এই তত্ত্বের ভিত্তি বহু উপনিষদে পাওয়া যায়। বৃহদারণ্যক উপনিষদ (৩.৭.১৫) বলছে—“He who dwells within all beings, whom all beings do not know, whose body all beings are, and who controls all beings from within — He is your inner Self, the immortal one.” (যঃ সর্বেষু ভূতেষু তিষ্ঠন্, যঃ সর্বেভ্যো ভূতেভ্যোঽন্তরাত্মা (অথবা অন্তঃরঃ), যং সর্বাণি ভূতানি ন বিদুঃ, যস্য সর্বাণি ভূতানি শরীরম্, যঃ সর্বাণি ভূতান্যন্তরো যময়তি, এষ ত আত্মা অন্তর্যামী অমৃতঃ।)
কাহোল (Kāhola) ছিলেন বৈদিক যুগের একজন প্রসিদ্ধ ঋষি। তাঁর পুরো নাম হলো কাহোল কৌষীতকেয়। তিনি মূলত বৃহদারণ্যক উপনিষদে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যের সঙ্গে তাঁর জ্ঞানগর্ভ আলোচনার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। এই কথোপকথন ভারতীয় দর্শনে, বিশেষ করে বেদান্ত দর্শনে, ব্রহ্মতত্ত্ব এবং আত্মতত্ত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বৃহদারণ্যক উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়ের সপ্তম ব্রাহ্মণে (৩.৭) কাহোল ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যকে সেই সাক্ষাৎ ও অপেরোক্ষ ব্রহ্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, যিনি সকলের অন্তরে আত্মা রূপে বিরাজমান। তাঁদের আলোচনায় যাজ্ঞবল্ক্য অন্তর্যামী ব্রহ্মের স্বরূপ ব্যাখ্যা করেন—যিনি সকল জীবের মধ্যে অবস্থান করেও তাদের থেকে ভিন্ন, সকল কিছুকে অভ্যন্তর থেকে নিয়ন্ত্রণ করেন এবং যিনি অমৃত (অমর)। এই আলোচনা অদ্বৈত বেদান্তের ব্রহ্মতত্ত্বের ভিত্তিস্থাপন করে। মন্ত্রের অংশটি কাহোলের ব্রাহ্মণের উত্তরে যাজ্ঞবল্ক্য ঋষি কর্তৃক উহ্য সেই অন্তর্যামী (Internal Ruler) ব্রহ্মের বর্ণনা।
“যঃ সর্বেষু ভূতেষু তিষ্ঠন্”-এর ভাবার্থ: যিনি সকল ভূতের (সকল জীব বা বস্তুর) মধ্যে অবস্থান করেন। এটি ব্রহ্মের সর্বব্যাপীত্ব ঘোষণা করে।
“যঃ সর্বেভ্যো ভূতেভ্যোঽন্তরাত্মা (অথবা অন্তঃরঃ)”-এর ভাবার্থ: যিনি সকল ভূতের (বস্তু বা জীব) অন্তরস্থ আত্মা বা অভ্যন্তরে (বা থেকেও আলাদা)। এটি ব্রহ্মের অভেদ্যতা এবং অন্তরাত্মা রূপে অবস্থান নির্দেশ করে।
“যং সর্বাণি ভূতানি ন বিদুঃ”-এর ভাবার্থ: যাকে সকল ভূত (জীব বা বস্তু) জানতে পারে না। এটি প্রকাশ করে ব্রহ্মের অজ্ঞেয়তা। ইন্দ্রিয় বা মন দ্বারা তাঁকে সরাসরি জানা যায় না।
“যস্য সর্বাণি ভূতানি শরীরম্”-এর ভাবার্থ: সকল ভূত (জীব বা বস্তু) যাঁর শরীর। এই অংশটি বিশিষ্টাদ্বৈত দর্শনের শরীর-শরীরী ভাব এবং অদ্বৈতের ঈশ্বরের উপাধিযুক্ত স্বরূপকে নির্দেশ করে। তিনি হলেন শরীরী, আর জগৎ তাঁর শরীর।
“যঃ সর্বাণি ভূতান্যন্তরো যময়তি”-এর ভাবার্থ: যিনি সকল ভূতের অভ্যন্তরে থেকে নিয়ন্ত্রণ (যময়তি) করেন। এটি ব্রহ্মের নিয়ন্তৃত্ব (Internal Controller) এবং ঈশ্বরের ভূমিকাকে তুলে ধরে।
“এষ ত আত্মা অন্তর্যামী অমৃতঃ”-এর ভাবার্থ: সেই ইনিই তোমার আত্মা, যিনি অন্তর্যামী এবং অমৃত (অমর)। এটিই চূড়ান্ত ঘোষণা যে, সেই অন্তর্যামীই হলেন তোমার (জীবের) প্রকৃত আত্মা এবং তিনি অবিনাশী।
এই মন্ত্রটি অন্তর্যামী ব্রহ্মের তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করে, যিনি সকল জীবের আত্মা হয়েও তাদের থেকে ভিন্ন এবং তাদের নিয়ন্ত্রক। এটি অদ্বৈত বেদান্তের ব্রহ্মই আত্মা এবং বিশিষ্টাদ্বৈতের ঈশ্বরই শরীরী—এই উভয় মতের ভিত্তি। এই শ্লোকের “যস্য সর্বাণি ভূতানি শরীরম্”—এই বাক্যাংশই রামানুজের তত্ত্বের ভিত্তি। অর্থাৎ, সমস্ত সত্তাই ঈশ্বরের শরীর, আর ঈশ্বর তাঁদের অন্তর্নিহিত আত্মা।
তেমনি মহানারায়ণ বা মহামৈত্রায়ণীয় উপনিষদ (১৩.৪) বলছে—”অন্তর বহিষ্ চ তৎ সর্বং ব্যাপ্য নারায়ণঃ স্থিতঃ” —“সেই নারায়ণ অভ্যন্তরে ও বাইরে সবকিছু পরিব্যাপ্ত করে অবস্থান করছেন”। এই মন্ত্রটি নারায়ণকে (বিষ্ণু/ঈশ্বর) সর্বোচ্চ সত্তা এবং সর্বব্যাপী রূপে প্রতিষ্ঠা করে।
“অন্তর বহিষ্ চ”-এর অর্থ হলো অভ্যন্তরে (inwardly) এবং বাইরে (outwardly)। “তৎ সর্বং ব্যাপ্য”-এর অর্থ হলো, সেই সমস্তকিছুকে পরিব্যাপ্ত করে বা ছেয়ে থেকে। “নারায়ণঃ স্থিতঃ”-এর অর্থ হলো, নারায়ণ অবস্থান করছেন।
এই মন্ত্রটি ঈশ্বরের সর্বব্যাপকত্ব (Omnipresence) ঘোষণা করে। এটি বোঝায় যে, নারায়ণ কোনো দূরবর্তী স্বর্গীয় সত্তা নন, বরং তিনি এই সমগ্র সৃষ্টির ভিতরে ও বাইরে সর্বত্র বিদ্যমান। বৈষ্ণব দর্শনে, নারায়ণই হলেন সেই পরমাত্মা এবং ঈশ্বর, যিনি সমগ্র জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করেন। যদিও এটি বৈষ্ণব মন্ত্র, তবে এটি অদ্বৈত বেদান্তের “সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম” (ছান্দোগ্য উপনিষদ, ৩.১৪.১) (এই সমস্তই ব্রহ্ম)—এই সর্বব্যাপকত্বের ধারণার সঙ্গেও সম্পর্কযুক্ত। বিশিষ্টাদ্বৈতে, এটি—ঈশ্বরই জগৎ ও জীবাত্মার শরীরী—এই সিদ্ধান্তকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে।
এই সম্পর্ক ঈশ্বর ও জগতের মধ্যে অভিন্নতা ও ভিন্নতা উভয়কেই সংহত করে। জীব ও জড় ঈশ্বরের দেহ—তাই তাঁদের অস্তিত্ব বাস্তব, কিন্তু স্বাধীন নয়; তাঁরা ঈশ্বরের অন্তর্গত ও নির্ভরশীল। ঈশ্বর তাঁদের মধ্যে বিরাজ করেই তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করেন। বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্ত এইভাবে ঈশ্বর-জীব-জগতের একাত্ম, অথচ ভিন্নতাযুক্ত সম্পর্ককে দার্শনিকভাবে রক্ষা করেছে।
এই তত্ত্বে মুক্তি মানে ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ ও আত্মানুভব। মুক্ত আত্মা বোঝে—“আমি ঈশ্বরের শরীর, তিনি আমার শরীরী; আমি তাঁর ইচ্ছায় পরিচালিত, আমার সত্তা তাঁর সেবারই প্রকাশ।” অতএব, মুক্তি কোনো অভেদজ্ঞান নয়, বরং এক প্রপত্তি-ভিত্তিক ঐক্য—যেখানে আত্মা ঈশ্বরের দেহরূপে নিজের অবস্থান উপলব্ধি করে এবং ঈশ্বরের ইচ্ছার সম্পূর্ণ আশ্রয় গ্রহণ করে।
প্রপত্তি-ভিত্তিক ঐক্য হলো বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের এক মৌলিক ধারণা, যেখানে প্রপত্তি (Prapatti) বা শরণাগতি-কে মোক্ষ বা মুক্তিলাভের সর্বোচ্চ উপায় হিসেবে গণ্য করা হয়। এই প্রপত্তির মাধ্যমে জীবাত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে এমন এক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপিত হয়, যা একাধারে ঐক্য এবং ভক্তিস্বরূপ আত্মসমর্পণ উভয়ই।
‘প্রপত্তি’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ‘সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ’ বা ‘শরণাগতি’। এটি সেই অবস্থান, যেখানে ভক্ত নিজের সমস্ত ব্যক্তিগত চেষ্টা, জ্ঞান, কর্ম, যোগ ইত্যাদির অহং ত্যাগ করে ঈশ্বরের কৃপাকেই একমাত্র পথ বলে মেনে নেন। জীব তখন নিজেকে ঈশ্বরের হাতে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করে এই বিশ্বাসে যে—তিনিই একমাত্র রক্ষক, পোষক ও গতি। প্রপত্তির মূলে রয়েছে ঈশ্বরের প্রতি নিঃশর্ত বিশ্বাস, অনুগত প্রেম ও পরম নির্ভরতা। ভক্ত তখন বলে ওঠে—“আমি কিছু নই, তুমি-ই সব।” এই অবস্থায় জীবের কর্তৃত্ববোধ ও ফলভোগের আকাঙ্ক্ষা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়, আর ঈশ্বরের ইচ্ছাই জীবের ইচ্ছায় পরিণত হয়।
রামানুজ এই প্রপত্তি-ভিত্তিক ঐক্যকে অদ্বৈত বেদান্তের মতো স্বরূপগত অভেদ হিসেবে ব্যাখ্যা করেননি। এখানে ‘ঐক্য’ মানে দুই সত্তার মধ্যে মিশে যাওয়া নয়, বরং অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ও ইচ্ছার অভিন্নতা। ব্রহ্ম হলেন শরীরী—অর্থাৎ, সমস্ত জীবের অন্তর্নিহিত আত্মা, আর জীবাত্মা তাঁর শরীর। প্রপত্তির মাধ্যমে জীব নিজের শরীরী ব্রহ্মের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে একাত্ম হয়—অর্থাৎ, ঈশ্বরের ইচ্ছার সঙ্গে নিজের ইচ্ছাকে এক করে নেয়। জীব তখন নিজের স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলে না, বরং তা ঈশ্বরের মধ্যে পূর্ণতা পায়।
এই ঐক্যের সঙ্গে যুক্ত আছে “সঙ্কোচ ও বিকাশ”-এর ধারণা। বদ্ধ জীবাত্মা অজ্ঞান ও উপাধির দ্বারা আবৃত হয়ে নিজের প্রকৃত স্বরূপ চিনতে পারে না; তার জ্ঞান সঙ্কুচিত থাকে। প্রপত্তির মাধ্যমে ঈশ্বর যখন তাঁর কৃপা বর্ষণ করেন, তখন জীবের জ্ঞান বিকশিত হয়। তখন জীবাত্মা উপলব্ধি করে যে, সে ঈশ্বরের শরীর, আর ঈশ্বর তার অন্তর্নিহিত আত্মা। এই উপলব্ধি থেকেই জন্ম নেয় ঐক্য, যা জ্ঞানের নয়, সম্পর্কের ঐক্য—সেবার ঐক্য। প্রপত্তি-ভিত্তিক মুক্ত জীব ঈশ্বরের সঙ্গে সমান আনন্দ ও ঐশ্বর্য ভোগ করে, কিন্তু ব্রহ্মের থেকে আলাদা সত্তা হিসেবেই থাকে।
“সঙ্কোচ ও বিকাশ” হলো বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্তে জীবাত্মার অবস্থার এক সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা, যা বোঝায়—জীবের জ্ঞান ও শক্তি কখনও সঙ্কুচিত অবস্থায় থাকে, আবার ঈশ্বরের কৃপায় তা বিকশিত হয়। রামানুজাচার্যের মতে, জীবাত্মা বা আত্মা চিরন্তন, চৈতন্যময় এবং ঈশ্বরের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কিন্তু যখন সে দেহ, ইন্দ্রিয় ও কর্মফলের বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তখন তার স্বাভাবিক জ্ঞান সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এই সীমাবদ্ধ অবস্থাই সঙ্কোচ, আর যখন ঈশ্বরের কৃপায় সেই সীমাবদ্ধতা দূর হয়ে জীবের জ্ঞান তার পূর্ণ দীপ্তিতে প্রকাশিত হয়, তখন সেটাই বিকাশ।
বদ্ধ জীবের অবস্থা সঙ্কোচ দ্বারা চিহ্নিত। জীব স্বরূপতঃ অসীম জ্ঞান ও আনন্দময়, কিন্তু দেহ, মন, ইন্দ্রিয় ও অজ্ঞানতার আচ্ছাদনে তার প্রকৃত চৈতন্য আড়াল হয়ে যায়। তখন সে নিজেকে কেবল দেহ বা ব্যক্তি হিসেবে দেখে, ঈশ্বরের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে নয়। যেমন সূর্য মেঘে ঢেকে গেলে তার আলো ম্লান মনে হয়, অথচ সূর্যের উজ্জ্বলতা কখনও কমে না—তেমনি জীবের জ্ঞানও আচ্ছাদনের কারণে সঙ্কুচিত মনে হয়, কিন্তু তা আসলে কখনও বিলুপ্ত হয় না। এই সঙ্কোচের মূল কারণ হলো ঈশ্বরনির্ধারিত কর্মফল, উপাধি ও অবিদ্যা, যা জীবকে দেহাভিমান ও সংসারচক্রে আবদ্ধ করে রাখে।
যখন জীব ঈশ্বরের প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ বা প্রপত্তি করে, তখন ঈশ্বর তাঁর কৃপা বর্ষণ করেন। সেই কৃপাই জীবের জ্ঞানকে উন্মুক্ত করে তোলে—এটাই বিকাশ। এই বিকাশে জীব নিজের প্রকৃত পরিচয় চিনে ফেলে—সে বুঝতে পারে, “আমি ঈশ্বরের শরীর, তিনি আমার শরীরী; আমার কোনো স্বাধীন অস্তিত্ব নেই, আমি তাঁর ইচ্ছারই প্রকাশ।” এই উপলব্ধি জীবের চেতনার পরিপূর্ণ প্রস্ফুটন ঘটায়। সে তখন আর দেহ, মন বা ইন্দ্রিয়ের সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ থাকে না; তার জ্ঞান, আনন্দ ও শক্তি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। এই বিকাশের ফলেই জীব ঈশ্বরের সঙ্গে ঐক্য অনুভব করে—ইচ্ছার ঐক্য, প্রেমের ঐক্য, সেবার ঐক্য।
দর্শনগতভাবে রামানুজ বলেন—সঙ্কোচ ও বিকাশ জীবের স্বরূপে কোনো পরিবর্তন নয়, বরং জ্ঞানের প্রকাশের পরিবর্তন। জীবের প্রকৃতি চিরকালই ঈশ্বরের অংশ, কিন্তু বদ্ধ অবস্থায় তার এই সত্য উপলব্ধি সঙ্কুচিত থাকে। ঈশ্বরের কৃপা ও প্রপত্তির দ্বারা সেই সঙ্কোচ দূর হলে বিকাশ ঘটে। অর্থাৎ, ঈশ্বরই জীবের বিকাশের কারণ, এবং প্রপত্তি সেই বিকাশের মাধ্যম।
সঙ্কোচ হলো জীবের জ্ঞানের সীমাবদ্ধ অবস্থা, যখন সে নিজের ঈশ্বরনির্ভর প্রকৃতি ভুলে থাকে; আর বিকাশ হলো সেই জ্ঞানের পূর্ণ জাগরণ, যখন ঈশ্বরের করুণা ও প্রপত্তির মাধ্যমে সে নিজের প্রকৃত চৈতন্য-স্বভাব উপলব্ধি করে। এইভাবেই সঙ্কোচ থেকে বিকাশে উত্তীর্ণ হওয়াই জীবের মুক্তি—যেখানে ঈশ্বরই নিয়ামক, আর জীব তাঁর ইচ্ছায় একাত্ম হয়ে চিরসেবা ও চিরআনন্দে প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই ঐক্যের চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে কৈঙ্কর্য বা ঈশ্বরসেবায়। মুক্ত জীবের একমাত্র আনন্দ তখন ব্রহ্মের সেবা করা, তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ করা। সেবা-ই তখন প্রেম, আর প্রেমই তখন মুক্তি। জীব তখন নিজের অস্তিত্ব ভুলে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যেই বাঁচে—এটাই প্রপত্তির সিদ্ধি।
প্রপত্তির সিদ্ধি (Prapatti-siddhi) বা শরণাগতির পরিণতি হলো বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্তে মোক্ষ বা মুক্তির চূড়ান্ত উপলব্ধি—যেখানে জীবাত্মা ঈশ্বরের পূর্ণ কৃপায় তাঁর চিরসেবা ও চিরআনন্দে প্রতিষ্ঠিত হয়। রামানুজাচার্যের মতে, প্রপত্তি কেবল ভক্তির একটি অঙ্গ নয়, বরং মুক্তিলাভের স্বয়ংসম্পূর্ণ উপায় (svatantra-upāya)। এটি এমন এক আত্মসমর্পণ, যেখানে জীব ঈশ্বরের হাতে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে অর্পণ করে এবং তাঁর ইচ্ছাকেই নিজের একমাত্র গতি হিসেবে গ্রহণ করে। এই প্রপত্তির সিদ্ধিই জীবকে চিরকালের জন্য ঈশ্বরের সান্নিধ্যে স্থাপন করে।
প্রপত্তি অর্থাৎ শরণাগতির আভিধানিক অর্থ “নিজেকে ঈশ্বরের হাতে সঁপে দেওয়া”—এমনভাবে যে, জীবের কোনো নিজস্ব ইচ্ছা, কর্তৃত্ব বা প্রচেষ্টা অবশিষ্ট থাকে না। জীব তখন বিশ্বাস করে—“আমি কিছু করতে পারি না; তিনিই আমার রক্ষক, তিনিই আমার গতি।” রামানুজ এই আত্মসমর্পণকে ঈশ্বরপ্রাপ্তির সহজতম, সর্বজনগ্রাহ্য এবং কৃপাভিত্তিক পথ বলে স্বীকৃতি দেন। কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ বা ভক্তিযোগ যতই মহৎ হোক, তারা জীবের নিজ প্রচেষ্টার ওপর নির্ভরশীল; কিন্তু প্রপত্তি ঈশ্বরের করুণার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। এখানেই এর মহিমা।