অবিদ্যা-বিদ্যা: ৬৯


নিষ্কাম কর্মের সঙ্গে সম্পর্ক: ভগবদ্গীতার শিক্ষা অনুসারে, এই মনোভাবই হলো নিষ্কাম কর্মের চূড়ান্ত ও সহজতম রূপ। যখন কোনো ব্যক্তি মনে করেন, "আমি কর্তা নই, আমি কেবল ভগবানের দাস," এবং সমস্ত কর্ম ভগবানের সেবার জন্য করছেন, তখন—

কর্তৃত্বের অহংকার ত্যাগ: সেই কর্মে কর্তৃত্বের অহংকার (আমি কর্তা) থাকে না।

বন্ধনমুক্তি: কর্মের ফল তাঁকে স্পর্শ করে না, কারণ তিনি সেই ফলের মালিকানা দাবি করেন না।

“ভগবদ্-আরাধনার্থ কর্ম” হলো সেই নিষ্কাম কর্ম, যা জীবকে বন্ধনমুক্ত করে এবং মোক্ষ বা ভাগবৎ-সাক্ষাৎকারের দিকে চালিত করে। কর্ম যদি আত্মকেন্দ্রিক হয়, তবে তা বন্ধন; কিন্তু যদি ঈশ্বরকেন্দ্রিক হয়, তবে তা ভক্তি। কর্মের উদ্দেশ্য তখন আর ফললাভ নয়, ঈশ্বরের প্রসন্নতা। এই ভক্তিপূর্ণ কর্মেই চিত্ত হয় শুদ্ধ, মন হয় শান্ত, আর অহংকার বিলুপ্ত হয়।

চিত্তশুদ্ধি ও জ্ঞানের যোগসূত্র: চেতসা সর্বকর্মাণি ময়ি সংনস্য মৎপরঃ। / বুদ্ধিযোগমুপাশ্রিত্য মচ্চিত্তঃ সততং ভব।। (গীতা, ১৮.৫৭)

“চেতসা সর্বকর্মাণি ময়ি সংনস্য মৎপরঃ”-এর ভাবার্থ—তোমার মন (চেতসা) দ্বারা সমস্ত কর্ম (সর্বকর্মাণি) আমাতে (ঈশ্বরে/ময়ি) সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ (সংনস্য) করে, আমাকে পরম আশ্রয়রূপে (মৎপরঃ) গ্রহণ করো। এটি নির্দেশ করে যে, কর্মফল অর্পণের প্রক্রিয়াটি কেবল যান্ত্রিক নয়, বরং সচেতন মন দ্বারা ঈশ্বরকে একমাত্র লক্ষ্য (মৎপরঃ) রেখে করতে হবে।


“বুদ্ধিযোগম্ উপাশ্রিত্য মচ্চিত্তঃ সততং ভব”-এর ভাবার্থ—বুদ্ধিযোগের (সমত্ববুদ্ধি) আশ্রয় নিয়ে (উপাশ্রিত্য), আমাতেই চিত্ত নিবদ্ধ (মচ্চিত্তঃ) রেখে সর্বদা স্থিত থাকো (সততং ভব)। বুদ্ধিযোগ (নিষ্কাম কর্মের জ্ঞান) হলো সেই মাধ্যম, যা মনকে শুদ্ধ করে। সেই শুদ্ধ মন দ্বারা সর্বদা ঈশ্বরে মনোনিবেশ করাই হলো মোক্ষ লাভের পদ্ধতি।

এই শ্লোকটি জ্ঞান (বুদ্ধিযোগ), কর্ম (সর্বকর্মাণি সন্ন্যাস) এবং ভক্তি (মৎপরঃ, মচ্চিত্তঃ)—এই তিন যোগের চূড়ান্ত সমন্বয়। শ্রীকৃষ্ণ এখানে বলছেন, কর্মফলের আসক্তি ত্যাগ করে ঈশ্বরের শরণাগত হওয়াই হলো মোক্ষলাভের সরলতম পথ।

“ঈশ্বরচিন্তায় স্থিত থেকে কর্ম করা”—এই অবস্থায় কর্মফল ও আসক্তি থেকে মন মুক্ত হয়। ফলস্বরূপ জ্ঞান ও ভক্তি—দুই-ই বিকশিত হয়। জ্ঞান কর্মকে বিশুদ্ধ করে, কর্ম জ্ঞানকে স্থিত করে—এবং উভয়ই মিলে ভক্তির পরিপূর্ণ রূপ সৃষ্টি করে।

শঙ্কর ও রামানুজের দার্শনিক অবস্থানগত পার্থক্য: শঙ্করের মতে, কর্ম আত্মজ্ঞানের পূর্বপ্রস্তুতি; জ্ঞানলাভের পর কর্ম বিলীন হয়, কারণ নির্গুণ ব্রহ্ম কর্মাতীত। কিন্তু রামানুজের মতে, ঈশ্বর সগুণ ও সর্বব্যাপী—তাঁর সৃষ্টিতে, জীবনে, কর্মে সর্বত্র ঈশ্বরীয় সত্তা বিরাজমান। তাই কর্ম কখনও ঈশ্বরচেতনা থেকে আলাদা হতে পারে না। কর্ম ঈশ্বরসেবার পথ; এই সেবাই মুক্তির উপায়।

মুক্তির ধারণা—ভক্তির পরিণতি: রামানুজ বলেন, নিষ্কাম কর্মের মাধ্যমে প্রস্তুত-হওয়া মন যখন ভক্তিতে পরিপূর্ণ হয়, তখন ঈশ্বর স্বয়ং কৃপা করেন। সেই কৃপাই মোক্ষের কারণ। এখানে মুক্তি মানে আত্মার ঈশ্বরের সঙ্গে নিত্যসঙ্গ—একত্ব নয়, বরং অনন্ত সেবায় অংশগ্রহণ। তিনি বলেন—“Bhakti is not a means to dissolve into God, but to live eternally in loving union with Him.”

জগৎ সত্য, কারণ তা ঈশ্বরের প্রকাশ। কর্ম সত্য, কারণ তা ঈশ্বরের শক্তির ক্রিয়া। নিষ্কাম কর্ম মানে ঈশ্বরচেতনায় কর্ম করা—ফল বা অহংকার ছাড়া। এই কর্ম চিত্তশুদ্ধির মাধ্যমে ভক্তিকে জন্ম দেয়। ভক্তি ঈশ্বরকৃপায় মুক্তির দিকে নিয়ে যায়।

রামানুজাচার্যের দর্শনে নিষ্কাম কর্ম একদিকে ত্যাগের সাধনা, অন্যদিকে ভক্তির প্রস্তুতি। কর্ম এখানে জড় নয়, ঈশ্বরীয় লীলার অংশ; আর কর্মযোগী মানুষ ভক্ত হয়ে ওঠে ঈশ্বরের সহচর। এভাবেই বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্তে ত্যাগ ও ভোগ, কর্ম ও জ্ঞান, ব্যক্তি ও ঈশ্বর—সব এক সুরে মিশে যায় ঈশ্বরসেবার চিরন্তন ঐক্যে।

নিষ্কাম কর্মের মূল নীতি—আসক্তি বর্জন—কেবল ভগবদ্গীতা বা হিন্দু দর্শনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি সমগ্র ভারতীয় আধ্যাত্মিক ভাবধারার এক অভিন্ন নীতি। কর্মের ফলের প্রতি আসক্তি বা তৃষ্ণাকেই সব দর্শনই দুঃখের মূল কারণ বলে মনে করেছে, আর সেই আসক্তি থেকে মুক্তিই মোক্ষ বা নির্বাণ লাভের পথ।

যোগশাস্ত্রে, মহর্ষি পতঞ্জলির অষ্টাঙ্গিক যোগের প্রথম দুটি ধাপ, যম ও নিয়ম, আসক্তিমুক্ত জীবনের ভিত্তি স্থাপন করে। এই দুটি স্তর ব্যক্তির নৈতিক ও আত্মিক পরিশুদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

যম, যা সামাজিক আচরণের পথপ্রদর্শক, তাতে পাঁচটি মূল বিধান রয়েছে—

অহিংসা: কোনো জীবকে কায়িক, বাচিক বা মানসিক স্তরে আঘাত না করা। এটি কেবল শারীরিক আঘাত থেকে বিরত থাকা নয়, বরং ঘৃণা, বিদ্বেষ বা নেতিবাচক চিন্তা থেকেও মুক্ত থাকা।

সত্য: মন, বাক্য ও কর্মে সত্যের অনুসরণ। অপ্রিয় বা ক্ষতিকারক সত্য পরিহার করাও এর অন্তর্ভুক্ত।

ব্রহ্মচর্য: ইন্দ্রিয় সংযম, বিশেষ করে যৌন শক্তিকে উচ্চতর আধ্যাত্মিক সাধনায় চালিত করা। এটি কেবল শারীরিক বিরত থাকা নয়, বরং মনের পবিত্রতাও বোঝায়।

অস্তেয়: চুরি না করা। এটি কেবল অপরের সম্পত্তি হরণ না করা নয়, বরং কোনো কিছু পাওয়ার অবৈধ আকাঙ্ক্ষা না রাখাও বোঝায়।

অপরিগ্রহ: অপ্রয়োজনীয় বস্তু বা সম্পদের প্রতি আসক্তি ত্যাগ করা। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সংগ্রহ না করা এবং সঞ্চয় প্রবণতা ত্যাগ করা।

নিয়ম, যা ব্যক্তিগত শৃঙ্খলার ভিত্তি, তাতেও পাঁচটি মূল নীতি রয়েছে—

শৌচ: শারীরিক ও মানসিক পবিত্রতা। শরীরকে পরিষ্কার রাখা এবং মনকে রাগ, ঘৃণা, অহংকার ইত্যাদি থেকে মুক্ত রাখা।

সন্তোষ: যা আছে, তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা। অতিরিক্ত আকাঙ্ক্ষা বা অতৃপ্তি থেকে মুক্ত থাকা।

তপঃ: কঠোর অনুশীলন বা কৃচ্ছ্রসাধন। এটি শরীরের কষ্টকর অনুশীলন হতে পারে বা মনের একাগ্রতার জন্য নিয়মিত অভ্যাস হতে পারে।

স্বাধ্যায়: আত্ম-অধ্যয়ন এবং শাস্ত্র অধ্যয়ন। নিজের আত্মাকে জানা এবং আধ্যাত্মিক গ্রন্থ পাঠ করে জ্ঞান অর্জন করা।

ঈশ্বরপ্রণিধান: ঈশ্বরের প্রতি পূর্ণ সমর্পণ। নিজের সমস্ত কর্মফল ঈশ্বরকে উৎসর্গ করা এবং তাঁর ইচ্ছার প্রতি আস্থা রাখা।

এই যম ও নিয়মের অনুশীলন চিত্তকে শুদ্ধ করে, ভোগলালসা ও আসক্তি দূর করে এবং মনকে সংযত করে। যখন মন বহির্ভোগ থেকে মুক্ত হয়, তখন চিত্ত নির্মল ও স্থির হয়। এই স্থির ও নির্মল চিত্তেই যোগের চূড়ান্ত লক্ষ্য—চিত্তবৃত্তি নিরোধ—সাধিত হয়। চিত্তবৃত্তি নিরোধ মানে, মনের সমস্ত চঞ্চলতাকে দমন করে তাকে একাগ্র করা, যাতে আত্মজ্ঞান লাভ করা যায়।

যোগপথে আসক্তিবর্জনই প্রথম ও অপরিহার্য ধাপ। কারণ, যদি সাধকের মনে কোনো ফললাভের আকাঙ্ক্ষা বা ভোগের লালসা থাকে, তবে যোগের গভীরতম অবস্থা, অর্থাৎ যোগসমাধি, লাভ করা অসম্ভব। আসক্তি থাকলে মন সর্বদা বহির্মুখী থাকে এবং আত্মস্বরূপে স্থির হতে পারে না। তাই, প্রকৃত যোগ সাধনার জন্য নিঃস্বার্থভাবে কর্ম করা এবং ফলাফলের প্রতি অনাসক্ত থাকা একান্ত আবশ্যক।

বৌদ্ধ দর্শনের মূল ভিত্তি হলো দুঃখের ধারণা এবং তা থেকে মুক্তির পথ। গৌতম বুদ্ধের প্রচারিত চারটি আর্যসত্য (Cattāri Ariyasaccāni) হলো বৌদ্ধ দর্শনের মূল ভিত্তি, যা স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ তাঁর প্রথম ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্রে, বেনারসের সারনাথে মৃগদায়ে উপদেশ দেন। এই চারটি সত্য মানুষের জীবনের দুঃখ, তার কারণ, তার নিরোধ এবং সেই নিরোধে পৌঁছানোর পথ—এই সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়াকে প্রকাশ করে।

প্রথম সত্য দুঃখ আর্যসত্য (Dukkha Ariya Sacca)। বুদ্ধ বলেন, জন্ম, বার্ধক্য, রোগ, মৃত্যু—সবই দুঃখ। প্রিয় থেকে বিচ্ছেদ, অপছন্দনীয়ের সংস্পর্শ, আকাঙ্ক্ষা পূরণ না হওয়া—সব দুঃখ। এই দুঃখ কেবল যন্ত্রণার অর্থে নয়, বরং জীবনের পরিবর্তনশীলতা ও অনিত্যতার উপলব্ধি। জীবন স্বয়ং অনিত্য, আর অনিত্য জগতে স্থায়িত্ব খুঁজতে গিয়ে মানুষ দুঃখভোগ করে।

দ্বিতীয় সত্য সমুদয় আর্যসত্য (Samudaya Ariya Sacca)। দুঃখের কারণ হলো তৃষ্ণা (Taṇhā)—অর্থাৎ আকাঙ্ক্ষা ও আসক্তি। তৃষ্ণা তিন প্রকার: কামতৃষ্ণা—ইন্দ্রিয়সুখের আকাঙ্ক্ষা; ভবতৃষ্ণা—অস্তিত্ব বা জীবনধারণের আকাঙ্ক্ষা; বিভবতৃষ্ণা—অস্তিত্বহীনতার আকাঙ্ক্ষা। এই তৃষ্ণা মানুষকে পুনর্জন্মের চক্রে আবদ্ধ রাখে। যতদিন আকাঙ্ক্ষা আছে, ততদিন দুঃখ চলবে।

তৃতীয় সত্য নিরোধ আর্যসত্য (Nirodha Ariya Sacca)। দুঃখের অবসান সম্ভব, যখন তৃষ্ণা সম্পূর্ণরূপে নিঃশেষিত হয়। বুদ্ধ বলেন, “তৃষ্ণাক্ষয়ই নির্বাণ।” আকাঙ্ক্ষার ক্ষয় মানেই দুঃখের অবসান, জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি। এই অবস্থায় ‘আমি’ বা ‘আমার’ ধারণা বিলীন হয়; মন স্থির, শান্ত, নির্বিকার হয়। এটি নির্বাণ বা মুক্তির অবস্থা।

চতুর্থ সত্য মার্গ আর্যসত্য (Magga Ariya Sacca)। দুঃখের অবসানের জন্য যে-পথ অনুসরণ করতে হবে, সেটি হলো অষ্টাঙ্গিক মার্গ। এই আটটি অঙ্গ হলো—সম্যক দৃষ্টি (সত্য ও কর্মফল সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান), সম্যক সংকল্প (অহিংসা ও ত্যাগের চিন্তা), সম্যক বাক (মিথ্যা ও কু-বাক্য থেকে বিরত থাকা), সম্যক কর্ম (নৈতিক ও অহিংস আচরণ), সম্যক আজীবিকা (ন্যায়সংগত জীবিকা), সম্যক প্রয়াস (পাপকর্ম দমন ও শুভকর্ম চর্চা), সম্যক স্মৃতি (সচেতন ও বর্তমান মুহূর্তে স্থিত থাকা), এবং সম্যক সমাধি (ধ্যানের একাগ্রতা)। এই পথই মধ্যম মার্গ—না ইন্দ্রিয়সুখে লিপ্ততা, না কঠোর দেহদমন; বরং সমন্বিত, সুষম জীবনযাত্রা।

চার আর্যসত্য বিশ্বাস নয়, অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধিনির্ভর দর্শন। মানুষ অনিত্য জগতে স্থায়িত্ব খোঁজে, তাই দুঃখে পড়ে; তৃষ্ণা এই দুঃখের কারণ; তৃষ্ণার ক্ষয়েই মুক্তি; আর সেই মুক্তির পথ নৈতিকতা, ধ্যান ও প্রজ্ঞার সমন্বিত অষ্টাঙ্গিক মার্গ।

সংক্ষেপে, চার আর্যসত্যের ক্রম হলো—দুঃখ: জীবনের অনিত্যতা ও অসম্পূর্ণতা। সমুদয়: দুঃখের কারণ আকাঙ্ক্ষা। নিরোধ: আকাঙ্ক্ষার ক্ষয়ে মুক্তি। মার্গ: সেই মুক্তির পথ অষ্টাঙ্গিক মার্গ।

এই চারটি সত্যই বুদ্ধের ধর্মচক্রের চিরন্তন ঘূর্ণন—দুঃখের উপলব্ধি, তৃষ্ণার পরিত্যাগ, নির্বাণের অভিজ্ঞতা এবং সেই পথে চলার অনুশীলনই বৌদ্ধধর্মের মূলসার।

দ্বিতীয় আর্যসত্য, "দুঃখসমুদয় সত্য", বিশেষভাবে তৃষ্ণা বা আসক্তিকে (taṇhā) সকল দুঃখের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে। এই তৃষ্ণা কেবল শারীরিক আকাঙ্ক্ষা বা ইন্দ্রিয়সুখের প্রতি লালসা নয়, বরং এটি অস্তিত্বের প্রতি প্রবল আসক্তি এবং অহংকারের তৃষ্ণাকেও অন্তর্ভুক্ত করে। বুদ্ধের মতে, মানুষ বার বার জন্ম-মৃত্যুর চক্রে (সংসার) আবদ্ধ থাকে এই তৃষ্ণার কারণেই। যখন মানুষ কোনো কিছুর প্রতি আসক্ত হয়, তখন সেই বস্তুর প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি বা বিনাশের কারণে সে দুঃখ ভোগ করে।

এই তৃষ্ণার সম্পূর্ণ বিনাশই হলো নির্বাণ। নির্বাণকে প্রায়শই ভুলভাবে একটি স্থান বা অবস্থা হিসেবে দেখা হয়, কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মানুসারে, এটি হলো তৃষ্ণার সম্পূর্ণ নিঃশেষ—অর্থাৎ, সমস্ত প্রকার আসক্তি থেকে মুক্ত হওয়ার একটি গভীর মানসিক অবস্থা। এই মুক্তি কেবল বাহ্যিক ত্যাগ নয়, বরং নিজের ভেতরের আকাঙ্ক্ষা, লোভ এবং অহংকারকে সম্পূর্ণরূপে বিলীন করার প্রক্রিয়া।

নির্বাণের পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য বুদ্ধ "অষ্টাঙ্গিক মার্গ" এর উপদেশ দিয়েছেন। এই আটটি পদক্ষেপ মানুষকে তৃষ্ণামুক্ত চেতনার দিকে পরিচালিত করে—

১. সম্যক দর্শন (Right Understanding): চার আর্যসত্যকে সঠিকভাবে বোঝা এবং জীবনের প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করা।

২. সম্যক সংকল্প (Right Thought): অহিংসা, প্রেম এবং ত্যাগের মনোভাব নিয়ে চিন্তা করা, যা সকল আসক্তি থেকে মুক্তির পথ দেখায়।

৩. সম্যক বাক (Right Speech): মিথ্যা, কটু কথা, পরনিন্দা এবং অপ্রয়োজনীয় আলাপ পরিহার করে সত্য, মধুর এবং উপকারী কথা বলা।

৪. সম্যক কর্ম (Right Action): হত্যা, চুরি এবং ব্যভিচার থেকে বিরত থাকা এবং সকল প্রাণীর প্রতি দয়া প্রদর্শন করা।

৫. সম্যক আজীবন (Right Livelihood): এমন পেশা গ্রহণ করা যা অন্যের ক্ষতি করে না এবং নীতিগতভাবে সঠিক।

৬. সম্যক ব্যায়াম (Right Effort): খারাপ চিন্তা থেকে নিজেকে বিরত রাখা এবং ভালো চিন্তা ও গুণাবলি বিকাশের জন্য ক্রমাগত প্রচেষ্টা চালানো।

৭. সম্যক স্মৃতি (Right Mindfulness): নিজের শরীর, অনুভূতি, মন এবং ধর্মীয় সত্য সম্পর্কে সচেতন থাকা, বর্তমান মুহূর্তে পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া।