অবিদ্যা-বিদ্যা: ৬৬



অদ্বৈত বেদান্তে যেখানে মুক্তি মানে স্বরূপগত অভেদ—জীব ব্রহ্ম হয়ে যায়, সেখানে বিশিষ্টাদ্বৈতে মুক্তি মানে ঈশ্বরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক স্থাপন—জীব ঈশ্বরের সত্তায় নিমগ্ন থাকে, কিন্তু আলাদা সত্তা হিসেবেই তাঁকে সেবা করে।

তাই, প্রপত্তি-ভিত্তিক ঐক্য এমন এক চেতনা, যেখানে জীব নিজের সমস্ত অহং, কর্ম ও জ্ঞান পরিত্যাগ করে ঈশ্বরের করুণায় আশ্রয় নেয়, তাঁর ইচ্ছায় নিজের অস্তিত্ব বিলিয়ে দেয়, এবং তাঁর সেবায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। এটি কোনো দার্শনিক মিলন নয়, বরং এক অন্তরঙ্গ, প্রেমপূর্ণ ও সেবামূলক ঐক্য, যেখানে আত্মসমর্পণই মোক্ষ, আর ঈশ্বরের সেবা-ই পরম আনন্দ।

শরীর-শরীরী-ভাব (śarīra-śarīrī-bhāva) হলো ঈশ্বর ও সৃষ্টির মধ্যে এমন এক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক যেখানে—জীব ও জড়বিশ্ব ঈশ্বরের শরীর, ঈশ্বর তাঁদের অন্তর্নিহিত আত্মা ও নিয়ন্তা, এবং এই সম্পর্কের মধ্য দিয়েই ঈশ্বরের সর্বব্যাপিতা, সর্বশক্তি ও করুণাস্বরূপ প্রকাশিত হয়। এভাবেই বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্ত ঈশ্বর ও জগতের একাত্ম, অথচ নির্ভরশীল ঐক্যের মহাসূত্র স্থাপন করেছে।

এই প্রেক্ষিতে, নিষ্কাম কর্ম রামানুজাচার্যের মতে কোনো নিঃসঙ্গ জ্ঞানসাধনা নয়, বরং ভক্তিরই একটি অঙ্গ। তিনি বলেন—যখন মানুষ তার সমস্ত কর্ম ঈশ্বরকে উৎসর্গ করে, তখন সেই কর্ম হয়ে ওঠে “কাইনকর্মযোগ”—অর্থাৎ, সেবা-রূপে উপাসনা। কর্ম তখন ঈশ্বরের ইচ্ছার প্রকাশমাত্র, আর কর্তা কেবল যন্ত্র। এই অবস্থায় কর্মফল-চিন্তা ও অহংকার ত্যাগই প্রকৃত ত্যাগ, যা ভক্তিকে বিশুদ্ধ করে।

কাইনকর্মযোগ (Kainkarya-karma-yoga) শব্দটি এসেছে “কাইনকার্য” (Kainkarya) থেকে, যার অর্থ সেবা বা ঈশ্বরের সন্তুষ্টির জন্য নিঃস্বার্থ কার্য। রামানুজাচার্যের বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্তে এটি নিষ্কাম কর্মযোগের এক বিশেষ রূপ—যেখানে কর্মকে আত্মার স্বাভাবিক ধর্ম, অর্থাৎ ঈশ্বরসেবার মাধ্যম হিসেবে দেখা হয়। জীবাত্মা ঈশ্বরের অংশ, ঈশ্বর তার আশ্রয়; তাই জীবের প্রকৃত কর্তব্য ঈশ্বরকে সেবা করা। সেই সেবাই কাইনকর্ম, আর সেই সেবাকে ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে ও অহংকারবর্জিতভাবে সম্পাদন করাই কাইনকর্মযোগ।

রামানুজাচার্যের মতে, জগৎ ও জীব উভয়ই ঈশ্বরের শরীরস্বরূপ, আর ঈশ্বর তাঁদের অন্তঃস্থিত আত্মা—এটি শরীর-শরীরী-ভাব। তাই জগৎকে মিথ্যা বা অবাস্তব বলা যায় না; এটি ঈশ্বরের সত্য শক্তির প্রকাশ। সেইজন্য জগতের কর্মও ত্যাজ্য নয়; কর্মই ঈশ্বরের ইচ্ছার এক প্রকাশমাত্র। নিষ্কাম কর্ম এই চেতনায় করলে তা আর সংসারবন্ধনের কারণ হয় না, বরং ভক্তিরই রূপ ধারণ করে।

এই কাইনকর্মযোগে কর্মের উদ্দেশ্য ব্যক্তিগত লাভ নয়, ঈশ্বরসেবা। গীতার শ্লোকে—“ময়ি সর্বাণি কর্মাণি সন্ন্যাস্য অধ্যাত্মচেতসা” (ভগবদ্গীতা, ৩.৩০)—কৃষ্ণ যা বলেছেন, রামানুজ তার ব্যাখ্যা দেন এভাবে: জীব যদি বুঝতে পারে যে, সে ঈশ্বরের অংশ, তবে তার প্রতিটি কর্ম ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে সম্পন্ন হবে। কর্তা সে নয়, কর্তা ঈশ্বর; জীব কেবল তাঁর সেবক। এই অবস্থায় কর্মের ফল ঈশ্বরের কাছে নিবেদন হয় এবং সেই কর্ম ভক্তির প্রকাশ হয়ে ওঠে।

রামানুজের মতে, নিষ্কাম কর্ম ও জ্ঞানযোগ উভয়ই আত্মাকে প্রস্তুত করে, কিন্তু মুক্তি দেয় না; মুক্তি দেয় কেবল ভক্তি—যা ঈশ্বরের প্রতি প্রেম ও সমর্পণ। নিষ্কাম কর্ম এই ভক্তির প্রস্তুতি; কর্ম চিত্তকে শুদ্ধ করে, মনকে ঈশ্বরচেতনায় স্থির করে এবং অহংকারকে বিলীন করে। তাই তিনি বলেন, “কাইনকার্যই ভক্তির পূর্বশর্ত।”

কর্মযোগ ভক্তির ভিত, আর ভক্তি মুক্তির দ্বার—এই বাক্যটি বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের সাধনামূলক ক্রমকে নিখুঁতভাবে প্রকাশ করে। রামানুজ ঈশ্বরপ্রাপ্তির পথকে ধাপে ধাপে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন—মানবজীবনের সাধনা কর্ম থেকে ভক্তিতে, আর ভক্তি থেকে প্রপত্তি ও মুক্তিতে পরিণত হয়।

প্রথমে আসে কর্মযোগ। কর্মযোগ মানে এমন কর্ম, যা ফললাভের বাসনা ছেড়ে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে সম্পন্ন হয়—অর্থাৎ নিষ্কাম কর্ম। এই কর্মের মাধ্যমে মন ও অন্তঃকরণ পরিশুদ্ধ হয়। কর্মযোগে ব্যক্তি নিজের কর্তৃত্ববোধ ও স্বার্থচিন্তা ত্যাগ করে প্রত্যেক কর্মকে ঈশ্বরার্পণ করে। যেমন—পূজা, যজ্ঞ, দান, সেবা, ন্যায়ভিত্তিক সামাজিক কর্তব্য ইত্যাদি। রামানুজ বলেন, এই নিষ্কাম কর্মই ভক্তির প্রস্তুতি, কারণ এটি মনকে ঈশ্বরচিন্তায় স্থির করে ও অহং দূর করে। তাই কর্মযোগ হলো ভক্তির ভিত—যে-ভূমিতে ঈশ্বরপ্রেমের অঙ্কুর জন্ম নেয়।

যখন মন ও চিত্ত কর্মের মাধ্যমে পরিশুদ্ধ হয়, তখন জীবের অন্তরে ঈশ্বরের প্রতি প্রেম ও নিবেদন জাগে—এটাই ভক্তিযোগ। ভক্তি এখানে কেবল আবেগ নয়; এটি ঈশ্বরের মহিমা উপলব্ধি করে তাঁর প্রতি অগাধ প্রেম ও নিরন্তর স্মরণের অবস্থান। রামানুজ বলেন, ভক্তি হলো সেই জ্ঞান, যা প্রেমে পরিণত হয়েছে—“ভক্তিঃ প্রীতি-বিশেষ-জ্ঞানম্”, যার অর্থ: "ভক্তি হলো বিশেষ ধরনের প্রীতি বা প্রেমজ্ঞান।"

এই বাক্যটি একটি বিখ্যাত দার্শনিক সূত্র বা সংজ্ঞা, যা বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের দর্শনে, বিশেষতরূপ রূপ গোস্বামী কর্তৃক রচিত গ্রন্থাদিতে, এবং রামানুজের ভক্তি তত্ত্বে ব্যবহৃত হয়। এটি ভক্তির স্বরূপকে সংজ্ঞায়িত করে, যেখানে ভক্তিকে কেবল আবেগ বা আচার হিসেবে নয়, বরং জ্ঞানমিশ্রিত এক বিশেষ প্রেম হিসেবে দেখা হয়। এই সংজ্ঞাটি প্রায়শই বৈষ্ণব আচার্যদের রচনায় পাওয়া যায়, যেখানে ভক্তিকে সাধারণ জাগতিক প্রেম থেকে আলাদা করা হয়।

এই সূত্রটি ভক্তি (Bhakti) এবং জ্ঞান (Jñānam)-এর মধ্যেকার সংযোগ স্থাপন করে।

প্রীতি-বিশেষ (Prīti-Viśeṣa): প্রীতি মানে সাধারণ প্রেম বা স্নেহ। বিশেষ মানে হলো এটি সাধারণ প্রেম নয়, বরং এক অনন্য বা উৎকৃষ্ট ধরনের প্রেম। এই প্রেম কেবল ঈশ্বরকেই উদ্দেশ্য করে, অন্য কোনো জাগতিক বস্তু বা ফলের আকাঙ্ক্ষা দ্বারা প্রভাবিত হয় না।

জ্ঞানম্ (Jñānam): ভক্তিকে জ্ঞান বলা হয়েছে। অর্থাৎ, এই বিশেষ প্রেমটি অজ্ঞতা বা আবেগের ফল নয়। এই জ্ঞান হলো ঈশ্বরের স্বরূপ জ্ঞান এবং জীবাত্মার সঙ্গে ঈশ্বরের নিত্য সম্পর্কের জ্ঞান। ভক্ত জানে যে, ঈশ্বরই একমাত্র উপাস্য এবং জীবাত্মাই তাঁর অবিচ্ছেদ্য অংশ বা দাস। এই জ্ঞানই ভক্তিকে দৃঢ় করে এবং তাকে জাগতিক আসক্তি থেকে মুক্ত রাখে।

ভক্তি কেবল একটি আবেগ নয়, বরং জ্ঞান দ্বারা শুদ্ধ ও পরিচালিত প্রেম, যা মোক্ষ বা ঈশ্বর প্রাপ্তির একমাত্র সরাসরি পথ। ভক্তিই জীবকে ঈশ্বরের নিকট নিয়ে যায়, কারণ ঈশ্বর ভক্তির দ্বারা আকৃষ্ট হন। ভক্ত জীব ঈশ্বরকে প্রভু, বন্ধু, পিতা বা প্রেমিক হিসেবে অনুভব করে, আর তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় ঈশ্বরসেবা।

ভক্তির পূর্ণতা ঘটে যখন ভক্ত নিজের সীমাবদ্ধতা ও অক্ষমতা উপলব্ধি করে ঈশ্বরের কৃপায় নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে—এই আত্মসমর্পণই প্রপত্তি (śaraṇāgati)। এই অবস্থায় ভক্ত বুঝে যায়—তার নিজের প্রচেষ্টা নয়, বরং ঈশ্বরের অনুগ্রহই মুক্তির একমাত্র কারণ।

কর্মযোগ মনকে শুদ্ধ করে ও ভক্তির জন্য প্রস্তুত করে, ভক্তি হৃদয়কে ঈশ্বরমুখী করে ও প্রপত্তির দিকে নিয়ে যায়, আর প্রপত্তির দ্বারা জীব ঈশ্বরের কৃপায় মুক্তি লাভ করে। তাই রামানুজের সাধনাক্রমটি—কর্মযোগ থেকে ভক্তিযোগ, তা থেকে প্রপত্তি, আর তা থেকে আসে মোক্ষ।

এই ক্রমের সারকথা হলো—কর্মযোগ ভক্তির ভিত, কারণ কর্ম শুদ্ধ না হলে ভক্তি স্থির হয় না; আর ভক্তি মুক্তির দ্বার, কারণ ভক্তিই জীবকে ঈশ্বরের প্রেমে ও কৃপায় একাত্ম করে মুক্তির পথে নিয়ে যায়। এভাবেই রামানুজ কর্ম, ভক্তি ও মুক্তিকে এক অবিচ্ছেদ্য সাধনাপথে রূপ দিয়েছেন—যেখানে কর্ম ভক্তিতে রূপান্তরিত হয়, আর ভক্তি শেষপর্যন্ত মুক্তির দ্বার উন্মোচন করে।

শঙ্করাচার্যের নির্গুণ ব্রহ্মতত্ত্ব কর্মকে জ্ঞানলাভের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে দেখে; জ্ঞানলাভ হলে কর্মের প্রয়োজন ফুরোয়। কিন্তু রামানুজাচার্য সগুণ ঈশ্বরকে স্বীকার করে বলেন—কর্ম কখনও অপ্রয়োজনীয় নয়, কারণ কর্মই সেবা, আর সেবা ঈশ্বরের নিত্যধর্ম। মুক্ত জীবও ঈশ্বরসেবা থেকে বিরত থাকে না, কারণ সেই সেবা-ভাবই আত্মার পরম ধর্ম। তাই কাইনকর্ম কেবল সাধনার উপায় নয়, সিদ্ধিরও প্রকাশ।

কাইনকর্মযোগে কর্ম ও ভক্তির মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। কর্মই ভক্তি, যখন তা ঈশ্বরচিন্তায় ও সমর্পণবোধে সম্পন্ন হয়। কর্ম তখন আত্মচেতনার প্রকাশ, ভক্তির শরীরে প্রাণ। এই যোগে বাহ্যকর্ম নয়, অন্তর্গত উদ্দেশ্যই মুখ্য। একই কাজ—যজ্ঞ, দান বা সেবা—যদি ঈশ্বরস্মৃতিতে করা হয়, তবে তা যোগ; যদি অহংকারে করা হয়, তবে তা বন্ধন। এই উক্তিটির গভীর অর্থ রামানুজাচার্যের বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্ত ও গীতা-তত্ত্ব উভয়ের সঙ্গে যুক্ত। এই বাক্যে আসলে কর্মের অন্তঃপ্রেরণা (inner motive)-ই মুক্তি বা বন্ধনের নির্ণায়ক হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

রামানুজ বলেন, কোনো কর্ম স্বয়ং ভালো বা মন্দ নয়—তার ফল নির্ভর করে সেই কর্মের ভাব বা উদ্দেশ্য-এর ওপর। একই কর্ম—যজ্ঞ, দান, সেবা, বা অন্য কোনো কর্তব্য—দুই ভিন্ন চেতনায় সম্পন্ন হতে পারে।

যদি সেই কর্ম করা হয় ঈশ্বরস্মৃতিতে, অর্থাৎ, ঈশ্বরকে স্মরণ করে, তাঁকে উদ্দেশ্য করে, ফল-লোভ ও অহংকার ত্যাগ করে, তবে সেটি হয়ে ওঠে যোগ (yoga)—অর্থাৎ, ঈশ্বরের সঙ্গে সংযোগের উপায়। এই অবস্থায় কর্মের লক্ষ্য থাকে ঈশ্বরসেবা, ফলভোগ নয়। কর্ম তখন আর বেঁধে রাখে না; বরং মনকে শুদ্ধ করে ও ভক্তির পথে নিয়ে যায়। এইভাবেই নিষ্কাম কর্ম বা কর্মযোগ-এর জন্ম হয়।

শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতায় (২.৪৮) কৃষ্ণ বলেন—“যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা ধনঞ্জয়।” অর্থাৎ, "হে ধনঞ্জয় (অর্জুন), যোগে স্থিত হয়ে ফলের আসক্তি ত্যাগ করে কর্ম করো।" এখানে “যোগস্থ” মানেই ঈশ্বরস্মৃতিসম্পন্ন চেতনা। এই শ্লোকাংশটি নিষ্কাম কর্মযোগের মূলনীতি ব্যাখ্যা করে।

যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি: এখানে 'যোগস্থ' বলতে বোঝানো হয়েছে সমত্ববুদ্ধিতে স্থিত বা আত্মার স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে সেই মানসিক স্থিরতা নিয়ে কর্ম করার নির্দেশ দিচ্ছেন।

সঙ্গং ত্যক্ত্বা ধনঞ্জয়: কর্ম করার সময় ফলের প্রতি আসক্তি (সঙ্গম্) সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ (ত্যক্ত্বা) করতে হবে। এই আসক্তিই মানুষকে বন্ধন করে।

পরের অংশে (২.৪৮) শ্রীকৃষ্ণ এই যোগের সংজ্ঞা দেন—"সিদ্ধ্যসিদ্ধ্যোঃ সমো ভূত্বা সমত্বং যোগ উচ্যতে" (সাফল্য ও ব্যর্থতায় সমভাবাপন্ন হওয়াকেই যোগ বলা হয়)। কর্মযোগের মূল নির্দেশ—ফলকে নয়, কেবল কর্তব্যের প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ করে মানসিক সমতা বজায় রেখে কর্ম করে যাওয়া।

অন্যদিকে, যদি সেই একই কাজ করা হয় অহংকারে, অর্থাৎ “আমি করছি”, “আমিই দাতা”, “আমার কর্তৃত্ব”, এই ভাব নিয়ে, ঈশ্বরকে বাদ দিয়ে, নিজের গর্ব ও ফল-লোভে প্রেরিত হয়ে—তাহলে সেই কর্মই হয়ে ওঠে বন্ধন (bandha)। তখন কর্মের ফল কর্মফল-রূপে জীবকে সংসারে বেঁধে রাখে। কারণ সে ঈশ্বরকে নয়, নিজেকেই লক্ষ্য করেছে।

যিনি অহংকারে আবদ্ধ, তিনি ভাবেন—“আমি কর্তা।” এই ভাবই বন্ধনের মূল। দেখা যায়, একই কাজ—যজ্ঞ, দান বা সেবা—দুই ভিন্ন ফল দেয়। ঈশ্বরস্মৃতিতে করা হলে—কর্ম হয়ে যায় যোগ, মন হয় শুদ্ধ, এবং তা মুক্তির পথে নিয়ে যায়। অহংকারে করা হলে—কর্ম হয়ে যায় বন্ধন, মন হয় কলুষিত, এবং তা সংসারচক্রে বেঁধে রাখে।

রামানুজের মতে, কর্মের শুদ্ধি মানে কর্মত্যাগ নয়, বরং কর্মকে ঈশ্বরার্পণ করা। যখন প্রতিটি কাজ ঈশ্বরচিন্তায় সম্পন্ন হয়—যেমন যজ্ঞকে তাঁর উপাসনা, দানকে তাঁর সেবার অঙ্গ, আর সেবাকে তাঁর প্রতি প্রেমের প্রকাশ হিসেবে দেখা হয়—তখন সেই কর্মই হয়ে ওঠে যোগ, অর্থাৎ ঈশ্বরসান্নিধ্যের সোপান।

তাই, কর্ম নয়, কর্মের ভাবই মুক্তি বা বন্ধনের কারণ। ঈশ্বরস্মৃতিসম্পন্ন কর্ম আত্মাকে মুক্ত করে; অহংকারসম্পন্ন কর্ম আত্মাকে আবদ্ধ রাখে। যোগ ও বন্ধনের পার্থক্য তাই বাহ্য কর্মে নয়, অন্তরের চেতনায়।

চিত্তশুদ্ধি কাইনকর্মযোগের প্রধান ফল। ফল-লালসা বিলুপ্ত হলে মন শান্ত হয়, জ্ঞান প্রসারিত হয়, আর ভক্তি জাগে। এই শুদ্ধ চিত্তেই ঈশ্বরকৃপা প্রকাশিত হয়। রামানুজ বলেন, জীব যখন এই ভক্তিতে পূর্ণ হয়, ঈশ্বর স্বয়ং কৃপা করেন, আর সেই কৃপাই মোক্ষের কারণ। মুক্তি এখানে ঈশ্বরে লয় নয়, বরং ঈশ্বরের সঙ্গে নিত্য সেবাসঙ্গ—ভগবৎ-সাক্ষাৎকার।