অবিদ্যা-বিদ্যা: ৫৮


৩. প্রজ্ঞানম্ ব্রহ্ম (Prajñānam Brahma)। উৎস: ঐতরেয় উপনিষদ (৩.৩)। সংক্ষিপ্ত অর্থ: চেতনা (জ্ঞান) নিজেই ব্রহ্ম। তাৎপর্য: এটি ব্রহ্মের স্বরূপকে সংজ্ঞায়িত করে—ব্রহ্ম হলেন বিশুদ্ধ জ্ঞান বা চৈতন্য।

৪. অয়ম্ আত্মা ব্রহ্ম (Ayam Ātmā Brahma)। উৎস: মাণ্ডুক্য উপনিষদ (মন্ত্র ২)। সংক্ষিপ্ত অর্থ: এই আত্মাই ব্রহ্ম। তাৎপর্য: এটি পরিচয়ের বাক্য, যা ঘোষণা করে যে, ব্যক্তিগত আত্মা (জীবাত্মা) এবং পরমাত্মা (ব্রহ্ম) এক এবং অভিন্ন।

জ্ঞান এখানে কোনো “অর্জন” নয়, বরং আবরণ-ভঙ্গ (Āvaraṇa-bhaṅga)—অর্থাৎ, আত্মার নিজস্ব স্বরূপে প্রতিস্ফুরণ। শ্রুতি সেই উপলব্ধির দ্বার উন্মুক্ত করে, যেখানে জানা যায়—জানার কোনো প্রক্রিয়া নেই, জ্ঞানই নিজে স্বরূপ, এবং আত্মাই সেই চিরন্তন প্রকাশমান জ্ঞান—চিত্-স্বরূপ ব্রহ্ম।

সত্যিকারের জ্ঞান কখনও উৎপন্ন হয় না, কারণ জ্ঞান নিজেই চিরন্তন—এটি আত্মার স্বরূপ, আত্মারই স্বপ্রকাশ (Ātma-prakāśa)। কিন্তু অবিদ্যার (Avidyā) আচ্ছাদনে সেই জ্ঞান যেন অদৃশ্য হয়ে থাকে, যেমন মেঘ সূর্যের আলো ঢেকে দেয়, কিন্তু আলোককে নিঃশেষ করতে পারে না। আত্মা সর্বদা জ্ঞানরূপ (Jñāna-svarūpa), কিন্তু অজ্ঞানতার আচ্ছাদনে সে নিজেকে সীমাবদ্ধ সত্তা, কর্তা, ভোক্তা ও দেহাত্মা বলে মনে করে। যখন অবিদ্যার এই পর্দা সরে যায়, তখন আত্মার চির-উজ্জ্বল স্বরূপ নিজেই প্রকাশিত হয়—তখন কোনো নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি হয় না, বরং আচ্ছন্ন আলোকই উন্মুক্ত হয়ে ওঠে।

অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনে, সত্য জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়াটি "বাধ-সম্বন্ধ" (Bādha-Sambandha) নামে পরিচিত। এই শব্দটি মিথ্যা বা ভ্রমাত্মক জ্ঞানকে নিবারণ বা বিলুপ্ত করার সম্পর্ককে বোঝায়। অদ্বৈত বেদান্তের মৌলিক ধারণা হলো, সমস্ত বৈধ জ্ঞান (প্রমা) আসলে কোনো নতুন বাস্তবতার সৃষ্টি করে না, বরং বিদ্যমান মিথ্যা জ্ঞান (অপ্রমা) বা ভ্রান্ত ধারণাকে অপনোদন করে মাত্র। এটি কোনো নতুন সত্তা বা বস্তুর উদ্ভব ঘটায় না, বরং যা প্রকৃত সত্য, তার উপর থেকে অজ্ঞানের পর্দা সরিয়ে দেয়।

এই প্রক্রিয়াটি একটি পরিচিত উদাহরণের মাধ্যমে সহজে বোঝা যায়: যখন একজন ব্যক্তি অন্ধকারে একটি ঝিনুককে ভুল করে রুপা বলে মনে করেন, তখন এটি একটি ভ্রমাত্মক জ্ঞান (রজত-ভ্রম)। এই ভ্রম ততক্ষণ পর্যন্ত স্থায়ী হয়, যতক্ষণ না সঠিক জ্ঞান উদয় হয়। যখন আলো জ্বলে ওঠে বা ব্যক্তিটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেন, তখন তিনি উপলব্ধি করেন যে, "এটি রুপা নয়, এটি একটি ঝিনুক।" এই উপলব্ধির মাধ্যমে নতুন কোনো রুপা বা নতুন কোনো ঝিনুকের সৃষ্টি হয় না। বরং, রুপা দেখার যে-ভ্রম ছিল, তার বিলোপ ঘটে। প্রকৃত বস্তুটি—অর্থাৎ ঝিনুক—আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল, কিন্তু ভ্রান্ত ধারণার কারণে তা সঠিকভাবে উপলব্ধ হয়নি।

সত্য জ্ঞানের প্রকৃতিকে "বাধক" বলা হয়। "বাধক" মানে, যা মিথ্যাকে দূর করে বা বিলুপ্ত করে। এটি মিথ্যার উপর থেকে অজ্ঞানতা বা ভুল ধারণার পর্দা সরিয়ে দেয়, যা বস্তুর প্রকৃত স্বরূপকে আবৃত করে রেখেছিল। এই "বাধ-সম্বন্ধ" কেবলমাত্র বস্তুর ত্রুটিপূর্ণ উপলব্ধিকে দূর করে, কিন্তু বস্তুর সত্তাকে পরিবর্তন করে না। অদ্বৈত বেদান্তে, ব্রহ্মই একমাত্র সত্য এবং জগতের অন্যান্য সব কিছুই মায়া বা মিথ্যা। আত্মজ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে এই মায়া বা মিথ্যা জ্ঞানের নিবারণ হয়, যা ব্রহ্মের প্রকৃত স্বরূপকে উদ্‌ভাসিত করে। এই প্রক্রিয়া ব্যক্তিকে মুক্তি বা মোক্ষ লাভের দিকে পরিচালিত করে, যেখানে দ্বৈততার বিলোপ ঘটে এবং ব্রহ্মের সাথে আত্মার অভিন্নতা উপলব্ধি হয়।

তেমনি “অহম্ ব্রহ্মাস্মি”—“আমিই ব্রহ্ম”—এই মহাবাক্যের জ্ঞানও কোনো নতুন সত্তা তৈরি করে না; এটি কেবল সেই ভুল ধারণাকে ভঙ্গ করে দেয় যে, আত্মা জগৎ থেকে, ঈশ্বর থেকে বা অন্য কোনো সত্তা থেকে পৃথক। জগৎ, কর্তা, ভোক্তা—এই সমস্ত বিভ্রম জ্ঞানের উদয়েই মুছে যায়, যেমন আলো জ্বাললে অন্ধকার অদৃশ্য হয়। অন্ধকারকে আলাদা করে ধ্বংস করতে হয় না; আলোর উপস্থিতিই যথেষ্ট। ঠিক তেমনি, আত্মজ্ঞানের উপস্থিতিতে অবিদ্যা নিজে নিজেই বিলীন হয়।

অদ্বৈতের এই জ্ঞানের প্রক্রিয়াটি ধীরে ধীরে তিনটি স্তরে উন্মোচিত হয়। প্রথম ধাপ হলো পরোক্ষ-জ্ঞান (Parokṣa-Jñāna)—যা শাস্ত্র ও গুরু-উপদেশের মাধ্যমে অর্জিত হয়। এখানে জ্ঞান এখনও ধারণার পর্যায়ে থাকে—বৌদ্ধিক ও ভাষাগত। সাধক বোঝে, “আমি আত্মা, আমি ব্রহ্ম”—কিন্তু তা এখনও তার প্রত্যক্ষ উপলব্ধি নয়।

দ্বিতীয় ধাপ হলো মনন-জ্ঞান (Manana-Jñāna)—যেখানে অনুসন্ধানী যুক্তির মাধ্যমে সেই শোনা সত্যকে আত্মস্থ করেন, সন্দেহ দূর করেন, এবং নিজের অভ্যন্তরীণ চিন্তাজগৎকে সেই সত্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যে আনেন। এখানে শ্রবণে প্রাপ্ত ধারণাটি এক দার্শনিক দৃঢ়তায় রূপ নেয়—মানসিক স্থিতি পায়।

তৃতীয় ও চূড়ান্ত ধাপ হলো অপরোক্ষ-অনুভূতি (Aparokṣa-Anubhūti)—যেখানে সেই জ্ঞান আর কেবল চিন্তা বা ধারণা থাকে না, বরং প্রত্যক্ষ আত্ম-অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়। এখানে জ্ঞাতা, জানা, ও জ্ঞেয়—এই তিনের ভেদ বিলীন হয়ে যায়। আত্মা নিজেকে নিজের মধ্যেই উপলব্ধি করে, কোনো দ্বিতীয় সত্তা ছাড়াই। এটি সেই অবস্থান যেখানে বলা যায়—“দ্রষ্টা, দৃশ্য, দর্শন—সব এক।”

এর উপায়সমূহ—এই ত্রিস্তরীয় অনুশীলন—শ্রবণ, মনন, নিদিধ্যাসন (Śravaṇa-Manana-Nididhyāsana)—অদ্বৈত সাধনার মূলসোপান। শ্রবণ হলো শাস্ত্র থেকে মহাবাক্য শোনা ও তার অর্থ বোঝা; মনন হলো যুক্তির মাধ্যমে সেই অর্থে সন্দেহমুক্ত বিশ্বাস স্থাপন; এবং নিদিধ্যাসন হলো দীর্ঘ ধ্যানের মাধ্যমে সেই বিশ্বাসকে জীবন্ত উপলব্ধিতে রূপান্তরিত করা। শ্রুতি এখানে শিক্ষকের মতো পথ দেখায়, যুক্তি সেই পথে নিশ্চিততা দেয়, আর ধ্যান সেই পথকে অভিজ্ঞতার রূপে পরিণত করে।

শেষে, যখন এই অপরোক্ষ-অনুভূতি সম্পূর্ণ হয়, তখন সাধক উপলব্ধি করেন—জ্ঞান কখনও উৎপন্ন হয়নি, এটি সর্বদা ছিল। যা ঘটেছে তা কেবল মায়ার অন্তর্ধান, অবিদ্যার ভঙ্গ। আত্মার স্বরূপই তখন উদ্‌ভাসিত হয়—চিরন্তন, স্বয়ংপ্রকাশ, নির্বিকার চিদানন্দ।

শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতার আলোকে অনাসক্তি ও নিষ্কাম কর্মের দার্শনিক ভিত্তি, প্রয়োগগত চ্যালেঞ্জ এবং বাস্তবসম্মত সমাধান নিয়ে আলোচনা করছি। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কর্মজীবনের সফলতা বা ব্যর্থতা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সরাসরি এবং গভীর প্রভাব ফেলে। আধুনিক মানুষ ক্রমাগত সাফল্য অর্জনের আকাঙ্ক্ষা (কামনা) এবং ফল লাভের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয় (উদ্‌বেগ বা অ্যাংজাইটি) দ্বারা তাড়িত। এই মানসিক সঙ্কট নিরসনের পথ দেখিয়েছে ভারতীয় দর্শন, বিশেষত শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতা।

গীতা, বিশেষত কর্মযোগ (দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়), এই উদ্‌বেগ নিরসনের জন্য নিষ্কাম কর্মের পথ ব্যাখ্যা করেছে, যা কর্ম এবং মানসিক শান্তির মধ্যে এক সমন্বয় স্থাপন করে। ভারতীয় দর্শনে, জীব কর্ম করে এবং তার ফল ভোগ করে। এই কর্মফল ভোগের শৃঙ্খলই জন্ম-মৃত্যুচক্র (সংসার) বা বন্ধনের মূল কারণ। যে-কর্ম ফলের আকাঙ্ক্ষা দ্বারা সিক্ত, তা সকাম কর্ম নামে পরিচিত, যা এই বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে। এর বিপরীতে, নিষ্কাম কর্মের লক্ষ্য হলো, এই কার্যকারণ শৃঙ্খল থেকে মুক্তি লাভ করে মোক্ষ বা মুক্তি অর্জন করা।

নিষ্কাম কর্মযোগই গীতার ত্রিমার্গ সমন্বয়ের ভিত্তি। শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতায় মোক্ষলাভের জন্য তিনটি প্রধান পথের কথা বলা হয়েছে: জ্ঞান যোগ (জ্ঞান), ভক্তি যোগ (ভক্তি), এবং কর্ম যোগ (কর্ম)। নিষ্কাম কর্মযোগ হলো এই তিনের সমন্বয়কারী ভিত্তি। নিষ্কাম কর্মের মাধ্যমে চিত্তের শুদ্ধি লাভ হয়—যা জ্ঞান বা ভক্তির পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য একটি অপরিহার্য প্রস্তুতি। একজন ব্যক্তি যদি কর্মত্যাগ করেন, তবে তিনি কখনও জ্ঞানলাভের যোগ্যতারূপ শুদ্ধি অর্জন করতে পারবেন না। সুতরাং, কর্মযোগের প্রধান কাজ হলো এই শুদ্ধি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা। এটি একদিকে যেমন কর্তব্য পালনের উপর জোর দেয়, তেমনই অন্যদিকে ফলাকাঙ্ক্ষা বর্জন করে মানসিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।

কর্মে অনাসক্তি ও কর্মফল-অনাসক্তির সূক্ষ্ম পার্থক্য: 'নিষ্কাম' শব্দটি গঠিত হয়েছে 'নিঃ' (না) এবং 'কাম' (আকাঙ্ক্ষা বা বাসনা) শব্দ দুটির সমন্বয়ে। সুতরাং, নিষ্কাম কর্মের আক্ষরিক অর্থ হলো সকল প্রকার কামনা বা বাসনা থেকে মুক্ত হয়ে কর্ম করা। এটি ফলাকাঙ্ক্ষা-রহিত কর্ম।

তবে এই ধারণার একটি গুরুত্বপূর্ণ সূক্ষ্মতা রয়েছে: নিষ্কাম কর্ম কখনোই কর্মের প্রতি ঔদাসীন্য বা কর্মত্যাগ নয়। এর অর্থ হলো কর্মফলের প্রতি অনাসক্তি বা আসক্তি বর্জন। অনাসক্তি বলতে কেবল ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করা বোঝায় না, বরং কর্মের সঙ্গে যুক্ত কর্তৃত্বাভিমান ('আমি কর্তা' এই ভাব) এবং মমতা বোধ (মালিকানা বা My-ness) ত্যাগ করাও বোঝায়। এই অহংবোধই কর্মকে বন্ধনকারী সকাম কর্মে পরিণত করে।

গীতার মূল সূত্রসমূহে নিষ্কাম কর্মের চতুঃসূত্র: ভগবদ্‌গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৪৭ নং শ্লোকে (২/৪৭) শ্রীকৃষ্ণ নিষ্কাম কর্মের যে-মূলভিত্তি স্থাপন করেছেন, তা চারটি অপরিহার্য নীতি বা সূত্রের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়—
কৰ্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।
মা কৰ্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোঽস্ত্বকৰ্মণি।।

১. কর্মেই তোমার অধিকার (কর্মণ্যেবাধিকারস্তে): তোমার অধিকার কেবল কর্ম করার ওপর। এর অর্থ হলো, একজন ব্যক্তি তার সমস্ত মনোযোগ, শক্তি এবং দক্ষতা কেবল কর্মটি সম্পন্ন করার ওপর নিবদ্ধ করবে। এটি কর্তব্যের প্রতি সম্পূর্ণ নিষ্ঠাকে বোঝায়।

২. কখনও কর্মফলে নয় (মা ফলেষু কদাচন): তোমার অধিকার কখনোই কর্মের ফলের ওপর নয়। নিষ্কাম কর্মের এটিই হলো মূলকথা—কর্মফল কী হবে, তার প্রত্যাশা ত্যাগ করতে হবে। ফললাভ হবে কি হবে না, সেই বিষয়ে চিন্তা না করে কর্ম করে যেতে হবে।

৩. কর্মফলের হেতু হয়ো না (মা কর্মফলহেতুর্ভূঃ): কর্মফলের প্রত্যাশা বা ফলাসক্তি দ্বারা তাড়িত হয়ে কর্ম কোরো না। অর্থাৎ, ফলাকাঙ্ক্ষা যেন তোমার কর্মের কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। যদি তুমি ফলের জন্য কর্ম করো, তবে সেই ফলই তোমাকে বন্ধনযুক্ত করবে। এই সূত্রটি কর্তৃত্বাভিমান (আমি কর্তা) ত্যাগ করতে উৎসাহিত করে।

৪. কর্মত্যাগে আসক্ত হয়ো না (মা তে সঙ্গোঽস্ত্বকর্মণি): তুমি কর্ম না করার প্রতিও আসক্ত হয়ো না বা কর্মত্যাগ করো না। নিষ্কাম কর্মের এই সূত্রটি অলসতা বা কর্মবিমুখতাকে খণ্ডন করে। এর অর্থ হলো, কেবল ফল পাব না বলে কর্ম থেকে বিরত থাকা উচিত নয়; কর্ম করা মানুষের স্বভাবগত ধর্ম এবং কর্তব্য।

সংক্ষেপে, নিষ্কাম কর্ম হলো কর্তব্যপালন (১) এবং ফলাকাঙ্ক্ষা-ত্যাগ (২ ও ৩)-এর এমন একটি অবস্থা, যা কোনো অবস্থাতেই কর্মবিমুখতা (৪) শেখায় না।

কর্মফল যেন কর্মীর কর্মের প্রেরণার হেতু না হয়। অর্থাৎ, শুধু ফলের লোভেই যেন কর্মে প্রবৃত্তি না হয়। আবার, ফলের আকাঙ্ক্ষা নেই বলে যেন কর্মত্যাগেও তার আসক্তি না থাকে। আসক্তিহীনতার পথ মোক্ষলাভের পথে সহায়ক। নিষ্ক্রিয়তা বা কর্মহীনতা (Akarma) মুক্তির পথ নয়, বরং তা মানবপ্রকৃতির বিরোধী। গীতা তীব্রভাবে নিষ্ক্রিয়তার নিন্দা করে, কারণ কর্মত্যাগ করাও একধরনের আসক্তি (অকর্মের প্রতি আসক্তি)।

মানুষের পক্ষে কর্ম থেকে মুক্তি লাভ করা অসম্ভব, কেননা কর্ম ব্যতীত দেহযাত্রাও নির্বাহিত হয় না। সুতরাং, কর্মত্যাগ করা অসম্ভব বলে, গীতায় কর্মের বাহ্যিক ত্যাগের উপদেশ দেওয়া হয়নি, ফলত্যাগের উপদেশ দেওয়া হয়েছে। তাই শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে কর্তব্যকর্ম করার উপদেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু ফলাকাঙ্ক্ষা বর্জন করতে বলেছিলেন।

নিষ্কাম কর্মের মূলনীতি চারটি সূত্রের মাধ্যমে ব্যক্ত করা যায়:
১. কর্ম করাতেই তোমার অধিকার।
২. ফলে তোমার কোনো অধিকার নেই।
৩. তুমি কর্মফলের হেতুও হয়ো না (কর্তৃত্বাভিমান ত্যাগ)।
৪. কর্মরহিত হওয়াতে যেন তোমার আসক্তি না হয়।