অবিদ্যা-বিদ্যা: ৫৪



তুরীয় কখনও প্রপঞ্চে প্রবেশ করে না, আবার কখনও ত্যাগও করে না। এর মানে হলো, তুরীয় এমন এক নিত্যসত্তা, যা জাগতিক দ্বৈততা, বৈচিত্র্য এবং মায়ার দ্বারা সৃষ্ট ভ্রম থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। এটি সক্রিয়ভাবে জগতের অংশীদার নয়, আবার সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্নও নয়। বরং, এটি একটি ধ্রুব আলোকের মতো, যা নিজস্ব স্বভাবে স্থিত থেকে সব অবস্থাকে আলোকিত করে। এটি জাগতিক সকল অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানকে আলোকিত করে, কিন্তু নিজে কোনো অভিজ্ঞতা বা জ্ঞানের বিষয়বস্তু হয় না।


এই কারণেই তুরীয়কে 'প্রপঞ্চোপশম' বলা হয়। 'প্রপঞ্চ' বলতে বোঝায় জাগতিক সকল দ্বৈততা, বৈচিত্র্য এবং মায়িক প্রকাশ। 'উপশম' মানে নিস্তব্ধতা বা বিলীন হওয়া। অর্থাৎ, তুরীয় এমন একটি অবস্থা, যেখানে সমস্ত দ্বৈততা, সংঘাত এবং ভ্রম দূর হয়ে যায় এবং পরম শান্তি ও একত্বের অনুভূতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি সেই চূড়ান্ত আধ্যাত্মিক অবস্থা, যেখানে আত্মা তার প্রকৃত স্বরূপে প্রতিভাত হয়, সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে। এটি শুধু একটি দার্শনিক ধারণা নয়, বরং আধ্যাত্মিক অনুশীলনের মাধ্যমে উপলব্ধ এক গভীর অনুভূতির নাম, যেখানে ব্যক্তি তার অস্তিত্বের মূল কেন্দ্রে স্থিত হয় এবং পরম সত্যের সাথে একাকার হয়ে যায়।


মান্ডুক্য উপনিষদ, যা দশটি প্রধান উপনিষদের মধ্যে অন্যতম, তার সংক্ষিপ্ততা সত্ত্বেও গভীর দার্শনিক অন্তর্দৃষ্টির জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। এটি যে শুধু আধুনিক বেদান্তিক চিন্তাধারায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব লাভ করেছে তা নয়, বরং বিভিন্ন ঋষি ও পণ্ডিত এর ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করে একে আরও প্রভাবশালী করে তুলেছেন। উপনিষদটি চেতনার চারটি অবস্থা—জাগ্রত (বৈশ্বানর), স্বপ্ন (তৈজস), সুষুপ্তি (প্রাজ্ঞ) এবং তুরীয়—এর বিশদ বর্ণনা দেয়, যা আত্ম-উপলব্ধির পথে এক মৌলিক ভিত্তি স্থাপন করে।


স্বামী চিন্ময়ানন্দ, একজন প্রভাবশালী বেদান্তিক আচার্য, মাণ্ডুক্য উপনিষদের কেন্দ্রীয় ধারণাকে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর অর্থে তুলে ধরেছেন: “The first three are experiences in time; the fourth is timeless Being. Knowing it is liberation.” এই উক্তিটি উপনিষদের মূল শিক্ষাকে দারুণভাবে ফুটিয়ে তোলে। এখানে প্রথম তিনটি অবস্থা, অর্থাৎ জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি, সময়ের সাথে আবদ্ধ অভিজ্ঞতা হিসেবে বিবেচিত। জাগ্রত অবস্থায় আমরা বাহ্যিক জগৎকে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অনুভব করি। স্বপ্নাবস্থায় মন অভ্যন্তরীণ জগৎ তৈরি করে এবং তাতে বিচরণ করে। সুষুপ্তিতে, গভীর নিদ্রায়, সমস্ত প্রকার ভেদাভেদ বিলীন হয়ে যায় এবং মন সম্পূর্ণ শান্ত থাকে, যদিও তখনও চেতনার একটি সূক্ষ্ম স্তর বিদ্যমান থাকে। এই তিনটি অবস্থাই পরিবর্তনশীল এবং আপেক্ষিক, যার সাথে অহংবোধ জড়িত।


অন্যদিকে, তুরীয় হলো এই তিনটি অবস্থার ঊর্ধ্বে, এক শাশ্বত ও অখণ্ড সত্তা। এটি দেশ, কাল ও কার্যকারণের বাইরে, নির্গুণ ব্রহ্মের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। স্বামী চিন্ময়ানন্দের মতে, এই তুরীয় অবস্থাকে জানা বা উপলব্ধি করাই হলো প্রকৃত মুক্তি। এটি কোনো নতুন অভিজ্ঞতা নয়, বরং আমাদের প্রকৃত স্বরূপে ফিরে আসা, যা সর্বদা বিদ্যমান ছিল, কিন্তু মায়ার আবরণে ঢাকা পড়েছিল। তুরীয় হলো সেই বিশুদ্ধ চেতনা, যা সমস্ত অভিজ্ঞতাকে আলোকিত করে, কিন্তু নিজে কোনো অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রভাবিত হয় না। এটি নিছক একটি অবস্থা নয়, বরং সমস্ত অবস্থার ভিত্তি এবং তাদের সাক্ষী।


স্বামী স্বরূপানন্দ মাণ্ডুক্য উপনিষদের ব্যাখ্যায় আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা যোগ করেছেন। তিনি বলেন, “Mandukya is not about four separate states but about realizing that you, the awareness, are untouched by waking, dream, or sleep.” স্বামী স্বরূপানন্দের এই বক্তব্য উপনিষদের আরেকটি মৌলিক সত্যকে তুলে ধরে। এটি চেতনার চারটি পৃথক সত্তা নিয়ে নয়, বরং সেই সচেতনতার উপলব্ধি সম্পর্কে—যা জাগ্রত, স্বপ্ন বা সুষুপ্তি কোনো অবস্থাতেই প্রভাবিত হয় না।


এই ব্যাখ্যা অনুসারে, আমাদের প্রকৃত স্বরূপ হলো সেই ‘সচেতনতা’ বা ‘দ্রষ্টা’, যা এই তিনটি অবস্থার পরিবর্তনকে কেবল পর্যবেক্ষণ করে। আমরা জাগতিক অভিজ্ঞতার সাথে নিজেদের এত গভীরভাবে চিহ্নিত করি যে, আমরা ভুলে যাই, আমরা আসলে এই অভিজ্ঞতার সাক্ষী মাত্র, অভিজ্ঞতার অংশ নই। জাগ্রত অবস্থায়, আমাদের মনে হয়, আমরা শরীর এবং মন; স্বপ্নাবস্থায়, আমরা স্বপ্নের চরিত্র; এবং সুষুপ্তিতে, আমরা একটি শূন্যতা অনুভব করি। কিন্তু এই প্রতিটি অভিজ্ঞতার পেছনে একটি অপরিবর্তনীয় চেতনা বিদ্যমান, যা এই সমস্ত পরিবর্তনকে আলোকিত করে। এই অপরিবর্তনীয় চেতনাকেই তুরীয় বলা হয়। এটি কোনো কিছু যুক্ত করে বা বিয়োগ করে পাওয়া যায় না; এটি কেবল উপলব্ধি করার বিষয়।


মাণ্ডুক্য উপনিষদ এই উপলব্ধি প্রদানের জন্য একটি বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করে। এটি 'ওঁ' (AUM) মন্ত্রের মাধ্যমে চেতনার চারটি অবস্থা ব্যাখ্যা করে। 'অ' (A) অক্ষরটি জাগ্রত অবস্থাকে, 'উ' (U) অক্ষরটি স্বপ্ন অবস্থাকে এবং 'ম' (M) অক্ষরটি সুষুপ্তি অবস্থাকে নির্দেশ করে। 'ওঁ'-এর নীরব অংশ বা অনাহত ধ্বনিটি তুরীয় অবস্থাকে বোঝায়। এই গভীর বিশ্লেষণ মানব-মনকে তার নিজস্ব প্রকৃতির গভীরে প্রবেশ করতে সাহায্য করে এবং তাকে তার সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে অসীম চেতনার সাথে একীভূত হওয়ার পথ দেখায়।


আধুনিক যুগে, যেখানে মনস্তত্ত্ব এবং নিউরোসায়েন্স চেতনার রহস্য উন্মোচনে সচেষ্ট, সেখানে মাণ্ডুক্য উপনিষদের এই প্রাচীন জ্ঞান এখনও প্রাসঙ্গিক। এটি শুধুমাত্র ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক গ্রন্থ নয়, বরং মানব চেতনার প্রকৃতি এবং আত্ম-উপলব্ধির একটি ব্যাবহারিক পথপ্রদর্শক। এর শিক্ষা আমাদেরকে আমাদের অভ্যন্তরীণ জগতের গভীরে প্রবেশ করতে এবং আমাদের প্রকৃত সত্তার সাথে সংযোগ স্থাপন করতে সাহায্য করে, যা সমস্ত দুঃখ ও সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তির পথ দেখায়। এই উপনিষদ তাই কেবল একটি প্রাচীন গ্রন্থ নয়, বরং মানবাত্মার শাশ্বত জিজ্ঞাসার এক চিরন্তন উত্তর।


আত্মা এক, চিরন্তন, অদ্বিতীয়—তার প্রকাশই বিশ্ব, তৈজস ও প্রাজ্ঞ। কিন্তু যখন মন এই তিনের অতীত হয়ে তুরীয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখনই আত্মা উপলব্ধি করে নিজের প্রকৃত স্বরূপ—চিদানন্দরূপ ব্রহ্ম। এই উপলব্ধিই মাণ্ডুক্যের চরম শিক্ষা, যেখানে “চতুষ্পাদ্ আত্মা” শেষপর্যন্ত অদ্বৈত চৈতন্যে লীন হয়, আর বাকি থাকে একমাত্র সেই সত্য—“একমেবাদ্বিতীয়ম্”, এক এবং অদ্বিতীয়।


জীব এই চার অবস্থার মধ্য দিয়েই প্রতিনিয়ত চলাচল করে—জাগরণ, স্বপ্ন, নিদ্রা ও তুরীয় অভিজ্ঞতার সম্ভাবনা। কিন্তু জীবের স্বরূপ কখনও বদলায় না—সেই একই চৈতন্য প্রতিটি অবস্থার মধ্যে অব্যাহত থাকে। যেমন সূর্য দিনে জ্বলে, রাতে লুকায়, মেঘে আচ্ছন্ন হয়—তবু সূর্য অপরিবর্তিত।


জগৎ যতই বৈচিত্র্যময় হোক না কেন, ব্রহ্মই একমাত্র নিত্যসত্য (Nitya-Satya)। এ সমস্ত পরিবর্তন, রূপ, ভাব ও কর্ম ব্রহ্মেরই অন্তর্গত। উপনিষদ তাই দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করে—“অয়ম্ আত্মা ব্রহ্ম”—এই আত্মাই ব্রহ্ম, এই জগৎই ব্রহ্মের মধ্যস্থ প্রকাশ। যা-কিছু দেখা যায়, শোনা যায়, ভাবা যায়, সবই সেই এক চেতনার তরঙ্গমাত্র।


এই উপলব্ধি যখন সাধকের অন্তরে জেগে ওঠে, তখন তাঁর কাছে জগৎ আর “অন্য” থাকে না; সমস্ত অস্তিত্বে তিনি নিজেকেই চিনতে থাকেন। তখন তাঁর বোধে “সর্বং হি এতৎ ব্রহ্ম” (মাণ্ডুক্য উপনিষদ, মন্ত্র ২)—এই এক বাক্যই চিরসত্য হয়ে ওঠে—সবই ব্রহ্ম, ব্রহ্ম ব্যতীত কিছুই নয়।


আত্মা চির-আলোকিত, স্বয়ংপ্রকাশ (Svayam-Prakāśa)। আবরণ-শক্তি কখনও তাকে আচ্ছন্ন করতে পারে না, যেমন অন্ধকার কখনও সূর্যকে স্পর্শ করতে পারে না। সূর্য “আলোকিত” হয় না, সে স্বয়ং আলোক; কেবল চোখ বন্ধ থাকলে তার আলোক অনুভূত হয় না। তেমনি আত্মা কখনও অজ্ঞানগ্রস্ত হয় না, কেবল মনই অবিদ্যার প্রতিফলনে আচ্ছন্ন বলে মনে হয়। অবিদ্যা ও তার ভঙ্গ, উভয়ই সেই মনের স্তরে ঘটে—আত্মায় নয়।


অদ্বৈত বেদান্তে তিনটি গভীর ধারণা পরস্পর সম্পর্কিতভাবে আত্মা, জগৎ ও ব্রহ্মের ঐক্য ব্যাখ্যা করে—আভাস-বাদ, চির-ব্রহ্ম-অনুভব এবং আত্মা-ব্রহ্ম-তাদাত্ম্য। এই তিনটি ধারণাই মূলত এক চেতনার তিন দিক—প্রতিফলন, উপলব্ধি ও ঐক্য।


আভাস-বাদ (Ābhāsa-vāda) অনুযায়ী, জগৎ কোনো প্রকৃত সৃষ্টি নয়; এটি ব্রহ্মচেতনারই এক প্রতিফলন, এক মায়াময় প্রকাশ। ‘আভাস’ মানে প্রতিফলন বা প্রতিবিম্ব, যেমন আয়নায় মুখের ছায়া দেখা যায়—সে সত্য নয়, তবুও মুখ ছাড়া তা সম্ভব নয়। ব্রহ্মই সেই মুখ, আর জগৎ তার প্রতিফলন। পদ্মপাদাচার্য ও প্রকাশাত্মন প্রণীত বিবরণ বিদ্যালয়ে (স্কুল অব থট) বলা হয়েছে, “চিতির্ভাসে বিশ্বমিদম্”—এই জগৎ কেবল চিত্তের প্রতিফলনমাত্র। উক্তিটির ভাব কঠোপনিষদ (২.২.১৫) এবং মুণ্ডক উপনিষদ (২.২.১০)-এর একটি বিখ্যাত শ্লোকের ওপর প্রতিষ্ঠিত: “তমেব ভান্তম অনুভাতি সর্বম্। তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি।।” অর্থাৎ, সেই আত্মা প্রকাশিত হলে সব কিছুই তাঁর অনুগামী হয়ে প্রকাশিত হয়। তাঁর আলোতেই এই সমস্ত জগৎ প্রকাশিত হয়।


এই সূত্রটি ব্রহ্মের সর্বব্যাপকত্ব এবং আত্মার স্বয়ম্প্রকাশত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এখানে, চিৎ (Cit) হলো বিশুদ্ধ চৈতন্য বা ব্রহ্ম। এটিই একমাত্র নিত্য এবং স্বয়ং প্রকাশিত সত্তা। ভাসে (Bhāse)-র অর্থ হলো আলোতে, প্রকাশে বা উদ্‌ভাসনে। বিশ্বমিদম্ (Viśvamidam) মানে এই সমগ্র দৃশ্যমান জগৎ।


এই জগৎ বা আমাদের দেখা কোনো বস্তুই স্বয়ং-প্রকাশিত নয়। আমাদের মন, বুদ্ধি এবং ইন্দ্রিয়—সব কিছুই সেই একমাত্র চিৎ বা চৈতন্য-এর আলোতেই আলোকিত হয় এবং কার্যক্ষম হয়। এটি প্রমাণ করে যে, জগৎ সত্য নয়, বরং চিৎ-এর ওপর আরোপিত একটি প্রতিচ্ছবি মাত্র।


“আত্মনা আভাসত্”—আত্মার প্রতিফলনেই বহুবিধ প্রপঞ্চের প্রতীতি ঘটে। এটি ব্রহ্ম বা আত্মার স্বয়ম্প্রকাশত্ব (Self-Luminous nature) এবং প্রকাশকত্ব (Power to manifest everything) বোঝাতে ব্যবহৃত একটি সিদ্ধান্তমূলক প্রবচন। এই উক্তিটির মূল ভাব কঠোপনিষদ, মুণ্ডক উপনিষদ এবং শুক্ল যজুর্বেদের মতো উপনিষদগুলিতে পাওয়া যায়। যেমন: "তমেব ভান্তম্ অনুভাতি সর্বম্। তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি।।" অর্থাৎ, সেই আত্মা প্রকাশিত হলে সব কিছু তাঁর অনুগামী হয়ে প্রকাশিত হয়। তাঁর আলোতেই এই সমস্ত জগৎ প্রকাশিত হয়। এই বিখ্যাত মন্ত্রটি তিনটি প্রধান উপনিষদে প্রায় অভিন্ন রূপে পাওয়া যায়, যা এর গুরুত্বকে প্রমাণ করে।


কঠোপনিষদ (Kaṭha Upaniṣad)—২.২.১৫। মুণ্ডক উপনিষদ (Muṇḍaka Upaniṣad)—২.২.১০। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ (Śvetāśvatara Upaniṣad)—৬.১৪।


এই মন্ত্রটি ব্রহ্মের স্বরূপ এবং তাঁর স্বয়ম্প্রকাশত্ব (Self-Luminousness) নীতিকে প্রতিষ্ঠা করে।


আত্মার স্বয়ম্প্রকাশত্ব (তমেব ভান্তম্ অনুভাতি সর্বম্)—ভান্তম্ (Bhāntam): এখানে আত্মা বা ব্রহ্ম হলেন সেই একমাত্র সত্তা, যিনি স্বয়ং প্রকাশিত (Self-luminous)। তাঁর প্রকাশের জন্য অন্য কোনো কিছুর প্রয়োজন হয় না। অনুভাতি সর্বম্: "অনুভাতি" শব্দের অর্থ হলো অনুসরণ করে প্রকাশিত হওয়া। এর মানে হলো, জগতের অন্য যা-কিছু প্রকাশিত হয়—সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র, আগুন বা আমাদের মন ও বুদ্ধি—তা সবই ব্রহ্মের আলোর ধার করা শক্তিতে প্রকাশিত হয়। ব্রহ্মই তাদের সকলের প্রাথমিক প্রকাশক।


জগৎ ব্রহ্মের প্রতিচ্ছবি (তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি)—তস্য ভাসায়: 'তাঁহার আলোতেই'—এই অংশটি চূড়ান্তভাবে ঘোষণা করে যে, এই সমগ্র দৃশ্যমান জগৎ (সর্বমিদং) যে আমরা দেখতে পাই (বিভাতি), তার মূল ভিত্তি ব্রহ্মের চৈতন্য।


যেমন সূর্যের আলোয় ঘর আলোকিত হয়; ঘর স্বয়ং-প্রকাশিত নয়—ঠিক তেমনই, ব্রহ্মের চৈতন্যরূপ আলোতেই এই জড় জগৎ প্রকাশিত এবং সচল থাকে। এই মন্ত্রটি অদ্বৈত বেদান্তের সেই চরম সত্যকে তুলে ধরে যে, এই জগৎ সত্য নয়, বরং ব্রহ্মই একমাত্র সত্য। জগৎ হলো ব্রহ্মের আলোতে প্রকাশিত একটি প্রতিচ্ছবি বা আপাত-প্রকাশ (Māyā)।