অবিদ্যা-বিদ্যা: ৮২


নিও-বেদান্তের দৃষ্টিতে, যেমন স্বামী বিবেকানন্দ, অরবিন্দ বা নিসর্গদত্ত এই ধারণাকে মানবচেতনার বিকাশের প্রতীক হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন: ব্যক্তিসত্তা আসলে মহাচেতনার এক সীমাবদ্ধ প্রকাশ; যোগ ও জ্ঞানসাধনার মাধ্যমে এই সীমা দ্রবীভূত হলে সেই চেতনা নিজের উৎসে, মহাচেতনায়, পুনঃপ্রবেশ করে।

অবচ্ছেদবাদ শেখায় যে, জীব ও ব্রহ্মের বিভেদ কোনো প্রকৃত বা সত্তাতাত্ত্বিক (ontological) বাস্তবতা নয়, বরং অধ্যাসগত বা জ্ঞানতাত্ত্বিক (epistemic) বিভ্রম—অবিদ্যার দ্বারা সৃষ্ট এক জ্ঞানগত সীমারেখা। চেতনা সর্বদাই এক ও অবিভাজ্য; দেহ-মন-ইন্দ্রিয় কেবল সেই এক চেতনার ওপর সীমারেখা টানে, যার ফলে “আমি” বলে একটি সীমিত অভিজ্ঞতা জন্ম নেয়। জ্ঞান বা আত্মবোধের মুহূর্তে এই সীমারেখা গলে যায়, অবচ্ছেদ বিলুপ্ত হয়, এবং আত্মা নিজের চির-অসীম স্বরূপে উদ্ভাসিত হয়। তখন আর “আমি” বা “তুমি”, “ভিতর” বা “বাহির” কোনো ভেদ থাকে না—থাকে কেবল এক অবিভাজ্য চিদাকাশ, চির-সাক্ষী ব্রহ্ম, যা সর্বদা নিজেরই আলোকিত উপস্থিতি।

এই উপলব্ধির মুহূর্তেই প্রমাণ বিলীন হয় অপরোক্ষ-অভিজ্ঞতায়; “জানা” একতা লাভ করে “থাকা”-র সঙ্গে। তখন আত্মা আর কোনো দ্রষ্টা নয়, কারণ সে যা দেখছিল, তা-ই সে নিজে। প্রপঞ্চ আর বিলোপের বস্তু নয়; বরং উন্মোচিত হয় যে, কখনও কিছুই ব্রহ্মের বাইরে ঘটেনি। এই উপলব্ধিই বাধ-ব্যবহার (Bādha-Vyavahāra)—যেখানে নিম্নতর সত্য উচ্চতর সত্যের আলোয় মিলিয়ে যায়, যেমন স্বপ্ন জাগরণের আলোয় লয়প্রাপ্ত হয়।

অদ্বৈত বেদান্তে বাধ-ব্যবহার (Bādha-Vyavahāra) এক গভীর জ্ঞানতাত্ত্বিক ধারণা, যা সত্য ও মিথ্যার মধ্যবর্তী সূক্ষ্ম সম্পর্ককে প্রকাশ করে। “বাধ” অর্থ ‘অতিক্রম’ বা ‘সংশোধন’—যেখানে নিম্নতর জ্ঞান উচ্চতর জ্ঞানে পৌঁছে তার আপাত-বাস্তবতাকে বিলোপ না করে মিথ্যা হিসেবে প্রকাশ করে। আর “ব্যবহার” মানে সেই অভিজ্ঞতাজগৎ, যা আপাত সত্য বলেই আমাদের সামনে ক্রিয়াশীল। সুতরাং বাধ-ব্যবহার হলো জ্ঞানের এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়া—যেখানে প্রতিটি নিম্নতর সত্য নিজের স্তরে বৈধ, কিন্তু উচ্চতর জ্ঞানে তা সীমিত বলে প্রতীয়মান হয়। এই প্রক্রিয়াই মিথ্যাত্বের প্রকৃত দার্শনিক ভিত্তি।

শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে এই নীতিকে ব্যবহার করেছেন ব্রহ্ম ও জগতের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে—“অবিদ্যোপাধিনিমিতো ব্রহ্মণো ব্যাপারো ন তত্ত্বতঃ”—অর্থাৎ, ব্রহ্মের ক্রিয়াশীলতা বা বহুত্ব দেখা যায় কেবল অবিদ্যা-উপাধির কারণে; সত্যতায় তা নেই। এই বক্তব্যে “বাধ” মানে হলো—যখন ব্রহ্মজ্ঞান উদিত হয়, তখন জগতের আপাত-বাস্তবতা আর টিকে থাকে না, কিন্তু তার অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ বিলুপ্তও হয় না; বরং বোঝা যায়, যা সত্য বলে মনে হচ্ছিল, তা আপাত-সত্য। যেমন স্বপ্নে-দেখা বস্তু জাগ্রত অবস্থায় মিথ্যা বলে প্রকাশিত হয়, কিন্তু সেই স্বপ্নের অভিজ্ঞতা একসময়ে বাস্তব বলে অনুভূত হয়েছিল। এভাবে প্রতিটি স্তরের জ্ঞান পরবর্তী স্তরে অতিক্রান্ত হয়—এই ধারাবাহিক অতিক্রমই বাধ-ব্যবহার।

অদ্বৈতের মতে, সত্য তিন স্তরে প্রকাশিত হয়—প্রাতিভাসিক (ভ্রম বা স্বপ্নসত্য), ব্যাবহারিক (জাগ্রত জগতের সত্য) ও পারমার্থিক (চূড়ান্ত ব্রহ্মসত্য)। প্রাতিভাসিক স্তর বাধিত হয় ব্যাবহারিক সত্যে এবং ব্যাবহারিক সত্য বাধিত হয় পারমার্থিক জ্ঞানে। যেমন অন্ধকারে কেউ দড়িকে সাপ বলে ভুল করলে, আলো জ্বাললে বোঝা যায় সেটি দড়ি; সাপ তখন বাধিত, কিন্তু সম্পূর্ণ অদৃশ্য নয়—স্মৃতিতে তার অভিজ্ঞতা থেকে যায়। তেমনি ব্রহ্মজ্ঞান উদিত হলে জগৎও বাধিত হয়—অদৃশ্য নয়, বরং মিথ্যা বলে প্রতীয়মান হয়। শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে (২.১.১৪) বলেন—“যথা রজ্জুসর্পব্রান্তির্বিনাশে রজ্জুর্ভানম্”—যেমন সাপের ভ্রম দূর হলে দড়ি প্রকাশ পায়, তেমনি জগতের মিথ্যাত্ব প্রকাশ হলে ব্রহ্মের স্বরূপ উদ্ভাসিত হয়।

অদ্বৈত বেদান্তে জ্ঞানের গতিশীলতা বোঝার জন্য “প্রমা-বিরোধ (Pramā-Virodha)” ও “বাধ-ব্যবহার (Bādha-Vyavahāra)” একে অপরের পরিপূরক নীতি। “প্রমা” শব্দটি এসেছে “প্র + মা” থেকে, যার অর্থ “যথার্থ জ্ঞান” বা “অবাধিত সত্য উপলব্ধি”—অর্থাৎ এমন জ্ঞান, যা কোনো উচ্চতর জ্ঞানে বাধিত হয় না। “বিরোধ” মানে অতিক্রম বা পরস্পরবিরোধী অবস্থা। সুতরাং “প্রমা-বিরোধ” বোঝায় এমন এক জ্ঞান-প্রক্রিয়া, যেখানে নিম্নতর বা আংশিক সত্য উচ্চতর জ্ঞানের আলোয় অতিক্রান্ত হয়, কিন্তু সম্পূর্ণ ধ্বংস হয় না। অদ্বৈতের মতে, জ্ঞান ক্রমাগত অগ্রসর হয় নিম্ন থেকে উচ্চতর পর্যায়ে, যেখানে প্রতিটি পর্যায়ে পূর্ববর্তী জ্ঞানের আপাত-বাস্তবতা সীমিত বলে প্রকাশ পায়।

এই অবস্থায় “বাধ” বা sublation বলতে বোঝানো হয়—এক জ্ঞানের দ্বারা অন্য জ্ঞানকে মিথ্যা বা আপাত বলে প্রকাশ করা। স্বপ্নে-দেখা জগৎ স্বপ্নের মধ্যে সত্য, কিন্তু জাগরণের পরে সেই সত্যতা বাধিত হয়; জাগরণের জগৎও ব্রহ্মজ্ঞান উদিত হলে মিথ্যা বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু এই বাধে ধ্বংস নেই—এটি এক প্রকার revelatory transcendence, যেখানে নিম্নতর জ্ঞান বিলোপ নয়, বরং উচ্চতর প্রজ্ঞার দ্বারা আলোকিত হয়ে তার প্রকৃতি প্রকাশ করে। তাই অদ্বৈত বলে—“মিথ্যা তা-ই, যা পরজ্ঞানে বাধিত হয়।” অর্থাৎ, যে-জ্ঞান উচ্চতর জ্ঞানে সীমাবদ্ধ বলে প্রতীয়মান, সেটিই আপাত-সত্য (mithyā-sattā)।

"Revelatory Transcendence" হচ্ছে উদ্ঘাটনমূলক উত্তরণ, প্রকাশক পরোৎক্রমণ (অত্যন্ত দার্শনিক পরিভাষা) বা জ্ঞানমূলক অতীন্দ্রিয়তা (সহজবোধ্য)। এটি এমন একটি দার্শনিক বা আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা, যেখানে অতীন্দ্রিয় (Transcendent) বা জাগতিক সীমার বাইরের কোনো পরম সত্য বা বাস্তবতাকে হঠাৎ করে প্রকাশ (Revelation) বা উদ্ঘাটন করা হয়। এই ধারণার দুটি মূল উপাদান—

১. Transcendence (উত্তরণ/অতীন্দ্রিয়তা): এই জগৎ (দেশ, কাল, কার্যকারণ) থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, ঊর্ধ্বে এবং অসীম সত্তা। যেমন বেদান্তে ব্রহ্ম।

২. Revelatory (উদ্ঘাটনমূলক/প্রকাশক): এই অতীন্দ্রিয় সত্তাটি যুক্তি বা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে ধীরে ধীরে জানা যায় না, বরং এক বিশেষ মুহূর্তে বা উপলব্ধিতে সরাসরি প্রকাশিত হয়।

ভারতীয় দর্শনে এই অভিজ্ঞতাটি প্রায়ই মোক্ষ বা আত্মজ্ঞান লাভের সঙ্গে সম্পর্কিত। যেমন—

উপনিষদ ও বেদান্ত: ব্রহ্মের স্বরূপ হলো সত্যম্‌ জ্ঞানম্‌ অনন্তম্‌। সেই অসীম ব্রহ্মকে যখন জীবাত্মা তাঁর নিজের ভেতরে উপলব্ধি করেন, তখন এই ঘটনাই ঘটে—জীবের কাছে হঠাৎ পরম সত্যটি উদ্ঘাটিত হয় এবং সে তার জাগতিক সীমাবদ্ধতা (অবচ্ছেদ) থেকে উত্তরণ লাভ করে।

বৌদ্ধ দর্শন: নির্বাণের উপলব্ধিও এক ধরনের অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা, যেখানে সমস্ত দুঃখের কারণ বাসনার বিলুপ্তি প্রকাশ পায়।

এটি হলো সীমাবদ্ধ জীবাত্মার কাছে অসীম পরমাত্মার জ্ঞান প্রকাশের একটি নাটকীয় ও গভীর অভিজ্ঞতা।

“প্রমা” বা যথার্থ জ্ঞান ভারতীয় জ্ঞানতত্ত্বের কেন্দ্রীয় ধারণা, যা ন্যায়, বৈশেষিক ও বেদান্ত সকল ধারাতেই অপরিহার্য। প্রমা মানে যথার্থ জ্ঞান—যা বাস্তবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, অবাধিত ও প্রত্যক্ষ-অভিজ্ঞতাজাত সত্য। জ্ঞানকে প্রমা বলে গণ্য করার জন্য তিনটি শর্ত পূরণ জরুরি।

প্রথমত, অব্যভিচারিতা (Non-contradiction): জ্ঞানটি অন্য কোনো জ্ঞানে বাধিত বা মিথ্যা প্রমাণিত হতে পারবে না; যেমন—অন্ধকারে দড়িকে সাপ মনে হওয়া প্রমা নয়, কারণ পরে আলো জ্বাললে সেই জ্ঞান বাধিত হয়।

দ্বিতীয়ত, অধিগততা (Novelty): জ্ঞানটি নতুন হতে হবে, পূর্বে পরিচিত বা স্মৃতিজাত জ্ঞান প্রমা নয়।

তৃতীয়ত, যথার্থতা (Veridicality): জ্ঞানটি বস্তুর প্রকৃত স্বরূপের সঙ্গে মেলে, অর্থাৎ জ্ঞেয় ও জ্ঞান একে অপরের প্রতিফলন।

এই প্রমা অর্জনের জন্য যে উপায় বা মাধ্যম ব্যবহৃত হয়, তাকে বলে প্রমাণ (Pramāṇa)—যেমন প্রত্যক্ষ (Perception), অনুমান (Inference), উপমান (Analogy), এবং শব্দ (Verbal testimony বা শাস্ত্রবাক্য)। প্রমাণ হলো জ্ঞান-উৎপাদনের উপায়, আর প্রমা হলো সেই উপায়ের ফল—যথার্থ জ্ঞান। যখন কোনো জ্ঞান পরবর্তী পর্যায়ে ভুল বলে প্রতীয়মান হয়, তখন সেটি প্রমা নয়; সেটি ভ্রম (bhrānti) বা অবিধিত জ্ঞানের অভাব (অনুপস্থিতি)।

উপনিষদ এবং বেদান্তে 'অবিধিত' (যা জানা যায় না) শব্দটি প্রায়শই ব্রহ্ম বা পরমাত্মার স্বরূপ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এই প্রসঙ্গে এর অর্থ হয়—জ্ঞানের অতীত, যা সাধারণ জ্ঞানেন্দ্রিয়, মন বা বুদ্ধি দ্বারা জানা সম্ভব নয়। ব্রহ্মকে জানার জন্য সাধারণ 'জ্ঞান-ব্যাপার' যথেষ্ট নয়। ব্রহ্ম বা আত্মা হলো জ্ঞাতা (Subject), তাই তিনি কোনো জ্ঞেয় বস্তু (Object) হতে পারেন না। যদি তিনি জ্ঞেয় বস্তু হতেন, তবে তা সীমিত হয়ে যেত, কিন্তু ব্রহ্ম হলেন অনন্তম্ (অসীম)।

ব্রহ্ম কেন অবিধিত? তৈত্তিরীয় উপনিষদে বলা হয়েছে, ব্রহ্মকে 'সৎ-চিৎ-আনন্দ' রূপে জানতে হয়। যদি কেউ ব্রহ্মকে শুধু একটি জানা বস্তু (বিধিত) হিসেবে দেখে, তবে সে তাকে ভুল জানে, আবার সম্পূর্ণভাবে অজানা (অবিধিত) হিসেবে দেখলে সেটাও ভুল।

দার্শনিক অর্থে, অবিধিত জ্ঞান মানে সেই পরম সত্য, যা আমাদের সাধারণ জ্ঞানের সীমার বাইরে এবং যা কেবল revelatory transcendence (উদ্ঘাটনমূলক অতীন্দ্রিয়তা) বা প্রত্যক্ষ উপলব্ধির মাধ্যমেই জানা সম্ভব, কোনো সাধারণ পদ্ধতি দ্বারা নয়।

'অবিধিত জ্ঞান' পদটি প্রায়শই ব্রহ্ম-এর স্বরূপ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, কারণ ব্রহ্ম সাধারণ জ্ঞানেন্দ্রিয় বা বুদ্ধি দ্বারা জ্ঞেয় বস্তু (Object) হতে পারেন না। যদি ব্রহ্মকে 'জানা' যেত, তবে তিনি সীমিত হয়ে পড়তেন। তাই ব্রহ্ম এমন এক সত্তা, যা আমাদের সাধারণ জ্ঞানের ক্ষেত্রে অবিধিত থেকে যান, যতক্ষণ না আত্মজ্ঞান (Self-realization) হয়।

সমস্ত জাগতিক ভ্রম (যেমন জগৎকে সত্য বলে মনে করা) মূলত অবিধিত জ্ঞান বা পরম সত্যের অজ্ঞতার কারণে ঘটে। যতক্ষণ পর্যন্ত ব্রহ্ম (পরম সত্য) আমাদের কাছে অবিধিত থাকে, ততক্ষণ আমরা মায়ার দ্বারা সৃষ্ট ভ্রমকে সত্য বলে ধরে নিই। অর্থাৎ, ভ্রম হলো ফল, আর ব্রহ্ম সম্পর্কে অজ্ঞতা (অবিধিত জ্ঞানের অভাব) হলো সেই ভ্রমের মূল কারণ। মুক্তি হলো অবিধিতকে "জানার" (উপলব্ধি করার) মাধ্যমে ভ্রমকে দূর করা।

"অবিধিত জ্ঞান" (Avidhita Jñāna) হলো এমন একটি ধারণা, যা মূলত উপনিষদের জ্ঞানতত্ত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। এর মাধ্যমে বোঝানো হয় যে, জ্ঞান সাধারণ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা বুদ্ধিগ্রাহ্য জ্ঞানের সীমার বাইরে, এবং তাই তা অজানা বা অসাধারণ উপলব্ধির বিষয়। এই ধারণাটির মূল উৎস হলো কেন উপনিষদ (Kena Upaniṣad), যেখানে ব্রহ্মের স্বরূপ বর্ণনা করা হয়েছে।

"ন তত্র চক্ষুগচ্ছতি ন বাগ্গচ্ছতি নো মনঃ। ন বিদ্মঃ ন বিজানীমো যথেতদনুতিষ্যাৎ।।" (কেন উপনিষদ, ১.৩) অর্থাৎ, সেখানে চোখ পৌঁছায় না, বাক্য পৌঁছায় না, মনও না। আমরা জানি না (ন বিদ্মঃ), আমরা জানতে পারি না (ন বিজানীমঃ), কী করে তা (ব্রহ্মকে) উপদেশ দেওয়া যায়।

এই শ্লোকের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় যে, ব্রহ্ম সাধারণ জ্ঞানেন্দ্রিয়, বাক্য বা মনের বিষয় নন—অর্থাৎ, তিনি সাধারণ অর্থে 'অবিধিত' (যা জানা যায় না)। কেন উপনিষদের পরবর্তী শ্লোকগুলিতে (যেমন ১.৪) এই বিষয়টি আরও স্পষ্ট করা হয়েছে—

ব্রহ্ম জ্ঞেয় বস্তু নন: ব্রহ্ম বা আত্মা হলেন জ্ঞাতা (Subject of Knowledge) বা চৈতন্যস্বরূপ। তাই তাঁকে কোনো জ্ঞেয় বস্তু (Object of Knowledge) হিসেবে মন বা বুদ্ধি দ্বারা জানা সম্ভব নয়। যদি তিনি জ্ঞেয় হতেন, তবে তিনি অনন্ত (অসীম) না হয়ে সীমিত হয়ে যেতেন।

জ্ঞানেরও অতীত: কেন উপনিষদের ১.৪ (ন তত্র চক্ষুর্গচ্ছতি...) এবং এর পরের শ্লোক (১.৫) ইঙ্গিত দেয় যে, ব্রহ্ম সাধারণ 'জানা' (Known) এবং 'অজানা' (Unknown)—উভয়ের ঊর্ধ্বে।

উপলব্ধিই পথ: ব্রহ্মকে সাধারণ পদ্ধতিতে জানা যায় না (অবিধিত), কিন্তু আত্মজ্ঞান বা প্রত্যক্ষ উপলব্ধির মাধ্যমে তাঁকে অনুভব করা সম্ভব।

'অবিধিত জ্ঞান' বলতে তাই সেই পরম সত্যকে বোঝানো হয়, যা সাধারণ জ্ঞানের মাধ্যমে অগম্য, কিন্তু আধ্যাত্মিক উত্তরণ (revelatory transcendence)-এর মাধ্যমে উপলব্ধিযোগ্য। ‘বিধিত’ হচ্ছে ‘যা জ্ঞাত (informed, known) বা যা জ্ঞাত হওয়া যায়’; আর এর উলটোটাই ‘অবিধিত’।