রামানুজাচার্য সগুণ ব্রহ্মের কথা বলেন—যিনি সৃষ্টির অন্তরে সক্রিয়, জগৎ ও জীবের মধ্যেই প্রকাশমান। তাই কর্মও তাঁর লীলার অংশ, এবং ঈশ্বরকে নিবেদিত কর্মই ভক্তির প্রকাশ। এইভাবে রামানুজাচার্যের দর্শনে নিষ্কাম কর্ম নিছক ত্যাগ নয়, বরং সেবা; নিছক অনাসক্তি নয়, বরং ঈশ্বরের প্রতি প্রেমময় অনুরাগ। কর্ম যদি ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে হয়, তবে তা মোক্ষের পথে স্থায়ী সোপান।
শঙ্কর যেখানে বলেন—“জ্ঞানের জন্য কর্ম ত্যাজ্য,” রামানুজ সেখানে বলেন—“জ্ঞানের সঙ্গে কর্ম মিলিয়ে ঈশ্বরকে সেবাই মুক্তির উপায়।” কর্ম তখন আর জড় নয়, ঈশ্বরের দেহে জীবের ভক্তিপূর্ণ স্পন্দন; আর নিষ্কাম কর্মভোগী ভক্ত হয়ে ওঠেন সেই সর্বব্যাপী সত্তার আনন্দের মাধ্যম।
মোক্ষ-সন্ন্যাস যোগ (Mokṣa-Sannyāsa Yoga) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার অষ্টাদশ ও শেষ অধ্যায়। এই অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ গীতার সমগ্র শিক্ষাকে একত্রিত করে দেখিয়েছেন—কীভাবে মানুষ কর্মের মধ্যেই ত্যাগের চেতনা ধরে রেখে মুক্তি লাভ করতে পারে। এখানে তিনি সন্ন্যাস ও ত্যাগ—এই দুটি পথের মধ্যে প্রকৃত পার্থক্য ব্যাখ্যা করে বলেন যে, মুক্তির উপায় কর্মবর্জন নয়, বরং আসক্তিবর্জন।
সন্ন্যাস মানে কাম্যকর্ম ত্যাগ—যে-কর্ম ফলের আশায় করা হয়, তা সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করা। ত্যাগ মানে ফল-লালসা ও কর্তৃত্ববোধ ত্যাগ—কর্মের ফল এবং “আমি কর্তা” এই অহংকার ত্যাগ করাই প্রকৃত ত্যাগ। কৃষ্ণ বলেন—নিয়ত কর্তব্যকর্ম ত্যাগ করা অযৌক্তিক, কারণ দেহ থাকলে কর্ম অনিবার্য। কিন্তু যদি ফলের আশা ও আসক্তি ত্যাগ করা যায়, তবে সেই কর্মই মুক্তির পথ হয়ে ওঠে।
শ্রীকৃষ্ণ এখানে কর্মের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন—প্রতিটি কর্মের পেছনে পাঁচটি কারণ থাকে: দেহ, কর্তা, ইন্দ্রিয়, প্রচেষ্টা এবং দৈব। এই তত্ত্ব ভগবদ্গীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ে (১৮.১৪) স্পষ্টভাবে বর্ণিত—
অধিষ্ঠানং তথা কর্তা করণং চ পৃথগ্ বিধম্।
বিবিধাশ্চ পৃথক্ চেষ্টা দৈবং চৈবাত্র পঞ্চমম্।।
অর্থাৎ, কোনো কর্ম সংঘটিত হওয়ার জন্য পাঁচটি কারণ থাকে—দেহ, কর্তা, ইন্দ্রিয়, প্রচেষ্টা ও দৈব।
প্রথমত, দেহ (adhiṣṭhāna) হলো কর্মের অবলম্বন বা মঞ্চ। এটি সেই স্থান, যার মাধ্যমে আত্মা কর্ম প্রকাশ করে। দেহ না থাকলে কোনো কর্মই প্রকাশ পায় না।
দ্বিতীয়ত, কর্তা (kartā) হলো জীবাত্মা, যিনি চৈতন্যময় সত্তা। তিনিই কর্মের সূচক, কিন্তু তিনি স্বাধীন কর্তা নন; তিনি ঈশ্বরের অধীন। ঈশ্বর তাঁর অন্তর্নিহিত আত্মা—তাঁর শক্তি ছাড়া জীব কিছুই করতে পারে না।
তৃতীয়ত, ইন্দ্রিয়সমূহ (karaṇa) কর্মের যন্ত্ররূপ। দৃষ্টি, শ্রবণ, স্পর্শ, বাক্, গতি—এই ইন্দ্রিয়গুলির মাধ্যমে দেহ ও মন কার্যকর হয়। কিন্তু ইন্দ্রিয়রাও নিজে নিজে কাজ করতে পারে না; তারা ঈশ্বরের শক্তি দ্বারা চালিত।
চতুর্থত, প্রচেষ্টা (ceṣṭā) হলো মন ও ইচ্ছার প্রেরণা। এটি সেই অন্তর্গত চেতনা, যা দেহ, ইন্দ্রিয় ও জীবকে সংযুক্ত করে কর্মে প্রবৃত্ত করে। প্রচেষ্টা না থাকলে কোনো কর্ম বাস্তবায়িত হয় না।
পঞ্চমত, দৈব (daiva) হলো ঈশ্বরীয় নিয়ন্ত্রণশক্তি—সেই অদৃশ্য শক্তি, যা সময়, স্থান, সুযোগ, ফল ও ফলনির্ণায়ক রূপে সর্বত্র কাজ করে। এটি ঈশ্বরের ইচ্ছা বা বিধান, যা সমস্ত কর্মের পরিণতি নির্ধারণ করে।
এই পাঁচটি কারণ একত্রে বুঝলে স্পষ্ট হয়—ব্যক্তিই একমাত্র কর্তা নয়। দেহ, ইন্দ্রিয় ও মন ঈশ্বরনির্ভর, প্রচেষ্টা ঈশ্বরপ্রদত্ত, ফল নির্ভর করে দৈবের উপর—অতএব, ঈশ্বরই প্রকৃত কর্তা, জীব কেবল যন্ত্র। যেমন দেহ আত্মার নির্দেশে কাজ করে, তেমনি জীব ঈশ্বরের ইচ্ছায় পরিচালিত হয়। কিন্তু অজ্ঞান জীব ভাবে—“আমি কর্তা”, “আমি করছি”—এই অহংকারই বন্ধনের মূল।
যখন এই জ্ঞান উদয় হয় যে, “আমি নই কর্তা, ঈশ্বরই কর্তা”—তখন কর্তা-অহংকার বিলীন হয়, মন শান্ত হয়। সেই শান্ত মনেই জন্ম নেয় সত্য জ্ঞান। তখন কর্ম আর বন্ধন ঘটায় না, বরং যোগে পরিণত হয়—কারণ তখন কর্ম ঈশ্বরস্মৃতিতে সম্পন্ন হয়। এই অবস্থায় ব্যক্তি প্রতিটি কাজ করে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে, ফলের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে, এবং বুঝতে শেখে—সবই ঈশ্বরের দ্বারা, ঈশ্বরের জন্য, ঈশ্বরেই সম্পন্ন।
এই পাঁচ কারণ জানলে বোঝা যায়—কোনো কর্মই একক ব্যক্তির দ্বারা সম্পন্ন হয় না; প্রতিটি কর্মই ঈশ্বরের মহাশক্তির প্রকাশ। এই জ্ঞান অর্জনের ফলে কর্মযোগী অহংকারমুক্ত হয়ে যায়, তার মন স্থিতিশীল হয়, আর সেই শান্ত মনেই জ্ঞানের উন্মেষ ঘটে। এই জ্ঞানই পরিণত হয় মুক্তির পথে, যেখানে কর্ম ঈশ্বরের সেবায় রূপ নেয়, আর কর্তা-ভাব লীন হয়ে যায় ঈশ্বরচেতনায়।
শ্রীকৃষ্ণ গীতার ১৮.২০ শ্লোকে বলেন—
“সর্বভূতেষু যেনৈকং ভাবমব্যয়মীক্ষতে।
অবিভক্তং বিভক্তেষু তজ্ জ্ঞানং বিদ্ধি সাত্ত্বিকম্।।” (ভগবদ্গীতা, ১৮.২০)
অর্থাৎ, “যে-জ্ঞান দ্বারা মানুষ সমস্ত জীবের মধ্যে অবিভক্ত এক চিরন্তন সত্তাকে দেখে, যে-জ্ঞান বিভক্ত দেহগুলির মধ্যেও ঐক্য উপলব্ধি করে—সেই জ্ঞানই সত্ত্বগুণী জ্ঞান।”
এই শ্লোকের মাধ্যমে কৃষ্ণ বোঝাচ্ছেন যে, সত্য-জ্ঞান হলো সেই জ্ঞান, যা বহুত্বের মধ্যে ঐক্য উপলব্ধি করে—যে দেখে, নানা দেহ ও ভেদসীমার আড়ালে একই আত্মা সর্বত্র বর্তমান। দেহ, জাতি, ধর্ম, সমাজ, রূপ বা অবস্থার ভেদ সত্ত্বেও প্রতিটি সত্তায় যে এক চিরন্তন আত্মা বিরাজমান, সেটিই ব্রহ্মস্বরূপ।
যখন মানুষ এই জ্ঞান অর্জন করে, তখন তার মনে “আমি” ও “অন্য”, এই বিভাজন বিলীন হয়। তখন সে কাউকে ঘৃণা করতে পারে না, কাউকে অবজ্ঞা করতে পারে না, কারণ সে জানে—সবাই এক আত্মার বিভিন্ন প্রকাশ। এই দৃষ্টিই সত্ত্বগুণী জ্ঞান—যা মনকে বিশুদ্ধ, শান্ত ও সমানবৃত্ত করে তোলে।
সমত্ব (Sameness) বা সমদর্শন-এর প্রসঙ্গে ‘সমানবৃত্ত’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। ভগবদ্গীতায় স্থিতপ্রজ্ঞ বা জ্ঞানী ব্যক্তির লক্ষণ হিসেবে এই সমত্বকে চরম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সমানবৃত্ত মানে হলো—অন্যান্য জীবের প্রতি সমান আচরণ করা এবং সকলের মধ্যে একই আত্মাকে দর্শন করা (সর্বভূতাত্মভূতাত্মা)। জ্ঞানীর দৃষ্টিতে, কোনো বস্তুই অতিরিক্ত প্রিয় বা অতিরিক্ত অপ্রিয় নয়, ফলে তাঁর আচরণে কোনো পক্ষপাত বা আসক্তিজনিত বৈষম্য থাকে না। সমানবৃত্ত মানে হলো মনের সেই স্থির অবস্থা, যেখানে ব্যক্তি সমস্ত জাগতিক দ্বন্দ্বে সমতা বজায় রাখে এবং সকল জীবের প্রতি সমান ও স্থির দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে।
এই অবস্থায় কর্ম আর বন্ধন ঘটায় না, কারণ সেই কর্মে অহংকার থাকে না। যে ভাবে—“আমি নই কর্তা, ঈশ্বরই সর্বকর্তা, সব প্রাণেই তিনিই আছেন”—তার কর্ম ঈশ্বরার্পিত হয়ে যায়, ফলের আকাঙ্ক্ষা বিলীন হয়। তখন কর্ম যোগে পরিণত হয়, আর যোগ থেকে জন্ম নেয় জ্ঞান।
অতএব, গীতার এই শিক্ষার সার হলো—যখন মানুষ সকল জীবের মধ্যে এক অবিভক্ত আত্মাকে দেখে, তখন সে ভেদবুদ্ধি ও অহংকার থেকে মুক্ত হয়। এই জ্ঞানই মুক্তির প্রত্যক্ষ কারণ, কারণ তখন আর কিছুই “অন্য” থাকে না—সবই হয়ে ওঠে এক, সেই এক ব্রহ্মসত্তা, যিনি সর্বত্র বিরাজমান।
এই অধ্যায়ে কৃষ্ণ জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তি—এই তিন যোগের মিলন ঘটান। জ্ঞান মনকে আত্মাস্মৃতিতে স্থিত করে, কর্ম মনকে শুদ্ধ করে, আর ভক্তি মনকে ঈশ্বরে নিবিষ্ট করে। যখন এই তিনটি একত্রিত হয়, তখন মানুষ ঈশ্বরকে উপলব্ধি করে। তখন কর্ম ঈশ্বরার্পিত হয়ে যায়, ফল ও কর্তৃত্ব বিলীন হয়, আর ভক্তি তার পরিণত রূপ পায় শরণাগতিতে।
এই অধ্যায়ের চূড়ান্ত উপদেশ গীতার সবচেয়ে বিখ্যাত শ্লোকে প্রকাশিত—
সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।
অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।। (ভগবদ্গীতা, ১৮.৬৬)
অর্থাৎ, সমস্ত ধর্ম বা কর্তব্যের ধারণা ত্যাগ করে একমাত্র ঈশ্বরের শরণ নাও; আমি তোমাকে সমস্ত বন্ধন ও পাপ থেকে মুক্ত করব, ভয় কোরো না।
এটি গীতার অষ্টাদশ অধ্যায় (মোক্ষসন্ন্যাস যোগ)-এর সমাপ্তি শ্লোকগুলির মধ্যে অন্যতম এবং একে চরমাশ্লোক (চূড়ান্ত শ্লোক) বলা হয়। এই শ্লোকটি ভক্তিযোগের চরম নীতি এবং মোক্ষ লাভের শেষ উপায় ঘোষণা করে।
সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য (Sannyāsa of All Duties): এখানে 'ধর্ম' বলতে কেবল আচার-অনুষ্ঠান নয়, বরং জীবনের সমস্ত কর্তব্য বা ধর্মীয় কর্মকে বোঝানো হয়েছে, যা ফলের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে করা হয়। শ্রীকৃষ্ণ নির্দেশ দিচ্ছেন, সমস্ত ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা, কর্তৃত্বের অহংকার এবং কর্মফলের ভাবনা ত্যাগ করতে হবে।
মাম্ একং শরণং ব্রজ (Ultimate Surrender): সমস্ত কিছু ত্যাগ করে একমাত্র তাঁরই শরণাগত হতে হবে। এটি হলো একান্ত ভক্তি এবং সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ (প্রপত্তি)। এই শরণাগতির মাধ্যমে ভক্ত নিজেকে সম্পূর্ণভাবে ঈশ্বরের কৃপা বা অনুগ্রহের (Grace) ওপর সমর্পণ করেন।
অহং ত্বা সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি (The Divine Assurance): ঈশ্বর স্বয়ং প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে, এই শরণাগতির ফলে তিনি ভক্তকে সমস্ত পাপ (বন্ধন সৃষ্টিকারী কর্মফল) থেকে মুক্ত করবেন (মোক্ষয়িষ্যামি)।
মা শুচঃ (Do Not Grieve): চূড়ান্ত আশ্বাস হিসেবে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে শোক বা উদ্বেগ ত্যাগ করতে বলছেন, কারণ মুক্তির দায়িত্ব স্বয়ং ঈশ্বর গ্রহণ করেছেন।
এই শ্লোকটি মোক্ষ লাভের জন্য নিষ্কাম কর্ম, জ্ঞান এবং ভক্তি—এই তিন যোগের চূড়ান্ত সংযোগ ঘটিয়ে ঈশ্বরের প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণকে শ্রেষ্ঠ এবং নিশ্চিত উপায় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। এখানে মোক্ষ মানে ঈশ্বরে লয় নয়, বরং ঈশ্বরসঙ্গ—চিরসেবা ও অনন্ত শান্তি।
মোক্ষ-সন্ন্যাস যোগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো—কর্ম ত্যাগ নয়, আসক্তি ত্যাগই মুক্তির উপায়। কর্ম ঈশ্বরের ইচ্ছা হিসেবে করতে হবে; ফল, অহংকার ও কর্তৃত্ববোধ ত্যাগ করতে হবে; এবং সমস্ত চেতনা ঈশ্বরে নিবিষ্ট রাখতে হবে। এই অবস্থাতেই কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগ একীভূত হয়ে যায়। মুক্তি তখন দেহে থেকেও চেতনার এক অবস্থা—যেখানে মানুষ উপলব্ধি করে, “আমি নই কর্তা, ঈশ্বরই কর্তা; আমি তাঁরই অংশ, তাঁরই সেবা।”
মোক্ষ-সন্ন্যাস যোগ গীতার সেই পরিসমাপ্তি যেখানে ত্যাগ ও ভোগ, জ্ঞান ও কর্ম, ব্যক্তি ও ঈশ্বর—সব একীভূত হয়ে যায় ব্রহ্মস্মৃতিতে। কর্ম তখন যোগ, যোগ তখন ভক্তি, আর ভক্তি তখন চিরমুক্তির দ্বার।
রামানুজাচার্যের বিশিষ্টাদ্বৈত দর্শনে নিষ্কাম কর্ম কেবল নৈতিক আদর্শ নয়, এটি এক গভীর দার্শনিক প্রক্রিয়া—যার মাধ্যমে মানুষ আত্মাকে ঈশ্বরের ইচ্ছার সঙ্গে একীভূত করে। তাঁর মতে, জগৎ ও জীব উভয়ই ঈশ্বরের বাস্তব রূপে বিদ্যমান; সুতরাং জগতকে প্রত্যাখ্যান করা নয়, বরং ঈশ্বররূপে গ্রহণ করাই প্রকৃত ত্যাগ।
জগৎ ও জীবের ঈশ্বরসম্পর্ক: রামানুজ বলেন—ঈশ্বর, জীব ও জগৎ—এই তিনটি পরস্পর সম্পর্কিত, যেমন আত্মা ও দেহের সম্পর্ক। ঈশ্বর হলেন আশ্রয় (śarīrī), আর জীব ও জগৎ হল তাঁর আশ্রিত শরীর (śarīra)। এই কারণে কর্ম, যা জগতে সংঘটিত হয়, সেটি ঈশ্বরের শক্তিরই প্রকাশ। তাই নিষ্কাম কর্ম মানে জগৎকে ত্যাগ করা নয়, বরং কর্মকে ঈশ্বরার্পিত করা—এই বোধে প্রতিষ্ঠিত হওয়া।
নিষ্কাম কর্ম ভক্তির অবিচ্ছেদ্য অংশ: রামানুজের ভক্তিতত্ত্বে নিষ্কাম কর্ম হলো “ভগবদ্-আরাধনার্থ কর্ম”, অর্থাৎ, "ভগবানকে আরাধনা করার উদ্দেশ্যে কৃত কর্ম", তথা ঈশ্বরসেবার জন্য কর্ম। এটি নিষ্কাম কর্মযোগ এবং ভক্তিযোগের একটি প্রধান নীতি। বাক্যটি কর্মযোগের সেই উচ্চতর স্তরকে বোঝায়, যেখানে কর্মের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তিগত লাভ বা জাগতিক ফল থেকে সরিয়ে ঈশ্বরের সন্তুষ্টির দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। এটি তিনটি প্রধান ধারণার সমন্বয়—
কর্মের প্রকৃতি: এখানে 'কর্ম' বলতে সাধারণ কাজ বা কর্তব্যকর্মকে বোঝানো হয়।
আরাধনা (Ārādhanā): এর অর্থ হলো উপাসনা বা পূজা করা। অর্থাৎ, কাজটিকে শুধুমাত্র একটি জাগতিক কর্তব্য হিসেবে না দেখে, তাকে প্রার্থনা বা পূজার মানসিকতা নিয়ে সম্পাদন করা।
ঈশ্বরের উদ্দেশ্য (Bhagavad-artham): কর্মের ফল বা কর্তৃত্ব নিজের জন্য না রেখে, তা সম্পূর্ণরূপে ভগবানের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা।