এই অবস্থাকে শাস্ত্র বলে প্রপঞ্চ-উপশম (Prapancha-Upaśama)—অর্থাৎ প্রপঞ্চ বা বহুত্বের অবসান। কিন্তু “উপশম” এখানে “ধ্বংস” নয়; এটি অসত্যতার অন্তর্ধান—যেমন অন্ধকার আলোর দ্বারা নাশিত হয় না, বরং আলো উদিত হলে তার অভাবই প্রকাশ পায়। প্রপঞ্চ লুপ্ত হয় না; বরং দেখা যায়, সে চিরকালই ব্রহ্ম ছাড়া কিছু ছিল না। এই বোধই সেই বাধ-সম্বন্ধ (Bādha-Sambandha), যেখানে নিম্নতর সত্য উচ্চতর সত্যে মিশে যায়—না দ্বন্দ্বে, না বিরোধে, বরং পূর্ণ সমন্বয়ে।
ঋষির এই অবস্থায় কোনো পৃথক “দ্রষ্টা” বা “দর্শন”-এর ধারণা অবশিষ্ট থাকে না। দ্রষ্টা, দৃশ্য ও দর্শন—সব একাকার হয়ে যায় সেই চিরন্তন চিদ্-আনন্দে (Cit-Ānanda)। জ্ঞান এখানে আর প্রমাণ বা প্রতিপাদ্যের দ্বারা নির্ভর করে না; প্রমাণ বিলীন হয় অপরোক্ষ-অনুভূতিতে (Aparokṣānubhūti)—যেখানে আত্মা নিজেই নিজের প্রত্যক্ষ। এটি “স্বরূপ-প্রকাশ” (Self-luminous revelation)—যেখানে চেতনা নিজেকে দেখায়, কারণ সে নিজেই দেখা (দর্শন, দেখার কাজ) ও দৃষ্টির পরম একতা।
এই অবস্থায় আর কোনো জানার অবশিষ্ট থাকে না, কারণ “জানা” মানেই দ্বৈততা—কিছু জানে, কিছু জানা হয়। কিন্তু এখন আর কিছু জানার নেই, কারণ সব ‘জেনে ফেলা হয়েছে’ এক চিরন্তন ঐক্যের মধ্যে। উপনিষদ এই অবস্থাকে ঘোষণা করেছে—“ন তত্র প্রজ্ঞানম্ না অপ্রজ্ঞানম্, ন বিজ্ঞানম্ ন অবিজ্ঞানম্; অদৃষ্টম্, অব্যবহার্যম্, অগ্রাহ্যম্, অচিন্ত্যম্, অব্যপদেশ্যম্।” (মাণ্ডুক্য উপনিষদ, ৭) অর্থাৎ, সেখানে প্রজ্ঞা আছে, কিন্তু তা কোনো বস্তুর জ্ঞান নয়; তা এমন চেতনা, যা নিজেই নিজের আলো—যাকে ধরা, বলা বা ভাবা যায় না।
এই চূড়ান্ত উপলব্ধিই জ্ঞানের সিঁড়ির শেষ ধাপ—যেখানে জ্ঞান আর কোনো প্রক্রিয়া নয়, বরং সত্তারই স্বরূপ হয়ে ওঠে। তখন সমস্ত প্রমাণ, অভিজ্ঞতা ও ব্যাখ্যা বিলীন হয়ে যায় এক নিঃসীম নীরবতায়—যেখানে আত্মা নিজের মধ্যেই বিশ্রাম নেয়।
তখন থাকে কেবল এক অনন্ত, অচল, স্বয়ং-আলোকিত চেতনা (Svayam-Prakāśa Cit)—যা সময় ও স্থানের অতীত, নাম-রূপের অতীত, আর সমস্ত জ্ঞানেরও অতীত। সেই ব্রহ্মই “সত্যম্ জ্ঞানম্ অনন্তম্” (তৈত্তিরীয় উপনিষদ,২.১.১)—যে-জ্ঞানের আলোয় জ্ঞানও ম্লান হয়ে যায়।
সত্যম্ (Satyam): সত্য বা অস্তিত্ব; ব্রহ্ম হলেন চিরন্তন বাস্তবতা। যাঁর অস্তিত্ব ত্রিকালব্যাপী (ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান) কখনও পরিবর্তিত হয় না বা বাধিত হয় না।
জ্ঞানম্ (Jñānam): জ্ঞান বা চৈতন্য; ব্রহ্ম হলেন বিশুদ্ধ চৈতন্য (Consciousness)। তিনি কোনো ব্যক্তি-জ্ঞাতা নন, বরং জ্ঞানস্বরূপ।
অনন্তম্ (Anantam): অনন্ত বা অসীম; ব্রহ্ম হলেন সীমাহীন। তিনি দেশ (স্থান), কাল (সময়) বা বস্তু (Form)-এর দ্বারা সীমাবদ্ধ নন।
এবং, তখনই সত্য উপলব্ধ হয়—“ব্রহ্মই একমাত্র বাস্তব, জগৎ মিথ্যা, এবং আত্মা সেই ব্রহ্ম।”—এই অজাত, অচল, নির্ভ্রান্ত চেতনার নিঃশেষ ঐক্যে জ্ঞানের যাত্রা সমাপ্ত হয়। এই তিনটি গুণ একসাথে আত্মার স্বরূপ লক্ষণ (Essential Characteristics) বর্ণনা করে—
গীতায়: আত্মা যে নিত্য, শাশ্বত এবং অচল, তা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে: "অজো নিত্যঃ শাশ্বতোঽয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।।" (গীতা, ২.২০)। এটি 'অজাত' (যা জন্ম নেয়নি (Unborn)) এবং 'অচল' (যা চঞ্চল বা পরিবর্তনশীল নয় (Immovable/Unchanging)) ধারণাকে নিশ্চিত করে।
আত্মা বা ব্রহ্ম নিত্য ও অনাদি। তাঁর কোনো শুরু নেই, তাই তিনি জন্ম এবং মৃত্যুর অধীন নন। আত্মা তাই অজাত।
আত্মা অপরিবর্তনীয়। প্রকৃতির গুণাবলী (সত্ত্ব, রজ, তম) বা জাগতিক বিকার দ্বারা তিনি প্রভাবিত হন না। তিনি সর্বদা স্থির এবং একরূপে বিদ্যমান। আত্মা তাই অচল।
উপনিষদে: উপনিষদ ব্রহ্মকে 'সৎ-চিৎ-আনন্দ' (সৎ = অস্তিত্ব, চিৎ = চেতনা, আনন্দ = Bliss) বলে বর্ণনা করে, যেখানে 'চিৎ' বা চৈতন্য হলো 'নির্ভ্রান্ত চেতনা' (ভ্রান্তিহীন বা ত্রুটিমুক্ত চৈতন্য (Unerring Consciousness))। এই চেতনাই সমস্ত ভ্রম (ভ্রান্তি) থেকে মুক্ত। আত্মা হলো বিশুদ্ধ জ্ঞানস্বরূপ বা স্বয়ং-প্রকাশিত চেতনা। এই চেতনা মোহ, আসক্তি বা ভ্রম দ্বারা কখনও আবৃত হয় না এবং এটিই সমস্ত জ্ঞানের মূল উৎস। আত্মা তাই নির্ভ্রান্ত।
অদ্বৈত বেদান্তের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে আত্মা কখনোই সীমাবদ্ধ নয়—সে চিরন্তন, সর্বব্যাপী, স্বয়ং-আলোকিত (svayam-prakāśa)। কিন্তু অবিদ্যা (Avidyā) বা মায়ার দ্বৈত শক্তি—আবরণ (Āvaraṇa) ও বিক্ষেপ (Vikṣepa)—এর প্রভাবে এই অসীম চেতনা তিনটি স্তরে যেন সীমাবদ্ধ সত্তা হয়ে ওঠে। এই তিন স্তরই হলো ত্রিবিধ দেহ (Śarīra-Traya)—স্থূল, সূক্ষ্ম ও কারণ। এগুলি আত্মার প্রকৃত স্বরূপ নয়, বরং উপাধি (Upādhi) বা “শর্তস্বরূপ পরিধান”—যার দ্বারা নিরুপাধি আত্মা “আমি দেহ”, “আমি মন”, “আমি ঘুমোচ্ছি”—এই ভ্রান্ত অভিজ্ঞতা লাভ করে।
এই তিন দেহের সঙ্গে যুক্ত আছে তিনটি অভিজ্ঞতার অবস্থা—জাগ্রত (Jāgrat), স্বপ্ন (Svapna), ও সুষুপ্তি (Suṣupti)। জাগ্রতে আত্মা স্থূল শরীরের সঙ্গে, স্বপ্নে সূক্ষ্ম শরীরের সঙ্গে, আর গভীর নিদ্রায় কারণ শরীরের সঙ্গে আত্মপরিচয় স্থাপন করে। প্রতিটি অবস্থাই অধ্যাস (Adhyāsa)—অর্থাৎ, আত্মার উপর অনাত্মার গুণের আরোপ। এই আরোপই অবিদ্যার সক্রিয় প্রকাশ—যেখানে চেতনা নিজেকে বস্তু বা মানসিক অবস্থা বলে ভুল করে।
স্থূল শরীর (Sthūla-Śarīra): স্থূল দেহ হলো আত্মার প্রথম ও বহিরাবরণ। এটি পাঁচটি স্থূল উপাদান (Pañca-Mahā-Bhūta)—পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু ও আকাশ—দ্বারা গঠিত। এই দেহে অবস্থান করে আত্মা কর্মেন্দ্রিয় (কর্মের যন্ত্র) ও জ্ঞানেন্দ্রিয় (ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপলব্ধির যন্ত্র)-এর মাধ্যমে জগতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে। জন্ম, বৃদ্ধি, বার্ধক্য ও মৃত্যু—এই চার পরিণামধর্মী প্রক্রিয়াই স্থূল শরীরের বৈশিষ্ট্য। এটি জন্মে অন্ন থেকে, বাঁচে অন্ন দ্বারা, এবং বিলীন হয় অন্নেই—তাই এর নাম অন্নময়কোষ (Annamaya-Kośa)।
জাগ্রত অবস্থায় আত্মা এই শরীরের সঙ্গে নিজেকে অভিন্ন মনে করে—“আমি অসুস্থ”, “আমি পুরুষ”, “আমি সুন্দর”—ইত্যাদি। এখানেই আত্মা-অনাত্মা-অধ্যাসের (Ātma-Anātma-Adhyāsa) সর্বাধিক ঘন স্তর কাজ করে। এই দেহের পরিবর্তন আত্মার প্রকৃত সত্তাকে স্পর্শ করতে পারে না, কিন্তু অবিদ্যা এটিকে “আমিই” বলে প্রতীয়মান করে। শঙ্করাচার্য বলেছেন, দেহ আত্মার জন্য একটি “পোশাক” (বস্ত্র-বৎ শরীরম্) মাত্র—যা জন্ম-মৃত্যুর মাধ্যমে বদলায়, অথচ পরিধানকারী আত্মা অক্ষত থাকে।
বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবাহি গৃহ্নাতি নরোঽপরাণি।
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্য্ আন্যানি সংযাতি নবানি দেহী।। (গীতা, ২.২২)
অর্থাৎ, মানুষ যেমন পুরোনো জীর্ণ বস্ত্র ত্যাগ করে নতুন বস্ত্র গ্রহণ করে, ঠিক তেমনই দেহী (আত্মা) জীর্ণ পুরোনো শরীর ত্যাগ করে নতুন অন্য শরীর গ্রহণ করে।
"বস্ত্র-বৎ শরীরম্" কথাটি শ্লোকের প্রথম লাইনের "বাসাংসি জীর্ণানি" (পুরাতন বস্ত্র) এবং তৃতীয় লাইনের "শরীরাণি জীর্ণানি" (পুরাতন শরীর) উপমার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এখানে বস্ত্রের মতো (vastra-vat) শরীরকে তুলনা করা হয়েছে।
গীতার ২.২২ শ্লোকটি আত্মার অবিনশ্বরতা (নিত্যতা) এবং পুনর্জন্মের ধারণাকে অত্যন্ত সরল উপমার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে।
দেহ ও আত্মার পার্থক্য: শরীর (śarīraṁ) হলো অস্থায়ী এবং পরিবর্তনের অধীন, যা একটি পোশাকের (Vastra) মতো। আর আত্মা (দেহী) হলো সেই পোশাক পরিধানকারী।
ভগবানের অভয়বাণী: এই জ্ঞান অর্জুনকে দেওয়া হয়েছিল, যাতে তিনি বুঝতে পারেন যে, যুদ্ধে শরীরের বিনাশ ঘটলেও আত্মা কেবল জীর্ণ দেহ ত্যাগ করে নতুন দেহে প্রবেশ করবে, তাই শোক করার বা ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।
এই দেহ প্রকৃতপক্ষে আত্মার নয়—এটি ব্যাবহারিক সত্য (Vyāvahārika-Sattā)-র অন্তর্গত। যখন জ্ঞান উদিত হয়, তখন দেখা যায়—“আমি দেহ নই; আমি দেহের সাক্ষীমাত্র”—এই আত্মদৃষ্টি স্থূল দেহের মিথ্যাবোধকে ভঙ্গ করে।
সূক্ষ্ম শরীর (Sūkṣma-Śarīra): সূক্ষ্ম শরীর স্থূল দেহের তুলনায় অদৃশ্য অথচ ক্রিয়াশীল। এটি পাঁচটি সূক্ষ্ম উপাদান (Tan-Mātra)—শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, ও গন্ধ—দ্বারা গঠিত, এবং এর ১৭টি উপাঙ্গ (Saptadaśa-Avayava):
১. পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, জিহ্বা, ত্বক, ঘ্রাণ)
২. পাঁচ কর্মেন্দ্রিয় (বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু, উপস্থ)
৩. পাঁচ প্রাণ (প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান, সমান)
৪. অন্তঃকরণ চতুষ্টয়—মন (Manas), বুদ্ধি (Buddhi), অহংকার (Ahaṅkāra), চিত্ত (Citta)
এই ব্রহ্মাণ্ডে আমাদের অস্তিত্ব কেবল স্থূল দেহেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এক সূক্ষ্ম শরীরও রয়েছে, যা সমস্ত অভিজ্ঞতা ও চেতনার উৎস। এই সূক্ষ্ম শরীর পঞ্চকোষের ভেতরের অংশ, এবং এটিই আমাদের জাগতিক ও আধ্যাত্মিক যাত্রার মূল কেন্দ্র। আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তথ্য, আবেগ, চিন্তা এবং স্মৃতি এই সূক্ষ্ম শরীরেই প্রক্রিয়াজাত হয়। এর মাধ্যমেই আমরা বাহ্য জগৎকে অনুভব করি এবং অভ্যন্তরীণ জগতকে নির্মাণ করি।
জ্ঞান-ব্যাপার—অনুভূতির প্রক্রিয়া: জ্ঞানলাভের প্রক্রিয়াকে যোগ দর্শনে 'জ্ঞান-ব্যাপার' (Jñāna-Vyāpāra) বলা হয়। এটি চারটি প্রধান উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত:
মন (Manas): এটি ইন্দ্রিয়গুলির মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য গ্রহণ করে। মনই আমাদের সংবেদনশীলতার উৎস; এটি আনন্দ, বেদনা, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, প্রেম এবং ঘৃণার মতো অনুভূতিগুলি ধারণ করে। মন অস্থির এবং চঞ্চল, প্রতিনিয়ত বাইরের জগতে বিচরণ করে।
বুদ্ধি (Buddhi): মন দ্বারা সংগৃহীত তথ্যগুলি বুদ্ধি বিশ্লেষণ করে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বুদ্ধি হলো আমাদের বিচার শক্তি, যা সঠিক ও ভুল, ভালো ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে সাহায্য করে। এটি আমাদের যুক্তি এবং বিচক্ষণতার উৎস।
অহংকার (Ahaṁkāra): অহংকার হলো 'আমি'-বোধের কেন্দ্র। যখন বুদ্ধি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, তখন অহংকার বলে, "আমি জানি" বা "আমি এটি করেছি"। এটি আমাদের স্বতন্ত্র পরিচয়ের জন্ম দেয় এবং আমাদের কর্মের ফল ভোগের ধারণার সাথে যুক্ত। অহংকার ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয়ই হতে পারে; এটি আত্মসম্মান বৃদ্ধি করতে পারে বা অহংকে পুষ্ট করে ভুল পথে পরিচালিত করতে পারে।
চিত্ত (Chitta): চিত্ত হলো স্মৃতিভাণ্ডার, যা সমস্ত অভিজ্ঞতা, জ্ঞান এবং সংস্কারকে স্মরণে রাখে। এটি আমাদের অবচেতন মন, যেখানে আমাদের অতীত কর্মের ছাপ এবং অভিজ্ঞতার সারাংশ সঞ্চিত থাকে। চিত্তই আমাদের আচরণ এবং ব্যক্তিত্বকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
এই চারটি উপাদানের সম্মিলিত ক্রিয়া আমাদের জ্ঞান-ব্যাপারকে সম্পূর্ণ করে। মন তথ্য সংগ্রহ করে, বুদ্ধি বিচার করে, অহংকার সেই জ্ঞানকে নিজের বলে দাবি করে এবং চিত্ত তা স্মরণে রাখে।
স্বপ্নাবস্থা—সূক্ষ্ম শরীরের স্বাধীনতা: স্বপ্নাবস্থা সূক্ষ্ম শরীরের এক অনন্য ক্রিয়াশীলতা প্রদর্শন করে। এই অবস্থায় স্থূল দেহ নিশ্চল থাকলেও সূক্ষ্ম শরীর সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে সক্রিয় থাকে। স্বপ্নকালে আমরা বাহ্য জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেদের অন্তর্জগৎ সৃষ্টি করি এবং তাতে বিচরণ করি। এই অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে, আত্মা দেহ নয়। কারণ, যদি আত্মা দেহের সাথে অভিন্ন হতো, তাহলে দেহ স্থির থাকলে কোনো অভিজ্ঞতা সম্ভব হতো না। স্বপ্ন দেখায় যে, আমাদের চেতনা দেহ থেকে ভিন্ন এবং এটি একটি স্বাধীন সত্তা।
দৃষ্টি-সৃষ্টি-বাদ—মনই স্রষ্টা: স্বপ্নাবস্থায় "দৃষ্টি-সৃষ্টি-বাদ" (Dṛṣṭi-Sṛṣṭi-Vāda) তত্ত্ব কার্যকর হয়, যার অর্থ "দেখা মানেই সৃষ্টি"। এই তত্ত্ব অনুসারে, আমাদের মনই তার নিজের জগৎকে কল্পনা করে, সৃষ্টি করে এবং তাতে বাস করে। স্বপ্নের সময় আমাদের মন বাইরের কোনো উদ্দীপনা ছাড়াই দৃশ্য, শব্দ, গন্ধ, অনুভূতি এবং পরিস্থিতি তৈরি করে। এই অভিজ্ঞতা কেবল স্বপ্নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং আমাদের জাগতিক জীবনের উপলব্ধিও এই নীতির দ্বারা প্রভাবিত হয়। আমরা যা দেখি, শুনি বা অনুভব করি, তা মূলত আমাদের মনের দ্বারা ব্যাখ্যা করা এবং নির্মিত হয়। এই দর্শন আমাদের বোঝায় যে, আমাদের বাস্তবতার একটি বড় অংশ আমাদের মনেরই সৃষ্টি, এবং আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের অভিজ্ঞতাকে কীভাবে রূপ দেয়, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।