অবিদ্যা-বিদ্যা: ৬১


স্বামী চিন্ময়ানন্দ বলেন—এই দুই শ্লোকই কর্মযোগের পরম ফল প্রকাশ করে। “By dedicating all actions to the Lord and remaining in constant awareness of the Self, one transcends all limitations.” তাঁর মতে, বুদ্ধিযোগ এখানে মানে আত্মজ্ঞানসমন্বিত কর্মবোধ—যা কর্মকে জ্ঞানরূপে রূপান্তরিত করে।

শ্রীঅরবিন্দ বলেন—এ অবস্থায় ব্যক্তি আর কর্মের অধিকারী নয়; চেতনা যখন ঈশ্বরে কেন্দ্রীভূত, তখন কর্ম হয় ঈশ্বরের ইচ্ছার প্রকাশ। মৎ‌প্রসাদাদবাপ্নোতি—মুক্তি তখন কৃপা, অর্জন নয়; কারণ কর্ম ও কর্মফল দুই-ই ব্রহ্মে বিলীন।

ওশো ব্যাখ্যা করেন—“To surrender all acts in consciousness is to dissolve the ego completely.” চেতসা সন্ন্যাস্য মানে কর্তা-ভাবের মৃত্যু, সাক্ষী-চেতনার উদ্ভব। যিনি কর্ম করেন, কিন্তু নিজের স্বার্থে নয়, সেই মুক্ত।

এইভাবে, গীতার এই দুই শ্লোক দেখায়—“অধ্যাত্মচেতসা”-য় স্থিত কর্মই ধীরে ধীরে চেতসা সন্ন্যাস্য-র দিকে নিয়ে যায়, আর সেই চেতনা-সমর্পণই জন্ম-মৃত্যুর সীমা অতিক্রম করে শাশ্বত পদমব্যয়ম্—পরম মুক্তি—লাভ করায়।

এই তিনটি শ্লোক—য এনং বেত্তি হন্তারং যশ্চৈনং মন্যতে হতম্‌... ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে... বেদাবিনাশিনং নিত্যং... (গীতা ২.১৯–২.২১)—গীতার অন্যতম দার্শনিক হৃদয়, যেখানে কৃষ্ণ অর্জুনের দ্বিধা ও ভয়কে ভাঙতে আত্মার অজন্মা, অমৃত ও অদ্বৈত স্বরূপ ব্যাখ্যা করছেন।

অর্জুনের বিভ্রান্তি ছিল—“আমি আমার গুরুকে হত্যা করব?” কৃষ্ণ উত্তরে বললেন: “যে আত্মাকে হত্যাকারী বা নিহত বলে ভাবে, সে কিছুই জানে না; আত্মা জন্মায় না, মরে না, দেহ ধ্বংস হলেও ধ্বংস হয় না।”

শ্লোক ২.১৯:
য এনং বেত্তি হন্তারং যশ্চৈনং মন্যতে হতম্‌।
উভৌ তৌ ন বিজানীতো নায়ং হন্তি ন হন্যতে।।
অর্থাৎ, আত্মা কাউকে হত্যা করে না, আত্মাকেও কেউ হত্যা করতে পারে না। হত্যা-হত্যাকারিতা শরীরের ধর্ম, আত্মার নয়। আত্মা শুদ্ধ সাক্ষী (সাক্ষিচৈতন্য)।

“য এনম্ বেত্তি হন্তারম্ যঃ চ এনম্ মন্যতে হতম্:”-এর ভাবার্থ: যে-ব্যক্তি এই আত্মাকে (এনম্) হত্যাকারী (হন্তারম্) বলে মনে করেন (বেত্তি), এবং যে-ব্যক্তি এই আত্মাকে হত বা মৃত (হতম্) বলে মনে করেন (মন্যতে)।

“উভৌ তৌ ন বিজানীতঃ না অয়ম্ হন্তি ন হন্যতে”-এর ভাবার্থ: সেই উভয় ব্যক্তিই (উভৌ তৌ) প্রকৃত সত্য জানেন না (ন বিজানীতঃ)। কারণ, এই আত্মা (অয়ম্) হত্যাও করেন না (ন হন্তি) এবং হতও হন না (ন হন্যতে)।

এই শ্লোকটি আত্মার নিষ্ক্রিয়তা এবং অবিনশ্বরতা—এই দুটি নীতিকে একসঙ্গে প্রতিষ্ঠা করে। আত্মার অকর্তৃত্ব বোঝাতে বলা হচ্ছে, আত্মা হত্যা করে না (ন হন্তি)। কারণ, আত্মা হলেন শুদ্ধ চৈতন্য বা সাক্ষী (দ্রষ্টা)। সমস্ত কর্ম প্রকৃতির গুণ দ্বারা হয়, আত্মা সেই কর্মের কর্তা নন। আত্মা অবিনাশী। আত্মা হত হন না (ন হন্যতে)। কারণ, আত্মা নিত্য, শাশ্বত এবং অক্ষয়। তাঁকে কোনোভাবেই বিনাশ করা যায় না (যেমনটি পরের শ্লোকগুলিতে বলা হয়েছে)।

অর্জুন এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অন্যান্যরা মনে করছেন যে, তাঁরা হয় অন্যদের হত্যা করবেন, নতুবা নিজেরাই নিহত হবেন। শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, এটি অজ্ঞান বা ভ্রম। যারা নিজেকে কর্তা বা ভোগী মনে করে, তারাই এই ভ্রান্ত ধারণায় আবদ্ধ থাকে। এই শ্লোকটি শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক অর্জুনকে দেওয়া প্রথম দার্শনিক শিক্ষা—আত্মা নিত্য, অপরিবর্তনীয় এবং কর্মের বন্ধন থেকে মুক্ত।

আদি শঙ্করাচার্য বলেন, “Ātman is akartā and abhoktā—non-doer and non-enjoyer. Action belongs to Prakṛti, not to the Self.” কর্ম প্রকৃতির গুণে ঘটে; আত্মা তার সাক্ষী।

রমণ মহর্ষি বলেন: “The Self neither kills nor is killed; it is the screen on which the movie of life plays.” অর্থাৎ, আত্মা নিঃস্পৃহ দর্শক—জীবনের নাটক চলেছে, কিন্তু আত্মা তাতে অচল।

শ্লোক ২.২০:
ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্‌ নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতো’য়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।।
অর্থাৎ, আত্মা কখনও জন্মায় না, কখনও মরে না। দেহ আসে যায়, কিন্তু আত্মা নয়।

তিনি অজ (unborn)—কারণ তিনি কখনও উৎপন্ন হননি; নিত্য (eternal)—তিনি সর্বদা একই; শাশ্বত (permanent)—তিনি কালের স্রোতে অপরিবর্তনীয়; পুরাণ (primordial)—চিরন্তন অস্তিত্ব।

“ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্”-এর ভাবার্থ: এই আত্মা কখনোই জন্মায় না (ন জায়তে কদাচিন্) এবং কখনোই মরেও না (ন ম্রিয়তে বা কদাচিন্)।

“ন অয়ম্ ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ”-এর ভাবার্থ: এই আত্মা (অয়ম্) একবার হয়ে আবার হয় না (ন ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ)। অর্থাৎ, তাঁর অস্তিত্বের শুরু বা শেষ নেই। আত্মা এমন সত্তা নয়, যা পূর্বে ছিল না কিন্তু এখন সৃষ্টি হয়েছে।

“অজো নিত্যঃ শাশ্বতোঽয়ং পুরাণঃ”-এর ভাবার্থ: এই আত্মা অজ (জন্মরহিত), নিত্য (চিরন্তন), শাশ্বত (শাশ্বতিক) এবং পুরাণ (সদা পুরাতন বা অনাদি)। এই শব্দগুলি আত্মার ত্রিকালাতীত এবং অপরিবর্তনশীল স্বরূপকে প্রতিষ্ঠা করে।

“ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে”-এর ভাবার্থ: দেহ নিহত হলেও (হন্যমানে শরীরে), এই আত্মা নিহত হন না (ন হন্যতে)। এটি আত্মার দেহ থেকে ভিন্নতা প্রমাণ করে। আত্মা হলেন দ্রষ্টা বা সাক্ষী; দেহ বিনাশী হলেও আত্মা অবিনাশী।

এই শ্লোকটি অদ্বৈত বেদান্তের এবং গীতার আত্মতত্ত্বের মূল ভিত্তি। এটি নিশ্চিত করে যে, আত্মা হলেন জন্ম-মৃত্যুর চক্রের ঊর্ধ্বে স্থিত একমাত্র পরম সত্তা (ব্রহ্ম), যিনি কাল বা স্থলের কোনো পরিবর্তনের অধীন নন।

শঙ্করাচার্য বলেন, “Ātman never comes into being, for It ever is. Birth and death belong to the body, not to the Self.”

স্বামী বিবেকানন্দ এই শ্লোক ব্যাখ্যা করে বলেন, “If you are the body, you are bound to die; if you are the soul, death is only a change of garment.” দেহ পোশাক, আত্মা পরিধানকারী। পোশাক ক্ষয় হয়, আত্মা নয়।

শ্রী অরবিন্দ লেখেন (Essays on the Gita), “This is the beginning of spiritual realism; the discovery that being is not becoming.” অর্থাৎ, আত্মা ‘হওয়া’-র জগতে নয়, ‘থাকা’-র জগতে—সে সর্বদা বর্তমান।

শ্লোক ২.২১:
বেদাবিনাশিনং নিত্যং য এনমজমব্যয়ম্‌।
কথং স পুরুষঃ পার্থ কং ঘাতয়তি হন্তি কম্‌।।
অর্থাৎ, যে জানে, আত্মা অবিনাশী, নিত্য, অজ, অব্যয়—সে কাকে হত্যা করবে? কাকে হত্যা হয়েছে বলবে?

এটি দ্বিতীয় অধ্যায় (সাংখ্যযোগ)-এর অংশ এবং পূর্ববর্তী শ্লোকগুলির (২.১৯-২০) ধারাবাহিকতায় আত্মার স্বরূপ ব্যাখ্যা করে।

“বেদাবিনাশিনং নিত্যং য এনমজমব্যয়ম্”-এর ভাবার্থ: যিনি এই আত্মাকে (এনম্) অবিনাশী (অবিনাশিনম্), নিত্য (চিরন্তন), অজ (জন্মনিরহিত) এবং অব্যয় (ক্ষয়হীন) বলে জানেন (বেদা)।

“কথং স পুরুষঃ পার্থ কং ঘাতয়তি হন্তি কম্”-এর ভাবার্থ: হে পার্থ (অর্জুন)! সেই পুরুষ (জ্ঞানী ব্যক্তি) কাকে (কম্) হত্যা করান (ঘাতয়তি), আর কাকেই বা হত্যা করেন (হন্তি কম্)?

এই শ্লোকটি জ্ঞানীর কর্ম এবং কর্তৃত্বের অহংকার ত্যাগ (Non-doership) নীতির চূড়ান্ত প্রমাণ। জ্ঞানের পরিণতি—যিনি আত্মার অবিনশ্বর স্বরূপ সম্পর্কে নিশ্চিত, তাঁর পক্ষে হত্যা করা বা হত্যার কারণ হওয়া—এই ধরনের কর্তৃত্বের অহংকার রাখা সম্ভব নয়। জ্ঞানী ব্যক্তি জানেন যে, আত্মা অক্ষয়। তাই শরীর নিহত হলেও আত্মা বিনাশী হন না। এই জ্ঞানে স্থিত হয়ে তিনি সাক্ষী বা দ্রষ্টা রূপে কর্ম করেন (সাক্ষীভাব)।

যখন দ্বৈতভাব থাকে না, নিবৃত্ত হয় এবং আত্মা ও ব্রহ্মের অভেদ জ্ঞান লাভ হয়, তখন 'আমি কর্তা' এবং 'অন্যকে হত্যা করছি'—এই দু-ধরনের ভ্রান্ত ধারণা (অধ্যাস) দূর হয়ে যায়। এই শ্লোকটি কর্মযোগের মূল সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে—যে-ব্যক্তি আত্মার নিত্যতা জানেন, তাঁর কর্ম বন্ধন সৃষ্টি করতে পারে না, কারণ তাঁর মন থেকে কর্তৃত্বের অহংকার সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়েছে।

রমণ মহর্ষি বলেন, “When you know the Self as imperishable, there remains no ‘you’ to kill or ‘others’ to be killed.” আত্মজ্ঞান হলে কর্তা, কর্ম, ভোক্তা—এই তিন ভেদ (ত্রিপুটি) লুপ্ত হয়।

বিবেকানন্দ বলেন, “Freedom comes when you realize that you were never bound. Death and birth are mere scenes in the drama.” মুক্তি আসে, যখন বোঝা যায়—আমরা কোনোদিনই বন্ধনগ্রস্ত ছিলাম না। জন্ম-মৃত্যু কেবল নাট্যমঞ্চের দৃশ্য।

স্বামী চিন্ময়ানন্দ ব্যাখ্যা করেন, “The man who knows the indestructible Self sees no killing and no killer; he performs duty with detachment.” জ্ঞানী ব্যক্তি জানেন—কর্ম শরীরের, আত্মা কেবল সাক্ষী; তাই কর্ম করেও তিনি অনাসক্ত।

আত্মা ও দেহের ভেদ—দেহ ক্ষণস্থায়ী, আত্মা চিরন্তন। অহংকার-বিলোপ—“আমি হত্যা করব”, এই ভাবটাই অবিদ্যা। আত্মা কর্তা নয়। কর্মের প্রকৃতি—কর্ম প্রকৃতির স্তরে ঘটে; আত্মা তাতে অচল। জ্ঞানই মুক্তি—আত্মাকে অবিনশ্বর জানলে পুণ্য-পাপ, সুখ-দুঃখ, জন্ম-মৃত্যু—সব বিলীন হয়।

শ্রী অরবিন্দ বলেন, “The Gita’s secret is not the rejection of action, but the transformation of the sense of the doer.”

স্বামী রঙ্গনাথানন্দ বলেন, “These three verses mark the dawn of immortality in human consciousness—the discovery that man is not his body, but the deathless spirit within.”

আত্মা অজন্মা, অমৃত, অবিনাশী। দেহ বদলায়, আত্মা নয়। কর্তা-বোধ মুছে গেলে হত্যা, মৃত্যু, শোক—সব মায়া বিলীন হয়। আত্মাকে জানলে যুদ্ধেও শান্তি, কর্মেও মুক্তি, জীবনেও অমরত্ব। রমণ মহর্ষির কথায়—“Know the Self, and the battle ceases even in the battlefield.” এই তিনটি শ্লোক তাই কেবল যুদ্ধক্ষেত্রের বক্তব্য নয়—এগুলি চেতনার যুদ্ধক্ষেত্রে আত্মার জাগরণ।

সকাম কর্ম ও নিষ্কাম কর্মের তুলনামূলক বিশ্লেষণ: নিষ্কাম কর্মের মূল ধারণাটি সকাম কর্ম (ফলাকাঙ্ক্ষাযুক্ত কর্ম) থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই পার্থক্য কেবল নৈতিকতার নয়, বরং মানসিক অবস্থারও।

প্রেরণা ও উদ্দেশ্যের পার্থক্য: সকাম কর্মের প্রধান প্রেরণা হলো ব্যক্তিগত লাভ, ভোগবাসনা এবং ফল লাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষা (ফলাকাঙ্ক্ষা)। অন্যদিকে, নিষ্কাম কর্ম কর্তব্যবোধ, চিত্তশুদ্ধি এবং ঈশ্বর প্রীতির মতো অভ্যন্তরীণ প্রেরণা দ্বারা চালিত হয়।

অহমিকাবোধ ও মালিকানা: সকাম কর্মে 'আমি কর্তা' এবং ফলের মালিকানার অর্থাৎ কর্তৃত্বাভিমান বিদ্যমান থাকে। নিষ্কাম কর্মী কর্তৃত্বাভিমান ত্যাগ করেন এবং কর্মকে যজ্ঞ বা ঈশ্বরের সেবা হিসেবে দেখে 'আমি তাঁর ভৃত্য-স্বরূপ কর্ম করছি', এই জ্ঞানে কর্ম করেন।

বন্ধন ও ফল: সকাম কর্ম হলো সংসার-বন্ধন ও পুনর্জন্মের হেতু। সকাম কর্মের ফলভোগ একজীবনে শেষ না হলে জীবকে পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে হয়, ফলে জীব সংসারের দুঃখকষ্টের অধীন হয়। পক্ষান্তরে, নিষ্কাম কর্ম কর্মের বন্ধন থেকে মুক্তি দেয় এবং মোক্ষলাভের সহায়ক হয়। নিষ্কাম কর্মের ফলভোগ করতে হয় না।

মানসিক অবস্থা: সকাম কর্মে ব্যক্তি লাভ-অলাভে চঞ্চলতা অনুভব করে, যার ফলে রাগ, দ্বেষ, মোহ সৃষ্টি হয়। এর বিপরীতে, নিষ্কাম কর্ম সিদ্ধি-অসিদ্ধিতে সমত্বভাব (যোগ) এবং স্থির বুদ্ধির জন্ম দেয়। এই নিষ্কাম নীতিতে কর্ম সম্পাদনে স্বার্থশূন্য আসক্তিহীনতার বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে।