অবিদ্যা-বিদ্যা: ৮১



এই ধারণাটি জ্ঞানতত্ত্বে যেমন প্রাথমিক উপাদান, তেমনি অস্তিত্বতত্ত্বেও এর গভীর দার্শনিক প্রভাব রয়েছে। বেদান্তে আত্মা (Ātman) হল স্বপ্রকাশ, স্বতঃসিদ্ধ, নিরুপাধি, চিরন্তন ও অদ্বিতীয় চেতনা; আর অনাত্মা (Anātman) হল পরিবর্তনশীল, নির্ভরশীল ও উপাধিসমূহে সীমাবদ্ধ জগৎ, দেহ ও মন। কিন্তু অবিদ্যা (Avidyā) বা অজ্ঞানতার প্রভাবে এই দুইয়ের গুণ একে অপরের উপর আরোপিত হয়—চেতনা (আত্মা)-র অচঞ্চল দীপ্তি জড় (অনাত্মা)-তে প্রতিফলিত হয়, আর জড়ের পরিবর্তন, সীমাবদ্ধতা ও কৃতৃত্ব আত্মায় আরোপিত হয়। এই মিথ্যা সংমিশ্রণই “আত্মা-অনাত্মা-অধ্যাস”—যেখানে “আমি” (আত্মা) নিজের সীমাহীন, নিরুপাধি স্বরূপ ভুলে শরীর-মন-বুদ্ধির সীমিত পরিচয়ে আবদ্ধ হয়ে পড়ে।

অনাত্মা বলতে সেই সব বস্তু বা সত্তাকে বোঝানো হয়, যা আত্মা (Ātman) বা ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন, অসত্য এবং বিনাশী (নশ্বর)। অনাত্মা হলো সেই সমস্ত জড় উপাদান, যা আত্মার উপর ভ্রান্তিবশত আরোপিত হয়েছে। অনাত্মা মূলত মানুষের মিথ্যা পরিচয় বা উপাধি এবং জাগতিক অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র। একে সাধারণত পাঁচটি স্তরে বা পঞ্চকোষে (Kośas) ভাগ করা হয়:

১. অন্নময় কোষ: স্থূল শরীর (দেহ)। এটি খাদ্য থেকে উৎপন্ন হয় এবং খাদ্যেই লীন হয়। ২. প্রাণময় কোষ: জীবনী শক্তি (Prāṇa)। এটি শ্বাস-প্রশ্বাস, ক্ষুধা, তৃষ্ণা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে। ৩. মনোময় কোষ: মন। এটি চিন্তা, কল্পনা, ইচ্ছা এবং সংশয়ের ক্ষেত্র। ৪. বিজ্ঞানময় কোষ: বুদ্ধি (Buddhi) ও জ্ঞানেন্দ্রিয়। এটি বিচার, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও অহংকার নিয়ন্ত্রণ করে। ৫. আনন্দময় কোষ: কারণ শরীর বা অজ্ঞানের স্তর। এটি সুষুপ্তির আনন্দ এবং অজ্ঞানের কারণ। এই পাঁচটি কোষই হলো অনাত্মা। এগুলো পরিবর্তনশীল, সীমিত এবং অচেতন (Jada)। এদেরকে ভুল করে 'আমি' বলে মনে করার ফলেই জীব বন্ধন ও দুঃখ ভোগ করে।

অনাত্মাকে 'আমি' বা 'আমার' মনে করাই হলো অবিদ্যা বা অজ্ঞানতা (Ignorance)। এই অজ্ঞানের ফলেই মানুষ জন্ম-মৃত্যুর চক্রে (সংসার) আবদ্ধ থাকে। বেদান্তের মূল লক্ষ্য হলো নিত্য আত্মা এবং অনিত্য অনাত্মা-র মধ্যেকার পার্থক্য (আত্মা-অনাত্মা বিবেক) উপলব্ধি করা। যখন জীবাত্মা বুঝতে পারে যে, সে এই পাঁচটি কোষ থেকে পৃথক, শুদ্ধ এবং অপরিবর্তনশীল, তখনই সে মোক্ষ লাভ করে।

ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যের ভূমিকায় (অধ্যাস ভাষ্য) শঙ্করাচার্য স্পষ্ট করে বলেন, “আত্মানাত্মনোঃ ইতরেতরাধ্যাসঃ অবিদ্যা।” অর্থাৎ, আত্মা এবং অনাত্মার ধর্মকে পরস্পরের ওপর আরোপ করাই হলো অবিদ্যা বা অজ্ঞানতা। এই অবস্থায় মানুষ নিজের শরীর, মন ও ইন্দ্রিয়কে আত্মা বলে ভুল করে। সে বলে—“আমি ক্ষুধার্ত”, “আমি সুখী”, “আমি চিন্তা করছি”; যেখানে আসলে—“ক্ষুধা” দেহের ধর্ম, “সুখ-দুঃখ” মনের, “চিন্তা” বুদ্ধির; আত্মা কেবল এই সব অভিজ্ঞতার সাক্ষী, অংশগ্রহণকারী নয়। তবু অধ্যাসের ফলে আত্মা অনাত্মার গুণে ও রঙে রঞ্জিত হয়ে “অহং” বা কর্তা-ভোক্তা রূপ ধারণ করে, এবং সেখান থেকেই উৎপন্ন হয় সংসার, কর্মফল ও দুঃখ।

এই অধ্যাসের রূপগুলি তিন স্তরে প্রকাশ পায়—স্থূল শরীর, সূক্ষ্ম শরীর, এবং কারণ শরীর। স্থূল দেহে আত্মা বলে—“আমি মানুষ”, “আমি বালক”—এখানে দেহের সীমাবদ্ধতা আত্মায় আরোপিত হয়েছে। সূক্ষ্ম দেহে আত্মা বলে—“আমি ভাবছি”, “আমি জানি”, “আমি সিদ্ধান্ত নিচ্ছি”—এখানে মন ও বুদ্ধির পরিবর্তনশীলতা আত্মার অচল স্বরূপে আরোপিত হয়েছে। আর কারণ শরীরে আত্মা বলে—“আমি অচেতন ছিলাম”—যেখানে গভীর নিদ্রার অজ্ঞানতাকে আত্মার প্রকৃত অবস্থা বলে মনে করা হয়। (আত্মা অচেতন থাকলে জানল কী করে যে, সে অচেতন ছিল?) এই তিন দেহ বা উপাধিই অনাত্মা; আত্মা কখনোই তাদের সঙ্গে অভিন্ন নয়।

তবে এই অধ্যাস নিছক জ্ঞানগত বিভ্রম নয়, বরং এটি এক সত্তাতাত্ত্বিক অধ্যাস বা অধ্যাস (ontological superimposition)—অস্তিত্বের স্তরে ঘটে-যাওয়া এক মিথ্যা সংযোগ। আত্মা কখনও পরিবর্তিত হয় না, কিন্তু অনাত্মার ভেদ-বাহুল্য ও পরিবর্তন আত্মার প্রতিফলনে মিথ্যা সত্যরূপ ধারণ করে। যেমন—আয়নায় মুখের প্রতিবিম্ব দেখা যায়, কিন্তু মুখ কখনও আয়নায় মিশে যায় না; তবু দর্শক মনে করে, মুখই যেন আয়নায় প্রবিষ্ট হয়েছে। আত্মা-অনাত্মা-অধ্যাসও তেমন—চেতনা নিজে পরিবর্তিত নয়, কিন্তু প্রতিফলনের বিভ্রমে সে নিজেকে সীমিত ও সংসারবদ্ধ বলে মনে করে।

জ্ঞান বা বিবেক-এর দ্বারা এই অধ্যাস ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়। “আত্মা-অনাত্মা-বিবেক” মানে চেতনা ও তার প্রতিফলনের পার্থক্য নির্ণয়। ধ্যান, মনন ও শ্রবণ—এই তিন প্রক্রিয়ায় যখন মন শুদ্ধ হয়, তখন আত্মার স্বরূপ নিজেই উদ্‌ভাসিত হয়। তখন দেখা যায়, যা “আমি” বলে মনে হচ্ছিল, তা আসলে অনাত্মা, আর প্রকৃত “আমি” কখনোই জন্মেনি, মরে না, পরিবর্তিত হয় না।

অদ্বৈত বেদান্তে এই প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত অবস্থা হলো বাধ-ব্যবহার (Bādha-Vyavahāra)—যেখানে অনাত্মা ধ্বংস হয় না, বরং তার মিথ্যাত্ব উদ্ঘাটিত হয়। মরীচিকায় জল অদৃশ্য হয় না, কিন্তু জানা যায়, তা জল নয়; তেমনি জগৎ থাকে, কিন্তু দেখা যায়, তা ব্রহ্মের প্রতিভাসমাত্র। আত্মা তখন কেবল “সাক্ষী-দৃক্” রূপে অবশিষ্ট থাকে—অর্থাৎ দ্রষ্টা—কিন্তু কখনোই দৃশ্য নয়।

এই অবস্থায় আত্মা-অনাত্মা-অধ্যাস সম্পূর্ণরূপে লুপ্ত হয়। জ্ঞানী জানেন—“দেহ, মন, বুদ্ধি—সবই উপাধি, আমি কেবল স্বয়ংচেতনা।” আত্মা তখন হয়ে ওঠে নিঃশর্ত সত্তা, চিদানন্দ-ঘন, যেখানে আর কোনো ভেদ নেই। এই অবস্থায় মুক্তি মানে কোনো পরিবর্তন নয়; এটি আত্মার স্বরূপে প্রত্যাবর্তন, অবিদ্যা-প্রক্ষেপিত অনাত্মা-অধ্যাসের অন্তর্ধান।

আত্মা-অনাত্মা-অধ্যাস অদ্বৈত বেদান্তে শুধু মানসিক বিভ্রম নয়, বরং চেতনা ও মায়ার অন্তঃক্রিয়ায় গঠিত এক সত্তাতাত্ত্বিক প্রক্ষেপণ। এর বিলোপই ব্রহ্ম-সাক্ষাৎকার, যেখানে দ্রষ্টা ও দৃশ্য এক হয়ে যায়, এবং থাকে কেবল এক অবিভাজ্য চিদাকাশ—চির-সাক্ষী আত্মা, যার বাইরে আর কিছুই সত্য নয়।

এখানে অবচ্ছেদবাদ (Avaccheda-Vāda)-এর তত্ত্ব প্রযোজ্য। ব্যক্তিসত্তা কোনো স্বাধীন সত্তা নয়; সে অসীম চেতনারই একটি সীমাবদ্ধ প্রতিফলন—যেমন পাত্রে-ধরা আকাশ ঘটাকাশ, যা আসলে মহাকাশেরই অংশ। পাত্র ভাঙলে ঘটাকাশ আর মহাকাশের ভেদ থাকে না; তেমনি উপাধি-নিবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে আত্মা নিজের নিরুপাধি স্বরূপে প্রকাশিত হয়। স্থূল, সূক্ষ্ম, কারণ—সবই মায়ার পরত; জ্ঞানের সূর্য উঠলে এই মেঘমালা সরে যায়, এবং থাকে কেবল সেই এক চিদানন্দ—নিজের স্বয়ংজ্যোতিষ্ময় সত্তা।

অদ্বৈত বেদান্তে অবচ্ছেদবাদ (Avaccheda-vāda) একটি মৌলিক ও সূক্ষ্ম উপপত্তি (যুক্তিগত ব্যাখ্যা বা কার্য-কারণ সম্পর্ক, যা কোনো অনুমিত সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে), যা এক চেতনার মধ্যকার বহু জীবের আপাত-ভেদ ব্যাখ্যা করতে ব্যবহৃত হয়। এর মূল উদ্‌ভাবক পদ্মপাদাচার্য (Padmapāda, শঙ্করাচার্যের শিষ্য) তাঁর পঞ্চপাদিকা-গ্রন্থে এই তত্ত্ব উপস্থাপন করেন, এবং পরে প্রকাশাত্মন তাঁর পঞ্চপাদিকা-বিভাষ্য-এ একে আরও সুসংহতভাবে ব্যাখ্যা করেন। এই তত্ত্বের উদ্দেশ্য হলো বোঝানো যে, ব্যক্তিসত্তার সীমাবদ্ধতা প্রকৃত নয়, বরং আত্মা বা ব্রহ্মচেতনা এক এবং সর্বব্যাপী হলেও, দেহ-মন-ইন্দ্রিয়ের উপাধি দ্বারা আপাতভাবে সীমিত বলে প্রতীয়মান হয়। এই সীমাবদ্ধতা কোনো বাস্তব বিভাজন নয়, বরং চেতনার উপর উপাধির আরোপিত “সীমা” বা “অবচ্ছেদ”—যা কেবল জ্ঞানগত, অস্তিত্বগত নয়।

“অবচ্ছেদ” শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘সীমা’, ‘বিভাগ’ বা ‘পরিসীমা’। অবচ্ছেদবাদের কেন্দ্রীয় উপমাটি আকাশ বা ākāśa-এর: যেমন একই আকাশ ঘট, ঘর বা গুহার দ্বারা সীমাবদ্ধ মনে হয়, তেমনি এক ব্রহ্মচেতনা দেহ-মন-ইন্দ্রিয়রূপ উপাধির দ্বারা সীমাবদ্ধ বলে মনে হয়। ঘটাকাশ ও মহাকাশ বাস্তবে অভিন্ন, কিন্তু ঘটের প্রাচীরের জন্য তাদের মধ্যে আপাত ভেদ দেখা দেয়; ঘট ভাঙলেই বোঝা যায়, কখনও কোনো সত্য বিভাজন ঘটেনি। তেমনি, জীবত্ব বা ব্যক্তিসত্তা আসলে সেই ব্রহ্মচেতনারই দেহ-মনরূপ অবচ্ছেদ।

অবচ্ছেদবাদের মর্মকথা হলো যে, চেতনার কোনো বাস্তব বিভাজন (real division) ঘটে না। বিভাজন কেবল সীমার ধারণা মাত্র—যেমন পাত্রে-থাকা জল ও সমুদ্রের জল পৃথক নয়, কিন্তু পাত্রের সীমা তাদের ভিন্ন মনে করায়। আত্মা বা ব্রহ্মচেতনা ঠিক তেমনি সর্বব্যাপী, কিন্তু উপাধির দ্বারা সীমাবদ্ধ দেখায়। উপাধি বা upādhi মানে সেই পরিমিত শর্ত বা পরিবেষ্টন, যা অসীম আত্মাকে সীমিত বলে প্রতীয়মান করে। মন-দেহ-ইন্দ্রিয় এই উপাধিগুলি আত্মাকে সীমাবদ্ধ মনে করায়, কিন্তু আত্মা কখনও প্রকৃতভাবে তাতে প্রবিষ্ট বা পরিবর্তিত হয় না।

এই তত্ত্বটি অন্য দুটি শঙ্করোত্তর ব্যাখ্যা-পদ্ধতির সঙ্গে তুলনা করলে তার বৈশিষ্ট্য আরও স্পষ্ট হয়। অদ্বৈত পরম্পরায় আত্মা-জীব-ব্রহ্ম সম্পর্ক বোঝাতে প্রধানত তিনটি ব্যাখ্যা ব্যবহৃত হয়েছে—আভাসবাদ (Ābhāsa-vāda), প্রতিবিম্ববাদ (Pratibimba-vāda) এবং অবচ্ছেদবাদ (Avaccheda-vāda)। ভামতী-প্রপঞ্চের আবসবাদে বলা হয় যে, ব্যক্তিচেতনা ব্রহ্মচেতনারই এক মৃদু প্রতিরূপ বা আভাস। বিদ্যারণ্য-র প্রতিবিম্ববাদে মনরূপ দর্পণে আত্মাচেতনা প্রতিফলিত হয়ে জীবচেতনা সৃষ্টি করে—অর্থাৎ, ব্রহ্মচেতনার প্রতিফলনই জীব। কিন্তু অবচ্ছেদবাদে কোনো প্রতিফলনের কথা নেই; এখানে বলা হয়, এক ও অবিভাজ্য চেতনা উপাধির দ্বারা কেবল সীমিত বলে প্রতীয়মান হয়, যেমন আকাশ ঘটের দ্বারা সীমিত বলে মনে হয়। প্রতিবিম্ববাদে উপাধি আয়নার মতো, আর অবচ্ছেদবাদে উপাধি ঘটের মতো—দু-ক্ষেত্রেই মূল চেতনা অপরিবর্তিত থাকে, কিন্তু ভ্রম হয় সীমা বা প্রতিবিম্বের কারণে।

অবচ্ছেদবাদের মতে, মুক্তি (mokṣa) মানে কোনো নতুন অবস্থা অর্জন নয়; এটি কেবল উপাধি-নিবৃত্তি (upādhi-nivṛtti)—অর্থাৎ সীমাবদ্ধতার ধারণার বিলোপ। যতক্ষণ পর্যন্ত আত্মা নিজেকে দেহ, মন ও ইন্দ্রিয়ের দ্বারা নির্ধারিত মনে করে, ততক্ষণ সে “ঘটাকাশ”; কিন্তু যখন জ্ঞান দ্বারা উপলব্ধি করে যে, “আমি সেই সর্বব্যাপী মহাকাশ”, তখন উপাধির অবচ্ছেদ বিলুপ্ত হয়। ভাষ্য-পরম্পরায় তাই বলা হয়েছে—“অবচ্ছেদনিবৃত্তিরূপা মুক্তিঃ”—অবচ্ছেদ বা (মিথ্যা) সীমাবদ্ধতার নিবৃত্তি বা অপসারণই হলো মুক্তি। মুক্তি মানে তাই সীমার ধারণা বিলুপ্ত হওয়া। মুক্তি হলো আত্মার নিত্য স্বরূপ, যা শুধুমাত্র অজ্ঞানের অপসারণের অপেক্ষায় থাকে। ঘট ভাঙলে ঘটাকাশ ও মহাকাশ মিশে যায় না, কারণ তারা কখনও পৃথক ছিল না; কেবল সীমার ভ্রমটি লুপ্ত হয়। তেমনি মুক্তিও কোনো গমন নয়, বরং এক অন্তর্দৃষ্টির উন্মোচন, যেখানে দেখা যায় যে ব্যক্তি-চেতনা সর্বদাই ব্রহ্মচেতনার অঙ্গ।

দার্শনিকভাবে অবচ্ছেদবাদ এক সূক্ষ্ম সত্তাতাত্ত্বিক নীতি নির্দেশ করে—সীমা সৃষ্টি করে অভিজ্ঞতার ভেদ, কিন্তু বাস্তবতার ভেদ নয়। আধুনিক phenomenology-র ভাষায় বলতে গেলে, এটি এক intentional delimitation—চেতনার একক প্রবাহ বিভিন্ন ‘অবজেক্ট’ বা উপাধির মাধ্যমে সীমাবদ্ধ বলে প্রতীয়মান হয়। অর্থাৎ, আমাদের চেতনা (Consciousness) আসলে একটি অসীম, অবিচ্ছিন্ন প্রবাহ। কিন্তু যখনই এই চেতনা কোনো একটি নির্দিষ্ট বস্তুর (Object) উপর মনোনিবেশ করে, তখনই এটি সেই বস্তুর আকার নেয় এবং সীমাবদ্ধ হয়ে যায়।

এটি Intentional (অভিপ্রায়মূলক), কেননা চেতনার একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো, এটি সর্বদা কোনো কিছুর প্রতি নির্দেশিত। চেতনা কখনও 'খালি' থাকে না, এটি সবসময় কোনো একটি বস্তুকে 'লক্ষ্য' করে। এর Delimitation (সীমাবদ্ধতা) হলো, যখন চেতনা কোনো একটি বস্তুর উপর লক্ষ্য রাখে, তখন এটি সেই নির্দিষ্ট বিষয়ের মধ্যেই নিজেকে গুটিয়ে নেয়—অর্থাৎ, চেতনা নিজেকে সেই বস্তুর দ্বারা সীমাবদ্ধ করে ফেলে।

আমাদের ভেতরের জ্ঞান বা সচেতনতা হলো বহমান নদীর মতো এক ও অভিন্ন অবিচ্ছিন্ন সত্তা (যেমন বেদান্তে আত্মা বা ব্রহ্ম)। যখন আমি একটি টেবিল দেখছি, তখন আমার চেতনা সেই মুহূর্তে 'টেবিল'-এর উপাধি ধারণ করছে; যখন আমি দুঃখ অনুভব করছি, তখন চেতনা 'দুঃখ'-এর উপাধি দ্বারা সীমাবদ্ধ হচ্ছে। চেতনা তার অসীম স্বরূপ ছেড়ে যখনই কোনো নির্দিষ্ট বস্তুকে উদ্দেশ্য করে (intentional) জ্ঞান সৃষ্টি করে, তখনই সেই বস্তুর আকার নিয়ে সাময়িকভাবে সীমাবদ্ধ হয় (delimitation) বা খণ্ড খণ্ড রূপে প্রতিভাত হয়। এটি অনেকটা অদ্বৈত বেদান্তের 'অবচ্ছেদ' (সীমাবদ্ধতা) বা 'অধ্যাস' (আরোপ) ধারণার মতো—যেখানে অসীম আকাশ ঘট বা পাত্রের মাধ্যমে সীমিত বলে মনে হয়।