স্থির করে। অর্থাৎ, মহাবিশ্ব কী প্রক্রিয়ায় কাজ করবে, বস্তুরা কীভাবে সম্পর্কিত হবে, এবং বিবর্তন কীভাবে ঘটবে—তার সমস্ত মূলনীতি মহৎ-তত্ত্বের মধ্যেই নিহিত থাকে।

এটি একটি ব্লুপ্রিন্ট (Blueprint) বা মাস্টার প্ল্যান-এর মতো। মহৎ-তত্ত্ব হলো সেই আদি মহাজাগতিক বুদ্ধি, যা মহাবিশ্বকে এলোমেলোভাবে চলতে না দিয়ে একটি সুশৃঙ্খল ও নিয়মবদ্ধ পথে পরিচালিত করে।

"Bandha-mukti vyavahāra" (বন্ধন ও মুক্তির ব্যবহার) বলতে ভারতীয় দর্শনে, বিশেষত বেদান্তে, সেই ধারণাকে বোঝানো হয় যে, বন্ধন (Bondage) এবং মুক্তি (Liberation)—এই উভয় ধারণাই হলো ব্যাবহারিক জগতের (Vyavahāra) আপেক্ষিক সত্য। পরমার্থিক বা চূড়ান্ত সত্যের দিক থেকে, আত্মা সর্বদাই মুক্ত। "বন্ধন ও মুক্তির ব্যবহার" বলতে বোঝায়: যতক্ষণ পর্যন্ত অজ্ঞানতা আছে, ততক্ষণ বন্ধন ও মুক্তির দ্বৈততা সত্য, কিন্তু জ্ঞানের উদয় হলে সেই দ্বৈততা মিথ্যা প্রমাণিত হয় এবং আত্মা তার নিত্য-মুক্ত স্বরূপেই প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যক্তি যখন নিজের সীমা ভুলে যায়, তখনই ব্রহ্ম থেকে পৃথক বলে মনে হয়; আবার যখন নিজের চেতনার উৎসে ফিরে যায়, তখন উপলব্ধি করে—“আমি ব্রহ্ম”—এই জগৎ, দেহ ও মন সবই আমার প্রতিফলন।

এই উপলব্ধি কোনো রূপক নয়; এটি cosmic identity—যেখানে ব্যক্তির ভেতর ও বাহির, মাইক্রোকসম (ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ড বা ক্ষুদ্র জগৎ) ও ম্যাক্রোকসম (বৃহৎ ব্রহ্মাণ্ড বা বৃহৎ জগৎ), পুরুষ ও প্রকৃতি, আত্মা ও ব্রহ্ম—সব এক নিত্য, নিরুপাধি, অপরিবর্তনীয় চেতনায় মিশে যায়। যেমন আকাশকে কোনো পাত্রে বন্দি করা যায় না, তেমনি ব্যক্তিচেতনাকে কখনও বিশ্বচেতনা থেকে আলাদা করা যায় না। ব্যক্তিই ব্রহ্মাণ্ড; আত্মাই বিশ্ব; ঘটাকাশই মহাকাশ।

ক্ষুদ্রের মধ্যে বৃহতের প্রতিফলন—মানবদেহ বা যে-কোনো একক সত্তা হলো বৃহৎ বিশ্ব (Macrocosm বা ম্যাক্রোকসম)-এর প্রতিচ্ছবি বা ক্ষুদ্র সংস্করণ। গ্রিক দার্শনিকরা মনে করতেন, মানুষ হলো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একটি নিখুঁত প্রতিরূপ। ভারতীয় দর্শনে এই ধারণাটি বিশেষভাবে প্রচলিত। ব্রহ্মাণ্ড ও পিণ্ডাণ্ড—এটি প্রায়শই ব্রহ্মাণ্ড (বৃহৎ জগৎ) এবং পিণ্ডাণ্ড (ক্ষুদ্র শরীর বা দেহ) ধারণার সঙ্গে তুলনীয়। মানুষ যা ভাবে, অনুভব করে বা কাজ করে, তা বৃহত্তর জগতের নিয়মেরই প্রতিফলন।

ম্যাক্রোকসম হলো সমগ্র মহাবিশ্ব, জগৎ এবং প্রকৃতির সমস্ত মৌলিক উপাদান, নীতি ও কাঠামো। এটি হলো সেই বৃহত্তর বাস্তবতা, যার অংশ হলো প্রতিটি ক্ষুদ্র সত্তা। ম্যাক্রোকসমের ধারণাটি প্রায়শই মাইক্রোকসম (ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ড) ধারণার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করে ব্যাখ্যা করা হয়। ম্যাক্রোকসম (Macrocosm) আর মাইক্রোকসম (Microcosm)—এই দার্শনিক দ্বৈততা অনুসারে, সমগ্র মহাবিশ্ব (ম্যাক্রোকসম) যা-কিছু ধারণ করে, তার একটি ক্ষুদ্র ও প্রতিরূপ মানবদেহ বা একক সত্তার মধ্যেও বিদ্যমান (মাইক্রোকসম)।

ভারতীয় দর্শনে এটি ব্রহ্মাণ্ড (ম্যাক্রোকসম) এবং পিণ্ডাণ্ড (মাইক্রোকসম) নামে পরিচিত। যেমন, ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত মৌলিক শক্তি ও পদার্থ (পঞ্চভূত) পিণ্ডাণ্ডেও (দেহ) বিদ্যমান। ম্যাক্রোকসম হলো সেই বৃহত্তর মহাবিশ্ব, যা ক্ষুদ্র সত্তার (যেমন মানবদেহ) সমস্ত নিয়ম ও অস্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে।

যোগশাস্ত্রে মানবদেহকে যে-শক্তিচক্র বা নাড়িগুলির সমন্বয়ে গঠিত একটি ক্ষুদ্র জগৎ হিসেবে দেখা হয়, তা এই মাইক্রোকসম ধারণারই একটি উদাহরণ। সংক্ষেপে, মাইক্রোকসম হলো সেই ধারণা, যা ঘোষণা করে: "যেমন ব্রহ্মাণ্ডে, তেমনই পিণ্ডাণ্ডে।" অর্থাৎ, বৃহৎ ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত মৌলিক উপাদান, নীতি ও কাঠামো, যা বিশ্বকে চালনা করে—তা সবই মানবদেহের মধ্যেও (ব্যক্তিগত স্তরে) বিদ্যমান। এই উপলব্ধিতেই আত্মা ও ব্রহ্মের ভেদ মুছে যায়, এবং প্রকাশিত হয় সেই এক অনন্ত সত্য—চিদানন্দরূপ ব্রহ্ম, যার মধ্যে ব্যক্তি ও জগৎ দুটোই এক চিরন্তন প্রতিধ্বনি।

"Cosmic Anatomy" বা মহাজাগতিক অঙ্গসংস্থানবিদ্যা/মহাজাগতিক শরীরবিদ্যা/ব্রহ্মাণ্ডিক অঙ্গসংস্থান হলো একটি দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক ধারণা, যা মূলত ভারতীয় দর্শন, রহস্যবাদ (Mysticism) এবং পশ্চিমা গূঢ়বিদ্যা (Esotericism)-তে ব্যবহৃত হয়। এর কেন্দ্রবিন্দু হলো চিদাকাশ (Cit-ākāśa)—চেতনার আকাশ—যা সমস্ত অভিজ্ঞতার পটভূমি। এই চিদাকাশের মধ্যেই ব্যক্তিগত অন্তঃকরণ (মন, বুদ্ধি, অহং, চিত্ত) মহাজাগতিক মন (Hiraṇyagarbha)-এর প্রতিফলনরূপে কাজ করে। এই ধারণাটি দুটি নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত:

১. একত্ব (Unity): এটি বিশ্বাস করে যে, মহাবিশ্বের প্রতিটি সত্তা—মানুষ, গ্রহ, নক্ষত্র—একই মৌলিক কাঠামো বা ঐশ্বরিক নকশা অনুসরণ করে গঠিত।

২. ক্ষুদ্রের মধ্যে বৃহৎ (Microcosm in the Macrocosm): এটি হলো ম্যাক্রোকসম (বৃহৎ ব্রহ্মাণ্ড) এবং মাইক্রোকসম (ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ড বা মানবদেহ)-এর মধ্যেকার সংযোগ।

অদ্বৈত বেদান্ত, ভারতীয় দর্শনের একটি গভীর নীতি শেখায়—“যথা স্বপনে জগত্ প্রপঞ্চিতো মনসা, তথা জাগ্রতে ব্রহ্মচেতনায়”—অর্থাৎ, "যেমন স্বপ্নে জগৎ মন দ্বারা বিস্তারিত (বা সৃষ্ট) হয়, তেমনই জাগ্রত অবস্থায় (এই জগৎ) ব্রহ্মচেতনা দ্বারা (বিস্তৃত বা সৃষ্ট হয়)।" এই বাক্যটি মূলত দুটি স্তরের বাস্তবতা তুলনা করে—