ভগবদ্গীতার (৩.১৯) এই শ্লোক—
“তস্মাদসক্তঃ সততং কার্যং কর্ম সমাচর।
অসক্তো হ্যাচরন্ কর্ম পরমাপ্নোতি পুরুষঃ।।”
—কর্মযোগের মূল মর্মকে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে।
এখানে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন, কর্মপরিত্যাগ নয়, বরং আসক্তির পরিত্যাগই মুক্তির পথ। মানুষ কর্ম না করে থাকতে পারে না; তাই গীতা নির্দেশ দেয়—কর্ম করো, কিন্তু তার ফলের প্রতি আসক্ত হয়ো না।
“তস্মাৎ অসক্তঃ সততং কার্যং কর্ম সমাচর”—অর্থাৎ, হে অর্জুন, যেহেতু কর্ম অনিবার্য এবং জীবনের স্বাভাবিক ধর্ম, তাই তোমার উচিত সর্বদা কর্তব্যকর্ম সম্পাদন করা, কিন্তু ফলের প্রত্যাশা বা ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্ত থেকে। এখানে “সততম্” শব্দটি দেখায় যে, অনাসক্তি কোনো সাময়িক মানসিক অবস্থা নয়; এটি জীবনের এক অবিচ্ছিন্ন সাধনা, এক অভ্যন্তরীণ মনোভাব, যেখানে কর্ম ঈশ্বরার্পণ হিসেবে সম্পন্ন হয়।
“অসক্তো হ্যাচরন্ কর্ম পরমাপ্নোতি পুরুষঃ”—অর্থাৎ, যে-ব্যক্তি আসক্তিহীনভাবে কর্ম করে, সে পরম অবস্থায়—অর্থাৎ মোক্ষ বা ব্রহ্মজ্ঞান—লাভ করে। কারণ কর্ম নিজে মুক্তির বাধা নয়; আসক্তিই বাধা। আসক্তি মানে ফলের প্রত্যাশা, কর্তৃত্ববোধ, “আমি করছি”—এই অহংকার। যখন কর্ম এই অহংকার থেকে মুক্ত হয়, তখন তা নিষ্কাম কর্মে রূপান্তরিত হয়—যা মনকে বিশুদ্ধ করে এবং জ্ঞানপ্রাপ্তির উপযোগী করে তোলে।
এইভাবেই গীতা কর্ম এবং জ্ঞানের মধ্যে সেতুবন্ধন স্থাপন করে। গীতা বলে, কর্ম নিজে বন্ধনের কারণ নয়, বরং “অসক্তি”—এই অভ্যন্তরীণ মনোভাবই মুক্তির মূল চাবিকাঠি। তাই কর্ম ত্যাগ নয়, কর্মে অনাসক্তি—এই শিক্ষাই কর্মযোগের সার।
শঙ্করাচার্য তাঁর ভাষ্যে এই শ্লোক ব্যাখ্যা করতে বলেছেন, “অসক্তঃ সন্ ব্রহ্মবিত্ কর্ম আচারন্ ন লিপ্যতে।”—যিনি ব্রহ্মজ্ঞ, তিনি আসক্তিহীনভাবে কর্ম করলেও তাতে লিপ্ত হন না। কর্ম তাঁর কাছে আর ব্যক্তিগত চেষ্টার ফল নয়, বরং এক স্বতঃস্ফূর্ত ঈশ্বরার্পণ।
এই শিক্ষার ধারাকে পরবর্তীকালে রমণ মহর্ষি ও স্বামী বিবেকানন্দ আরও প্রসারিত করেছেন। রমণ মহর্ষি বলেন, “Action performed without attachment purifies the mind and reveals the Self.” আর স্বামী বিবেকানন্দ ব্যাখ্যা করেন, “It is not the work that binds us, but the desire for its fruits. Work, but never be attached.”
এই শ্লোকের মূল ভাব হলো—কর্ম করো, কিন্তু নিজেকে কর্তা ভেবো না; ফল কামনা কোরো না। এই অনাসক্ত কর্মই “পরম” অর্থাৎ চূড়ান্ত মুক্তির প্রস্তুতি। জ্ঞান ও মুক্তি তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশিত হয়, কারণ জ্ঞান সবসময় ছিল—আসক্তিই কেবল সেটিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।
ভগবদ্গীতার (২.৪৮) শ্লোক—
“যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা ধনঞ্জয়।
সিদ্ধ্যসিদ্ধ্যোঃ সমো ভূত্বা সমত্বং যোগ উচ্যতে।।”
—গীতার সমগ্র কর্মযোগ দর্শনের অন্তর্নিহিত মনস্তত্ত্বের কেন্দ্রবিন্দু। এখানে শ্রীকৃষ্ণ নিষ্কাম কর্মের অভ্যন্তরীণ ভিত্তি এবং যোগের প্রকৃত সংজ্ঞা উভয়কেই একত্রে প্রকাশ করেছেন।
নিষ্কাম কর্মের অভ্যন্তরীণ ভিত্তি হলো সমত্ববুদ্ধি (Equanimity)। নিষ্কাম কর্ম কেবল বাহ্যত ফলের আকাঙ্ক্ষাহীন কর্ম নয়; এর অন্তর্নিহিত মানসিক অবস্থা হলো সমত্ববুদ্ধি—অর্থাৎ, সাফল্য বা ব্যর্থতা, লাভ বা অলাভ, সুখ বা দুঃখ—সব অবস্থায় মনকে সমভাবে স্থির রাখা।
গীতায় বলা হয়েছে, “যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি”—অর্থাৎ, কর্ম করো, কিন্তু যোগে স্থিত হয়ে, আত্মায় অবিচল থেকে। এখানে “যোগস্থ” শব্দটি বোঝায় আত্মার স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত থাকা, বা ঈশ্বরচেতনার সঙ্গে একাত্ম থাকা। এমন অবস্থায় কর্ম কেবল কর্তব্য হিসেবে সম্পন্ন হয়, কোনো ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা বা ফলের লোভ থেকে নয়।
“সঙ্গং ত্যক্ত্বা”—অর্থাৎ, আসক্তি ত্যাগ করো। এখানে “সঙ্গ” মানে ফল, ভোগ বা অর্জনের প্রতি মানসিক আসক্তি। ফলের সঙ্গে মন জুড়ে দিলে কর্ম বন্ধনের কারণ হয়; কিন্তু সেই আসক্তি ত্যাগ করলে কর্ম মুক্তির মাধ্যম হয়ে ওঠে।
যোগের সংজ্ঞা—সমত্বং যোগ উচ্যতে: গীতা বলে—“সিদ্ধ্যসিদ্ধ্যোঃ সমো ভূত্বা সমত্বং যোগ উচ্যতে”—অর্থাৎ, সাফল্য ও ব্যর্থতা—উভয় অবস্থায় যে-ব্যক্তি সমানভাবে স্থির থাকে, তার মন যে-অবস্থায় নির্বিকার, সেটিই যোগ। এই সংজ্ঞা দ্বারা শ্রীকৃষ্ণ যোগকে কোনো আচারিক প্রণালী নয়, বরং মানসিক স্থিতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। যোগ মানে না দেহের আসন, না ধ্যানের কোনো কৌশল; যোগ মানে—মন যখন দোলাচলহীন, যখন বাইরের ঘটনা মনকে না নাড়িয়ে, চেতনা নিজের আত্ম-স্বরূপে স্থিত থাকে।
শঙ্করাচার্য তাঁর ভাষ্যে ব্যাখ্যা করেছেন—“সমত্বং যোগ ইত্যুক্তম্—সমচিত্ততা হি যোগঃ।” অর্থাৎ, যোগ মানে হলো সমচিত্ততা, এমন মানসিক ভারসাম্য যা কর্মের ফলের ওঠা-নামায় স্পর্শিত হয় না।
সমত্ববুদ্ধি মানে কোনো জড়তা নয় বা ফলের প্রতি উদাসীনতা নয়; বরং ফলের প্রতিক্রিয়াহীনতা। একজন যোগী কর্ম করেন শতভাগ মনোযোগ দিয়ে, কিন্তু তাঁর মন থাকে ফল থেকে মুক্ত। তিনি কর্মের মাধ্যমে আত্মাকে প্রকাশ করেন, কিন্তু সেই কর্মের দ্বারা নিজের মূল্য নির্ধারণ করেন না। এভাবে সমত্ববুদ্ধি নিষ্কাম কর্মের মানসিক ভিত্তি হয়ে ওঠে। যতক্ষণ পর্যন্ত “সাফল্যে আনন্দ” ও “ব্যর্থতায় বিষাদ” টিকে থাকে, ততক্ষণ মন দাসত্বে আবদ্ধ। কিন্তু যখন উভয় অবস্থায় মন সমান, তখনই মানুষ মুক্ত।
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন—“Yoga is skill in action—it is the art of keeping the mind even while acting.” অর্থাৎ, যোগ হলো এমন কর্মদক্ষতা যেখানে মন নির্বিকার থাকে—কর্মের মাঝেও স্থিরতা বজায় থাকে। রমণ মহর্ষি বলেন—“True yoga is to perform action without the sense of doership.” অর্থাৎ, যোগ মানে সেই অবস্থান, যেখানে “আমি করছি”—এই অহংকার বিলীন হয়ে যায়, কর্ম হয়ে ওঠে চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহ।
এই শ্লোক নিষ্কাম কর্মের দুটি স্তম্ভ স্থাপন করে—
আসক্তি-ত্যাগ: কর্মের ফলের প্রতি আসক্তি থেকে মুক্তি।
সমত্ববুদ্ধি: সাফল্য-ব্যর্থতার উর্ধ্বে মানসিক সমতা।
এই দুই একত্রে যোগকে পরিণত করে মানসিক স্থিতির বিজ্ঞানে। যোগ তখন আর কেবল বাহ্যিক প্রক্রিয়া নয়, বরং জীবনের অভ্যন্তরে এক অবস্থান—যেখানে কর্ম চলে, কিন্তু মন স্থির থাকে; যেখানে ফল আসে বা যায়, কিন্তু আত্মা অনড় ও শান্ত থাকে। এই অবস্থাই প্রকৃত নিষ্কাম কর্মযোগ, যেখানে কর্ম মুক্তির পথ হয়ে ওঠে, কারণ কর্ম তখন আর বন্ধনের কারণ নয়, বরং আত্মার স্বরূপ প্রকাশের মাধ্যম।
ভগবদ্গীতার (২.৫০) এই শ্লোক—
“বুদ্ধিযুক্তো জহাতীহ উভে সুকৃতদুষ্কৃতে।
তস্মাদ্ যোগায় যুজ্যস্ব যোগঃ কর্মসু কৌশলম্॥”
—গীতার কর্মযোগ দর্শনের অন্যতম পরিণত ও দার্শনিক সারসংক্ষেপ, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ ব্যাখ্যা করেন সমত্ববুদ্ধি-সম্পন্ন নিষ্কাম কর্মের চূড়ান্ত ফল এবং যোগের প্রকৃত অর্থ।
এই শ্লোকটি দ্বিতীয় অধ্যায় “সাংখ্যযোগ”-এর অন্তর্গত। এখানে শ্রীকৃষ্ণ পূর্ববর্তী (২.৪৮) শ্লোক—“যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি… সমত্বং যোগ উচ্যতে”—এর ভাবকে আরও গভীরভাবে ব্যাখ্যা করছেন। সেখানে যোগের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল সমত্ব (Equanimity) হিসেবে; এখানে যোগের আরেকটি দিক প্রকাশ করা হচ্ছে—কর্মে কৌশল (Skill in Action)।
“বুদ্ধিযুক্তঃ জহাতীহ উভে সুকৃতদুষ্কৃতে”-এর ভাবার্থ: যিনি সমত্ববুদ্ধিতে যুক্ত, সেই ব্যক্তি এই জগতে (ইহ) পুণ্য (সুকৃত) ও পাপ (দুষ্কৃত) উভয়কেই ত্যাগ করেন (জহাতি উভে)। এখানে “বুদ্ধিযুক্তঃ” শব্দটি বোঝাচ্ছে সেই ব্যক্তিকে, যিনি বিবেকবুদ্ধি বা আত্মজ্ঞাননির্ভর বুদ্ধিতে স্থিত। এমন ব্যক্তি কর্ম করেন, কিন্তু তাঁর মন ফলের প্রত্যাশা বা ভয়ে দোলায়িত হয় না। ফলে তাঁর কর্ম পুণ্য বা পাপ কোনো বন্ধনই সৃষ্টি করে না।
“উভে সুকৃতদুষ্কৃতে জহাতি”—অর্থাৎ, তিনি কর্মফলের দ্বৈততা থেকে মুক্ত হন। পুণ্য তাঁকে স্বর্গে নিয়ে যায়, পাপ নরকে, কিন্তু উভয়ই সংসারের সীমার মধ্যে। জ্ঞানী ব্যক্তি এই উভয় সীমা অতিক্রম করেন, কারণ তাঁর কর্মে ফলাসক্তি নেই। তাই তিনি এই জন্মেই কর্মফল থেকে মুক্তি লাভ করেন—জীবন্মুক্ত হয়ে ওঠেন।
শঙ্করাচার্য এখানে মন্তব্য করেছেন: “সুকৃতদুষ্কৃতফলবিনিমুক্তো ভবতি—কর্মফলাভিসন্ধিহীনাত্।” অর্থাৎ, যিনি কর্মের ফল কামনা করেন না, তিনি স্বয়ং কর্মফল থেকে মুক্ত হন।
“তস্মাদ্ যোগায় যুজ্যস্ব যোগঃ কর্মসু কৌশলম্”-এর ভাবার্থ: অতএব, হে অর্জুন, তুমি যোগে যুক্ত হও—অর্থাৎ, সেই মনোভাব গ্রহণ করো, যেখানে কর্মের মধ্যে থেকেও মন সমত্বে স্থিত। কারণ, যোগই কর্মে প্রকৃত কৌশল। “যোগায় যুজ্যস্ব”—অর্থাৎ, কর্মে যোগের মনোভাব প্রয়োগ করো। এই যোগ মানে নিষ্কামতা ও সমত্বের অবস্থান।
“যোগঃ কর্মসু কৌশলম্”—এই অংশটি ভগবদ্গীতার সবচেয়ে বেশি উদ্ধৃত অংশগুলির একটি। এখানে “কৌশল” মানে আধ্যাত্মিক দক্ষতা—যে-দক্ষতা দ্বারা ব্যক্তি কর্মের মধ্যে থেকেও অবন্ধ থাকে। সাধারণত দক্ষতা মানে প্রযুক্তিগত বা প্রায়োগিক পারদর্শিতা, কিন্তু গীতা বলে, প্রকৃত দক্ষতা হলো সেই মনস্তাত্ত্বিক দক্ষতা, যার দ্বারা কর্মফলের দাসত্ব থেকে মুক্ত থাকা যায়।
স্বামী বিবেকানন্দ এই অংশটি ব্যাখ্যা করতে বলেন—“Yoga is skill in action—the skill of keeping the mind calm amidst all work.” অর্থাৎ, কর্মের মাঝেও মন স্থির রাখা—এই মনোদক্ষতাই প্রকৃত যোগ। রমণ মহর্ষিও বলেন—“When the mind remains still in the midst of activity, that is the highest yoga.” যখন কর্ম চলে, কিন্তু ‘আমি করছি’ এই কর্তা-বোধ বিলীন থাকে, তখনই যোগ সম্পূর্ণ হয়।
এই শ্লোক দুটি গভীর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে—
সমত্ববুদ্ধি মুক্তির কারণ: ফলাসক্তিহীন কর্ম মানেই মুক্তি। কর্ম তখন আর পুণ্য-পাপ উৎপন্ন করে না, কারণ জ্ঞানী ব্যক্তি কর্তা নয়, কেবল সাক্ষী।
যোগ হলো কর্মে দক্ষতা: যোগ মানে কর্মে এক আধ্যাত্মিক শিল্পকৌশল—যার দ্বারা কর্ম বন্ধনের কারণ না হয়ে মুক্তির সোপান হয়ে ওঠে।
শঙ্করাচার্যের ভাষ্যে বলা হয়েছে—“যোগঃ কর্মসু কৌশলম্—অসঙ্গত্ববুদ্ধিরূপঃ।“ অর্থাৎ, যোগ হলো সেই “অসঙ্গতা-বুদ্ধি,” যা কর্মের মাঝে থেকেও কর্মফলের বন্ধন থেকে মানুষকে রক্ষা করে। এই শ্লোক কর্মযোগের চূড়ান্ত দর্শন প্রকাশ করে—
কর্ম করো, কিন্তু কর্তার অহংকার ছাড়া;
কর্ম করো, কিন্তু ফলের প্রত্যাশা ছাড়া;
কর্ম করো, কিন্তু সমত্বে স্থিত থেকে।
যখন কর্ম এই অবস্থায় পৌঁছে, তখন তা মোক্ষের মাধ্যম হয়ে ওঠে। তখন মানুষ পুণ্য-পাপ, লাভ-ক্ষতি, সুখ-দুঃখ—সব দ্বন্দ্ব অতিক্রম করে নিজের অন্তর্নিহিত ব্রহ্মসত্তায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই অবস্থাই গীতার ভাষায় “যোগঃ কর্মসু কৌশলম্”—অর্থাৎ, “কর্মের মধ্যে থেকেও কর্মমুক্ত থাকার অনন্য কৌশল”—যা সত্যিকার নিষ্কাম কর্মযোগের পরম রূপ।
কর্মের নৈতিক বিচারের মানদণ্ড বাহ্যিক ফল বা পরিণাম নয়, বরং কর্মকর্তার স্থির ও শুদ্ধবুদ্ধিই এখানে মুখ্য। এই অভ্যাস মানুষকে বর্তমান মুহূর্তে সচেতন থাকতে সাহায্য করে, যা লাভের আকাঙ্ক্ষা বা ক্ষতির উদ্বেগ থেকে মনকে মুক্ত রাখে।
“কথং ভীষ্মমহং সংখ্যে দ্রোণং চ মধুসূদন।
ইষুভিঃ প্রতিযোৎস্যামি পূজার্হৌ অরি-সূদন।।” (ভগবদ্গীতা, ২.৪)
“কথং ভীষ্মম্ অহং সংখ্যে দ্রোণং চ মধুসূদন”-এর ভাবার্থ: হে মধুসূদন (শ্রীকৃষ্ণ)! কীভাবে আমি ভীষ্মকে এবং দ্রোণকে—এই দুই গুরুকে—সংগ্রামে (সংখ্যে) আক্রমণ করব?
“ইষুভিঃ প্রতিযোৎস্যামি পূজার্হৌ অরি-সূদন”-এর ভাবার্থ: হে অরি-সূদন (শত্রুদমনকারী কৃষ্ণ)! আমি বাণসমূহ (ইষুভিঃ) দ্বারা তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব (প্রতিযোৎস্যামি), অথচ তাঁরা পূজার যোগ্য (পূজার্হৌ)।
এই শ্লোকটি অর্জুনের নৈতিক ও ধর্মীয় সংঘাতকে তুলে ধরে। অর্জুন জানেন যে যুদ্ধ করা তাঁর ক্ষত্রিয় ধর্ম, কিন্তু প্রতিপক্ষ হলেন তাঁর পূজনীয় গুরু (দ্রোণ) ও পিতামহ (ভীষ্ম)। এই প্রশ্নটি অর্জুনের দেহগত আসক্তি এবং আত্মীয়তার বন্ধন থেকে উৎসারিত হয়েছে, যা তাঁকে তাঁর কর্তব্য থেকে বিমুখ করছে। অর্জুনের এই দ্বিধাই শ্রীকৃষ্ণকে কর্মযোগ এবং আত্মার নিত্যতার জ্ঞান দিতে উৎসাহিত করেছে।
এই শ্লোক অর্জুনের হৃদয়ের গভীর মানবিক দ্বন্দ্বের প্রকাশ। এটি শুধু যুদ্ধক্ষেত্রের প্রশ্ন নয়, বরং প্রতিটি চিন্তাশীল মানুষের নৈতিক, ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক সংঘাতের প্রতীক। এই শ্লোকের ব্যাখ্যায় আধুনিক বেদান্তিক ও গীতা-বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিভঙ্গি একে একে তুলে ধরা যাক।