অবিদ্যা-বিদ্যা: ৬৩



তবে উপনিষদ জানে, সকলের পক্ষে একমুহূর্তেই ত্যাগের পথ গ্রহণ করা সম্ভব নয়। অধিকাংশ মানুষই জীবনকে উপভোগ করতে চান—সন্তান, পরিবার, ধন, ইন্দ্রিয়সুখ—এইসবের মাধ্যমে তাঁরা জীবনের অর্থ খোঁজেন। ঈশোপনিষদের দ্বিতীয় মন্ত্র তাঁদের উদ্দেশে বলা হয়েছে—তুমি যদি দীর্ঘ জীবন কামনা করো, তা অন্যায় নয়; শতবর্ষ বাঁচার ইচ্ছাও পাপ নয়। কিন্তু সেই জীবনযাপন যেন শাস্ত্রসম্মত কর্মপথে হয়। কর্ম করো, কিন্তু কর্তব্য হিসেবে—আসক্তিহীনভাবে, ফল-লালসাহীনভাবে। এইভাবে কর্ম করতে করতে চিত্ত হবে শুদ্ধ, ইন্দ্রিয়সুখের আকাঙ্ক্ষা ক্ষীণ হবে, আর অন্তরে জাগবে আত্মজ্ঞানলাভের তীব্র তৃষ্ণা।


যখন মন এই অবস্থায় পৌঁছয়, তখন জীবনের সমস্ত কর্মফলও আর তাকে বাঁধতে পারে না। কারণ তখন কর্তা বা ভোগী হওয়ার ধারণাই মুছে যায়। সে প্রস্তুত হয় প্রকৃত ত্যাগের জন্য—ব্রহ্মজ্ঞানলাভের জন্য।


যাঁরা মুহূর্তে সব কিছু ত্যাগ করতে পারেন না, তাঁদের জন্য এই কর্মযোগই পথ। হতাশ হওয়ার কিছু নেই। ধীরে ধীরে এই কর্মই চিত্তকে প্রস্তুত করে, আসক্তিকে ক্ষয় করে, বোধকে পরিশুদ্ধ করে। তাই বলা হয়েছে—এই পথই অবশ্যম্ভাবী। তাড়াতাড়ি হোক বা বিলম্বে, প্রত্যেক সাধককেই একদিন এই ত্যাগের পথ গ্রহণ করতে হয়।


এইভাবে ঈশোপনিষদ শেখায়—জীবন ত্যাগে নয়, ত্যাগমুখী কর্মেই পরিশুদ্ধ হয়; আর সেই পরিশুদ্ধ কর্মের পরিণতি আত্মজ্ঞান, যা মানুষকে চিরশান্তির পথে নিয়ে যায়।


ঈশোপনিষদের প্রথম মন্ত্রের সাধারণ পাঠে মনে হতে পারে—ত্যাগেই সুখ, কারণ শ্লোকে বলা হচ্ছে “ত্যাগের মাধ্যমে ভোগ করো।” কিন্তু ঈশোপনিষদের দৃষ্টিতে “ত্যাগ” ও “ভোগ” একে অপরের পরিপূরক, বিপরীত নয়। “ত্যাগে সুখ নয়, ভোগেই প্রকৃত সুখ”—এই কথাটি এই উপনিষদের অন্তর্নিহিত দার্শনিক অবস্থানের সূক্ষ্ম প্রকাশ।


ভোগ মানে এখানে ইন্দ্রিয়সুখ নয়; বরং জগতের মধ্য দিয়ে আত্মার প্রকাশ। “ঈশা বাস্যমিদং সর্বম্”—জগতের প্রতিটি বস্তু ঈশ্বর দ্বারা আচ্ছাদিত। যখন এই চেতনা জাগে, তখন ভোগ মানে ঈশ্বরের অভিজ্ঞতা। বস্তু, ক্রিয়া, চিন্তা—সবই পরমের প্রতিফলন। তাই এই জগতকে উপভোগ করা মানে আত্মার রূপানুভব করা।


ত্যাগ (ত্যক্তেন) মানে দেহ, মন, অহং বা অধিকারবোধের ত্যাগ। উপনিষদ বলে—ঈশ্বরকে সর্বত্র জেনে, অধিকারবোধ ছেড়ে উপভোগ করো। এই ত্যাগের ফলে ভোগ বিশুদ্ধ হয়। অহংকার, আসক্তি, লোভ যখন বিলুপ্ত হয়, তখন জগতের প্রতিটি ভোগ আনন্দে পরিণত হয়। সেই আনন্দই ব্রহ্মানন্দ।


উপনিষদ শেখায় না যে, ত্যাগই একমাত্র পথ; বরং ত্যাগের মাধ্যমে ভোগকে বিশুদ্ধ করো—“তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা।” এই ভোগ হল আত্মভোগ—আত্মার মাধ্যমে আত্মার আস্বাদ। এতে ইন্দ্রিয়সুখ নয়, আত্মানন্দ লাভ হয়।


শংকরাচার্য ব্যাখ্যা করেন—“ত্যাগ” মানে নয় সম্পদ পরিত্যাগ; বরং “অধিকারবুদ্ধির ত্যাগ।” যখন মনে থাকে “এটা আমার,” তখন ভোগ বন্ধন হয়; কিন্তু যখন জেনে ভোগ করা হয় যে, “এটা ঈশ্বরের,” তখন সেই ভোগ মুক্তি।


রমণ মহর্ষি বলেন—“To enjoy without attachment is to see the Self everywhere.” ভোগ তখন অহংকারের নয়, সাক্ষীচেতনার; বস্তু পরিবর্তিত হলেও আনন্দ নষ্ট হয় না, কারণ তা আত্মাজাত।


স্বামী বিবেকানন্দ এই মন্ত্রের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন—“Enjoy through renunciation” অর্থাৎ, ঈশ্বরচেতনায় থাকলে ভোগই ত্যাগ হয়ে যায়। জগৎকে প্রত্যাখ্যান নয়, আত্মস্মৃতিতে জগতের আস্বাদই প্রকৃত সুখ।


শ্রীঅরবিন্দ বলেন—“True enjoyment is the Divine’s delight in manifestation.” অর্থাৎ, ব্রহ্ম যখন নিজেকে জগতে প্রকাশ করে, তখন প্রতিটি অভিজ্ঞতাই ঈশ্বরীয় ভোগ। ত্যাগ মানে, সেই ভোগে ব্যক্তিস্বার্থ মুছে ফেলা; তখন জীবনই উপনিষদীয় আনন্দের প্রতিমূর্তি।


এইভাবে ঈশোপনিষদের দর্শনে ভোগ মানে ত্যাগসঞ্জাত ঈশ্বরানুভব। যে জগতেই ঈশ্বরকে দেখেছে, তার জন্য ভোগ আর ইন্দ্রিয়সুখ নয়, ব্রহ্মসুখ। তাই বলা যায়—ত্যাগে নয়, ভোগেই প্রকৃত সুখ; তবে সেই ভোগ আত্মাসংলগ্ন, অহংশূন্য, ব্রহ্মময়।


বৈদান্তিক আচার্যগণের ব্যাখ্যায় নিষ্কাম কর্মের ভিন্নতা: জ্ঞান বনাম ভক্তি


ভারতীয় দর্শনে, বিশেষত বেদান্তের তিনটি প্রধান শাখায় (অদ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত, দ্বৈত) নিষ্কাম কর্মের গুরুত্ব স্বীকার করা হলেও, মোক্ষ সাধনে তার চূড়ান্ত স্থান নির্ধারণে মতভেদ দেখা যায়। এই আচার্যগণ নিষ্কাম কর্মের অনুশীলনকে আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য অপরিহার্য মনে করেছেন।


শঙ্করাচার্য (অদ্বৈত বেদান্ত)—নিষ্কাম কর্ম জ্ঞানের সাধন: শঙ্করাচার্য (অদ্বৈত বেদান্তের প্রধান প্রতিনিধি) মনে করেন যে, একমাত্র ব্রহ্মই সত্য, আর দৃশ্যমান জগৎ মায়া বা একটি মায়িক প্রতিভাস। কর্ম এই মায়িক জগতের অংশ, তাই কর্ম নিজে মোক্ষ দিতে পারে না। মোক্ষ হলো ব্রহ্মের সঙ্গে আত্মার একাত্মতা জ্ঞান দ্বারা উপলব্ধি করা।


শঙ্করের মতে, নিষ্কাম কর্মের প্রধান ভূমিকা হলো চিত্তশুদ্ধি বা মনকে পরিশুদ্ধ করা। এটি একটি অপরিহার্য প্রস্তুতি (জ্ঞান-সাধনম্‌), যা ব্যক্তিকে উচ্চতর জ্ঞান (জ্ঞানযোগ) লাভের জন্য উপযুক্ত করে তোলে। শঙ্কর তাই কর্ম যোগকে মোক্ষের প্রত্যক্ষ কারণ জ্ঞান যোগের তুলনায় গৌণ বা নিকৃষ্ট সাধন হিসেবে বিবেচনা করেন। তাঁর কাছে, কর্ম বন্ধনের কারণ, কিন্তু যখন তা নিষ্কামভাবে করা হয়, তখন তা আর বন্ধন সৃষ্টি না করে জ্ঞানলাভের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।


রামানুজাচার্যের বিশিষ্টাদ্বৈত দর্শন ঈশোপনিষদ ও গীতার “নিষ্কাম কর্ম” ধারণাকে এক অনন্য, ঈশ্বরমুখী অর্থে ব্যাখ্যা করে। তাঁর মতে, জগৎ ও জীব উভয়ই ঈশ্বরের শরীরস্বরূপ—“শরীর-শরীরী-ভাব” (śarīra–śarīrī–bhāva)—অর্থাৎ, পরমেশ্বরই এই জগতের অন্তঃস্থিত নিয়ন্তা, আর জগৎ তাঁর কার্যশক্তির বহিঃপ্রকাশ। এই দৃষ্টিতে, জগৎ মিথ্যা নয়, বরং সত্য—কারণ, এটি ঈশ্বরের সগুণ স্বরূপেরই বিকাশ।


রামানুজাচার্যের দর্শন, যা বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্ত (Viśiṣṭādvaita Vedānta) নামে পরিচিত, সেখানে ব্রহ্মের সগুণ স্বরূপ কেন্দ্রীয় স্থান অধিকার করে। তাঁর মতে, ব্রহ্ম কেবল সগুণ নন, বরং তিনিই একমাত্র পরম সত্য। রামানুজ নির্গুণ ব্রহ্মের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে ব্রহ্মকে গুণযুক্ত ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।


রামানুজের মতে, এই ব্রহ্মই শ্রীমান নারায়ণ বা বিষ্ণু—যিনি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, সর্বশক্তিমান এবং সর্বগুণপূর্ণ। তিনি নির্গুণ নন, বরং অসীম কল্যাণগুণে পরিপূর্ণ—জ্ঞান, আনন্দ, ঐশ্বর্য, বীর্য, শক্তি, তেজ ইত্যাদি অসংখ্য শুভগুণে তিনি স্বয়ং পরিপূর্ণ। এই ব্রহ্মই জগৎ ও জীবের অন্তর্নিহিত আত্মা বা শরীরী (Śarīrī), এবং জীব ও জগৎ তাঁর শরীর (Śarīra)।


রামানুজ ব্রহ্মকে তিনটি তত্ত্বের সমষ্টি হিসেবে ব্যাখ্যা করেন, যা একে অপরের থেকে অবিচ্ছেদ্য। এই তিনটি তত্ত্ব হলো—চিৎ (Cit), অচিৎ (Acit) ও ঈশ্বর (Īśvara)। চিৎ তত্ত্ব অর্থাৎ জীবাত্মারা ব্রহ্মের শরীরস্বরূপ; তাঁরা চেতনা-সম্পন্ন, কিন্তু ব্রহ্মের উপর নির্ভরশীল। অচিৎ তত্ত্ব হলো জড় জগৎ বা প্রকৃতি, যা পরিবর্তনশীল এবং ব্রহ্মেরই শক্তি। আর ঈশ্বর তত্ত্ব হলো সেই অন্তর্নিহিত আত্মা বা নিয়ন্তা, যিনি চিৎ ও অচিৎ উভয়কে ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করেন। এই তিনটি মিলেই “চিদচিদ্বিশিষ্ট ব্রহ্ম”—অর্থাৎ, গুণবিশিষ্ট এক সত্তা গঠন করে। তাই তাঁর দর্শনের নাম “বিশিষ্ট-অদ্বৈত”: এক তথা অদ্বৈত, কিন্তু বিশেষণে-যুক্ত।


এই সম্পর্ককে রামানুজ শরীর–শরীরী–ভাব (śarīra–śarīrī–bhāva) দ্বারা ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন আত্মা দেহে অবস্থান করে এবং দেহকে পরিচালনা করে, তেমনি ঈশ্বর সমগ্র সৃষ্টি ও জীবের অন্তরে অবস্থান করেন ও তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করেন। জীব ও জগৎ ঈশ্বরের শরীরস্বরূপ, আর ঈশ্বর তাঁদের শরীরী বা অধিষ্ঠাতা। এই সম্পর্ক এমন এক ঐক্য প্রকাশ করে, যেখানে ভিন্নতাও আছে—জীব ও জড় ঈশ্বরের দেহ হলেও তাঁরা ঈশ্বর স্বয়ং নন, কিন্তু ঈশ্বর ছাড়া তাঁদের অস্তিত্বও অসম্ভব।


রামানুজ মায়াকে মিথ্যা বা অবাস্তব মনে করেননি। তাঁর মতে, মায়া হলো ঈশ্বরেরই এক শক্তি—যার নাম প্রকৃতি—যার মাধ্যমে তিনি এই জগৎ সৃষ্টি ও পরিচালনা করেন। তাই জগৎ বাস্তব, কারণ এটি ঈশ্বরেরই দেহরূপ প্রকাশ। এইভাবে তিনি অদ্বৈতের “জগৎ মিথ্যা” ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে বলেন যে, ঈশ্বরের শক্তি কখনোই ভ্রম হতে পারে না; তা বাস্তব, শাশ্বত ও ঈশ্বরনির্ভর।


রামানুজের মতে, মুক্তি বা মোক্ষ হলো ঈশ্বরের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক জানা এবং ঈশ্বরের সেবায় আত্মসমর্পিত হওয়া। মুক্ত আত্মা ঈশ্বরের নিত্য সেবায় নিযুক্ত থাকে, তাঁর ঐশ্বর্য ও আনন্দ ভাগ করে নেয়, কিন্তু নিজের স্বতন্ত্র সত্তা হারায় না। অর্থাৎ, মুক্তি মানে ব্রহ্মে বিলীন হওয়া নয়, বরং ঈশ্বরের চিরসেবার মাধ্যমে ঈশ্বর-সান্নিধ্যে চিরআনন্দলাভ।


এভাবে রামানুজের দর্শনে ব্রহ্ম হলেন সর্বগুণসম্পন্ন ও ব্যক্তিত্বময় শ্রীমান নারায়ণ, যিনি একই সঙ্গে সৃষ্টিকর্তা, সংরক্ষক ও অন্তর্যামী। জীব ও জগৎ তাঁর দেহ, তিনি তাঁদের অন্তর্নিহিত আত্মা। জগৎ বাস্তব, মায়া ঈশ্বরের শক্তি, আর মুক্তি ঈশ্বরসেবার মাধ্যমে ঈশ্বরের চিরসান্নিধ্যে প্রতিষ্ঠা। এই তত্ত্বের মধ্যেই বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্ত ঈশ্বর, জীব ও জগতের অবিচ্ছেদ্য ও অন্তর্নিহিত ঐক্যকে প্রকাশ করেছে।


শরীর–শরীরী–ভাব (śarīra–śarīrī–bhāva) হলো এক গভীর ও মৌলিক দার্শনিক ধারণা, যা প্রধানত বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্তে রামানুজাচার্যের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। এই তত্ত্ব ঈশ্বর, জীব ও জগতের মধ্যে এমন এক সম্পর্ক নির্দেশ করে, যেখানে ঈশ্বর হলেন সর্বব্যাপী অন্তর্নিহিত আত্মা, আর জীব ও জড়বিশ্ব তাঁর শরীরস্বরূপ।


শরীর (śarīra) মানে দেহ বা অবলম্বন—যা অন্য কোনো সত্তার দ্বারা ধারণ ও নিয়ন্ত্রিত হয়। শরীরী (śarīrī) মানে সেই অন্তর্নিহিত সত্তা বা নিয়ন্ত্রক—যিনি শরীরকে ধারণ, সংরক্ষণ ও পরিচালনা করেন। ভাব (bhāva) মানে সম্পর্ক বা অবস্থান। তাই, śarīra–śarīrī–bhāva বলতে বোঝায় “ধারণকারী ও ধারণীয়”-এর সম্পর্ক—অর্থাৎ, “দেহ ও অধিষ্ঠাতা”-এর এক অনন্য ঐক্য, যেখানে দেহের অস্তিত্ব সম্পূর্ণরূপে অধিষ্ঠাতার ওপর নির্ভরশীল।


রামানুজাচার্য ব্রহ্মকে একমাত্র সত্য, সর্বব্যাপী ও সর্বনিয়ন্তা ঈশ্বর হিসেবে স্বীকার করেন। জীব (প্রাণী) ও জগৎ (প্রকৃতি)—উভয়ই তাঁর দেহ, এবং ঈশ্বর সেই দেহের শরীরী। তিনি বলেন—“শরীর-শরীরী-ভাবেন ব্রহ্ম-জীব-প্রকৃতীনাম্ ঐক্যম্” অর্থাৎ, ব্রহ্ম, জীব ও প্রকৃতির ঐক্য এই শরীর–শরীরী সম্পর্কের মধ্যেই নিহিত।


এই বাক্যটি রামানুজের বিশিষ্ট-অদ্বৈত (Qualified Non-duality) বেদান্তের মূল সিদ্ধান্তকে সংক্ষেপে প্রকাশ করে—"শরীর ও শরীরীর সম্পর্কের মাধ্যমে ব্রহ্ম, জীব ও প্রকৃতির একত্ব।" এটি ঘোষণা করে যে, ব্রহ্ম, জীব (চিৎ-তত্ত্ব) এবং প্রকৃতি (অচিৎ-তত্ত্ব)—এই তিনটি উপাদান একটি শরীর-শরীরী সম্পর্ক দ্বারা অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত হয়ে এক সত্তা গঠন করে।


শরীরী (Śarīrī): ইনি হলেন ব্রহ্ম বা ঈশ্বর (শ্রীমান নারায়ণ), যিনি হলেন আত্মা বা নিয়ন্তা।

শরীর (Śarīra): জীবাত্মা (চিৎ-তত্ত্ব) এবং জড় প্রকৃতি (অচিৎ-তত্ত্ব) উভয়ই ব্রহ্মের শরীর।

ঐক্য (Aikyam): যদিও জীব ও প্রকৃতি ব্রহ্মের থেকে গুণগতভাবে ভিন্ন (যেমন শরীর আত্মা থেকে ভিন্ন), তবুও তারা ব্রহ্মের অবিচ্ছেদ্য বিশেষণ বা অংশ। এই অংশগুলি ব্রহ্মের বাইরে থাকতে পারে না, তাই ব্রহ্ম যখন জীব ও প্রকৃতি সহ বিরাজ করেন, তখন এই সমগ্রতাটিকে এক সত্তা হিসেবে গণ্য করা হয়।


এই সূত্র প্রমাণ করে যে, রামানুজের মতে একত্ব (অদ্বৈত) বিদ্যমান, কিন্তু সেই একত্বটি বিশিষ্ট (বিশেষণযুক্ত)। এখানে এই ঐক্য অদ্বৈতবাদের মতো অভেদ নয়, আবার দ্বৈতবাদের মতো সম্পূর্ণ ভেদও নয়। এটি বিশিষ্ট অভেদ—যেখানে ঈশ্বর এক, কিন্তু তাঁর মধ্যে জীব ও জড়বিশ্ব অন্তর্ভুক্ত হয়ে তাঁকে বিশিষ্ট বা গুণবিশিষ্ট করে তোলে। যেমন আত্মা দেহে বিরাজমান থেকে তাকে ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করে, তেমনি ঈশ্বর সমগ্র সৃষ্টি ও জীবমণ্ডলকে ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করেন।

দেহ আত্মা ছাড়া কিছুই করতে পারে না—তেমনি জীব ও জগৎ ঈশ্বর ছাড়া অচল। আবার আত্মা দেহের মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়—তেমনি ঈশ্বরও সৃষ্টির মাধ্যমে প্রকাশ পান। অতএব, ঈশ্বর ও সৃষ্টি অভিন্নভাবে সংযুক্ত—ঈশ্বর হলেন অন্তর্নিহিত সত্তা (শরীরী), আর জগৎ ও জীব তাঁর দেহ (শরীর)।