অর্থাৎ, জ্ঞানী ব্যক্তি ভাবে, “আমি কিছুই করি না; ইন্দ্রিয়েরা ইন্দ্রিয়ার্থে ক্রিয়াশীল।” এই ভাবই সাক্ষিভাব—যেখানে কর্ম চলে, কিন্তু আত্মা নির্লিপ্ত থাকে। অদ্বৈত বেদান্তে আত্মাকে (Ātman) কখনো “সত্তা-চিত্-আনন্দ” (Sat-Chit-Ānanda) রূপে ব্যাখ্যা করা হয়, আবার কখনো তার অন্তর্নিহিত গুণগুলিকে বিশ্লেষণ করে বলা হয় যে, আত্মা ছয়টি মৌলিক স্বরূপধর্ম দ্বারা নির্ধারিত। এই ছয়টি ধর্মকে ষড়্গুণ বলা হয়, যা শঙ্করাচার্য ও তাঁর পরবর্তী আচার্যদের ভাষ্যে বার বার উঠে এসেছে, যেমন আত্মবোধ, ব্রহ্মসূত্রভাষ্য, বৃহদারণ্যকোপনিষদ্ভাষ্য প্রভৃতি গ্রন্থে।
আত্মার এই ছয়টি মৌলিক গুণ একত্রে “সাক্ষী চেতা কেবলঃ নিরন্তরঃ” এই সংক্ষিপ্ত বাক্যে প্রকাশিত হয়েছে (আত্মবোধ, শ্লোক 18): “সাক্ষী চেতা কেবলো নিরন্তরঃ”—আত্মা হলেন সাক্ষী, চেতা, একমাত্র ও চিরন্তন। এই এক পঙ্ক্তির মধ্যে আত্মার স্বরূপ ও গুণসমষ্টি নিহিত। বেদান্তীয় ব্যাখ্যা অনুযায়ী, আত্মার ছয়টি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—
১. চেতনা বা জ্ঞানস্বরূপ (Cetā / Jñānasvarūpa): আত্মা চেতনার মূর্তি; তিনি জ্ঞানী নন, বরং জ্ঞান নিজেই। বৃহদারণ্যক উপনিষদ (৪.৩.২৩) বলে—“দ্রষ্টা শ্রোতা মন্তা বোধতা”—তিনি দ্রষ্টা, শ্রোতা, চিন্তাকারী, বোধকারী। এই জ্ঞানের কারণ অন্য কিছু নয়; আত্মা নিজে স্বপ্রভা (self-luminous)।
২. সাক্ষিত্ব (Sākṣitva): আত্মা সমস্ত ক্রিয়া, চিন্তা, অনুভূতির নীরব সাক্ষী। গীতা (১৩.২৩)-এ বলা হয়েছে—“উপদ্রষ্টা অনুমন্তা চ ভর্তা ভোক্তা মহেশ্বরঃ”—আত্মা দেহে অবস্থান করেও দর্শক মাত্র, কর্মে লিপ্ত নন। দৃক্-দৃশ্য-বিবেক-এ বলা হয়েছে—“দৃশ্যং প্রকৃতিভূতং, দৃক্ তু চেতনাত্মা”—সব দৃশ্য পরিবর্তনশীল, কিন্তু দর্শী চেতনাত্মা স্থির।
৩. অদ্বিতীয়তা (Kevalatva): আত্মা এক ও অদ্বিতীয়। ছান্দোগ্য উপনিষদ (৬.২.১) বলে—“একমেবাদ্বিতীয়ম্”—এক, দ্বিতীয়হীন। কোনো দ্বিতীয় সত্তা, কোনো সীমা বা প্রভেদ আত্মাকে স্পর্শ করে না। তিনি সর্বসত্তার মধ্যে বিদ্যমান একমাত্র বাস্তব সত্তা।
৪. নিত্যতা (Nirantartva): আত্মা চিরন্তন, অনাদি, অবিনশ্বর। গীতা (২.২০) বলে—“ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্/নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ।”—তিনি কখনও জন্মগ্রহণ করেন না, কখনও বিনষ্ট হন না। এই নিত্যতা মানে সময়-পরিবর্তনের ঊর্ধ্বে থাকা।
৫. অকর্তৃত্ব (Akartṛtva): আত্মা কখনও কর্ম করেন না; কর্ম প্রকৃতির দ্বারা সম্পন্ন হয়। গীতা (৫.৮-৯) বলে—“নৈব কিঞ্চিত্ করোমি ইতি যুক্তো মন্যেত তত্ত্ববিত্; ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেষু বর্তন্ত ইতি ধারয়ন্”—জ্ঞানী ব্যক্তি ভাবে, “আমি কিছুই করি না; ইন্দ্রিয়েরা ইন্দ্রিয়ার্থে ক্রিয়াশীল।” বৃহদারণ্যক উপনিষদ (৪.৪.২২)-এও বলা হয়েছে—“নায়মাত্মা কর্মণালিপ্যতে”—আত্মা কর্মে লিপ্ত নয়।
৬. অপরিণামিতা বা নির্গুণতা (Nirguṇatva / Apariṇāmitva): আত্মা প্রকৃতির তিন গুণ—সত্ত্ব, রজ, তম—এর দ্বারা প্রভাবিত হন না। তিনি অপরিবর্তনীয়, অবিকারী। গীতা (১৩.৩১) বলে—“গুণাভ্যো চ পরম্”—আত্মা গুণেরও অতীত। শঙ্করাচার্য ব্যাখ্যা করেছেন, “গুণানাম্ অবিকৃতঃ সাক্ষী”—তিনি সব পরিবর্তনের সাক্ষী, কিন্তু পরিবর্তনশীল নন।
এই ছয়টি গুণ আত্মার স্বরূপকে সামগ্রিকভাবে প্রকাশ করে। আত্মা চেতনার উৎস (চেতা), জগতের নির্লিপ্ত দর্শক (সাক্ষী), একমাত্র ও অদ্বিতীয় (কেবলঃ), চিরন্তন (নিরন্তরঃ), কর্মে নিস্পৃহ (অকর্তা) এবং গুণাতীত (নির্গুণ)।
“সাক্ষী চেতা কেবলঃ নিরন্তরঃ” বাক্যটি বেদান্তীয় দৃষ্টিতে আত্মার এই ছয়টি মৌলিক ধর্মকে সংক্ষেপে প্রকাশ করে। আত্মা কখনও পরিবর্তনশীল, কর্তা বা ভোক্তা নয়; তিনি সেই বিশুদ্ধ, অনন্ত, চিরস্থায়ী চেতনা—যিনি সব অভিজ্ঞতার সাক্ষী, কিন্তু কোনো কিছুর দ্বারা স্পর্শিত হন না।
যখন সাক্ষিভাব স্থিত হয়, তখন কর্তা-ভাব ও ভোক্তা-ভাব বিলীন হয়। কর্ম, চিন্তা, দুঃখ—সব কিছুর মধ্যেও আত্মা শান্ত, স্থির ও অদ্বিতীয় থাকে। গীতা (২.৫৫)-এর ভাষায়—“স্থিতপ্রজ্ঞস্তদা প্রাহ,” অর্থাৎ, সেই ব্যক্তি তখন স্থিতপ্রজ্ঞ, যিনি সুখ-দুঃখ, লাভ-অলাভে সমবুদ্ধি হয়ে আত্মায় স্থিত। এই অবস্থাতেই মুক্তি—যেখানে মানুষ জগতের মধ্যে থাকলেও জগৎ তাকে স্পর্শ করতে পারে না।
সাক্ষিভাব মানে নিজের ভিতরের সেই নীরব, অচঞ্চল চেতনার মধ্যে স্থিত হওয়া। কর্ম, চিন্তা ও অভিজ্ঞতা তখন চলে, কিন্তু আত্মা থাকে অপ্রভাবিত। বেদান্ত, উপনিষদ ও গীতার মূল সুর এক—সত্যিকারের মুক্তি হলো নিজের সাক্ষিত্ব উপলব্ধি করা; কারণ আত্মা কখনো কিছু করে না, কেবল দেখেই থাকে। যে এই দর্শকের অবস্থানে স্থিত থাকে, সে-ই জ্ঞানী, মুক্ত, এবং নিজের মধ্যেই পরম শান্তি লাভ করে।
মা আনন্দময়ী নিষ্কাম কর্মকে স্বতঃস্ফূর্ত প্রেমরূপে দেখিয়েছেন। তাঁর মতে, কর্ম ত্যাগ নয়, বরং ঈশ্বর-স্মৃতিতে কর্মের রূপান্তর। তিনি বলতেন—“কর্মে থাকো, কিন্তু মন রাখো তাঁর চরণে।” তাঁর জীবন ছিল সেই জীবন্ত উদাহরণ, যেখানে প্রতিটি কাজ উপাসনায় পরিণত।
অ্যালেন ওয়াটস, পাশ্চাত্যের আধুনিক দার্শনিক এবং দাও-বৌদ্ধ চিন্তক, গীতার এই দর্শনকে “The Art of Letting Go” নামে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, প্রকৃত কর্ম হলো spontaneous action—যেখানে ব্যক্তি নিয়ন্ত্রণের আসক্তি ত্যাগ করে জীবনের প্রবাহে নিজেকে সঁপে দেয়। এই ধারণা গীতার “যজ্ঞরূপ কর্ম”-এর সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত—জগৎ নিজেই এক যজ্ঞ, আর মানুষ তার অঙ্গ। (গীতা, ৩.৯: যজ্ঞের জন্য অনুষ্ঠিত কর্ম ছাড়া অন্য কোনো কর্মই মানুষকে কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ করে। সেই কারণে, হে কৌন্তেয় (অর্জুন), তুমি আসক্তি ত্যাগ করে কেবল সেই যজ্ঞরূপ কর্মই সম্যকভাবে অনুষ্ঠান করো।)
নিষ্কাম কর্মের মূল দর্শন—ফলাকাঙ্ক্ষা (কামনা) ও “আমি কর্তা” এই অহংবোধ বর্জন করে কর্তব্যে নিবিষ্ট থাকা—এই সত্যকে ভারতীয় চিন্তাধারার প্রতিটি শাখা স্বীকার করেছে। উপনিষদ, যোগ, বৌদ্ধ ও বেদান্ত—সব ক্ষেত্রেই বলা হয়েছে, আসক্তিই দুঃখের কারণ, অনাসক্তিই মুক্তির পথ। গীতার এই নীতি আধুনিক মনোবিজ্ঞানেও প্রতিধ্বনিত—mindfulness ও flow-state-এর ধারণায়, যেখানে বর্তমান মুহূর্তে মনোযোগই মানসিক শান্তির উৎস।
Mindfulness (সচেতন উপস্থিতি) এবং Flow-state (প্রবাহাবস্থা)—এই দুটি ধারণা আধুনিক মনোবিজ্ঞান ও দর্শনের জগতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তাদের মূল সূত্র নিহিত রয়েছে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ও বেদান্ত দর্শনের গভীরে। গীতা যে “যোগঃ কর্মসু কৌশলম্” (২.৫০), এই নীতি ঘোষণা করেছে, তার মধ্যেই নিহিত আছে আধুনিক mindfulness ও flow-এর মনস্তাত্ত্বিক ও দার্শনিক ভিত্তি।
Mindfulness-এর মূল নীতি হলো—বর্তমান মুহূর্তে সম্পূর্ণ সচেতন থাকা—কোনো বিচার, ভয় বা প্রত্যাশা ছাড়া। আধুনিক মনোবিজ্ঞানী জন কাবাট-জিন (Jon Kabat-Zinn) এর সংজ্ঞা দিয়েছেন—“Mindfulness means paying attention in a particular way: on purpose, in the present moment, and non-judgmentally.” (Wherever You Go, There You Are, 1994)। কিন্তু এই ধারণা আসলে গীতারই বুদ্ধিযোগ বা সমত্ববুদ্ধি তত্ত্বেরই আধুনিক রূপ। গীতা (৫.৮-৯)-এ শ্রীকৃষ্ণ বলেন—“নৈব কিঞ্চিত্ করোমি ইতি যুক্তো মন্যেত তত্ত্ববিত্। ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেষু বর্তন্ত ইতি ধারয়ন্।” অর্থাৎ, “যিনি যুক্ত (আত্মস্মৃতিতে স্থিত), তিনি ভাবেন—আমি কিছুই করি না; ইন্দ্রিয়েরা ইন্দ্রিয়ার্থে ক্রিয়াশীল।” এই অবস্থাই বেদান্তে সাক্ষিভাব (Sākṣibhāva)—যেখানে মন ক্রিয়াশীল, কিন্তু আত্মা নির্লিপ্ত দর্শক।
Mindfulness এই সাক্ষিত্বের অনুশীলন। চিন্তা আসে ও যায়, অনুভূতি ওঠে ও নামে, কিন্তু চেতনা কেবল সেগুলোকে দেখে। বেদান্ত এই অবস্থাকে বলে চিত্তশুদ্ধি—মনকে এমনভাবে প্রশান্ত করা, যাতে চিন্তার আসা-যাওয়া তাকে প্রভাবিত না করে। বৃহদারণ্যক উপনিষদ (৪.৩.২৩)-এ বলা হয়েছে—“দ্রষ্টা শ্রোতা মন্তা বোধতা”—আত্মা কেবল দেখেন, কখনও জড়িয়ে পড়েন না। আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞানের (neuroscience) গবেষণাতেও দেখা গেছে যে, mindfulness চর্চা করলে amygdala-র প্রতিক্রিয়া কমে যায় এবং prefrontal cortex-এর কার্যকারিতা বাড়ে, ফলে মন শান্ত, সচেতন ও সংযত হয়। গীতা (২.৪৮)-এর ভাষায় এই অবস্থাই “সমত্ববুদ্ধি”—সাফল্য-ব্যর্থতায় সমবৃত্ত থাকা।
প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের “সমত্ব বুদ্ধি” বা মানসিক স্থিরতার ধারণা আজ আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞানের ভাষায় নতুনভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। মাইন্ডফুলনেস (Mindfulness) চর্চা, যা মূলত ধ্যানেরই একটি বৈজ্ঞানিক রূপ, মস্তিষ্কের কাজের ধরনকে এমনভাবে পরিবর্তন করে যে, মানুষ আবেগে নয়, সংযমে পরিচালিত হয়—এটাই গীতার যোগ ও বুদ্ধিযোগের মূল শিক্ষা।
যখন কেউ নিয়মিত মননশীলতা বা mindfulness চর্চা করে, তখন তার মস্তিষ্কের দুইটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিবর্তন ঘটে—অ্যামিগডালা (Amygdala) এবং প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স (Prefrontal Cortex)। অ্যামিগডালা হলো মস্তিষ্কের সেই অংশ, যা ভয়, উদ্বেগ, রাগ বা আকস্মিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। যখন মাইন্ডফুলনেস অনুশীলন করা হয়, তখন এই অ্যামিগডালার কার্যকলাপ কমে যায়। ফলে, কেউ হঠাৎ চাপ বা রাগের পরিস্থিতিতেও শান্ত থাকতে পারে। মস্তিষ্কের গ্রে ম্যাটার বা ধূসর পদার্থের ঘনত্ব কমে যাওয়া মানে হলো আবেগের তীব্রতা হ্রাস—এটাই স্থির মনের সূচনা।
অন্যদিকে, প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স বা PFC হলো মস্তিষ্কের সামনের অংশ, যা যুক্তিবোধ, মনোযোগ, সিদ্ধান্তগ্রহণ ও আবেগের নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, mindfulness চর্চা PFC-কে আরও শক্তিশালী করে, এর কর্টিক্যাল স্তরকে পুরু করে। এর ফলে ব্যক্তি নিজের চিন্তা ও প্রতিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে। আবেগের ঝড়ে ভেসে না গিয়ে, যুক্তিসঙ্গতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বাড়ে—অর্থাৎ, মন হয় শান্ত, সচেতন ও সংযত।
এই দুটি পরিবর্তন মিলে মস্তিষ্কে এক নতুন ভারসাম্য তৈরি করে—একদিকে আবেগের প্রভাব কমে (অ্যামিগডালার প্রশমনে), অন্যদিকে যুক্তিবোধ ও আত্মনিয়ন্ত্রণ বাড়ে (PFC-এর সক্রিয়তায়)। এই অবস্থাতেই মানুষ হয়ে ওঠে সমবৃত্ত, স্থির এবং ধৈর্যশীল—যেমন গীতায় বলা হয়েছে, “সমত্বং যোগ উচ্যতে” (২.৪৮), অর্থাৎ, সমতাই যোগ।
এই বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা ভারতীয় দর্শনের সঙ্গে একেবারে মিলে যায়। গীতা বলছে—“সিদ্ধ্যসিদ্ধ্যোঃ সমো ভূত্বা সমত্বং যোগ উচ্যতে” (২.৪৮): সাফল্য বা ব্যর্থতা উভয় অবস্থায় সমান থাকা—এই মানসিক ভারসাম্যই যোগ। আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞানের ভাষায়, এ মানে হলো অ্যামিগডালার প্রতিক্রিয়া হ্রাস ও প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের কার্যকারিতা বৃদ্ধি। এই পরিবর্তনের ফলেই কর্মে মন স্থির থাকে, সিদ্ধান্ত হয় যুক্তিনির্ভর, এবং জীবনের উত্থান-পতনে মনের ভারসাম্য অটুট থাকে।
অতএব, প্রাচীন যোগ-দর্শনের “বুদ্ধিযোগ” বা “সমত্ব বুদ্ধি” এবং আধুনিক মনোবিজ্ঞানের “মাইন্ডফুলনেস নিউরোসায়েন্স”—দুটিই মূলত একই সত্যের দুই ভাষা। প্রাচীন ঋষিরা বলেছিলেন, “স্থিতপ্রজ্ঞস্তদা প্রাহ” (গীতা, ২.৫৪)—স্থিত মনই জ্ঞানী; আধুনিক বিজ্ঞান বলছে, mindfulness চর্চা মস্তিষ্ককে পুনর্গঠন করে (neuroplasticity) এমনভাবে যে, মন হয়ে ওঠে স্থির, উপস্থিত ও সুষম।
মননশীলতা শুধু একটি ধ্যানপদ্ধতি নয়, বরং প্রাচীন গীতার সমত্ববুদ্ধি ধারণার আধুনিক রূপ—যেখানে বিজ্ঞান ও দর্শন মিলিত হয়ে প্রমাণ করে যে, যোগ আসলে এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক দক্ষতা, যা মস্তিষ্ক ও মন উভয়কেই শান্ত, সচেতন ও মুক্ত করে তোলে।
Flow-state ধারণাটি দিয়েছেন মনোবিজ্ঞানী মিহালি চিকসেন্টমিহাই (Mihály Csíkszentmihályi) তাঁর বই Flow: The Psychology of Optimal Experience (1990)-এ। তিনি বলেন—“Flow is the state in which people are so involved in an activity that nothing else seems to matter; the experience itself is so enjoyable that people will do it even at great cost.” অর্থাৎ, যখন ব্যক্তি এমনভাবে কোনো কাজে নিমগ্ন হয় যে, আত্মস্মৃতি, সময়বোধ ও ফলচিন্তা সব মিলিয়ে যায়, তখনই flow ঘটে। এই অবস্থাই গীতার কর্মযোগের ভাষায়—“যোগঃ কর্মসু কৌশলম্” (ভগবদ্গীতা, ২.৫০)—যোগ মানে কর্মে কৌশল বা দক্ষতা।