আত্মা ও মন, বন্ধু ও শত্রু, উদ্ধার ও অধঃপতন—সবই এক চেতনার দুই রূপ; আর জ্ঞানের মাধ্যমে এই দ্বন্দ্ব মিলিয়ে যায় ঐক্যে। বিবেকানন্দ যেমন বলেন, “The mind is not to be killed, it is to be transmuted into the spirit.” এবং, রমণ মহর্ষি সংক্ষিপ্ত ভাষায় বলেন, “Conquer the mind, and you have conquered the world.”
এভাবে, গীতার ৬.৫-এর নব্য-বেদান্তীয় ব্যাখ্যা মানুষের অস্তিত্বের একটি গভীর রূপক হয়ে ওঠে—আত্মা চিরমুক্ত, কিন্তু মনই তার উদ্ধারকর্তা। মন যখন আত্মার দিকে ফিরে যায়, তখন উদ্ধারের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়—জ্ঞান, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় এক হয়ে যায়, এবং মানুষ উপলব্ধি করে: মুক্তি কোনো লক্ষ্য নয়, বরং নিজের প্রকৃত স্বরূপে প্রত্যাবর্তন।
কারণ শরীর (Kāraṇa-Śarīra): স্থূল ও সূক্ষ্ম শরীরের অন্তর্গত স্তর হলো কারণ শরীর, যা গভীর নিদ্রায় প্রকাশ পায়। এখানে চিন্তা, ইন্দ্রিয় বা মন—সবই লয়প্রাপ্ত। চেতনা তখন অভিন্ন শান্তি হিসেবে থাকে—না জাগ্রত, না স্বপ্ন, বরং অবিদ্যার এক নিঃসচেতন সম্ভার। এই অবস্থায় আত্মা “আমি কিছুই জানি না” বলে মনে করে—এটাই অবিদ্যা-অবস্থা। কিন্তু সেই অচেতনতার মধ্যেও আত্মা নিজে কখনও নিস্তেজ নয়; সে সবসময় সাক্ষী, চিরজাগ্রত।
শঙ্করাচার্য বলেন, কারণ শরীর আসলে অবিদ্যার ঘনতম স্তর—এখানে সব সম্ভাবনা সুপ্ত অবস্থায় থাকে। জাগরণে তা প্রকাশিত হয়, স্বপ্নে বিকল্পভাবে প্রকাশিত হয়, আর নিদ্রায় আচ্ছাদিত থাকে। মুক্তির অর্থ এই আচ্ছাদন ভেদ করা, এই অচেতনতার পর্দা সরিয়ে ফেলা।
যখন এই তিন দেহের সঙ্গে আত্মার অভিন্নতা ভেঙে যায়—তখন প্রকাশিত হয় তার স্বরূপ:
উত্তমঃ পুরুষস্ত্বন্যঃ পরমাত্মেত্যুদাহৃতঃ।
যো লোকত্রয়মাবিশ্য বিভর্ত্যব্যয় ঈশ্বরঃ।। (গীতা, ১৫.১৭)
অর্থাৎ, ক্ষর (নশ্বর) ও অক্ষর (অবিনশ্বর) পুরুষ থেকে ভিন্ন এক উত্তম পুরুষ আছেন, যিনি পরমাত্মা বলে অভিহিত হন। সেই অব্যয় (অবিনাশী) ঈশ্বর লোকত্রয়ে (তিন লোকে—স্থূল, সূক্ষ্ম ও কারণ জগৎ) প্রবেশ করে সকলকে ধারণ (পালন) করেন।
শ্লোকটি ক্ষর (নশ্বর) এবং অক্ষর (অবিনশ্বর) পুরুষের ঊর্ধ্বে পুরুষোত্তম বা পরমাত্মার স্বরূপ বর্ণনা করে। এখানে পুরুষোত্তমযোগের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে, যা শ্রীকৃষ্ণের পরম ঈশ্বরত্ব প্রমাণ করে।
ত্রৈপাদ পুরুষ—এই অধ্যায়ে তিনটি সত্তার কথা বলা হয়েছে:
ক্ষর পুরুষ (নশ্বর): সমস্ত জড় জগৎ এবং বদ্ধ জীবসমূহ।
অক্ষর পুরুষ (অবিনশ্বর): মুক্ত জীবাত্মা বা কূটস্থ আত্মা (যা প্রকৃতিতে স্থিত হয়েও পরিবর্তিত হয় না)।
উত্তম পুরুষ (পুরুষোত্তম): ইনি ক্ষর ও অক্ষর—উভয়ের ঊর্ধ্বে। ইনিই পরমাত্মা।
পরমাত্মার কাজ: পরমাত্মা এই সমস্ত জগৎকে ধারণ বা পালন (বিভৃতি) করেন এবং সমস্ত লোকে প্রবিষ্ট (আবিশ্য) আছেন। তিনি অব্যয় (অবিনাশী) এবং ঈশ্বর (শাসক)।
পরবর্তী শ্লোক (১৫.১৮) অনুযায়ী, যিনি এই পুরুষকে ক্ষর ও অক্ষরের ঊর্ধ্বে জানেন, তিনিই পুরুষোত্তম রূপে শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পারেন।
কূটস্থ (Kūṭastha) হলো একটি দার্শনিক পরিভাষা, যা মূলত বেদান্ত ও সাংখ্য দর্শনে ব্যবহৃত হয়। এটি এমন এক সত্তাকে বোঝায়, যা অপরিবর্তনশীল, স্থির, এবং নির্লিপ্ত।
কূটস্থ শব্দটির আভিধানিক বিশ্লেষণ—কূট (Kūṭa): পাহাড়ের চূড়া বা শৃঙ্গ, যা স্থির। হাতুড়ির মাথার মতো যন্ত্র, যা আঘাত করে কিন্তু নিজে স্থির থাকে। মিথ্যা, কপটতা বা ভ্রম। স্থ (Stha): স্থিত বা অবস্থিত। তাই কূটস্থ বলতে বোঝায়—যা পাহাড়ের মতো স্থির ও অচল, বা যা সমস্ত পরিবর্তন ও আঘাতের মধ্যেও নিজের স্বরূপে স্থিত থাকে।
দর্শনের ক্ষেত্রে কূটস্থ ধারণাটি দুইভাবে ব্যবহৃত হয়—
কূটস্থ পুরুষ বা আত্মা (বেদান্ত ও গীতা): শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার পঞ্চদশ অধ্যায়ে (পুরুষোত্তমযোগে) যে অক্ষর পুরুষের কথা বলা হয়েছে, তাকেই কূটস্থ পুরুষ বলা হয়। এটি হলো জীবাত্মার সেই অংশ, যা বন্ধনদশা থেকে মুক্ত বা যা প্রকৃতির প্রভাবে প্রভাবিত হয় না। এটি শরীর, মন ও বুদ্ধির (ত্রিলোকে প্রবিষ্ট) সমস্ত কার্যকলাপের সাক্ষী বা দ্রষ্টা হিসেবে থাকে, কিন্তু নিজে সেই কর্মফলের অংশীদার হয় না। এটি অচল এবং সমস্ত পরিবর্তনকে আলোকিত করে, ঠিক যেমন পাহাড় চূড়া থেকে নিচের সমস্ত দৃশ্য দেখা যায়, কিন্তু চূড়া নিজে স্থির থাকে।
কূটস্থ চৈতন্য (যোগ ও অধ্যাত্ম): সাধনার ক্ষেত্রে, যোগী যখন মনকে স্থির করেন, তখন আজ্ঞাচক্রের (ভ্রূ-মধ্যস্থানে) মধ্যে যে-চৈতন্যবিন্দু বা জ্যোতি দেখা যায়, তাকেও কখনো কখনো কূটস্থ বলা হয়। এটি হলো মনের স্থিতাবস্থা, যেখানে সমস্ত চিন্তা বিলীন হয়। কূটস্থ এমন এক সত্তা যা সমস্ত পরিবর্তনশীলতার মধ্যে অবিচল ও অপরিবর্তিত থাকে। (আজ্ঞাচক্র (Ājñā Chakra) হলো হিন্দু যোগ এবং তান্ত্রিক ঐতিহ্যে বর্ণিত ষষ্ঠ প্রাথমিক চক্র বা শক্তি কেন্দ্র। এটিকে সাধারণত তৃতীয় নয়ন চক্র (Third Eye Chakra) নামেও অভিহিত করা হয়।)
এই অবস্থায় আত্মা আর কোনো দেহ, মন বা অভিজ্ঞতার দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়। তখন জ্ঞাত হয় যে, স্থূল দেহ জগতের খেলায় একটি পোশাক, সূক্ষ্ম দেহ অভিজ্ঞতার যন্ত্র, কারণ দেহ অবিদ্যার ছায়া—আর আত্মা? সে সবসময়ই ছিল, আছে, এবং থাকবে—নিত্য, এক, চিদানন্দস্বরূপ।
যখন এই উপলব্ধি দৃঢ় হয়, তখন জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি—সব অবস্থাই এক ব্রহ্মসত্তার প্রতিফলন বলে প্রতীয়মান হয়। তখন “আমি কে?” প্রশ্নের একমাত্র উত্তর থাকে—“অহম্ ব্রহ্মাস্মি।”
অদ্বৈত বেদান্তে আত্মা কখনোই সীমাবদ্ধ নয়—সে স্বয়ংচিরন্তন, স্বয়ংমুক্ত, শর্তহীন ও অসীম। কিন্তু অবিদ্যার (Avidyā) দ্বিবিধ শক্তি—আবরণ (Āvaraṇa) ও বিক্ষেপ (Vikṣepa)—যখন কার্যকর হয়, তখন এই এক অনন্ত চেতনা যেন “দেহ-মনের” স্তরে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। সেই অসীম আত্মা তখন অভিজ্ঞতার পরিসরে তিনটি স্তরে প্রকাশ পায়—স্থূল শরীর (Sthūla Śarīra), সূক্ষ্ম শরীর (Sūkṣma Śarīra) ও কারণ শরীর (Kāraṇa Śarīra)। এই তিনটি স্তর কোনো স্বাধীন বাস্তব সত্তা নয়, বরং আত্মার ওপর আরোপিত উপাধি (Upādhi)—শর্ত বা সীমারেখা, যার মাধ্যমে নিরুপাধি আত্মা সসীম বলে প্রতীয়মান হয়।
এই তিন দেহই আসলে অবিদ্যার পরিণতি—যেখানে এক চেতনা নিজেকে “আমি” ও “আমার অভিজ্ঞতা” হিসেবে বিভাজিত করে। এখানেই অধ্যাস (Adhyāsa) ঘটে—অর্থাৎ, আত্মার গুণ অনাত্মায় আরোপিত হয়, আর অনাত্মার গুণ আত্মার ওপর প্রতিফলিত হয়। শঙ্করাচার্য তাঁর অধ্যাসভাষ্যে লিখেছেন—“স্মৃতিরূপঃ অধ্যাসঃ”—অর্থাৎ, পূর্ব-অভিজ্ঞতার স্মৃতিবশে এক জিনিসকে অন্য জিনিস বলে ভুল দেখা। এই অধ্যাসই তিন দেহের মূলে, এবং এই অধ্যাসের ফলেই আত্মা জড় জগতের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে হয়।
এই তিন দেহের সঙ্গে অভিজ্ঞতার তিন অবস্থা যুক্ত—জাগ্রত (Jāgrat), স্বপ্ন (Svapna) ও সুষুপ্তি (Suṣupti)। জাগ্রতে আত্মা স্থূল শরীরের মাধ্যমে ইন্দ্রিয়ের জগৎ অনুভব করে, স্বপ্নে সূক্ষ্ম শরীরের মাধ্যমে নিজের মানসিক প্রক্ষেপণে বিচরণ করে, আর সুষুপ্তিতে কারণ শরীরের অচেতন প্রশান্তিতে লীন থাকে। এই তিন অবস্থাই আপাত ভিন্ন, কিন্তু আত্মা—যিনি প্রত্যক্ষদর্শী—অপরিবর্তনীয়। তিন অবস্থার মধ্য দিয়ে চলমান সেই অপরিবর্তনীয় চেতনার সম্পর্কই সাক্ষী-দৃক্-সম্বন্ধ (Sākṣī-Dṛk-Sambandha)—যিনি দেখেন, অথচ নিজে কখনও দেখার বস্তু হন না; যিনি প্রত্যক্ষ করেন, অথচ কখনও প্রত্যক্ষের বিষয় নন।
স্থূল শরীর হলো দৃশ্যমান ও স্পর্শযোগ্য দেহ, যা পাঁচটি স্থূল উপাদান—পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ—দ্বারা গঠিত। এটি জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বহির্জগতে ক্রিয়াশীল। জন্ম, বৃদ্ধি, বার্ধক্য ও মৃত্যু—এই পরিবর্তনগুলিই এর স্বাভাবিক ধর্ম। উপনিষদে একে বলা হয়েছে অন্নময়কোষ (Annamaya Kośa), কারণ এটি খাদ্য দ্বারা উৎপন্ন, খাদ্য দ্বারা রক্ষিত এবং খাদ্যেই বিলীন হয়। গীতার (২.২২) উপমা এখানে যথাযথ—যেমন মানুষ পুরোনো পোশাক ফেলে নতুন পরে, আত্মাও তেমনি পুরোনো দেহ ত্যাগ করে নতুন দেহ গ্রহণ করে। জাগ্রত অবস্থায় আত্মা যখন এই শরীরের সঙ্গে অভিন্নতা অনুভব করে—“আমি মোটা”, “আমি অসুস্থ”, “আমি বৃদ্ধ”—তখনই সর্বাধিক ঘন আত্মা-অনাত্মা-অধ্যাস ঘটে। আত্মার চেতনা দেহে প্রতিফলিত হয়ে এক সাময়িক সত্তার জন্ম দেয়, যা আসলে মায়াময়।
সূক্ষ্ম শরীর অদৃশ্য হলেও ক্রিয়াশীল; এটি পাঁচটি সূক্ষ্ম উপাদান (Tan-Mātra)—শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ দ্বারা গঠিত। এটি গঠিত সতেরোটি অংশে: পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পাঁচ কর্মেন্দ্রিয়, পাঁচ প্রাণ (প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান, সমান) এবং অন্তঃকরণ চতুষ্টয়—মন, বুদ্ধি, অহংকার, চিত্ত। এই শরীরেই সমস্ত চিন্তা, ইচ্ছা, ও অনুভূতি জন্ম নেয়। এখানে আত্মার প্রতিফলনই “আমি ভাবি, আমি জানি, আমি করি”—এই অভিজ্ঞতার উৎস। স্বপ্ন অবস্থায় এই সূক্ষ্ম দেহ নিজেরই জগৎ সৃষ্টি করে—মনই তখন দ্রষ্টা, মনই দৃশ্য, মনই সৃষ্টিকর্তা। এই অভিজ্ঞতাই “দৃষ্টি-সৃষ্টি-বাদ” (Dṛṣṭi-Sṛṣṭi-Vāda)-এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ—দেখা মানেই সৃষ্টি; অভিজ্ঞতা মানেই জগতের উদ্ভব।
এই সূক্ষ্ম শরীরের মধ্যে আত্মা তিনটি সূক্ষ্ম আবরণে পরিবেষ্টিত থাকে—প্রাণময়কোষ, মনোময়কোষ, বিজ্ঞানময়কোষ—যেগুলি চেতনার দীপ্তিকে ঢেকে রাখে। সূর্য যেমন মেঘে আচ্ছন্ন হয়, কিন্তু কখনও নিভে যায় না, তেমনি আত্মা এই তিন কোষের উপস্থিতিতে আচ্ছন্ন দেখায়। সাধনচতুষ্টয়—বিবেক, বৈরাগ্য, ষট্সম্পত্তি ও মুমুক্ষুত্ব—এর মাধ্যমে এই সূক্ষ্ম স্তরগুলি শুদ্ধ হয়। যখন মন শান্ত, তখন অন্তঃকরণ আত্মার নিখুঁত প্রতিফলন হয়ে ওঠে; তখনই আত্মা “দ্রষ্টা” রূপে প্রকাশিত হয়—নির্লিপ্ত, অপরিবর্তনীয়, চিরসচেতন।
কারণ শরীর হলো গভীরতম স্তর—অভিজ্ঞতার বীজাবস্থা। এখানে সমস্ত বাসনা, সংস্কার ও সম্ভাবনা ঘন অবস্থায় সুপ্ত থাকে। এটি অবিদ্যার সর্বাধিক সূক্ষ্ম প্রকাশ—অচেতনতা। সুষুপ্তি অবস্থায় যখন মন, ইন্দ্রিয় ও চিন্তা সবই প্রত্যাহৃত (Withdrawn/Restrained/Controlled), তখন আত্মা এখানে অবস্থান করে। গভীর নিদ্রা থেকে জেগে উঠে আমরা বলি—“ভালো ঘুমিয়েছি, কিছু জানতাম না”—এই বাক্যে প্রকাশ পায় আনন্দ ও অজ্ঞানের যুগল চিহ্ন। আনন্দ এসেছে, কারণ মন শান্ত হয়েছে; কিন্তু জ্ঞান অনুপস্থিত, কারণ প্রতিফলনের আয়না (মন) নিস্তেজ ছিল। এই স্তরেই বাস করে আনন্দময়কোষ (Ānandamaya Kośa)—যা ব্রহ্মানন্দের ম্লান প্রতিফলন। শঙ্করাচার্যের মতে, এই কারণ দেহই মূল অবিদ্যার আসন—যেখানে আত্মার দীপ্তি সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন।
এই তিন দেহ একত্রে অভিজ্ঞতার ধারাবাহিকতা গঠন করে। স্থূল দেহ প্রকাশিত, সূক্ষ্ম দেহ অভিজ্ঞতার মাধ্যম, কারণ দেহ সম্ভাবনার মূল। এরা যথাক্রমে জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি অবস্থার আধার। কিন্তু তিনটিই বধ্যম্—জ্ঞান উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে এরা বিলীন হয়। বিলয় মানে ধ্বংস নয়, বরং তাদের প্রকৃত স্বরূপ—মিথ্যাত্ব—প্রকাশ পায়। তখন বোঝা যায়, এরা আত্মা নয়, আত্মার উপর আরোপিত প্রতিচ্ছবি। আত্মা দৃক্, এরা দৃশ্য; আত্মা শাশ্বত, এরা পরিবর্তনশীল।
যখন জ্ঞান উদিত হয়, আত্মা-অনাত্মা-বিবেক জাগ্রত হয়—দেহ, মন, ইন্দ্রিয়, চিন্তা—সবই অবিদ্যার অস্থায়ী উপাধি বলে প্রকাশ পায়। তখন “আমি” আর দেহ বা মন নয়—আমি সেই চৈতন্য, যা দেহ ও মনেরও সাক্ষী। এই উপলব্ধিই সাক্ষী-দৃক্-সম্বন্ধের পরিণতি—যেখানে আত্মা জানে, সে আর কোনো অভিজ্ঞতার অংশ নয়, বরং অভিজ্ঞতার পটভূমি।
অদ্বৈত বেদান্তের দর্শনচর্চায় আত্মা-অনাত্মা-অধ্যাস (Ātma-Anātma-Adhyāsa) ধারণা এক মৌলিক তত্ত্বগত ভিত্তি, যার উপর সমগ্র শঙ্করীয় বেদান্তের জ্ঞানতত্ত্ব ও মুক্তিতত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত। অধ্যাস মানে আরোপ—অর্থাৎ এক সত্তার গুণ বা ধর্ম অন্য সত্তার উপর আরোপ করা। শঙ্করাচার্য তাঁর বিখ্যাত ব্রহ্মসূত্র-ভাষ্যের ভূমিকায় এই তত্ত্বকে সংজ্ঞায়িত করেছেন—“স্মৃতিরূপঃ পরত্র পূর্বদৃষ্টাবিভাসঃ অধ্যাসঃ।” অর্থাৎ, পূর্বে যে-অভিজ্ঞতা অন্যত্র হয়েছিল, সেটির ছায়া ভুলক্রমে অন্য কিছুর উপর পড়লে সেই ভ্রান্তি-প্রক্রিয়াকেই বলা হয় অধ্যাস।