অবিদ্যা-বিদ্যা: ৮৪



এই ধারণাটি জার্মান দার্শনিক হেগেলের “Aufhebung” বা sublation-এর সঙ্গে তুলনীয়। "Aufhebung" (আউফহেবুং) হলো জার্মান দার্শনিক জিডব্লিউএফ হেগেলের দর্শনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও কেন্দ্রীয় ধারণা, যা তাঁর দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে (Dialectics) ব্যবহৃত হয়। এর ইংরেজি পরিভাষা হলো Sublation (সাবলেশন)। বাংলায় এর কোনো একক প্রতিশব্দ নেই, তবে এর অর্থ হলো একইসাথে বিলোপ, সংরক্ষণ ও উন্নীতকরণ (Negating, Preserving, and Elevating)।

মজার ব্যাপার, এই ধারণার মধ্যেই একটি অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব লুকিয়ে আছে, কারণ 'Aufhebung' শব্দটির জার্মান ভাষায় দুটি পরস্পর-বিরোধী অর্থ রয়েছে: সংরক্ষণ করা (to preserve) এবং বিলোপ করা (to abolish)। হেগেল এই বিরোধাভাসকে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার সার হিসেবে ব্যবহার করেন।

Aufhebung-এর তিনটি স্তর—দ্বান্দ্বিক উন্মোচন: এই প্রক্রিয়াটি তিনটি স্তরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়, যা একটি ধারণা বা অবস্থার ক্রমাগত বিকাশকে নিশ্চিত করে:

১. বিলোপ (Negating/Abolishing): এই স্তরে প্রাথমিক ধারণা বা বাদ (Thesis)-এর সীমাবদ্ধতা বা ত্রুটিকে নাকচ করা হয়। এর ফলে পূর্বের অসম্পূর্ণতা দূর হয়।

২. সংরক্ষণ (Preserving/Retaining): বিলোপের অর্থ সম্পূর্ণ ধ্বংস নয়। বরং, বাদের (Thesis) মধ্যেকার যে-অংশটি সত্য বা মূল্যবান, তা সম্পূর্ণ ধ্বংস না করে ধরে রাখা হয়। এর মাধ্যমে সত্যের অংশটুকু সংরক্ষিত থাকে।

৩. উন্নীতকরণ (Elevating/Lifting): শেষ ধাপে, বাদ এবং প্রতিবাদের (Antithesis) সংঘাতের ফলে একটি নতুন, উচ্চতর, এবং সংশ্লেষিত (Synthesis) অবস্থা তৈরি হয়। এই সংশ্লেষের মাধ্যমেই জ্ঞান বা বাস্তবতা উচ্চস্তরে বিকশিত হয়।

উদাহরণ ও তাৎপর্য: জ্ঞানতত্ত্বের উদাহরণে এই প্রক্রিয়াটি সুস্পষ্ট। যখন কোনো পুরোনো তত্ত্ব (বাদ) নতুন প্রমাণের মুখে ভুল প্রমাণিত হয়, তখন তাকে বিলোপ করা হয়। কিন্তু নতুন তত্ত্বটি পুরোনো তত্ত্বের কিছু সত্য ধারণাকে সংরক্ষণ করে নেয় এবং তার ভিত্তিতে একটি উন্নত ব্যাখ্যা (উন্নীতকরণ) তৈরি করে।

হেগেলের কাছে, এই প্রক্রিয়াটি দেখায় যে, অগ্রগতি কেবল ধ্বংস বা সরল পরিবর্তন নয়, বরং বিরোধের মাধ্যমে সৃষ্ট এক ধরনের আত্ম-উত্তরণ। এই দ্বান্দ্বিক উন্মোচনের মাধ্যমেই চেতনা, ইতিহাস ও পরম জ্ঞান (Absolute Spirit) ক্রমান্বয়ে বিকশিত হয়।

হেগেলের মতে, নিম্নতর স্তর উচ্চতর স্তরে কেবল সংরক্ষিতই হয় না, বরং তার সীমাবদ্ধতাগুলোকে অতিক্রম করে এক নতুন সংশ্লেষে উত্তীর্ণ হয়। উদাহরণস্বরূপ, থিসিস ও অ্যান্টি-থিসিসের দ্বন্দ্ব থেকে একটি সিন্থেসিসের উদ্ভব হয়, যা উভয়কেই ধারণ করে কিন্তু একই সাথে তাদের সীমাবদ্ধতাগুলোকে অতিক্রম করে এক উন্নততর স্তরে উপনীত হয়। ‘বাধ-ব্যবহার’ এই দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়াকে প্রতিফলিত করে, যেখানে পূর্ববর্তী জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাগুলো নতুন জ্ঞানের মাধ্যমে অতিক্রমিত হয়, কিন্তু তার মূল নির্যাসটি অটুট থাকে।

একইসাথে, এটি ফেনোমেনোলজিক্যাল রিডাকশনেরও এক পূর্বসূত্র। "Phenomenological Reduction" হলো জার্মান দার্শনিক এডমুন্ড হুসার্ল (Edmund Husserl) কর্তৃক প্রবর্তিত প্রতিভাসতত্ত্ব (Phenomenology)-এর একটি কেন্দ্রীয় পদ্ধতি। এর বাংলা পরিভাষা হলো প্রতিভাসতত্ত্বীয় অবরোহণ বা প্রপঞ্চবিদ্যাগত লঘুকরণ। সহজ কথায়, এটি হলো সেই পদ্ধতি, যার মাধ্যমে গবেষক বা দার্শনিক কোনো অভিজ্ঞতাকে তার বিশুদ্ধতম রূপে অধ্যয়ন করার জন্য সমস্ত পূর্ব-ধারণা, প্রাকৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি (Natural Attitude) এবং জাগতিক অস্তিত্বের দাবিকে সাময়িকভাবে স্থগিত বা বন্ধ করে দেন।

১. অবরোহণের উদ্দেশ্য (The Goal of Reduction): এই পদ্ধতির লক্ষ্য হলো চেতনার বিষয়বস্তু বা অভিজ্ঞতাকে তার মৌলিক "স্বয়ং-উপস্থিতি" (Self-givenness) রূপে প্রকাশ করা।

বিবেক (Viveka): অবরোহণ গবেষককে জাগতিক বস্তু এবং তাদের উপলব্ধির মধ্যেকার পার্থক্য বুঝতে সাহায্য করে।

বিশুদ্ধ চেতনা: এর মাধ্যমে কেবল সেই অভিজ্ঞতাই অবশিষ্ট থাকে, যা সরাসরি চেতনায় প্রতিভাত হয়, যাকে হুসার্ল "বিশুদ্ধ চেতনা" (Pure Consciousness) বা "ট্রান্সেন্ডেন্টাল ইগো" বলেন।

২. অবরোহণের প্রক্রিয়া (The Process: Epoché): এই লঘুকরণের মূল প্রক্রিয়াটিকে হুসার্ল "এপোখে" (Epoché) বা "বন্ধনমুক্তকরণ" নামে অভিহিত করেছেন। এটি তিনটি প্রধান ধাপে সম্পন্ন হয়:

ক. প্রাকৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি বন্ধ করা (Bracketing the Natural Attitude): আমরা সাধারণত বিশ্বাস করি যে, বাইরে একটি জগৎ আছে এবং এটি আমাদের চেতনা থেকে স্বাধীন ও বস্তুগতভাবে বিদ্যমান। এপোখের মাধ্যমে গবেষক সাময়িকভাবে এই বিশ্বাসটিকে বন্ধ বা স্থগিত করে দেন—অর্থাৎ, তিনি জগতের অস্তিত্ব সম্পর্কে কোনো রায় বা বিচার দেন না।

খ. নিরূপণ (Noema) এবং নিওসিস (Noesis): এরপর তিনি অভিজ্ঞতাকে দুটি দিক থেকে বিশ্লেষণ করেন—নিরাপণ (অভিজ্ঞতার বস্তুগত দিক) এবং নিওসিস (অভিজ্ঞতার বিষয়গত দিক বা অভিজ্ঞতার কাজটি)।

গ. বিশুদ্ধ চেতনায় ফিরে আসা: সমস্ত জাগতিক ও মানসিক ধারণা বাতিল হওয়ার পর, যা অবশিষ্ট থাকে, তা হলো সেই বিশুদ্ধ চেতনা যা সমস্ত অভিজ্ঞতার ভিত্তি।

সংক্ষেপে, প্রতিভাসতত্ত্বীয় অবরোহণ হলো সেই কঠোর পদ্ধতি, যা গবেষককে তার নিজস্ব পক্ষপাত ও পূর্বধারণা থেকে মুক্ত করে চেতনায় যা প্রতিভাত হয়, তাকেই নিরপেক্ষভাবে অধ্যয়ন করার সুযোগ দেয়।

ট্রান্সেন্ডেন্টাল ইগো হলো বিশুদ্ধ চেতনা (Pure Consciousness)-এর সেই স্তর, যা সমস্ত জাগতিক এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে গঠন ও জানে, কিন্তু নিজে সেই অভিজ্ঞতার অংশ নয়। এই ধারণাটি দুটি ভাগে বোঝা যায়:

১. ট্রান্সেন্ডেন্টাল (Transcendental—অতীন্দ্রিয়): এর অর্থ হলো, এটি জাগতিক অভিজ্ঞতার ঊর্ধ্বে বা বাইরে বিদ্যমান। এটি দৈনন্দিন জগতের (যা আমরা ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি করি) বা আমাদের ভৌত শরীরের অংশ নয়। এটি হলো সেই মৌলিক কাঠামো, যা সব অভিজ্ঞতাকে সম্ভব করে তোলে।

২. ইগো (Ego—অহং বা আমিত্ব): এটি হলো চেতনার কেন্দ্র—সেই সত্তা, যা বলে, 'আমি অভিজ্ঞতা লাভ করছি'। তবে এটি কোনো মনস্তাত্ত্বিক বা ব্যক্তিগত 'আমি' নয় (যেমন—'আমি খুশি' বা 'আমি রুশ'), বরং একটি বিশুদ্ধ, সর্বজনীন জ্ঞাতা।

প্রাকৃতিক অহং থেকে পার্থক্য: হুসার্লের মতে, এই ইগো আমাদের দৈনন্দিন প্রাকৃতিক অহং (Empirical Ego) থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

প্রাকৃতিক অহং: এটি হলো আমাদের মনস্তাত্ত্বিক পরিচয়, যা আমাদের শরীর, আবেগ, সামাজিক ভূমিকা এবং অতীত অভিজ্ঞতার দ্বারা গঠিত। এটি সীমিত এবং পরিবর্তনশীল।

ট্রান্সেন্ডেন্টাল ইগো: এটি হলো সেই শুদ্ধ জ্ঞাতা সত্তা, যা প্রাকৃতিক অহংকে (দেহ, মন, স্মৃতি) পর্যবেক্ষণ করে এবং জগতের অস্তিত্বকে বিচার করে।

অর্জনের পদ্ধতি: ট্রান্সেন্ডেন্টাল ইগো হলো সেই অপরিবর্তনীয়, মৌলিক চেতনা, যা আমাদের সমস্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভিত্তি, কিন্তু যা নিজে সেই জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রভাবিত বা সীমিত নয়। এটিকে আবিষ্কার করার জন্য হুসার্ল ফেনোমেনোলজিক্যাল রিডাকশন (প্রতিভাসতত্ত্বীয় অবরোহণ) পদ্ধতির কথা বলেছেন, যেখানে গবেষক জাগতিক অস্তিত্বের দাবিকে সাময়িকভাবে স্থগিত (Epoché) করে চেতনার বিশুদ্ধ কেন্দ্রটিকে উন্মোচন করেন।

হুসার্লের ফেনোমেনোলজি (Phenomenology) অনুসারে, মানবচেতনা তার অভিজ্ঞতার গভীরে প্রবেশ করে নিজস্ব বিশুদ্ধ রূপে পৌঁছাতে পারে। এটি কোনো সরল প্রক্রিয়া নয়, বরং ধাপে ধাপে অভিজ্ঞতার স্তরগুলো উন্মোচন করার একটি পদ্ধতি। হুসার্লের মতে, আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে আমরা যেসব পূর্ব-ধারণা, বিশ্বাস, এবং জাগতিক অনুমান (pre-conceptions and worldly assumptions) নিয়ে কোনো অভিজ্ঞতাকে বিচার করি, সেগুলো প্রায়শই সেই অভিজ্ঞতার প্রকৃত স্বরূপকে আড়াল করে রাখে। এই অনুমানগুলো আমাদের দেখার ভঙ্গি, বোঝার ক্ষমতা এবং এমনকি আমাদের অনুভূতির ওপরও প্রভাব ফেলে।

এই বাধাগুলো অতিক্রম করার জন্য হুসার্ল 'এপোখে' (Epoché) বা 'বন্ধনীবদ্ধকরণ' ধারণাটি প্রস্তাব করেন। এপোখে হলো একটি পদ্ধতি, যেখানে আমরা সচেতনভাবে আমাদের সমস্ত পূর্ব-ধারণা এবং জাগতিক অনুমানকে স্থগিত রাখি, বা একটি বন্ধনীর মধ্যে স্থাপন করি। এর অর্থ এ নয় যে, আমরা সেগুলোকে অস্বীকার করছি বা বাতিল করছি; বরং আমরা সাময়িকভাবে সেগুলোকে বিচার-বিশ্লেষণ থেকে বিরত রাখছি, যাতে অভিজ্ঞতার মূল কাঠামো বা 'সারাংশ' (essence) আমাদের কাছে উন্মোচিত হতে পারে।

এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, চেতনা ধীরে ধীরে তার বহিরাগত আবরণ সরিয়ে ফেলে এবং তার নিজস্ব 'বিশুদ্ধ' (pure) রূপে ফিরে আসে। এই বিশুদ্ধ চেতনার মাধ্যমে আমরা অভিজ্ঞতার বস্তুনিষ্ঠ এবং ভেতরের দিকটি অনুধাবন করতে পারি, যা প্রাত্যহিক জীবনের নানা সীমাবদ্ধতা ও অনুমান দ্বারা প্রভাবিত হয় না। ফলস্বরূপ, আমরা কোনো বস্তুর বা ঘটনার মূল কাঠামো এবং তার 'প্রকৃত অর্থ' উপলব্ধি করতে সক্ষম হই, যা আমাদের প্রাক্‌-ধারণা এবং সাধারণ পর্যবেক্ষণের বাইরে থাকে। হুসার্লের এই পদ্ধতি দর্শনের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে, যা চেতনা এবং অভিজ্ঞতার গভীরতা অন্বেষণে সহায়ক।

‘বাধ-ব্যবহার’ ধারণাটিও এই বিশুদ্ধিকরণের পথ নির্দেশ করে, যেখানে জ্ঞানের প্রতিটি স্তরে আমরা অপ্রয়োজনীয় উপাদান বাদ দিয়ে আরও গভীর এবং মৌলিক সত্যের দিকে অগ্রসর হই। এটি কোনো সরলরৈখিক অগ্রগতি নয়, বরং একটি বহুস্তরীয় প্রক্রিয়া, যেখানে আত্ম-প্রতিফলন এবং নিরন্তর জিজ্ঞাসার মাধ্যমে জ্ঞান তার সর্বোচ্চ বিশুদ্ধতায় পৌঁছায়। এই প্রক্রিয়াটি ব্যক্তিকে কেবল বাহ্যিক জগৎ সম্পর্কেই নয়, নিজের ভেতরের সত্তা সম্পর্কেও এক গভীর উপলব্ধি প্রদান করে, যা তাকে চূড়ান্ত মুক্তি এবং আত্ম-উপলব্ধির দিকে পরিচালিত করে।

অদ্বৈতের দৃষ্টিতে মুক্তি বা মোক্ষ মানে হলো সমস্ত বাধ-ব্যবহারের সমাপ্তি। প্রাতিভাসিক ও ব্যাবহারিক উভয় স্তরই তখন পারমার্থিক জ্ঞানে মিশে যায়। ঋষি তখন জগৎকে অস্বীকার করেন না, বরং জানেন—জগৎ ব্রহ্মেরই বিভ্রান্ত প্রতিবিম্ব। বেদান্তে তাই বলা হয়—“ব্রহ্ম সত্যং জগৎ মিথ্যা, জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ।” এখানে “মিথ্যা” মানে ধ্বংস নয়, বরং বাধিত—অর্থাৎ, জগৎ অভিজ্ঞতার স্তরে আছে, কিন্তু চূড়ান্ত স্তরে নেই। জ্ঞান-প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে সমস্ত অভিজ্ঞতা ব্রহ্মে লীন হয়, কিন্তু ব্রহ্ম কোনো অভিজ্ঞতার বিষয় নয়—সে চিরসাক্ষী।

বাধ-ব্যবহার তাই বেদান্তের সেই জ্ঞানতত্ত্ব, যা বলে—অস্বীকার মানে ধ্বংস নয়, বরং উন্মোচন; প্রতিটি নিম্নতর সত্য যতক্ষণ পর্যন্ত উচ্চতর জ্ঞানে বাধিত না হচ্ছে, ততক্ষণ তা ব্যাবহারিকভাবে সত্য। কিন্তু চূড়ান্ত জ্ঞান উদিত হলে আর কোনো বাধের প্রয়োজন থাকে না, কারণ তখন সমস্ত ভেদই বিলীন, থাকে কেবল সেই স্বয়ং-আলোকিত চেতনা—ব্রহ্ম, যা কখনও বাধিত হয় না, কখনও অতিক্রান্ত হয় না, কেবল সাক্ষীরূপে চিরন্তন।

অবশেষে, সব দেহ, সব অবস্থান, সব ভেদ বিলীন হয়ে আত্মা নিজের অচল স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন চেতনা নিজেকেই প্রত্যক্ষ করে—না কর্তা, না ভোক্তা, না দ্রষ্টা—বরং একমাত্র চিদানন্দরূপ ব্রহ্ম, যা সব কিছুর অন্তর্লীন সত্তা। তখন দৃশ্য, দ্রষ্টা ও দর্শন—সব একে অপরের মধ্যে দ্রবীভূত; থাকে কেবল সেই স্বয়ং-আলোকিত, অবিনশ্বর চেতনা, যা কোনো কিছুর সাক্ষী নয়, বরং যার উপস্থিতিতেই সব কিছু প্রতীয়মান। এটাই অদ্বৈত বেদান্তের চূড়ান্ত উপলব্ধি—সাক্ষী-দৃক্‌-সম্বন্ধের পরিপূর্ণ লয়, যেখানে চেতনা ও অস্তিত্ব একই সত্তায় একীভূত।

“Cosmic Spiritual Anatomy”—এই ধারণাটি অদ্বৈত বেদান্ত, যোগ, এবং আধুনিক সমন্বিত আধ্যাত্মিক দর্শনের মিলনবিন্দুতে দাঁড়িয়ে-থাকা এক গভীর ও বিস্তৃত প্রতিফলন। এটি সেই অন্তঃকরণগত নকশা, যার মধ্যে ব্যক্তিগত আত্মা (jīva) ও মহাজাগতিক চেতনা (Brahman)—দুই-ই পরস্পরের প্রতিফলনরূপে উন্মোচিত হয়। এটি কোনো ভৌত বা দেহগত শারীরস্থান নয়, বরং এক চেতনা-স্থাপত্য (architecture of consciousness), যেখানে মন, প্রাণ, বুদ্ধি, ও আত্মা—ক্রমশ স্থূল থেকে সূক্ষ্মতর স্তরে বিন্যস্ত হয়ে ব্রহ্মচেতনায় মিলিত হয়।