নিত্য সেবাসঙ্গ ও ভগবৎ-সাক্ষাৎকার—এই দুইটি শব্দ একত্রে বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্তে মুক্ত আত্মার পরম অভিজ্ঞতা ও ঈশ্বর-সান্নিধ্যের অবস্থা নির্দেশ করে। রামানুজাচার্যের মতে, মুক্তি মানে ঈশ্বরের সঙ্গে একীভূত হয়ে চেতনালয় বা বিলয় নয়; বরং তাঁর চিরসান্নিধ্যে থেকে নিত্যসেবা করা, এবং তাঁকে সাক্ষাৎ উপলব্ধি করা (Bhagavad-sākṣātkāra)—এই দুই অভিজ্ঞতা একত্রে মুক্ত আত্মার চির আনন্দময় জীবন।
ভগবৎ-সাক্ষাৎকার হচ্ছে ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি। রামানুজের মতে, মুক্ত জীব ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করে—এই উপলব্ধিই হলো ভগবৎ-সাক্ষাৎকার। বদ্ধ জীব ঈশ্বরকে কেবল শ্রুতি, চিন্তা বা বিশ্বাসের মাধ্যমে জানে, কিন্তু মুক্ত জীব তাঁকে প্রত্যক্ষ দর্শন করে।
এই দর্শন ইন্দ্রিয়সৃষ্ট নয়; এটি চৈতন্যের অন্তর্দৃষ্টি, যেখানে আত্মা ঈশ্বরের অসীম সৌন্দর্য, করুণা, ঐশ্বর্য ও আনন্দকে স্বয়ং অনুভব করে।
রামানুজ বলেন—ঈশ্বরের এই সাক্ষাৎদর্শন অনুভূতিগত ঐক্য সৃষ্টি করে, কিন্তু স্বরূপগত অভেদ নয়। জীব ও ঈশ্বর পরস্পর সংযুক্ত থাকে যেমন দেহ ও আত্মা; ঈশ্বর অন্তর্নিহিত আত্মা, জীব তাঁর দেহরূপে বিদ্যমান। সেই সম্পর্কের পূর্ণ উপলব্ধিই হলো ঈশ্বরের সাক্ষাৎ—Bhagavad-sākṣātkāra।
এই অভিজ্ঞতা কোনো ক্ষণিক দর্শন নয়, বরং নিত্য-অনুভব—যেখানে আত্মা চিরকাল ঈশ্বরের উপস্থিতি, প্রেম ও ঐশ্বর্যের মাঝে অবস্থান করে। গীতায় এই অবস্থাকে বলা হয়েছে—
মাম্ উপেত্য পুনর্জন্ম দুষ্খালয়ম্ অশাশ্বতম্।
নাপ্নুবন্তি মহাত্মানঃ সংসিদ্ধিং পরমাং গতাঃ।। (ভগবদ্গীতা, ৮.১৫)
“মাম্ উপেত্য পুনর্জন্ম দুষ্খালয়ম্ অশাশ্বতম্”-এর অর্থ—আমাকে প্রাপ্ত হলে (মাম্ উপেত্য), আর দুঃখের আলয় (দুষ্খালয়ম্), অনিত্য (অশাশ্বতম্) পুনর্জন্ম (অর্থাৎ এই সংসারে ফেরা) হয় না।
“নাপ্নুবন্তি মহাত্মানঃ সংসিদ্ধিং পরমাং গতাঃ”-এর অর্থ—যিনি পরম সিদ্ধি (সংসিদ্ধিং পরমাং) লাভ করেছেন, সেই মহাত্মারা আর পুনর্জন্ম-প্রাপ্ত হন না (নাপ্নুবন্তি)।
এই শ্লোকটি মোক্ষের স্বরূপ এবং ভক্তের শ্রেষ্ঠত্বকে তুলে ধরে। শ্রীকৃষ্ণ এই জগৎসংসারকে দুঃখের আলয় (ঘর) এবং অনিত্য (অশাশ্বতম্) বলে চিহ্নিত করেছেন। এটি বেদান্তের জগৎ মিথ্যা—এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। মোক্ষ হলো সেই অবস্থা, যেখানে আত্মা ভগবানকে বা পরমাত্মাকে প্রাপ্ত হন। এই প্রাপ্তি জন্ম-মৃত্যুর চক্রের স্থায়ী সমাপ্তি ঘটায়। যাঁরা পরম সিদ্ধি লাভ করেছেন, সেই মহাত্মারা (জ্ঞানী বা শ্রেষ্ঠ ভক্তরা) আর অনিত্য ও দুঃখময় জগতে ফিরে আসেন না। তাঁরা অক্ষয় ও শাশ্বত ধামে অবস্থান করেন। অর্থাৎ, ঈশ্বরকে প্রাপ্ত মুক্ত আত্মারা আর কখনও দুঃখময় জগতে ফিরে আসেন না, তাঁরা ঈশ্বরের সান্নিধ্যে চিরকাল স্থিত থাকে।
এই ঈশ্বরদর্শনের সঙ্গে যুক্ত হয় নিত্য সেবা—যা মুক্ত আত্মার প্রকৃত ধর্ম ও আনন্দ। মুক্ত আত্মা বুঝে যায়—“আমি ঈশ্বরের শরীর, তিনি আমার শরীরী; আমার অস্তিত্ব তাঁর সেবার জন্য।” তখন তার আনন্দ ঈশ্বরসেবাতেই সীমাবদ্ধ থাকে; সে আর নিজের জন্য কিছু চায় না।
রামানুজ এই চিরসেবাকে বলেন পরকৈঙ্কর্য (para-kaiṅkarya)—যেখানে আত্মা ঈশ্বরের সান্নিধ্যে থেকে চিরসেবা করে। এই সেবা কোনো বাহ্য-কর্তব্য নয়; এটি প্রেমের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। আত্মা তখন ঈশ্বরের ইচ্ছারই সম্প্রসারণ হয়ে যায়। যেমন দেহ আত্মার ইচ্ছায় নিঃশর্তভাবে কাজ করে, তেমনি মুক্ত আত্মা ঈশ্বরের ইচ্ছায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেবা করে। এই চিরসেবা বা nitya-sevā ঈশ্বরের প্রতি অবিরাম প্রেম, ঈশ্বরস্মৃতি ও ঈশ্বর-আনন্দের ধারাবাহিক প্রকাশ।
ভগবৎ-সাক্ষাৎকার ও নিত্য-সেবাসঙ্গ-এর ঐক্য: ভগবৎ-সাক্ষাৎকার (Bhagavad-sākṣātkāra) এবং নিত্য-সেবাসঙ্গ (Nitya-sevāsaṅga) হলো বৈষ্ণব দর্শনের, বিশেষত বিশিষ্টাদ্বৈত এবং দ্বৈত বেদান্তের, মোক্ষ বা মুক্তির চূড়ান্ত দুটি অবস্থা।
ভগবৎ-সাক্ষাৎকার (ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি): এটি হলো পরমাত্মা বা ঈশ্বরের (ভগবানের) সরাসরি উপলব্ধি বা সাক্ষাৎ দর্শন। এই উপলব্ধির মাধ্যমে ভক্তের সমস্ত অজ্ঞান ও বন্ধন দূর হয়ে যায়। এটি মোক্ষ লাভের প্রথম পদক্ষেপ বা প্রাথমিক ফল। এই উপলব্ধির পরেই ভক্ত জাগতিক দুঃখ ও অনিত্যতা থেকে মুক্ত হন।
নিত্য-সেবাসঙ্গ (শাশ্বত সেবার সম্পর্ক): এটি হলো মুক্তির স্বরূপ। এই অবস্থায় মুক্ত জীবাত্মা চিরকালের জন্য ঈশ্বরের সেবা (কৈঙ্কর্য) এবং সান্নিধ্য (সঙ্গ) লাভ করে। বৈষ্ণব-মতে, মুক্তি হলো সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যাওয়া নয়, বরং ঈশ্বরের সঙ্গে একটি প্রেমময়, চিরন্তন সম্পর্ক স্থাপন করা এবং তাঁর সেবা করা। এটিই মুক্ত জীবনের সক্রিয় ও আনন্দময় প্রকৃতি।
এদের ঐক্য: এই দুটি ধারণা কারণ ও ফল (Cause and Effect)-এর সম্পর্ক দ্বারা একে অপরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। সাক্ষাৎকার হলো কারণ—ভগবৎ-সাক্ষাৎকার হলো সেই জ্ঞান বা উপলব্ধি, যা জীবাত্মার ভেদাভেদ ও অজ্ঞান দূর করে। এই জ্ঞানই মোক্ষের দ্বার উন্মোচন করে। সেবাসঙ্গ হলো ফল—এই সাক্ষাৎকারের চূড়ান্ত এবং স্থায়ী ফল হলো নিত্য-সেবাসঙ্গ। একবার ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করলেই ভক্ত আর নিষ্ক্রিয় হন না; বরং সেই প্রত্যক্ষ উপলব্ধির আনন্দ থেকেই তাঁর মধ্যে ঈশ্বরের শাশ্বত সেবা করার আকাঙ্ক্ষা (কৈঙ্কর্য-প্রবৃত্তি) জন্ম নেয়।
ভাগবৎ-সাক্ষাৎকার হলো জানার (Knowing) চূড়ান্ত পর্যায়, আর নিত্য-সেবাসঙ্গ হলো সেই জ্ঞানের আলোকে থাকার (Being) এবং কাজ করার (Serving) চূড়ান্ত অবস্থা। একটি ছাড়া অন্যটি অর্থহীন—জ্ঞান বা উপলব্ধির চরম পরিণতিই হলো ঈশ্বরের সঙ্গে চিরন্তন প্রেমের সেবায় যুক্ত হওয়া।
রামানুজের মুক্তিতত্ত্বে এই দুইটি পরস্পর-অবিচ্ছেদ্য। ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ উপলব্ধি (sākṣātkāra) ছাড়া চিরসেবা সম্ভব নয়, আর সেবা ছাড়া সেই দর্শনের আনন্দ সম্পূর্ণ হয় না। মুক্ত আত্মা একদিকে ঈশ্বরের সৌন্দর্য ও মহিমা প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করে, অন্যদিকে সেই উপলব্ধির আনন্দে নিরন্তর সেবা করে। অতএব, ভাগবৎ-সাক্ষাৎকার হলো মুক্ত আত্মার জ্ঞানময় উপলব্ধি, আর নিত্য-সেবাসঙ্গ হলো সেই উপলব্ধির প্রেমময় কর্মরূপ প্রকাশ। দুই মিলেই মুক্ত জীব ঈশ্বরের সঙ্গে এক অবিচ্ছেদ্য, প্রেমপূর্ণ, আনন্দময় ঐক্যে প্রতিষ্ঠিত হয়।
রামানুজের মুক্তির ধারণা হলো—“ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ দর্শন (Bhagavad-sākṣātkāra) ও চিরসেবা (Nitya-sevāsaṅga)”—এই দুইয়ের মিলন। এটি এমন এক অবস্থান, যেখানে জীব ঈশ্বরের করুণায় মুক্ত হয়ে তাঁর সান্নিধ্যে চিরকাল অবস্থান করে, তাঁর আনন্দে অংশগ্রহণ করে, এবং নিরন্তর সেবায় নিযুক্ত থাকে। এই ঐক্যই বিশিষ্টাদ্বৈতের মুক্তির সারার্থ—প্রেম, সেবা ও ঈশ্বরসঙ্গের অবিচ্ছেদ্য অভিজ্ঞতা।
কাইনকর্মযোগ হলো নিষ্কাম কর্ম, ঈশ্বরভক্তি ও আত্মসমর্পণের একত্র সংহতি। কর্ম এখানে দেহ বা জড়ের কাজ নয়, আত্মার প্রেমময় সাড়া; জগৎ এখানে ত্যাগের বস্তু নয়, বরং সেবার ক্ষেত্র। কর্মের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরকে অনুভব করাই এর উদ্দেশ্য। তাই রামানুজ বলেন—জীবের জীবনের প্রকৃত অর্থ এই এক বাক্যে ধরা যায়—“সেবা এভ মম ধর্মঃ”—সেবাই আমার ধর্ম। এই চেতনায় করা নিষ্কাম কর্মই কাইনকর্মযোগ, আর এই যোগের চূড়ান্ত ফল ঈশ্বরের চিরসঙ্গ ও পরম শান্তি।
“সেবা এভ মম ধর্মঃ” উক্তিটি মূলত ভক্তিযোগ এবং নিষ্কাম কর্মযোগের সমন্বিত ভাবকে প্রকাশ করে। বৈষ্ণব দর্শনে, বিশেষত রামানুজ এবং চৈতন্য মহাপ্রভুর দর্শনে, জীবাত্মাকে চিরকাল ঈশ্বরের দাস বা অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়। জীবের স্বাভাবিক ধর্ম বা কর্তব্য (ধর্মঃ) হলো তার প্রভুর সেবা করা। সেবাই তাই চরম লক্ষ্য। মোক্ষ বা মুক্তি হলো কেবল ঈশ্বরের সঙ্গে শাশ্বত সেবার সম্পর্ক (নিত্য-সেবাসঙ্গ) লাভ করা। এই সেবাই হলো নিষ্কাম কর্মের চূড়ান্ত রূপ।
যখন সমস্ত কর্মকে ফলের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে ঈশ্বরের সেবায় (বা ঈশ্বরজ্ঞানে মানুষের সেবায়) নিবেদন করা হয়, তখন সেই কর্ম আর বন্ধন সৃষ্টি করে না। এটি ঈশ্বরকে ভালোবাসার এবং জগতের প্রতি দায়িত্ব পালনের চূড়ান্ত অঙ্গীকার, যা ভক্তিযোগের সারমর্ম।
রামানুজের মতে, নিষ্কাম কর্ম ও জ্ঞানযোগ উভয়ই আত্মাকে প্রস্তুত করে, কিন্তু মুক্তি দেয় না; মুক্তি দেয় কেবল ভক্তি—যা ঈশ্বরের প্রতি প্রেম ও সম্পূর্ণ সমর্পণ। তবে সেই ভক্তি তখনই পরিণত হয়, যখন মন নিষ্কাম কর্মের দ্বারা শুদ্ধ হয়েছে। তাই নিষ্কাম কর্ম ভক্তির “প্রাক্অবস্থা” বা “সাহায্যকারক কারণ”—এটি ভক্তির পথে অপরিহার্য ধাপ।
গীতার দৃষ্টিতেও এই ধারণা সমর্থিত—“ময়ি সর্বাণি কর্মাণি সন্ন্যাস্য অধ্যাত্মচেতসা” (৩.৩০); “চেতসা সর্বকর্মাণি ময়ি সন্ন্যাস্য মৎপরঃ” (১৮.৫৭)
অর্থাৎ, (৩.৩০) "আমার (ঈশ্বরের) মধ্যে সমস্ত কর্মফল সমর্পণ করে, অধ্যাত্ম জ্ঞানে স্থিত মন দ্বারা"; যা নির্দেশ করে যে, কর্ম করার সময় ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করাই যথেষ্ট নয়। সেই ত্যাগের প্রক্রিয়াটি হতে হবে সচেতন মন (অধ্যাত্মচেতসা) দ্বারা, এই জ্ঞানে স্থিত হয়ে যে, আমি কর্তা নই এবং সমস্ত কর্ম ঈশ্বরের প্রতি নিবেদিত। এটি কর্তৃত্বের অহংকার ত্যাগের পদ্ধতি।
(১৮.৫৭) “মন দ্বারা সমস্ত কর্ম আমাতে (ঈশ্বরে) সমর্পণ করে, আমাকেই পরম আশ্রয়রূপে গ্রহণ করো।"; যা মোক্ষ-সন্ন্যাস যোগের একটি চূড়ান্ত নির্দেশ। এখানে পূর্বের ভাবটিকেই পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে, তবে ‘মৎপরঃ’ (আমিই পরম আশ্রয়) শব্দটি যোগ করে ভক্তিযোগের দিকটি জোরদার করা হয়েছে। অর্থাৎ, মন (চেতসা) দ্বারা সমস্ত কর্মফল ঈশ্বরে সমর্পণ করার পাশাপাশি, ঈশ্বরকেই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ও গতি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
উভয় উক্তিই নিশ্চিত করে যে, বন্ধনমুক্ত হওয়ার জন্য প্রয়োজন হলো—জ্ঞান (অধ্যাত্মচেতসা) ও ভক্তি (মৎপরঃ), এই দুই পরস্পর যুক্ত হয়ে কর্তৃত্বের অহংকার (আমি কর্তা) এবং ফলের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে সমস্ত কর্মফল ঈশ্বরে সমর্পণ করা।
এই শ্লোকগুলিকে রামানুজাচার্য ব্যাখ্যা করেন “ঈশ্বরার্পিত কর্ম” হিসেবে—যেখানে কর্মের উদ্দেশ্য ফল নয়, ঈশ্বরের সন্তুষ্টি। ভক্তের প্রতিটি ক্রিয়া তাঁর প্রতি সেবার রূপ নেয়। তাই নিষ্কাম কর্ম, যা শঙ্করের মতে আত্মজ্ঞানলাভের সহায়, রামানুজের মতে ভক্তিলাভের অভ্যন্তরীণ সোপান।
শঙ্করাচার্য ও রামানুজাচার্যের মতের মধ্যে পার্থক্য নিহিত তাঁদের ব্রহ্মদর্শনের ভিতেই। শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্তে ব্রহ্ম নির্গুণ ও মায়াতীত—এই জগৎ মায়িক, কর্মও মায়ার অংশ। তাই নিষ্কাম কর্ম তাঁর মতে আত্মজ্ঞানলাভের সহায়, কারণ মন কলুষিত থাকলে জ্ঞান উদিত হয় না। কর্মের ফল-লালসা ও অহংকার ত্যাগ করে মানুষ যখন চিত্তকে শুদ্ধ করে, তখনই সে ব্রহ্মজ্ঞান লাভে সক্ষম হয়। সেই জ্ঞান জন্মালে কর্মের প্রয়োজন ফুরোয়, কারণ জ্ঞানী জানে—“আমি ব্রহ্ম, আমি অকার্তা।” মুক্তি তখন জ্ঞানলাভের ফল, যেখানে কর্ম বিলীন হয়ে যায়।
অন্যদিকে রামানুজাচার্যের বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্তে ঈশ্বর সগুণ, সর্বব্যাপী ও সর্বশক্তিমান; জগৎ ও জীব উভয়ই তাঁর দেহ, আর তিনি অন্তঃস্থিত আত্মা। তাই জগৎ ও কর্ম উভয়ই বাস্তব, ঈশ্বরের শক্তির প্রকাশ। কর্ম এখানে মায়িক নয়, বরং ঈশ্বরসেবা। নিষ্কাম কর্ম মানে ঈশ্বরচিন্তায় স্থিত থেকে, ফল ও অহংকার ত্যাগ করে কর্ম করা। এভাবেই কর্ম হয়ে ওঠে ভক্তির এক অঙ্গ—ভক্তির ভিত। কর্মচর্চা মনকে শুদ্ধ করে, আর শুদ্ধ মনেই জাগে ঈশ্বরপ্রেম।
শঙ্করের কাছে নিষ্কাম কর্ম জ্ঞানের প্রস্তুতি—জ্ঞানলাভের পর তা লয়প্রাপ্ত। রামানুজের কাছে নিষ্কাম কর্ম ভক্তির অন্তর্গত ধাপ—এটি কখনও লয় পায় না, কারণ ঈশ্বরসেবা মুক্তিতেও অব্যাহত থাকে।
শঙ্করের মতে কর্ম অনিত্য, জ্ঞান নিত্য; রামানুজের মতে কর্ম—সেবার মাধ্যমে নিত্য ও ঈশ্বরসম্বন্ধিত। শঙ্করের মুক্তি আত্মার ব্রহ্মে লয়, রামানুজের মুক্তি আত্মার ঈশ্বরসঙ্গ ও অনন্ত সেবা। একজন বলেন, নিষ্কাম কর্ম শেষ হয় জ্ঞানপ্রাপ্তিতে; অন্যজন বলেন, তা পরিণত হয় প্রেমে।
এই পার্থক্যই দুই দর্শনের প্রাণ—অদ্বৈতে আত্মজ্ঞানে কর্ম বিলীন, বিশিষ্টাদ্বৈতে কর্মই ভক্তির রূপে শাশ্বত। আসলে এই দুটি দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য ব্রহ্মতত্ত্বের প্রকৃতি নিয়ে। শঙ্করাচার্য নির্গুণ ব্রহ্মের কথা বলেন—যিনি কর্মের ঊর্ধ্বে; তাই কর্ম এখানে কেবল অজ্ঞান মোচনের প্রাথমিক উপায়। মুক্তি মানে কর্মের লয়।