৬.২০: যে-অবস্থায় যোগাভ্যাসের দ্বারা নিরুদ্ধ চিত্ত সম্পূর্ণভাবে নিবৃত্ত হয়, এবং আত্মা দ্বারা আত্মাকে দর্শন করে যোগী আত্মাতেই সন্তুষ্ট হন—সেই অবস্থাই যোগের চূড়ান্ত ফল।
৬.২২: যে-অবস্থাকে লাভ করার পর তার থেকে আর কোনো বেশি লাভ আছে বলে মনে হয় না, এবং যাতে অবস্থিত হলে গুরুতর দুঃখ দ্বারাও বিচলিত হতে হয় না,—সেই স্থিতাবস্থাই হল মনো-নাশের ফল।
৬.২৫: ধৈর্যযুক্ত বুদ্ধি দ্বারা ধীরে ধীরে বিষয় চিন্তা থেকে মনকে নিবৃত্ত করো এবং মনকে আত্মাতে স্থির করে অন্য কিছুই চিন্তা করো না।
৬.২৬: চঞ্চল ও অস্থির মন যে যে বিষয়ে ধাবিত হয়, সেই সেই বিষয় থেকে তাকে নিবৃত্ত (নিয়ন্ত্রণ) করে আত্মাতেই বশীভূত করো।
এখানেই দৃক্-দৃশ্য-বিবেক (Dṛk-Dṛśya-Viveka)-এর চূড়ান্ত উপলব্ধি—দ্রষ্টা (আত্মা) চিরন্তন ও অচল, আর যা-কিছু দৃশ্যমান (দেহ, মন, চিন্তা, অনুভূতি, কর্ম) তা ক্ষণস্থায়ী ও মায়াময়। মন তখন আর প্রতিবন্ধক নয়, বরং মুক্তির সিঁড়ি হয়ে ওঠে—প্রমাণ (śruti, yukti) থেকে অপরোক্ষ অনুভূতি (Aparokṣānubhūti) পর্যন্ত।
যখন মন সম্পূর্ণ নীরব, স্বচ্ছ ও অচঞ্চল, তখন সমস্ত প্রমাণের প্রয়োজন বিলুপ্ত হয়, কারণ তখন আত্মা নিজেই নিজেকে প্রতিফলিত করে—স্বরূপ-প্রকাশ। উপনিষদ বলে—“ন তত্র সূর্যো ভাতি ন চন্দ্রতারকং, নেমা বিদ্যুতো ভান্তি কুতোয়মগ্নিঃ। তমেব ভান্তমনুভাতি সর্বং, তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি।” (কঠোপনিষদ, ২.২.১৫) অর্থাৎ, “যেখানে সূর্য, চন্দ্র বা আগুন আলোক দেয় না—সেই আত্মার জ্যোতিতেই সব কিছু আলোকিত।”
এই আত্মার দীপ্তিই কর্মযোগের চূড়ান্ত সত্য—যেখানে কর্ম হয়ে ওঠে অহংহীন আত্মপ্রকাশ, মন হয়ে ওঠে স্বচ্ছ দর্পণ, আর জীবন হয়ে ওঠে যজ্ঞ—অর্পণ, আত্মসংযম ও জাগতিক কর্মের মধ্যেই অনন্ত আত্মার উদ্ভাস।
অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে জ্ঞান একটি গতিশীল উন্মোচনপ্রক্রিয়া (Dynamic Unfoldment)—এটি কোনো হঠাৎ উদ্ঘাটন নয়, বরং ক্রমে ক্রমে নিম্নতর সত্যের অতিক্রম ও উচ্চতর সত্যের অভিজ্ঞতায় পৌঁছনো। এই ধারাটি শাস্ত্রীয়ভাবে পরিচিত “প্রমা-বিরোধ” (Pramā-Virodha) নামে—যেখানে এক স্তরের জ্ঞান অপর স্তরের জ্ঞানের দ্বারা “বাধিত” হয় (Bādha-Vyavahāra), কিন্তু কখনোই একেবারে অস্বীকৃত বা ধ্বংস হয় না। যেমন, স্বপ্ন-জ্ঞান জাগ্রত জ্ঞানে বিলীন হয়, কিন্তু স্বপ্নের ঘটনাগুলি মিথ্যা হলেও তারা একসময় স্বপ্নদ্রষ্টার কাছে সত্য বলে প্রতীয়মান হয়েছিল; তেমনি, জাগ্রত জগৎও ব্রহ্মজ্ঞানের উদয়ে বিলীন হয়, অথচ তার নিজস্ব স্তরে (ব্যাবহারিক বাস্তবতায়) তা বৈধ থাকে।
এই তিন স্তরের সত্য—প্রাতিভাসিক (Prātibhāsika), ব্যাবহারিক (Vyāvahārika), এবং পারমার্থিক (Pāramārthika)-কে একত্রে বলা হয় সত্তা-ত্রয় (Sattā-Traya)। প্রাতিভাসিক হলো বিভ্রম বা স্বপ্নের সত্য, যা আপাত; ব্যাবহারিক হলো জাগ্রত জগতের সত্য, যা সামাজিক ও অভিজ্ঞতালব্ধ; এবং পারমার্থিক হলো একমাত্র চূড়ান্ত সত্য—ব্রহ্ম, যা অবিকৃত, নিরাকার ও অদ্বিতীয়। প্রতিটি স্তরই নিজের ক্ষেত্রে সত্য, কিন্তু উচ্চতর স্তরের উপলব্ধি আসলে নিম্নতর স্তরের “অসত্যতা” প্রকাশ করে।
এই সত্যের বিলোপ বা “বাধ” আসলে ধ্বংস নয়, বরং প্রকৃত স্বরূপের প্রকাশ। বেদান্ত বলে—“বাধেন নাশো ন, মিথ্যাত্ব-প্রকাশম্।” অর্থাৎ, "বাধার দ্বারা (বস্তুর) বিনাশ হয় না, বরং তার মিথ্যাত্ব প্রকাশিত হয়।" এটি অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক ধারণাকে সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করে। এটি প্রধানত জগৎ বা দৃশ্যমান বস্তুসমূহের মিথ্যাত্ব (illusion/unreality) প্রমাণ করার জন্য ব্যবহৃত হয়। মিথ্যা জ্ঞান ধ্বংস হয় না, কেবল তার মিথ্যাত্ব জানা যায়। যেমন মরীচিকায় জল অদৃশ্য হয় না, কিন্তু জানা যায় তা কেবল সূর্যালোকের প্রতিফলনমাত্র। জ্ঞান এখানে আলো, যা ভ্রান্তির ছায়াকে বিলুপ্ত করে, কিন্তু অভিজ্ঞতার ঘটনাকে অস্বীকার করে না। এই কারণেই ঋষি জগৎকে অস্বীকার করেন না; তিনি বলেন—এটি “ব্রহ্ম-বিবর্ত” (Brahma-Vivarta)—ব্রহ্মেরই এক আপাত বিকাশ, এক চৈতন্যের তরঙ্গমাত্র।
এই উপলব্ধি অর্জনের জন্য মানবজীবনকে অদ্বৈত বেদান্ত দুই ভাগে ভাগ করে—কর্ম-কাণ্ড (Karma-Kāṇḍa) ও জ্ঞান-কাণ্ড (Jñāna-Kāṇḍa)। কর্ম-কাণ্ড মনকে পরিশুদ্ধ করে; জ্ঞান-কাণ্ড মুক্তি দেয়। কর্মযোগের উদ্দেশ্য তাই জগৎ থেকে পালানো নয়, বরং মনকে চিত্তশুদ্ধির মাধ্যমে জ্ঞানের যোগ্য করে তোলা। যখন মানুষ ফলত্যাগ (Tyāga-Vidhāna) চর্চা করে, তখন তার ভেতরের আসক্তি ও অহংকার (Ahaṅkāra) ক্ষীণ হয়। এতে অবিদ্যা-র দুই শক্তি—আবরণ-শক্তি (Āvaraṇa) ও বিক্ষেপ-শক্তি (Vikṣepa)—ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়। যখন আবরণ সরে যায়, তখন উদ্ভাসিত হয় ব্রহ্ম-বাস্তবতা (Brahma-Vastu-Jñāna)—যে-চেতনা নাম-রূপের অতীত, একমাত্র শর্তহীন সত্তা।
এই অবস্থাতেই ব্যক্তি হয়ে ওঠে জীবন্মুক্ত (Jīvanmukta)—দেহে অবস্থান করেও দেহাত্মবোধে আবদ্ধ নয়। তাঁর কাছে কর্ম কেবল প্রারব্ধ-ফল (Prārabdha-Karma)-এর স্বাভাবিক প্রবাহ। তিনি তাতে অংশ নেন, কিন্তু জানেন—“কর্মাণ্যকর্ম যঃ পশ্যেত্” (গীতা, ৪.১৮)—যিনি কর্মে অ-কর্ম দেখেন, তিনিই প্রকৃত জ্ঞানী। তিনি অহংকারহীনভাবে লোকসংগ্রহ (Loka-Saṅgraha)—অন্যের কল্যাণে কর্ম করেন, কিন্তু জানেন, কোনো কর্মই তাঁকে স্পর্শ করে না। শরীর থাকলে কর্ম চলে, কিন্তু “আমি করি” ভাবটা থাকে না।
যখন প্রারব্ধ ফুরিয়ে যায়, তখন ঘটে বিদেহ-মুক্তি (Videha-Mukti)—দেহের সঙ্গে আত্মপরিচয়ের অবসান। এটি কোনো গমন নয়, বরং অবস্থার রূপান্তর: আত্মা ব্রহ্মে লীন হয়, কারণ সে সর্বদাই ব্রহ্ম ছিল। এই অবস্থায় জ্ঞান কোনো প্রমাণ, যুক্তি বা ধ্যানের অবলম্বন রাখে না—এটি তাৎক্ষণিক আত্ম-সচেতনতা, যা বলে—“আমি দেহ নই, আমি মন নই, আমি শুদ্ধ চিদ্-আনন্দ।”
এই সরাসরি চেতনার উদ্ঘাটনই তত্ত্ব-জ্ঞান-উৎপত্তি (Tattva-Jñāna-Utpatti)—যেখানে সমস্ত উপাধি (দেহ, ইন্দ্রিয়, মন) দ্রবীভূত হয়ে যায়। জ্ঞানী তখন জানে—জ্ঞান, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়—এই ত্রয়ী আসলে এক। তখন থাকে কেবল সাক্ষী-দৃক্-সম্বন্ধ (Sākṣī-Dṛk-Sambandha)—চিরদ্রষ্টা আত্মা, যিনি নিজেই নিজের স্বরূপে স্থিত।
অদ্বৈত বেদান্তে “সাক্ষী-দৃক্-সম্বন্ধ” এমন এক গভীর তত্ত্ব, যা আত্মার নির্লিপ্ত চৈতন্যস্বভাবকে প্রকাশ করে। ‘সাক্ষী’ মানে সেই চেতনা, যিনি সব কিছু দেখেন, কিন্তু কোনো কিছুর সঙ্গে যুক্ত নন; ‘দৃক্’ মানে দ্রষ্টা বা দেখা-সচেতনতা; আর ‘সম্বন্ধ’ মানে সম্পর্ক বা যোগ। অতএব, সাক্ষী-দৃক্-সম্বন্ধ হলো আত্মা ও অভিজ্ঞতার মধ্যে এমন এক সম্পর্ক, যেখানে আত্মা সব অভিজ্ঞতার দর্শক, কিন্তু কোনো অভিজ্ঞতার অংশীদার নয়। এই সম্পর্ক একমুখী—সাক্ষী দৃষ্টিকে জানেন, কিন্তু দৃষ্টি কখনও সাক্ষীকে জানে না। এটি চেতনার স্বরূপ, যা সব জ্ঞান, চিন্তা ও ক্রিয়ার পটভূমি হিসেবে সর্বদা স্থিত।
বৃহদারণ্যক উপনিষদে (৩.৭.২৩) বলা হয়েছে—“যঃ সর্বেষু ভূতেষু তিষ্ঠান্ সর্বাণি ভূতানি অন্তরঃ যময়তি, যঃ সর্বেষু ভূতেষু অন্তরাত্মা, অমৃতঃ”—অর্থাৎ, যিনি সকল জীবের অন্তরে অবস্থান করেন, যিনি তাদের দ্বারা অজানা, অথচ তাঁদেরই অভ্যন্তরে নিয়ন্তা, তিনিই অন্তরাত্মা, সাক্ষী, অমৃত। এই অন্তরাত্মাই প্রতিটি অভিজ্ঞতার নীরব দর্শক; তিনি দেহ, মন, ইন্দ্রিয় ও চিন্তার সমস্ত গতিবিধি প্রত্যক্ষ করেন, কিন্তু নিজে কখনও পরিবর্তিত হন না।
শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে (২.৩.১৮) বলেছেন—“সাক্ষী চেতনঃ, অন্যদ্ভোগ্যং সর্বমজ্ঞাননিমিত্তম্।” অর্থাৎ, সাক্ষীই একমাত্র চেতন সত্তা; বাকী সব দেহ, মন, ইন্দ্রিয় ও বুদ্ধি অবিদ্যার কারণে ভোগ্য বা দ্রষ্টব্য বস্তু। চেতনা কখনও করে না, কেবল আলোকিত করে। যেমন সূর্য নিজে কিছু স্পর্শ করে না, কিন্তু তার আলোয় সব কিছু দৃশ্যমান হয়; তেমনি সাক্ষী আত্মা কেবল প্রত্যক্ষ করে, কিন্তু কোনো ক্রিয়ায় জড়িত নয়।
সাক্ষী-দৃক্ অবস্থায় মানুষ অভিজ্ঞতার কেন্দ্র থেকে সরে দাঁড়ায়। তখন সে ভাবে না—“আমি ভাবি”, “আমি দেখি”, “আমি করি”, বরং জানে—এই সব চিন্তা ও কর্ম কেবল মনের গতিবিধি, যা তারই আলোকেই ঘটছে। এই দৃষ্টিই “দৃক্-দৃশ্য-বিবেক”-এর ফল, যেখানে জ্ঞানী উপলব্ধি করেন—যা দৃশ্য, তা পরিবর্তনশীল; কিন্তু আমি দ্রষ্টা, তাই অপরিবর্তনীয়। সুতরাং আত্মা দৃশ্য নয়; সে দৃক্, এবং সেই দৃক্-এরও সাক্ষী—অর্থাৎ, আত্মা সাক্ষী-দৃক্, চির-দ্রষ্টা, অনাসক্ত চেতনা।
ধ্যান ও মননচর্চায় এই ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যখন মন উদ্বিগ্ন বা অস্থির হয়, তখন আত্মাকে সাক্ষী হিসেবে দেখলে মন ধীরে ধীরে প্রশমিত হয়। গীতা (৬.১৯) এই অবস্থাকে তুলনা করেছে বাতাসহীন স্থানে দীপশিখার সঙ্গে—“যথা দীপো নিবাতস্থো নেঙ্গতে সোপরমা স্মৃতাঃ।” অর্থাৎ, বাতাসহীন স্থানে দীপশিখা যেমন নড়ে না, তেমনি যোগীর মনও আত্মাসাক্ষী ভাবনায় স্থির হয়ে যায়।
যখন এই সাক্ষীভাব স্থায়ী হয়, তখন দেখা আর দর্শকের মধ্যে পার্থক্য বিলীন হয়ে যায়। তখন আত্মা জানে—সব দেখা, সব জানা, সব অভিজ্ঞতা সেই এক চৈতন্যের মধ্যেই প্রতিফলন। তখন “দ্রষ্টা-দৃশ্য-ভেদ” আর থাকে না; সাক্ষী ও দৃক্ একাকার হয়। এই অবস্থা আর কোনো বস্তুকে জানার নয়, বরং জানার মূলকে জানা—যিনি জানছেন, তিনিই একমাত্র সত্য। তখন আত্মা নিজেকে উপলব্ধি করে চিরসাক্ষী, চির-দ্রষ্টা, চিদানন্দরূপ ব্রহ্ম হিসেবে—যিনি কখনও জানেন না, কারণ তিনিই চিরজ্ঞান; যিনি কখনও দেখা দেন না, কারণ তিনিই চিরদ্রষ্টা; যিনি কখনও পরিবর্তিত হন না, কারণ তিনিই সমস্ত পরিবর্তনের পটভূমি।
এই অবস্থায় জ্ঞান, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়—এই ত্রয়ী মিলিয়ে যায়। আত্মা জানে যে, দেখা ও জানার সমস্ত ক্রিয়াই তারই আলোয় ঘটছে, কিন্তু সে নিজে কোনো ক্রিয়ার অংশ নয়। এই চিরনির্লিপ্ত অবস্থাই সাক্ষী-দৃক্-সম্বন্ধের পরিণতি—যেখানে চেতনা শুধু দেখা নয়, বরং দেখা ও দর্শনের অতীত বিশুদ্ধ উপস্থিতি। এটাই আত্ম-সাক্ষাৎকারের চূড়ান্ত রূপ, যেখানে “দ্রষ্টা”-র অস্তিত্বও বিলীন হয়ে যায়, থাকে কেবল সেই স্বয়ং-আলোকিত, অচল, একমাত্র সত্য—চিদ্-আনন্দ-স্বরূপ ব্রহ্ম।
এই চূড়ান্ত উপলব্ধিই ব্রহ্ম-সাক্ষাৎকার (Brahma-Sākṣātkāra)—যেখানে উপনিষদের মহাবাক্যসমূহ জীবন্ত হয়ে ওঠে:
“প্রজ্ঞানম্ ব্রহ্ম” (Aitareya Upaniṣad 3.3)—চেতনা নিজেই ব্রহ্ম।
“তৎ ত্বম্ অসি” (Chāndogya Upaniṣad 6.8.7)—তুমি সেই পরম সত্তা।
“অয়ম্ আত্মা ব্রহ্ম” (Māṇḍūkya Upaniṣad 2)—এই আত্মাই ব্রহ্ম।
“অহম্ ব্রহ্মাস্মি” (Bṛhadāraṇyaka Upaniṣad 1.4.10)—আমিই ব্রহ্ম।
এগুলি তখন আর দর্শনের সূত্র নয়, বরং অভিজ্ঞতার অন্তরঙ্গ সত্য। ঋষির অন্তরে এই জ্ঞান স্থায়ী হলে—মন, কর্ম, জগৎ সবই এক জ্যোতির্ময় চেতনার প্রকাশ বলে দেখা যায়। সেই চেতনা—নিত্য, এক ও অপরিবর্তনীয় ব্রহ্ম—যার বাইরে আর কিছুই নেই, যিনি স্বয়ং জ্ঞানের আলো—যাঁর জন্যই বলা হয়েছে, “ব্রহ্মবিত্ ব্রহ্মৈব ভবতি”—“যিনি ব্রহ্মকে জানেন, তিনিই ব্রহ্ম হয়ে ওঠেন।” (মুণ্ডক উপনিষদ, ৩.২.৯)
অদ্বৈত বেদান্তের পরিণতি যেখানে এসে দাঁড়ায়, সেখানে জ্ঞানের লক্ষ্য আর “কোনো কিছুকে জানা” নয়—বরং জানা, জাননেওয়ালা ও জানার বিষয়—এই তিনের মধ্যকার বিভাজনের বিলয়। অবিদ্যা যখন সম্পূর্ণরূপে নিবৃত্ত হয়, তখন অভিজ্ঞতার ত্রয়ী—জ্ঞাতা (knower), জ্ঞান (knowledge) এবং জ্ঞেয় (object of knowledge)—সবই এক অভিন্ন চেতনায় মিলিত হয়। তখন অভিজ্ঞতা কোনো “ঘটনা” থাকে না; কারণ ঘটনা মানেই পরিবর্তন, কিন্তু ব্রহ্ম তো অপরিবর্তনীয়। এই অবস্থায় ঋষি উপলব্ধি করেন—“ন কিঞ্চিদপ্যস্মাদ্ ব্রহ্মণো ভূতপূর্বম্ ন ভবিষ্যতি”—"এই ব্রহ্ম ব্যতীত (বা ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন) সামান্যতম কিছুও অতীতে ছিল না এবং ভবিষ্যতেও থাকবে না।"
এই উপলব্ধিই অজাতবাদ (Ajāta-Vāda)—যা গৌড়পাদাচার্য তাঁর মাণ্ডুক্য কারিকায় (৩.৪৮-৪৯) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি বলেন, “অজাতম্ অজম্ অব্যয়ম্”—কিছুই কখনও জন্মায়নি, কারণ যা সৃষ্টি বলে প্রতীয়মান হয়, তা কেবল চেতনার প্রতিফলন, বাস্তব কোনো উৎপত্তি নয়। সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়—সবই মনের ব্যাখ্যা মাত্র; ব্রহ্ম কখনও জন্ম নেয় না, তাই কিছুই প্রকৃত অর্থে “ঘটে” না। জগৎ, ব্যক্তি, অভিজ্ঞতা—সবই চিরন্তন চেতনারই মায়াময় প্রতিবিম্ব।