এই তিন তত্ত্ব একত্রে অদ্বৈতের সম্পূর্ণ দার্শনিক সার প্রকাশ করে। আভাস-বাদ দেখায়—জগৎ কেবল ব্রহ্মের প্রতিফলন; চির-ব্রহ্ম-অনুভব শেখায়—এই ব্রহ্ম সর্বদা অভিজ্ঞতায় আছে, শুধু তা চেনা দরকার; আর আত্মা-ব্রহ্ম-তাদাত্ম্য উপলব্ধি করায়—আত্মা ও ব্রহ্ম কখনও পৃথক ছিল না, কেবল অজ্ঞানই ভেদ সৃষ্টি করেছে। এই উপলব্ধিতে সমস্ত দ্বৈততা, মায়া ও বিভ্রম নিঃশেষ হয়; থাকে কেবল সেই এক, অনন্ত, চির-আলোকিত চেতনা—ব্রহ্ম, যা সর্বভূত, সর্বত্র ও সর্বকালে এক ও অদ্বিতীয়।
এই অবস্থায়, যাকে “বন্ধন” বলে মনে হচ্ছিল, বোঝা যায়—তা কখনও সত্য ছিল না; ছিল কেবল প্রতিফলনের এক খেলা। আভাস-বাদ (Ābhāsa-Vāda) বলে—সমস্ত অভিজ্ঞতা চেতনার প্রতিফলনমাত্র, স্বতন্ত্র কোনো সত্তা নয়। জগত, জীব, ঈশ্বর—সবই এক ব্রহ্ম-চেতনার অভাস, যা নিজে অপরিবর্তনীয়।
এই উপলব্ধিতে ঋষি স্থিত হন চির-ব্রহ্ম-অনুভবে (Nitya-Brahma-Anubhava)—এমন এক জাগরণে, যা কোনো প্রমাণ (Pramāṇa) বা অপ্রমাণ (Apramāṇa)-এর অধীন নয়, কোনো চিন্তা বা যুক্তির প্রয়োজন সেখানে নেই। তিনি যা জানেন, তা কোনো ধারণা নয়; এটি তাঁর সত্তার স্বরূপ। আত্মা-ব্রহ্ম-তাদাত্ম্য (Ātma-Brahma-Tādātmya) তখন কোনো তত্ত্ব নয়, বরং অস্তিত্বের নিজস্ব সার—যা চিন্তা নয়, চেতনা; যা অনুভব নয়, অস্তিত্ব নিজেই।
এই পরিণত অবস্থায় তিনি না জগৎকে গ্রহণ করেন, না প্রত্যাখ্যান করেন; তিনি কেবল দেখেন—যেমনটি তা আছে। জগৎ তখন তাঁর কাছে রজ্জু-সর্পের মতো নিরীহ বিভ্রম; বা চেতনার আকাশে ঝিকমিক-করা এক গন্ধর্ব-নগর (Gandharva-Nagara)—দেখতে সুন্দর, কিন্তু মায়াময়, অদৃশ্য ও অস্পর্শ। Gandharva-Nagara (গন্ধর্ব-নগর) হলো অদ্বৈত বেদান্তে ব্যবহৃত একটি রূপক বা উপমা, যার অর্থ মায়াজাল বা মিথ্যা প্রতিভাত জগৎ। এটিকে ভ্রম বা অবাস্তবতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
পৌরাণিক মতে, গন্ধর্বরা হলো স্বর্গের গায়ক বা অপ্সরাদের পুরুষ সঙ্গী। তারা প্রায়শই জাদুকরী শক্তি বা মায়া প্রদর্শন করত। গন্ধর্ব-নগর-এর আক্ষরিক অর্থ হলো গন্ধর্বদের দ্বারা সৃষ্ট নগর। গন্ধর্ব-নগরীর সবচেয়ে সাধারণ ব্যবহার হলো মরুভূমির মরীচিকার মতো—মরুভূমির দূর দিগন্তে যেমন আলোর বিচ্ছুরণের কারণে মিথ্যাভাবে জল বা শহরের আভাস দেখা যায়, ঠিক তেমনই এই গন্ধর্ব-নগর। এটি ক্ষণে ক্ষণে সৃষ্টি হয় এবং ক্ষণে ক্ষণে বিলীন হয়, কিন্তু এর বাস্তবে কোনো ভিত্তি নেই।
অদ্বৈত বেদান্তে গন্ধর্ব-নগর উপমাটি দৃশ্যমান জগতের মিথ্যাত্ব প্রমাণের জন্য ব্যবহৃত হয়। এই দৃশ্যমান জগৎ এবং এর সমস্ত বস্তু ক্ষণস্থায়ী (অনিত্য) এবং ভ্রমাত্মক (মায়া)। ব্রহ্মই একমাত্র সত্য। আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি অজ্ঞানের বশে এই জগৎকে বাস্তব বলে মনে করে, ঠিক যেমন ভ্রান্ত পথিক দূরে গন্ধর্ব-নগরকে সত্যিকারের শহর বলে ভুল করে। যখন ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয়, তখন এই মায়ার ভ্রম বা গন্ধর্ব-নগর বিলীন হয়ে যায়। জ্ঞানী ব্যক্তি বুঝতে পারেন যে, জগৎ কখনও ছিলই না—সেটি ছিল কেবল চেতনার ওপর আরোপিত একটি মিথ্যা প্রতিচ্ছবি। গন্ধর্ব-নগর হলো সেই অবাস্তব জগৎ, যা মায়া বা অজ্ঞান-এর কারণে সাময়িকভাবে সত্য বলে প্রতীয়মান হয়।
এই উপলব্ধি সাধকের মনে এক গভীর নির্বেদের জন্ম দেয়, যেখানে জাগতিক সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি, জয়-পরাজয় সবই অর্থহীন প্রতিভাত হয়। তিনি বুঝতে পারেন, এই জগৎ কেবলই মনের প্রক্ষেপণ, এক বিশাল নাট্যমঞ্চ, যেখানে নিত্যনতুন দৃশ্যের অবতারণা হয়, কিন্তু তার মূলে কোনো বাস্তব সত্তা নেই। এই দৃষ্টিতে, সমগ্র সৃষ্টি এক বিশাল স্বপ্নিল জগৎ, যা ঘুম ভেঙে গেলে বিলীন হয়ে যায়।
নির্ (Nir): ছাড়া, অভাব (Without); বেদ (Veda): অনুভব, ব্যথা, বা জ্ঞান। ‘নির্বেদ’ হলো সেই মানসিক শান্তি ও বৈরাগ্য, যা সাধককে অনিত্যতা উপলব্ধি করার পর মুক্তি বা ব্রহ্মজ্ঞানের দিকে চালিত করে। অদ্বৈত বেদান্তে নির্বেদ হলো মোক্ষলাভের পথে একটি অপরিহার্য ধাপ। এটি কেবল জাগতিক সুখ-দুঃখের প্রতি উদাসীনতা নয়, বরং বৈরাগ্যের (Vairāgya) চূড়ান্ত অবস্থা। মুণ্ডক উপনিষদ (১.২.১২)-এ নির্বেদকে এভাবে স্পষ্ট করা হয়েছে: কর্মের দ্বারা অর্জিত সমস্ত লোক (যেমন স্বর্গ) অনিত্য—এই সত্য উপলব্ধি করার পর একজন ব্রাহ্মণ (ব্রহ্মজ্ঞানী) নির্বেদ লাভ করেন।
এই নির্বেদ হলো সাধন-চতুষ্টয়ে (চারটি আবশ্যক যোগ্যতা) একটি উপাদান—ইহ-অমুত্র-ফল-ভোগ-বিরাগ (এই লোক ও পরলোকের ফলের প্রতি বিতৃষ্ণা)—লাভের পূর্বশর্ত। নির্বেদ মনকে চিত্তশুদ্ধি করতে সাহায্য করে। যতক্ষণ না মন জাগতিক আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্ত হচ্ছে, ততক্ষণ তা অসীম ব্রহ্মের জ্ঞান গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত হয় না। এই নির্বেদই সাধককে অনিত্য জগৎ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিত্য ব্রহ্মের দিকে মনোনিবেশ করতে পরিচালিত করে।
প্রপঞ্চ তখন আর ব্যবহারযোগ্য বস্তু নয়, বরং উপশম (Upaśama)—যেখানে সব দ্বৈততা, সব কর্ম, সব চিন্তা, সব প্রতীতি—নিস্তব্ধ হয়ে যায়। সেখানে নেই কর্তা বা ভোক্তা, নেই জানা বা অজানা, নেই সৃষ্টি বা বিলয়—আছে কেবল ব্রহ্ম, যা—নির্বাণসম (Nirvāṇasama), নিঃশব্দ (Niḥśabda), চির-উজ্জ্বল (Nitya-Prakāśa)। এই উপশম দশায়, ব্যক্তি সত্তার সকল বাঁধন ছিন্ন হয়ে যায়। অহংকার, কামনা-বাসনা, ভয়-ডর—সবই বিলীন হয়। যেমন একটি প্রদীপের শিখা নিভে গেলে তার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকে না, তেমনি এই অবস্থায় আত্মাও ব্রহ্মের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। এই একীভূত নীরব অবস্থাই অদ্বৈত বেদান্তের চূড়ান্ত লক্ষ্য।
এই নীরবতাই চূড়ান্ত জ্ঞান—যেখানে জানা মানেই হওয়া, আর হওয়া মানেই ব্রহ্ম। এখানে আর কিছু ভাঙার নেই, আর কিছু অর্জনের নেই, কারণ কখনও কিছু হারিয়েই ছিল না। এই জ্ঞান কোনো পুঁথিগত জ্ঞান নয়, বরং অস্তিত্বের গভীরতম উপলব্ধি। এই অবস্থায়, জ্ঞাতা, জ্ঞেয় ও জ্ঞান—এই ত্রিপুরীর ভেদ ঘুচে যায়। যা-কিছু ছিল বলে মনে হয়েছিল, সবই ছিল এক ভ্রান্তি; যা কিছু পাওয়ার ছিল বলে আকাঙ্ক্ষা ছিল, তা সবই ছিল এক মিথ্যা মায়া। এই পূর্ণতার রাজ্যে, সব কিছুই আদি থেকে অনন্তকাল পর্যন্ত অপরিবর্তিত ও পূর্ণ। জন্ম-মৃত্যুর চক্র, কর্মফলের বন্ধন—সবই এই মহাসাগরে বিলীন হয়ে যায়, যেখানে কেবল অনন্ত ব্রহ্মের নীরব উপস্থিতিই বিদ্যমান। এটি এক এমন অবস্থা, যেখানে সময় ও স্থান তাদের অর্থ হারায়, কেবল চিরন্তন সত্তারই প্রকাশ ঘটে।
ত্রিপুরী (Tripurī) বা ত্রিপুটি (Tripuṭi) শব্দটি বেদান্তে এক গভীর দার্শনিক ধারণা, যা জ্ঞানের কাঠামোকে বিশ্লেষণ করে দেখায়—কীভাবে এক অখণ্ড চেতনা (চিদ্-আত্মা) অজ্ঞানতার প্রভাবে তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়: জ্ঞাতা (প্রমাতৃ), জ্ঞেয় (প্রমেয়), এবং জ্ঞান (প্রমা)। এই ত্রিবিধ বিভাজনই সমস্ত অভিজ্ঞতার মূল, আর এর বিলোপই মুক্তি বা আত্মসাক্ষাৎকার।
অদ্বৈত বেদান্ত মতে, ব্রহ্মই একমাত্র পরম সত্য—অখণ্ড, অনন্ত, অদ্বিতীয় চৈতন্য। সেই ব্রহ্মে কোনো ভেদ নেই। কিন্তু মায়া বা অবিদ্যার প্রভাবে সেই এক চেতনা যেন বিভক্ত হয়ে পড়ে। চেতনা যখন দেহ-মন-ইন্দ্রিয়-এর সঙ্গে একীভূত হয়, তখন সে নিজেকে “আমি” বলে চিনে—এই “আমি”-বোধই জ্ঞাতা বা প্রমাতৃ। যা “আমি” জানি বা অনুভব করি, তা জ্ঞেয় বা প্রমেয়। আর জানার যে-প্রক্রিয়ায় এই দুই সম্পর্কিত হয়, সেটিই জ্ঞান বা প্রমা। এইভাবে এক চেতনা তিনভাগে বিভক্ত হয়ে যায়—জ্ঞাতা, জ্ঞেয় ও জ্ঞান। কিন্তু এই বিভাজন বাস্তব নয়, এটি কেবল চেতনার প্রতিফলনজনিত এক ভ্রম, এক আভাস—যেমন এক সূর্যের আলো অসংখ্য জলে প্রতিফলিত হয়ে অনেক সূর্যের ভ্রম সৃষ্টি করে, অথচ সূর্য এক।
অদ্বৈত বেদান্ত বলে, এই ত্রিপুরীই অবিদ্যার ফল। ব্রহ্মে কোনো দ্বিত্ব নেই, সেখানে কর্তা, কর্ম ও ক্রিয়া—এই তিনের কোনো অর্থ থাকে না। তুরীয় অবস্থা (মাণ্ডূক্য উপনিষদ, মন্ত্র ৭) নিয়ে বলা হয়েছে—“নান্তঃপ্রজ্ঞং ন বাহিঃপ্রজ্ঞং… অদ্বিতীয়ং শান্তং শিবমদ্বৈতম্”—যে-চেতনা বাহ্য বা অন্তর নয়, যাকে জানা যায় না, কিন্তু যার দ্বারাই জানা হয়, সেটিই অদ্বিতীয় ব্রহ্ম। এই স্তরে জ্ঞাতা, জ্ঞান ও জ্ঞেয়—সব বিলীন হয়ে যায়, থাকে কেবল নির্ভেদ চৈতন্য।
উপনিষদে বলা হয়েছে—“দ্বৈতং ইহ মনুষ্যঃ ভজতে, নৈহ নানাস্তি কিঞ্চন” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ৪.৪.১৯)—মানুষ দ্বৈততার মধ্যেই বিচরণ করে, কিন্তু সত্য স্তরে কোনো নানাত্ব নেই। এই শ্লোকটি দ্বৈত (Duality) এবং অদ্বৈত (Non-duality)—এই দুটি চেতনার অবস্থাকে ব্যাখ্যা করে।
“দ্বৈতং ইহ মনুষ্যঃ ভজতে” অর্থ—এই জগতে (ইহ) মানুষ দ্বৈততাকে ভজনা করে বা দ্বৈততাকে দেখে। যতক্ষণ মানুষ অজ্ঞানের (অবিদ্যা) মধ্যে থাকে, ততক্ষণ সে দ্বৈতভাব বা বহুত্ব দেখে—অর্থাৎ, সে নিজেকে দ্রষ্টা এবং জগৎকে দৃশ্য, নিজেকে জীব এবং ব্রহ্মকে ভিন্ন বলে মনে করে। এই দ্বৈততাই হলো বন্ধন এবং ভয় ও দুঃখের কারণ।
“নৈহ নানাস্তি কিঞ্চন” অর্থ—এখানে (ইহ) নানাত্ব (নানা) বলে কিছুই নেই (ন কিঞ্চন)। এই অংশটি হলো ব্রহ্মজ্ঞান লাভের পরের উপলব্ধি। যখন মানুষ অদ্বৈত জ্ঞান লাভ করে, তখন সে বুঝতে পারে যে, সমস্ত প্রকার দ্বৈততা, বহুত্ব বা পার্থক্য হলো ভ্রম মাত্র। একমাত্র ব্রহ্মই বিদ্যমান, এবং তাঁর থেকে ভিন্ন বা দ্বিতীয় আর কিছুই নেই।
এই শ্লোকটি মূলত এই চূড়ান্ত নির্দেশ যে, মোক্ষ বা মুক্তি হলো দ্বৈততার মায়া থেকে মুক্ত হয়ে একমাত্র অদ্বৈত সত্যে স্থিত হওয়া। অর্থাৎ, জ্ঞানযন্ত্র (প্রমাণ), জ্ঞেয়বস্তু, ও জ্ঞাতা—এই তিনের অস্তিত্ব কেবল ব্যাবহারিক স্তরে (vyāvahārika-sattā); পরমার্থে (pāramārthika-sattā) কেবল এক ব্রহ্মচৈতন্যই আছে।
শঙ্করাচার্য এই তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করতে বলেন—“জ্ঞাতৃত্বাদি ত্রয়ম্ আপাদানম্ মিথ্যা; আত্মা একং জ্ঞানস্বরূপম্।” অর্থাৎ জ্ঞাতা, জ্ঞেয় ও জ্ঞান—এই তিনই ভ্রান্ত, আত্মা একমাত্র সত্য জ্ঞানস্বরূপ। যেমন সাপ-দড়ির ভ্রমে দড়িই একমাত্র বাস্তব, সাপটি কেবল অভাস, তেমনি ত্রিপুরীও চেতনার উপর মিথ্যা আরোপণ মাত্র। এটি আদি শঙ্করাচার্য এবং তাঁর অনুগামীদের দ্বারা ত্রিপুরী (জ্ঞাতা, জ্ঞেয় ও জ্ঞান) তত্ত্বের ব্যাখ্যায় ব্যবহৃত একটি সিদ্ধান্তমূলক প্রবচন। এই উক্তিটির ভাব দৃক্-দৃশ্য-বিবেক এবং বেদান্তের ত্রিপুরী তত্ত্বের আলোচনায় পাওয়া যায়। সূত্রটি ত্রিপুরীর মিথ্যাত্ব এবং ব্রহ্মের স্বরূপ প্রতিষ্ঠা করে।
“জ্ঞাতৃত্বাদি ত্রয়ম্ আপাদানম্ মিথ্যা” অর্থ—জ্ঞাতৃত্বাদি ত্রয়ম্: জ্ঞাতৃত্ব (কর্তা হওয়া), এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট জ্ঞেয় ও জ্ঞান—এই তিনটি (ত্রয়ম্)। এই তিনটিকে একত্রে ত্রিপুরী বলা হয়। আপাদানম্ মিথ্যা: এই ত্রিপুরী হলো আপাদান বা আরোপণ (Superimposition) এবং তা মিথ্যা (Mithyā)। অদ্বৈত বেদান্ত অনুযায়ী, জ্ঞাতা, জ্ঞেয় ও জ্ঞান—এই ভেদাভেদগুলি অজ্ঞানের কারণে ব্রহ্মের ওপর আরোপিত, তাই তাদের কোনো বাস্তব বা পারমার্থিক সত্তা নেই।
“আত্মা একং জ্ঞানস্বরূপম্” অর্থ—আত্মা একম্: আত্মা হলেন এক এবং অদ্বিতীয়। জ্ঞানস্বরূপম্: আত্মা কোনো জ্ঞান অর্জন করেন না, বরং তিনি স্বয়ং জ্ঞানস্বরূপ বা চৈতন্যস্বরূপ।
এই সূত্রটির যথাযথ উপলব্ধি ও চর্চা মোক্ষ লাভের জন্য অপরিহার্য। এটি বলে যে, জ্ঞাতা হিসেবে নিজেকে সীমিত মনে করার ভ্রান্তি দূর করতে হবে এবং জানতে হবে যে, ত্রিপুরী মিথ্যা, এবং আত্মা হলেন সেই অখণ্ড জ্ঞানসত্তা। মুক্তির অর্থ হলো এই ত্রিপুরীর বিলোপ—জ্ঞাতা, জ্ঞেয়, ও জ্ঞান একাকার হয়ে যাওয়া। যখন সাধক উপলব্ধি করেন—“আমি, অর্থাৎ যে জানি; যা জানি; এবং জানার প্রক্রিয়া—তিনটিই আমি নিজেই”—তখন জ্ঞানের ত্রিভাগ মুছে যায়। তখন আত্মা নিজের স্বরূপে জেগে ওঠে—অখণ্ড, নিঃশেষ, নির্ভেদ চৈতন্যরূপে।
রমণ মহর্ষি, স্বামী বিবেকানন্দ এবং স্বামী চিন্ময়ানন্দ—এই তিন মহান আধ্যাত্মিক গুরুই জ্ঞান, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়-এর ত্রিপুটি এবং পরমাত্মার সঙ্গে এর সম্পর্ক নিয়ে গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়েছেন। তাঁদের শিক্ষাগুলি বেদান্ত দর্শনের মূল ধারণাগুলিকে তুলে ধরে এবং আত্ম-উপলব্ধির পথে সহায়ক হয়।