একই সুর দেখা যায় স্পিনোজা ও স্টোইক দর্শনে। স্পিনোজা বলেন, মানুষ যখন প্রকৃতিকে ঈশ্বররূপে উপলব্ধি করে, তখন সে নিজের কর্মকে বিশ্বব্যবস্থার একটি অংশ হিসেবে দেখে; ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা বিলীন হয় মহাবিশ্বের অনন্ত বুদ্ধিতে। এটি গীতার “ঈশ্বরার্পিত কর্ম” ধারণার (গীতা, ৩.৩০, ৯.২৭, ৯.২৮) পাশ্চাত্য প্রতিরূপ। আবার স্টোইক দার্শনিকরা, যেমন এপিকটেটাস ও মার্কাস অরেলিয়াস শিক্ষা দেন, “যা তোমার নিয়ন্ত্রণে নয়, তা নিয়ে দুঃখ কোরো না; যা নিয়ন্ত্রণে আছে, তা কর্তব্যবোধে সম্পন্ন করো।” এই মনোভাব নিষ্কাম কর্মেরই প্রতিধ্বনি—কর্মের লক্ষ্য কর্তব্য, ফল নয়।
গীতা, ৩.৩০: সমস্ত কর্ম আমাকে সমর্পণ করে, তোমার মনকে আধ্যাত্মিক চেতনায় (ব্রহ্মজ্ঞানে) নিবিষ্ট করো। তুমি আকাঙ্ক্ষাশূন্য (নিরাশীঃ), মমত্ববোধরহিত (নির্মমঃ) এবং শোক-তাপমুক্ত (বিগতজ্বরঃ) হয়ে যুদ্ধ করো (অর্থাৎ কর্তব্য পালন করো)।
গীতা, ৯.২৭: হে কৌন্তেয় (অর্জুন)! তুমি যা কিছু করো, যা কিছু আহার করো, যা কিছু হোম বা যজ্ঞ করো, যা কিছু দান করো এবং যে তপস্যা করো—তা সমস্তই আমাকে সমর্পণ করো।
গীতা, ৯.২৮: এইভাবে শুভ ও অশুভ কর্মের ফল থেকে তুমি মুক্ত হবে। সন্ন্যাসযোগে যুক্ত হয়ে তুমি কর্মের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে আমাকে প্রাপ্ত হবে।
প্রাচ্যে এই আদর্শের আধুনিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন স্বামী বিবেকানন্দ, শ্রীঅরবিন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মহাত্মা গান্ধী।
স্বামী বিবেকানন্দ নিষ্কাম কর্মকে মানবসেবার রূপ দিয়েছিলেন—“Work for work’s sake”—কর্মই উপাসনা, কর্মই যোগ। তিনি বলেন, নিষ্কাম কর্ম কেবল মুক্তির উপায় নয়, এটি আত্মবিকাশের সাধনা; কারণ সেবা ও ত্যাগের মধ্যেই আত্মা প্রসারিত হয়। তাঁর “Karma-Yoga” গ্রন্থে তিনি স্পষ্ট বলেছেন—“কাজ করো, কিন্তু নাম ও খ্যাতির জন্য নয়; ঈশ্বরচেতনায় করো।”
শ্রীঅরবিন্দ এই আদর্শকে আরও গভীরে নিয়ে গিয়ে বলেন, কর্ম হলো ঈশ্বরচেতনার বহিঃপ্রকাশ—“Karma is the dynamic side of Yoga।” তাঁর মতে, সত্য যোগী কর্ম ত্যাগ করে না; বরং কর্মের মধ্যেই ঈশ্বরচেতনা প্রকাশ করে। যখন কর্ম ঈশ্বরকে নিবেদিত হয়, তখন সেটি হয়ে ওঠে সাধনা—যেখানে বাহ্যিক ক্রিয়ার মধ্য দিয়েই আধ্যাত্মিক জাগরণ ঘটে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিষ্কাম কর্মকে সৌন্দর্য, প্রেম ও সৃজনের একীভূত রূপে দেখেছেন। তাঁর মতে, “যে-কর্মে অনন্তের প্রকাশ, সেই কর্মই ধর্ম।” কর্মের আনন্দ ফলের মধ্যে নয়, কর্মের সৃষ্টিতেই নিহিত। মানুষ যখন প্রেম, কর্তব্য ও সৌন্দর্যের মিলনে কাজ করে, তখন সে ঈশ্বরলীলায় অংশগ্রহণ করে।
মহাত্মা গান্ধী গীতার এই দর্শনকে নিজের জীবনদর্শনে রূপ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “গীতা আমার দৈনন্দিন পথপ্রদর্শক; নিষ্কাম কর্মই সত্যকার স্বরাজ।” তাঁর জন্য নিষ্কাম কর্ম মানে সত্য, অহিংসা ও সেবার একত্র সাধনা। তিনি বিশ্বাস করতেন—সেবা-ই প্রার্থনা, কর্মই উপাসনা, এবং ফলত্যাগই ঈশ্বরচিন্তার বাস্তব রূপ। ('স্বরাজ' শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ 'স্ব' (নিজে) এবং 'রাজ' (শাসন/নিয়ন্ত্রণ) থেকে। গান্ধীজির মতে, "স্বরাজ" হলো এক এমন আদর্শ অবস্থা, যেখানে ব্যক্তি আত্ম-নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নৈতিকভাবে উন্নত হয়, সমাজ স্বয়ংসম্পূর্ণ হয় এবং জাতি বিদেশী শাসন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে সত্য (Truth) ও অহিংসার (Non-violence) পথে পরিচালিত হয়।)
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস এই তত্ত্বকে সহজভাবে বলেছেন—“কর্ম করো, কিন্তু মন রাখো ঈশ্বরে। ঘুঘু বাইরে কুকু করে, কিন্তু ডিমের উপরেই বসে থাকে।” অর্থাৎ বাহ্য কর্ম চললেও অন্তরে স্থিত থাকুক ঈশ্বরস্মৃতি; এই দ্বৈত ভারসাম্যই সত্য যোগের প্রাণ।
অতএব, নিষ্কাম কর্ম কেবল এক ধর্মীয় নীতি নয়—এটি এক সর্বজনীন নৈতিক ও আধ্যাত্মিক তত্ত্ব। গীতা, কান্ট, স্পিনোজা, স্টোইক চিন্তাবিদগণ, বিবেকানন্দ, অরবিন্দ, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী ও রামকৃষ্ণ—সবাই বিভিন্ন ভাষায় এক কথাই বলেছেন: “কর্মের মূল্য ফলের মধ্যে নয়, কর্মের অন্তর্নিহিত চেতনায়।”
ফল আসুক বা না আসুক, কর্মের আনন্দ নিহিত কর্তব্যচেতনায়; কারণ কর্তব্যই ধর্ম, কর্মই ধ্যান, সেবাই মুক্তি। এই উপলব্ধিই নিষ্কাম কর্মের দার্শনিক নির্যাস—যেখানে কর্মের মধ্য দিয়েই মানুষ নিজের আত্মাকে, সমাজকে এবং ঈশ্বরকে একাকারভাবে উপলব্ধি করে।
নিষ্কাম কর্মের আদর্শ নিছক আধ্যাত্মিক বিমূর্ততা নয়; এটি এক অভ্যন্তরীণ চেতনা-বিকাশের প্রক্রিয়া, যেখানে কর্মের মূল লক্ষ্য বাহ্যিক ফল নয়, বরং চিত্তশুদ্ধি ও ঈশ্বরচেতনার প্রকাশ। গীতার এই আদর্শ—“কর্ম কর, ফলের আসক্তি ত্যাগ করো” (গীতা, ২.৪৭)—পরবর্তী যুগে নিও-বেদান্ত ও আধুনিক দর্শনে নতুন অর্থে বিকশিত হয়েছে।
নিষ্কাম কর্মের প্রথম ও প্রধান উপায় হলো ঈশ্বরে কর্মফল অর্পণ, যা গীতায় Yoga of Surrender নামে পরিচিত। যখন কর্মী ভাবে—“আমি কর্তা নই, ঈশ্বরই সর্বকর্তা” (গীতা, ৩.২৭)—তখন কর্তৃত্বাভিমান বিলীন হয়ে যায়। কর্মের সফলতা বা ব্যর্থতা তখন তাকে স্পর্শ করতে পারে না। আধুনিক নিও-বেদান্ত এই অর্পণের ভাবকে অভ্যন্তরীণ করে দেখেছে—ঈশ্বর মানে নিজের অন্তঃচৈতন্য, তাই কর্ম মানে সেই চৈতন্যেরই বিকাশ। “যোগঃ কর্মসু কৌশলম্” (Yogaḥ karmasu kauśalam)—এই শ্লোকটি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার দ্বিতীয় অধ্যায় (সাংখ্যযোগ)-এর ৫০তম শ্লোকে বলা হয়েছে—
বুদ্ধিযুক্তো জহাতি হ উভে সুকৃতদুষ্কৃতম্।
তস্মাদ্ যোগায় যুজ্যস্ব যোগঃ কর্মসু কৌশলম্।। (ভগবদ্গীতা, ২.৫০)
অর্থাৎ—“যিনি বুদ্ধিযুক্ত, তিনি সুকৃত ও দুষ্কৃত উভয় কর্মফল ত্যাগ করেন; তাই যোগে নিজেকে স্থাপন করো, কারণ যোগ মানে কর্মে কৌশল।” এই একটি শ্লোকেই শ্রীকৃষ্ণ সমগ্র কর্মযোগ তত্ত্বের সারমর্ম প্রকাশ করেছেন—যেখানে কর্ম, জ্ঞান ও যোগ একীভূত হয়েছে।
‘যোগ’ শব্দের মূল অর্থ ‘সংযোগ’ (যুগ্ ধাতু থেকে), অর্থাৎ জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন বা একত্ব। কিন্তু গীতায় এই ‘যোগ’ শব্দটি কেবল ধ্যান বা সংযম নয়, বরং ‘বুদ্ধিযোগ’—যে চেতনা বা মানসিক অবস্থায় কর্ম সম্পাদিত হলেও কর্মী ফলের আকাঙ্ক্ষা দ্বারা প্রভাবিত হয় না। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন—
যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি সঙ্ঙং ত্যক্ত্বা ধনঞ্জয়।
সিদ্ধ্যসিদ্ধ্যোঃ সমো ভূত্বা সমত্বং যোগ উচ্যতে।। (গীতা, ২.৪৮)
অর্থাৎ—“যোগে স্থিত হয়ে কর্ম করো, সংগতির ত্যাগ করে; সিদ্ধি ও অসিদ্ধিতে সমবুদ্ধি হও, কারণ সমত্বই যোগ।”
এই সমবুদ্ধিই গীতার মতে যোগের প্রকৃত অর্থ—যেখানে সাফল্য ও ব্যর্থতার পার্থক্য বিলীন হয়, আর মন স্থিত হয় অন্তর্নিহিত শান্তিতে। এই মানসিক সমতা বা সমত্ববুদ্ধিই হলো “যোগঃ কর্মসু কৌশলম্”-এর অভ্যন্তরীণ অর্থ—যেখানে যোগ মানে মানসিক স্থিরতা, আর কৌশল মানে সেই স্থিরতাকে কর্মে প্রয়োগ করার আধ্যাত্মিক কৌশল।
“কৌশল” (kauśalam) শব্দের সাধারণ অর্থ দক্ষতা, কিন্তু এখানে এর তাৎপর্য গভীরতর। এটি কেবল বাহ্যিক নিপুণতা নয়; বরং এক আধ্যাত্মিক কৌশল (spiritual strategy)—যা কর্ম করেও কর্মীকে বন্ধন থেকে মুক্ত রাখে। শঙ্করাচার্য তাঁর গীতাভাষ্যে (২.৫০) স্পষ্ট বলেন—“কৌশলম্ নাম সমত্ববুদ্ধিরূপা যোগঃ।” অর্থাৎ, “কৌশল” মানে সেই সমবুদ্ধিরূপ যোগ, যা কর্মে থেকেও ফলের আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্ত রাখে। এই বুদ্ধিযোগই কর্মকে জ্ঞানের পথে পরিণত করে, কর্মকে করে তোলে মুক্তির মাধ্যম।
গীতার দৃষ্টিতে কর্মের কৌশল হলো একপ্রকার মানসিক ভারসাম্য বা equilibrium of consciousness। এই ভারসাম্যের তিনটি স্তর আছে।
প্রথমত, বুদ্ধি-কৌশল—জানতে হবে যে, প্রকৃতি কর্ম করায়, আত্মা কর্তা নয়; যেমন গীতা (৩.২৭)-এ বলা হয়েছে, “প্রকৃতের ক্রিয়ামাণানি গুণৈঃ কর্মাণি সর্বশঃ”—সব কর্মই প্রকৃতির দ্বারা সংঘটিত হয়।
দ্বিতীয়ত, চিত্ত-কৌশল—ফলপ্রত্যাশা ত্যাগ করে সমবুদ্ধি অর্জন করা; যেমন (২.৪৮)-এ বলা হয়েছে, “যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি।”
তৃতীয়ত, কর্ম-কৌশল—কর্তব্যকর্মকে ঈশ্বরার্পিত যজ্ঞরূপে সম্পন্ন করা; যেমন (৩.৯)-এ বলা হয়েছে, “যজ্ঞার্থাত্ কর্মণোঽন্যত্র লোকোঽয়ং কর্মবন্ধনঃ”—যজ্ঞরূপে না করা হলে কর্ম মানুষকে বেঁধে ফেলে।
এই তিন স্তরের সংহতিই গীতার “কৌশলম্”—যা কর্মকে আধ্যাত্মিক সাধনায় রূপান্তরিত করে।
বেদান্তের দৃষ্টিতে কর্মের উদ্দেশ্য ফল নয়, বরং চিত্তশুদ্ধি। কর্ম চিত্তকে পরিশুদ্ধ করে, আর সেই চিত্তশুদ্ধিই জ্ঞানলাভের পূর্বশর্ত। তাই গীতা (৩.১৯) ঘোষণা করে—
তস্মাদসক্তঃ সততং কার্যং কর্ম সমাচর।
অসক্তো হ্যাচরং কর্ম পরমাপ্নোতি পুরুষঃ।। (গীতা, ৩.১৯)
অর্থাৎ, আসক্তিহীনভাবে কর্তব্য পালন করো; তাতেই মানুষ পরমার্থে পৌঁছে যায়। এই আসক্তিহীন কর্মই প্রকৃত “skill in action”—যেখানে দক্ষতা বাহ্যিক নয়, বরং অভ্যন্তরীণ প্রজ্ঞা ও সংযমের ফল। শঙ্করাচার্য ব্যাখ্যা করেন—“কৌশল” মানে সমবুদ্ধি ও ফলত্যাগের নিপুণতা, কারণ এই দুইয়ের দ্বারা কর্ম পুণ্য–পাপ উভয় বন্ধন থেকে মুক্ত থাকে।
বেদান্তীয় বিশ্লেষণে কর্মের কৌশল মানে কেবল কারিগরি দক্ষতা নয়, বরং চেতনার পরিপক্বতা। আত্মা কখনও কর্মে লিপ্ত নয়; কর্ম কেবল প্রকৃতির গুণমাত্র। গীতা (৫.৮-৫.৯)-এ বলা হয়েছে—
নৈব কিঞ্চিৎ করোমি ইতি যুক্তো মন্যেত তত্ত্ববিৎ।
পশ্যন্ শৃণ্বন্ স্পৃশন্ জিঘ্রন্ অश्नন্ গচ্ছন্ স্বপন্ শ্বসন্।। (৫.৮)
প্রলপন্ বিসৃজন্ গৃহ্ণন্ উন্মিষন্ নিমিষন্নপি।
ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেষু বর্তন্ত ইতি ধারয়ন্।। (৫.৯)
অর্থাৎ—“একজন তত্ত্বজ্ঞানী (তত্ত্ববিৎ) ব্যক্তি (যোগযুক্ত বা আত্মাতে স্থিত হয়ে) মনে করেন যে 'আমি কিছুই করি না', যখন তিনি: দেখেন, শোনেন, স্পর্শ করেন, শোঁকেন; আহার করেন, গমন করেন, নিদ্রা যান, শ্বাস-প্রশ্বাস নেন; কথা বলেন, ত্যাগ করেন (মলমূত্র), গ্রহণ করেন; চোখের পাতা খোলেন বা বন্ধ করেন। এই সময় তিনি শুধু এই স্থির বুদ্ধি রাখেন যে—'ইন্দ্রিয়গুলি তাদের নিজ নিজ বিষয়ে প্রবৃত্ত হচ্ছে' (অর্থাৎ আত্মা নয়, দেহ ও ইন্দ্রিয়ই কর্ম করে চলেছে)। এই শ্লোক দুটি কর্মযোগে কর্তৃত্বাভিমান ত্যাগের নীতিকে দৃঢ় করে—
অকর্তৃত্বের জ্ঞান: জ্ঞানী ব্যক্তি জানেন যে, তাঁর আসল স্বরূপ আত্মা—যা অচল, নিষ্ক্রিয় এবং নির্লিপ্ত। কাজগুলি আত্মা করে না; সেগুলি প্রকৃতির গুণগুলির (সত্ত্ব, রজ ও তম) প্রভাবে দেহ, মন ও ইন্দ্রিয়গুলি দ্বারা সম্পন্ন হয়।
কর্মের বন্ধন মুক্তি: যেহেতু জ্ঞানী ব্যক্তি নিজেকে কর্তা মনে করেন না এবং এই সত্যকে সর্বদা ধারণ করেন, তাই তাঁর কোনো কর্মের ফল তাঁকে বন্ধন করতে পারে না। এটিই হলো "আমি কর্তা নই, ঈশ্বরই সর্বকর্তা" এই উচ্চতর জ্ঞানের ব্যবহারিক দিক।
বৃহদারণ্যক উপনিষদ (৪.৪.২২) এই তত্ত্বকে পুনর্নিশ্চিত করেছে—“নায়মাত্মা কর্মণালিপ্যতে”—আত্মা কর্মে লিপ্ত নয়। গীতা এই উপনিষদীয় সত্যকে ব্যাবহারিক কৌশলে রূপ দিয়েছে—“ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্ম হবি, ব্রহ্মাগ্নৌ ব্রহ্মণা হুতম্” (গীতা, ৪.২৪); অর্থাৎ, যখন কর্ম ঈশ্বরস্মৃতিতে সম্পন্ন হয়, তখন তা ব্রহ্মার্পণে পরিণত হয়; তখন কর্ম হয়ে ওঠে মুক্তির সেতু।
“যোগ” ও “কৌশল” শব্দদুটি একে অপরের পরিপূরক। যোগ হলো অন্তর্গত ভারসাম্যের অবস্থা—চিত্তের স্থিতি; কৌশল হলো সেই স্থিতিকে কর্মে প্রয়োগ করার মানসিক দক্ষতা। যোগ অন্তর্জগতের নৈতিক শৃঙ্খলা, কৌশল তার বাস্তব প্রয়োগ। যোগ মানে চেতনার স্থিতি, কৌশল মানে সেই স্থিতির কৌশলগত প্রয়োগ। একজন যোগী জানে—দক্ষতা মানে কেবল বাহ্যিক নিপুণতা নয়, বরং প্রতিটি কর্মে আত্মস্মৃতি, সমবুদ্ধি ও ঈশ্বরচেতনা বজায় রাখা।
“যোগঃ কর্মসু কৌশলম্”-এর দার্শনিক তাৎপর্য হলো—যোগ মানে কর্মে বুদ্ধির সঠিক কৌশল প্রয়োগ। কর্মের প্রকৃত নৈপুণ্য তার ফল নয়, বরং চেতনার দক্ষতা; আর এই চেতনার কৌশলই কর্মকে আধ্যাত্মিক সাধনায় রূপান্তরিত করে। কর্মে স্থিত থেকে ফলাসক্তিহীন চিত্ত বজায় রাখাই মুক্তির পথ—যেমন গীতা বলে, “সমত্বং যোগ উচ্যতে” (গীতা, ২.৪৮)। অর্থাৎ, "সমতাই যোগ বলে কথিত হয়।" তাই গীতার নির্দেশ—কর্ম করো যোগে স্থিত থেকে; যোগ মানে অভ্যন্তরীণ কৌশল, যেখানে কর্ম হয়ে ওঠে আত্মার সাধনা, আর দক্ষতাই রূপ নেয় মুক্তির উপায়ে।