রামানুজের মতে, প্রপত্তির পাঁচটি আভ্যন্তরীণ অঙ্গ আছে—
১. আনুকূল্য-সংকল্প (Ānukūlya-saṅkalpa): ঈশ্বরের ইচ্ছানুসারে কল্যাণকর কর্মে স্থির সংকল্প করা।
২. প্রাতিকূল্য-বিবর্জন (Prātikūlya-vivarjana): যা ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধ, তা পরিত্যাগ করা।
৩. রক্ষিষ্যতীতি-বিশ্বাস (Rakṣiṣyatīti-viśvāsa): ঈশ্বর আমাকে রক্ষা করবেন, এই দৃঢ় বিশ্বাস।
৪. গোপ্তৃত্ব-বরণ (Goptṛtva-varaṇa): ঈশ্বরকেই একমাত্র রক্ষক ও আশ্রয় হিসেবে গ্রহণ করা।
৫. কার্পণ্য (Kārpaṇya): নিজের অক্ষমতা, ক্ষুদ্রতা ও নির্ভরতার বিনম্র স্বীকার।
এই পাঁচ অঙ্গ পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হলে প্রপত্তি সিদ্ধ হয়। তখন জীব ঈশ্বরের করুণার যোগ্য হয়ে ওঠে, আর ঈশ্বর নিজে তাকে নিজের সান্নিধ্যে টেনে নেন।
প্রপত্তির সিদ্ধির ফল হলো মুক্তি (mokṣa)—কিন্তু এই মুক্তি অদ্বৈতের মতো ব্রহ্মে লয় নয়। বরং, এখানে জীব ঈশ্বরের চিরসান্নিধ্যে অবস্থান করে, তাঁর ইচ্ছায় চিরসেবা করে, এবং ঈশ্বরের আনন্দে অংশগ্রহণ করে। জীব নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেও ঈশ্বরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত থাকে। এই অবস্থাকে বলা হয় নিত্য কৈঙ্কর্য—অর্থাৎ ঈশ্বরের নিরন্তর সেবা, যা চিরআনন্দময়।
এই প্রপত্তির সিদ্ধি মানে এমন এক অবস্থা, যেখানে জীবের সমস্ত অহং, কামনা ও ভয় বিলুপ্ত হয়; সে আর নিজেকে পৃথক ভাবে না, বরং ঈশ্বরের ইচ্ছায় সম্পূর্ণ একাত্ম হয়। তখন জীব অনুভব করে—“আমি নই, তিনিই আছেন; আমি কেবল তাঁর সেবার যন্ত্র।”
প্রপত্তির সিদ্ধি হলো ঈশ্বরের সঙ্গে জীবের প্রেমপূর্ণ, সেবামূলক, চিরস্থায়ী ঐক্য—যেখানে ঈশ্বর কৃপা করে জীবকে বদ্ধতা থেকে মুক্ত করেন, এবং জীব তাঁর আনন্দে, শক্তিতে ও ইচ্ছায় একাত্ম হয়ে চিরকালের জন্য ঈশ্বরসেবায় প্রতিষ্ঠিত থাকে। এই অবস্থাই বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্তে মুক্তির পরম রূপ—ভক্তির পরিণতি ও আত্মসমর্পণের চিরফল।
কৈঙ্কর্য (Kaiṅkarya) শব্দটি বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্ত দর্শনে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব, যা রামানুজাচার্যের সমগ্র ভাবধারার কেন্দ্রবিন্দু। এই শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো সেবা, পরিচর্যা, বা নিরন্তর ভক্তিমূলক কর্তব্য। কিন্তু রামানুজের দৃষ্টিতে কৈঙ্কর্য কোনো সাধারণ সেবা নয়—এটি হলো আত্মার স্বরূপধর্ম, অর্থাৎ জীবাত্মার প্রকৃত অস্তিত্বের উদ্দেশ্যই ঈশ্বরের সেবা করা।
যেমন দেহ আত্মার দ্বারা ধারণ ও পরিচালিত হয়, তেমনি জীবও ঈশ্বরের দ্বারা ধারণ ও নিয়ন্ত্রিত। এই সম্পর্কের মধ্যেই জীবের প্রকৃত কর্তব্য নিহিত—ঈশ্বরের ইচ্ছা পূর্ণ করা, তাঁর আনন্দে অংশ নেওয়া, এবং তাঁর উদ্দেশ্যেই নিজের অস্তিত্ব উৎসর্গ করা—এটাই কৈঙ্কর্য।
বদ্ধ জীব দেহ, অহংকার ও কামনার আবরণে ঢাকা থাকায় নিজের এই স্বরূপ ভুলে যায়; তখন সে নিজের স্বার্থ, সুখ ও ভোগের পিছনে ছুটে বেড়ায়। কিন্তু যখন ঈশ্বরের কৃপায় ও প্রপত্তির মাধ্যমে জীব নিজের প্রকৃত অবস্থান উপলব্ধি করে, তখন সে বুঝতে পারে—“আমি ঈশ্বরের দাস, আমি তাঁর সেবা করার জন্যই বিদ্যমান।” সেই চেতনা থেকেই জন্ম নেয় কৈঙ্কর্য।
রামানুজ বলেন, জীবাত্মা চিরকাল ব্রহ্মের শরীর এবং ঈশ্বর তাঁর শরীরী। এই উক্তিটি তাঁর বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু—এখানেই ঈশ্বর, জীব ও জগতের প্রকৃত সম্পর্কের সারতত্ত্ব নিহিত। এর মাধ্যমে তিনি একদিকে অদ্বৈত ও দ্বৈত দর্শনের মধ্যে সেতুবন্ধন করেন, অন্যদিকে ঈশ্বরনির্ভর ভক্তির এক গভীর দার্শনিক ভিত্তি স্থাপন করেন।
রামানুজের মতে, “শরীর” অর্থ তা-ই, যা অন্য দ্বারা ধারণ ও নিয়ন্ত্রিত হয়, আর “শরীরী” অর্থ সেই অন্তর্নিহিত সত্তা যিনি শরীরকে ধারণ, পরিচালনা ও উদ্দেশ্য প্রদান করেন। যেমন আত্মা দেহের মধ্যে থেকে দেহকে পরিচালনা করে, দেহ আত্মা ব্যতীত কিছুই করতে পারে না, তেমনি ঈশ্বর প্রত্যেক জীবের অন্তরে বিরাজ করেন এবং জীবকে ধারণ, পোষণ ও পরিচালনা করেন। ফলে জীব ঈশ্বরের শরীর, আর ঈশ্বর সেই জীবের অন্তর্নিহিত আত্মা বা শরীরী।
এই সম্পর্কের মাধ্যমে রামানুজ ঈশ্বর, জীব ও জগতের মধ্যে এক অবিচ্ছেদ্য ঐক্য স্থাপন করেন। তাঁর মতে, ঈশ্বর, জীব ও প্রকৃতি তিনটি চিরন্তন তত্ত্ব—কিন্তু এই তিনে মিলে গঠিত হয় এক সমগ্র সত্তা, যা চিদ্-অচিদ্-বিশিষ্ট ব্রহ্ম নামে পরিচিত। জীব (চিদ্) ও জগৎ (অচিদ্) ঈশ্বরের দেহ, আর ঈশ্বর (ঈশ্বর-তত্ত্ব) তাঁদের অন্তর্নিহিত আত্মা। তাই জীব ও জগৎ ঈশ্বরের থেকে পৃথক নয়, আবার অভিন্নও নয়—তাঁদের অস্তিত্ব ঈশ্বরনির্ভর, কিন্তু স্বতন্ত্র পরিচিতি বজায় থাকে। এ কারণেই রামানুজের দর্শন “বিশিষ্ট-অদ্বৈত”—অর্থাৎ, একত্ব আছে, কিন্তু সেই একত্ব গুণবিশিষ্ট ও সম্পর্কনির্ভর।
এই ধারণার মূল শাস্ত্রীয় ভিত্তি বৃহদারণ্যক উপনিষদ (৩.৭.১৫)-এর সেই বিখ্যাত বাক্যে—“যস্য আত্মা শরীরম্, যঃ আত্মা অন্তর্যামী অমৃতঃ”—“যাঁর শরীর আত্মা, যিনি অন্তর্নিহিত আত্মা, তিনিই অমর ঈশ্বর।” রামানুজ এই শ্লোকের ভিত্তিতেই বলেন, ঈশ্বর প্রত্যেক জীব ও সৃষ্টির অন্তরে অন্তর্যামী (antaryāmin) রূপে বিরাজ করেন। তিনি জীবের ভেতরে থেকে তার সমস্ত চিন্তা, অনুভব ও ক্রিয়া পরিচালনা করেন। জীব নিজেকে স্বাধীন ভাবলেও বাস্তবে সে ঈশ্বরের ইচ্ছার যন্ত্রমাত্র।
এইভাবে রামানুজ দ্বৈত ও অদ্বৈতের মধ্যে এক মধ্যপন্থা প্রতিষ্ঠা করেন। অদ্বৈত বলে—জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন, জগৎ মিথ্যা; দ্বৈত বলে—জীব ও ঈশ্বর সম্পূর্ণ পৃথক। কিন্তু রামানুজ বলেন—জীব ও জগৎ ঈশ্বরের অংশ, তাঁর দেহস্বরূপ, তাই বাস্তব ও সত্য; তবে তাঁরা ঈশ্বরের অন্তর্গত, স্বাধীন নয়। ঈশ্বর ও তাঁর দেহ অবিচ্ছেদ্য, যেমন আত্মা ও দেহের মধ্যে পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তারা পৃথকভাবে টিকে থাকতে পারে না। এই সম্পর্কেই নিহিত “অভিন্নতা ও ভিন্নতার একত্র সংহতি”—যা বিশিষ্টাদ্বৈতের মূলভাব।
এই দার্শনিক সম্পর্কের নৈতিক তাৎপর্যও গভীর। যেহেতু জীব ঈশ্বরের শরীর, তাই তার অস্তিত্বের লক্ষ্য ঈশ্বরের সেবা করা ও তাঁর ইচ্ছা পূরণ করা। জীবের কোনো স্বতন্ত্র অহং বা স্বাধীন উদ্দেশ্য নেই; তার প্রকৃত কর্তব্য হলো ঈশ্বরের ইচ্ছায় আত্মসমর্পণ ও কৈঙ্কর্য—অর্থাৎ ঈশ্বরসেবা। অহংকার, স্বতন্ত্রতা ও কামনা ত্যাগ করে ঈশ্বরের আনন্দেই নিজের আনন্দ খুঁজে পাওয়াই জীবের স্বরূপধর্ম।
মুক্তির অবস্থায় এই সত্য সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয়। তখন জীব উপলব্ধি করে—“আমি ঈশ্বরের দেহ, তিনি আমার শরীরী; আমার কোনো অস্তিত্ব তাঁর বাইরে নেই।” এই উপলব্ধির ফলেই জীব ঈশ্বরের চিরসান্নিধ্যে থেকে তাঁর সেবায় নিয়োজিত হয়। মুক্তি এখানে কোনো লয় বা বিলীনতা নয়, বরং ঈশ্বরের সঙ্গে চিরসেবা-নির্ভর ঐক্য। জীব ঈশ্বরের আনন্দ, ঐশ্বর্য ও শক্তিতে অংশগ্রহণ করে, কিন্তু নিজের পৃথক চৈতন্য বজায় রাখে—যেমন একটি অঙ্গ আত্মার ইচ্ছায় কাজ করে, তেমনি মুক্ত আত্মা ঈশ্বরের ইচ্ছায় স্বতঃস্ফূর্ত সেবা করে।
রামানুজের উক্তিটির দার্শনিক তাৎপর্য হলো—জীব ও ঈশ্বরের মধ্যে সম্পর্ক কেবল সৃষ্টিকর্তা-সৃষ্টি নয়, বরং দেহ-আত্মার সম্পর্ক। জীব ঈশ্বরের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, ঈশ্বর তাঁর অন্তর্নিহিত আত্মা। জীবের অস্তিত্ব সম্পূর্ণরূপে ঈশ্বরনির্ভর, আর ঈশ্বরের উদ্দেশ্য পূরণ করাই তার প্রকৃত কর্তব্য। এই সম্পর্কের মধ্য দিয়েই রামানুজ এক অনন্য ঐক্য স্থাপন করেন—যেখানে ভিন্নতা রক্ষিত, অথচ বিভক্তি নেই; ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান, আর সমস্ত জীব তাঁর সেবার জন্যই বিদ্যমান। এইভাবেই “জীব ব্রহ্মের শরীর, আর ঈশ্বর তাঁর শরীরী”—এই এক বাক্যেই বিশিষ্টাদ্বৈতের পূর্ণ দর্শন প্রতিফলিত হয়।
রামানুজাচার্যের মতে, মুক্তি বা মোক্ষ মানে কোনো লয় (liya) বা ব্রহ্মে বিলীন হওয়া (brahma-laya) নয়, বরং ঈশ্বরের সঙ্গে চিরসেবা-নির্ভর ঐক্য—অর্থাৎ, এমন এক চেতনা ও অস্তিত্বের অবস্থা, যেখানে জীবাত্মা ঈশ্বরের সান্নিধ্যে থেকে চিরকাল তাঁর সেবা করে, তাঁর আনন্দে অংশগ্রহণ করে, কিন্তু নিজের পৃথক চৈতন্য ও পরিচয় বজায় রাখে।
অদ্বৈত বেদান্তের মতো রামানুজ বলেননি যে, জীব ব্রহ্মে লীন হয়ে একাত্ম হয়ে যায় এবং ব্যক্তিগত সত্তা বিলুপ্ত হয়। বরং তিনি বলেছেন, জীব ও ঈশ্বরের সম্পর্ক চিরন্তন—ঈশ্বর হলেন শরীরী (অন্তর্নিহিত আত্মা), আর জীব তাঁর শরীর। তাই মুক্তির পরেও জীব ঈশ্বরের দেহরূপেই থাকে; পার্থক্য হলো—তখন আর অজ্ঞান, দুঃখ ও কর্মবন্ধন থাকে না।
এই মুক্তিকে বলা যায় “ঈশ্বরসেবা-নির্ভর ঐক্য”—যেখানে ঐক্যের অর্থ অভিন্নতা নয়, বরং সম্পূর্ণ সমন্বয় ও ইচ্ছার মিলন। মুক্ত জীব আর নিজের ইচ্ছায় কিছু করে না; ঈশ্বরের ইচ্ছাই তার ইচ্ছা হয়ে যায়। সে অনুভব করে—“আমি তাঁর দেহ, আমি তাঁর সেবার জন্য বিদ্যমান, তাঁর আনন্দই আমার আনন্দ।” এই অবস্থাই চিরসেবা-নির্ভর ঐক্য।
রামানুজ এই অবস্থাকে পরকৈঙ্কর্য (para-kaiṅkarya) নামে অভিহিত করেছেন—অর্থাৎ, মুক্ত জীব ঈশ্বরের চিরসেবা করে এবং ঈশ্বরের ঐশ্বর্য ও আনন্দে অংশ নেয়। এটি নিছক দার্শনিক ঐক্য নয়, বরং প্রেম, আত্মসমর্পণ ও সেবার ঐক্য। মুক্ত জীবের অস্তিত্ব ঈশ্বরনির্ভর, তার চেতনা ঈশ্বরকেন্দ্রিক, তার আনন্দ ঈশ্বরের আনন্দে একীভূত।
রামানুজাচার্যের মতে, কৈঙ্কর্য বা ঈশ্বরসেবা হলো জীবাত্মার চিরন্তন ধর্ম—তার অস্তিত্বের প্রকৃত উদ্দেশ্যই সেবা করা। জীব ঈশ্বরের শরীর, আর ঈশ্বর তাঁর শরীরী; এই সম্পর্কের মধ্যে জীবের স্বাভাবিক প্রবণতা হলো ঈশ্বরের ইচ্ছা পূরণ করা ও তাঁর আনন্দে অংশ নেওয়া। তাই রামানুজ কৈঙ্কর্যকে কেবল একধরনের ধর্মীয় কর্তব্য নয়, বরং আত্মার স্বরূপধর্ম (essential nature) হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।
কৈঙ্কর্য দুই রকম—প্রথমটি হলো সংসারিক বা প্রস্তুতিমূলক কৈঙ্কর্য (saṁsārika kaiṅkarya), আর দ্বিতীয়টি হলো মুক্ত বা পরকৈঙ্কর্য (para kaiṅkarya)।
সংসারিক কৈঙ্কর্য সেই অবস্থায় প্রকাশ পায়, যখন জীব এখনও দেহে আবদ্ধ, কিন্তু ঈশ্বরসেবার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে। এই কৈঙ্কর্যের রূপ হলো সাধনা—যেমন ঈশ্বরের উপাসনা, নামস্মরণ, ভক্তিযোগ, পূজা, প্রার্থনা, শাস্ত্রপাঠ ইত্যাদি। এগুলির মাধ্যমে জীব ধীরে ধীরে নিজের অহং, কামনা ও স্বার্থপরতা ত্যাগ করে এবং ঈশ্বরের কৃপাপ্রাপ্তির যোগ্য হয়ে ওঠে। এই কৈঙ্কর্য হলো প্রপত্তির (শরণাগতির) প্রস্তুতিপর্ব; এখানে জীব ঈশ্বরকে নিজের প্রভু ও রক্ষক হিসেবে স্বীকার করে, কিন্তু এখনও দেহ ও মনের সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ থাকে।
অন্যদিকে, পরকৈঙ্কর্য হলো মুক্ত জীবের অবস্থা—যেখানে জীব ঈশ্বরের সান্নিধ্যে চিরসেবা করে। মুক্ত জীব ঈশ্বরের ইচ্ছায় সম্পূর্ণ একাত্ম হয়ে যায়; সে আর নিজের কোনো স্বার্থ বা ইচ্ছা অনুভব করে না। তার একমাত্র আনন্দ ঈশ্বরের আনন্দে, তার একমাত্র গতি ঈশ্বরের ইচ্ছায়। রামানুজ বলেন, এই পরকৈঙ্কর্যই জীবের পরম গতি (parama gati)—কারণ সেবাই জীবের স্বরূপ, আর ঈশ্বরসেবা ব্যতীত অন্য কিছুতে সে আনন্দ পায় না। মুক্ত আত্মা তখন ঈশ্বরের নিত্যলীলা, ঐশ্বর্য ও আনন্দে অংশগ্রহণ করে, কিন্তু নিজের পৃথক চেতনা বজায় রাখে।
এই কৈঙ্কর্যকে তিনি ঈশ্বরসেবার অন্তরঙ্গ ঐক্য হিসেবে দেখিয়েছেন—যেখানে দাসত্ব অপমান নয়, বরং আনন্দের চরম রূপ। দেহ আত্মার ইচ্ছায় যেমন স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করে, মুক্ত আত্মাও তেমনি ঈশ্বরের ইচ্ছায় স্বাভাবিকভাবেই সেবা করে। সে আর নিজের কিছু চায় না, কারণ ঈশ্বরের সন্তুষ্টিই তার একমাত্র সুখ।
কৈঙ্কর্য তাই কোনো বাহ্যিক কর্তব্য নয়, বরং আত্মার অন্তর্গত প্রেমের প্রকাশ। সংসারিক কৈঙ্কর্য জীবকে শুদ্ধ করে মুক্তির উপযুক্ত করে তোলে, আর মুক্ত বা পরকৈঙ্কর্য জীবকে ঈশ্বরের সঙ্গে চিরসেবা-নির্ভর ঐক্যে স্থাপন করে। এইভাবেই রামানুজ বলেন—সেবা-ই মুক্তি, আর ঈশ্বরসেবা ব্যতীত অন্য কিছুতে জীব কখনও পরিতৃপ্ত হতে পারে না।
কৈঙ্কর্য হলো সেই দার্শনিক ও ভক্তিমূলক চেতনা, যেখানে জীব ঈশ্বরকে নিজের একমাত্র গতি ও প্রভু হিসেবে মেনে নিয়ে তাঁর ইচ্ছায় আত্মসমর্পিত থাকে এবং সেবার মধ্য দিয়েই নিজের অস্তিত্বকে উপলব্ধি করে। এটি কোনো বাহ্য সেবা নয়, বরং আত্মার অন্তর্গত ধর্ম—যেখানে সেবা মানে প্রেম, আত্মসমর্পণ, আনন্দ ও ঐক্য—এই চারটির মিলন। এটি জীবাত্মার স্বরূপসিদ্ধ কর্তব্য—ঈশ্বরের আনন্দে অংশগ্রহণের জন্য তাঁর ইচ্ছানুসারে সেবা করা। এটাই বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্তে মোক্ষের চূড়ান্ত রূপ, যেখানে মুক্ত আত্মা ঈশ্বরের চিরসান্নিধ্যে থেকে নিরন্তর সেবায় নিমগ্ন থাকে—না কোনো আকাঙ্ক্ষা, না কোনো অহং, কেবল প্রেমময় সেবা।