উক্তির মূল উৎস মাণ্ডুক্য উপনিষদের দ্বিতীয় মন্ত্র: “সঃ এষঃ চতুষ্পাত্” (Sa eṣa catuṣpāt)—অর্থাৎ “এই আত্মা চার পাদবিশিষ্ট।” এরপর তৃতীয় থেকে সপ্তম মন্ত্র পর্যন্ত এই চারটি অবস্থার বিস্তারিত বিশ্লেষণ পাওয়া যায়।
প্রথম পাদ হলো বিশ্ব (Viśva)—এটি জাগ্রত অবস্থা, যেখানে আত্মা ইন্দ্রিয় ও মন দ্বারা বহির্মুখী জ্ঞান লাভ করে এবং স্থূল বস্তু ভোগ করে। উপনিষদে বলা হয়েছে, “জাগরিতস্থানঃ বহির্প্রজ্ঞঃ... স্থূলভোগী বিশ্বঃ”—অর্থাৎ, জাগ্রত অবস্থায় আত্মা বহির্মুখী চেতনা নিয়ে স্থূল জগতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে।
দ্বিতীয় পাদ হলো তৈজস (Taijasa)—স্বপ্নাবস্থা, যেখানে আত্মা অন্তর্মুখী জ্ঞান লাভ করে এবং সূক্ষ্ম বস্তুর (চিন্তা, কল্পনা, স্মৃতি) অভিজ্ঞতা করে। উপনিষদে বলা হয়েছে, “স্বপ্নস্থানঃ অন্তঃপ্রজ্ঞঃ... সূক্ষ্মভোগী তৈজসঃ”—এই অবস্থায় ইন্দ্রিয় বিশ্রামে থাকে, কিন্তু মন নিজের জগৎ সৃষ্টি করে।
তৃতীয় পাদ হলো প্রাজ্ঞ (Prājña)—সুষুপ্তি বা গভীর নিদ্রার অবস্থা, যেখানে সকল বিভেদবোধ ও চিন্তা-প্রবাহ বিলীন। তখন আত্মা কেবল চৈতন্যরূপে থাকে, জ্ঞানঘন ও আনন্দময় অবস্থায়। মাণ্ডুক্য উপনিষদ বলে, “যত্র সুপ্তো ন কঞ্চন কামং কাময়তে ন কঞ্চন স্বপ্নং পশ্যতি তৎ সুষুপ্তম্... প্রাজ্ঞানঘন আনন্দময়ঃ।” অর্থাৎ, এই অবস্থায় কামনা ও স্বপ্ন লুপ্ত হয়, থাকে কেবল এক জ্ঞানময় আনন্দচেতনা।
চতুর্থ পাদ হলো তুরীয় (Turīya)—যা তিন অবস্থার ঊর্ধ্বে, অচিন্ত্য, অদ্বৈত, অব্যক্ত, নির্মল চৈতন্য। উপনিষদে বলা হয়েছে, “নান্তঃপ্রজ্ঞম্, ন বহিঃপ্রজ্ঞম্, ন উভয়তঃপ্রজ্ঞম্... প্রপঞ্চোপশমম্, শান্তম্, শিবম্, অদ্বৈতম্—চতুর্থম্, সঃ আত্মা, সঃ বিজ্ঞেয়ঃ।” অর্থাৎ, তুরীয় না বাহিরমুখী, না অন্তর্মুখী; এটি অব্যক্ত, অচিন্ত্য, সমস্ত প্রপঞ্চের উপশম, চিরশান্ত, শুভ ও অদ্বৈত—এই তুরীয়ই আত্মা, একে জানা উচিত।
এই চার অবস্থার দার্শনিক তাৎপর্য হলো, আত্মা কখনও পরিবর্তিত হয় না—জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি অবস্থায় শুধু অভিব্যক্তির ভেদ ঘটে। তুরীয় সেই আত্মা, যিনি সব অবস্থার সাক্ষী। শঙ্করাচার্য তাঁর কারিকাভাষ্যে বলেন, “তুরীয়ং সর্বাবস্থাভ্যঃ অনন্বয়ানুপপন্নম্”—তুরীয়ের সঙ্গে কোনো অবস্থারই যোগ নেই; সে সর্বাবস্থার ঊর্ধ্বে।
রমণ মহর্ষি এবং স্বামী বিবেকানন্দ উভয়েই গভীর আধ্যাত্মিক উপলব্ধির মাধ্যমে আত্মার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন, যা উপনিষদিক দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু। মহর্ষি তাঁর গভীর আত্মানুসন্ধানের ফলস্বরূপ বলেন, "Waking, dream, and deep sleep come and go, but you, the Witness, remain. That immutable awareness is the Turīya, the Self।" এই উক্তিটি আত্মার অক্ষয় ও অপরিবর্তনীয় প্রকৃতিকে নির্দেশ করে। জাগরণ, স্বপ্ন এবং সুষুপ্তি—এই তিনটি অবস্থা আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার অংশ। জাগরণে আমরা বাহ্যিক জগতের সঙ্গে যুক্ত থাকি, স্বপ্নে আমাদের মন অভ্যন্তরীণ সৃষ্টিতে মগ্ন হয়, এবং সুষুপ্তিতে আমরা গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন থাকি, যেখানে কোনো স্বপ্ন বা বাহ্যিক অভিজ্ঞতার জ্ঞান থাকে না। এই প্রতিটি অবস্থায় আমাদের চেতনার ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ ঘটে, কিন্তু এই সব অবস্থার মধ্য দিয়েও একটি অপরিবর্তনীয় সত্তা বিদ্যমান থাকে, যা এই সমস্ত অভিজ্ঞতাকে সাক্ষী হিসাবে প্রত্যক্ষ করে। এই সাক্ষীই হলো 'দ্রষ্টা', এবং এই অপরিবর্তনীয় সচেতনতাই হলো 'তুরীয়' অবস্থা। তুরীয় হলো চতুর্থ অবস্থা, যা জাগরণ, স্বপ্ন ও সুষুপ্তির ঊর্ধ্বে, এবং এটিই আমাদের প্রকৃত আত্মস্বরূপ। এটি নির্বিকার, নিরঞ্জন এবং সমস্ত দ্বৈততার অতীত।
মহর্ষির এই উক্তিটি যোগবাশিষ্টের 'দ্রষ্টা-দৃশ্য' ভেদ এবং মাণ্ডুক্য উপনিষদের আত্মতত্ত্বের সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত। যোগবাশিষ্টে, জগৎকে দ্রষ্টার মনের সৃষ্টি হিসাবে দেখা হয়, যেখানে দ্রষ্টা এবং দৃশ্য একে অপরের থেকে অবিচ্ছেদ্য। এই দার্শনিক ধারণা অনুসারে, বাহ্যিক জগৎ আমাদের চেতনারই প্রতিচ্ছবি। আমাদের মন যেমন ভাবে, জগৎ তেমনই আকার ধারণ করে। এই বিভাজন, অর্থাৎ দ্রষ্টা ও দৃশ্যের মধ্যে আপাত পার্থক্য, আসলে এক মায়া মাত্র। যখন এই বিভেদ ঘুচে যায়, তখন উপলব্ধি হয় যে, দৃশ্যমান সবকিছুই দ্রষ্টারই ভিন্ন প্রকাশ।
অন্যদিকে, মাণ্ডুক্য উপনিষদ আত্মাকে 'তুরীয়' অবস্থা হিসাবে বর্ণনা করে, যা জাগ্রত, স্বপ্ন এবং সুষুপ্তি—এই তিন অবস্থার অতীত। এই তুরীয় অবস্থাই পরমাত্মা বা ব্রহ্মের সাথে একাত্মতার প্রতীক। এই উপনিষদ ব্যাখ্যা করে যে, আত্মা চারটি পাদে প্রকাশ পায়: জাগ্রত অবস্থায় স্থূল বস্তুর ভোগ, স্বপ্নাবস্থায় সূক্ষ্ম বস্তুর অনুভব, সুষুপ্তি অবস্থায় আনন্দময় অখণ্ড জ্ঞান এবং চতুর্থ অবস্থায় অদ্বৈত, অব্যক্ত ও শান্ত তুরীয়। এই তুরীয় অবস্থাতেই আত্মতত্ত্বের পূর্ণ উপলব্ধি হয়, যেখানে কোনো দ্বৈততা থাকে না।
মহর্ষির উক্তিটি এই দুটি দর্শনের মূল বার্তাগুলিকে একত্রিত করে। এর মাধ্যমে বোঝানো হয় যে, যেমন যোগবাশিষ্টে দ্রষ্টা-দৃশ্যের অভেদত্ব পরিলক্ষিত হয়, তেমনই মাণ্ডুক্য উপনিষদের আত্মতত্ত্বের তুরীয় অবস্থায় পৌঁছালে এই অভেদত্ব সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। উভয়ই আত্ম-উপলব্ধি এবং পরম সত্যের দিকে নির্দেশ করে, যেখানে ব্যক্তিগত আত্মা এবং বিশ্ব আত্মার মধ্যে কোনো বিভেদ থাকে না। এই সংযোগের মাধ্যমে, মহর্ষি আধ্যাত্মিক পথের এক গভীর দিক উন্মোচন করেছেন, যা আমাদের সত্তার প্রকৃত প্রকৃতি এবং মহাবিশ্বের সাথে এর সংযোগ সম্পর্কে নতুনভাবে চিন্তা করতে শেখায়।
স্বামী বিবেকানন্দও একই সত্যকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি মাণ্ডুক্য উপনিষদকে সকল উপনিষদের মধ্যে সবচেয়ে আলোকোজ্জ্বল বলে অভিহিত করে বলেছেন, "The Mandukya is the most illuminating of all Upanishads; it shows that the Self is beyond all states—ever pure, eternal, and free।" স্বামীজি মনে করতেন, মাণ্ডুক্য উপনিষদ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হলেও এর গভীরতা অপরিসীম। এটি ওঙ্কার (A-U-M)-এর মাধ্যমে আত্মার চারটি অবস্থাকে (জাগরণ, স্বপ্ন, সুষুপ্তি এবং তুরীয়) ব্যাখ্যা করে এবং দেখায় যে, আত্মা এই সমস্ত অবস্থার অতীত।
আত্মা নিত্যশুদ্ধ, সনাতন এবং চিরমুক্ত। এটি কোনো জাগতিক বন্ধনে আবদ্ধ নয় এবং কোনো ক্ষণস্থায়ী অবস্থার দ্বারা প্রভাবিত হয় না। স্বামীজির ব্যাখ্যায়, আত্মাকে উপলব্ধি করা মানে এই চিরন্তন বিশুদ্ধতা এবং মুক্তিকে উপলব্ধি করা, যা আমাদের প্রকৃত সত্তা। তাঁর মতে, মানবজীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো এই আত্মজ্ঞান লাভ করা এবং সমস্ত মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে পরম সত্যে বিলীন হওয়া। মাণ্ডুক্য উপনিষদ অদ্বৈত বেদান্তের একটি প্রধান ভিত্তি, যা আত্মার অভিন্নতাকে ব্রহ্মের সাথে প্রতিষ্ঠিত করে।
উভয় মহাপুরুষের বাণীই এই মৌলিক সত্যের উপর জোর দেয় যে, আমাদের বাহ্যিক অভিজ্ঞতা এবং শারীরিক অস্তিত্ব ক্ষণস্থায়ী হলেও, আমাদের প্রকৃত আত্মস্বরূপ অপরিবর্তনীয়, শাশ্বত এবং মুক্ত। রমণ মহর্ষি আত্মানুসন্ধানের মাধ্যমে আত্মস্বরূপে লীন হওয়ার কথা বলেছেন, যেখানে ব্যক্তি কেবল 'আমি কে?' এই প্রশ্নের গভীরতম উত্তর খুঁজে পায়। অন্যদিকে, স্বামী বিবেকানন্দ আধ্যাত্মিক জ্ঞান এবং যোগের মাধ্যমে এই আত্মাকে উপলব্ধি করার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন, যা মানুষকে সকল প্রকার দুঃখ ও বন্ধন থেকে মুক্তি দেয়। তাঁদের শিক্ষাগুলি আজও লক্ষ লক্ষ মানুষকে আত্মোপলব্ধির পথে অনুপ্রাণিত করে চলেছে, যা মানবজীবনের পরম উদ্দেশ্য এবং পরম শান্তি লাভের একমাত্র পথ।
আত্মার চতুষ্পাদ মানে চারটি ভিন্ন আত্মা নয়, বরং এক আত্মার চারটি প্রকাশস্তর। জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি—এগুলি মন ও মায়ার ক্রিয়া; আর তুরীয় হলো আত্মার নিজের স্বরূপ—নির্মল, অদ্বিতীয়, চিরচৈতন্য। এই কারণেই মাণ্ডুক্য উপনিষদ শেষে ঘোষণা করে, “ওঁ ইত্যেতদক্ষরং ইদং সর্বং; ওঁ ইত্যেতদ্ ব্ৰহ্ম; ওঁ ইত্যেতদ্ আত্মা।” অর্থাৎ, ওঁ-কারই এই সমগ্র জগত, ওঁ-কারই ব্রহ্ম, এবং ওঁ-কারই আত্মা—যেখানে চারটি পাদ মিলেমিশে এক হয়ে যায়।
মাণ্ডুক্য উপনিষদের "চতুষ্পাদ্ আত্মা" ধারণাটি কেবল মানুষের চেতনার বিভিন্ন স্তরকে বর্ণনা করে না, বরং এটি সমগ্র অস্তিত্বের একটি গভীর দার্শনিক ব্যাখ্যা প্রদান করে। এই চারটি অবস্থা—জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি, এবং তুরীয়—একটি অবিচ্ছিন্ন সত্তার বিভিন্ন প্রকাশ হিসেবে বিবেচিত হয়, যা স্থূল থেকে সূক্ষ্ম এবং তারও অতীত এক পরম স্তরে ব্যাপ্ত।
বিশ্ব (জাগ্রত অবস্থা)—বহির্জগৎ এবং স্থূল ভৌতিক জগৎ: "বিশ্ব" হলো আত্মার জাগ্রত অবস্থা, যা আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা এবং বহির্জগতের সাথে যুক্ত। এই অবস্থায় আমরা পঞ্চেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে স্থূল ভৌতিক জগৎকে অনুভব করি। আমরা যা দেখি, শুনি, স্পর্শ করি, স্বাদ গ্রহণ করি এবং গন্ধ পাই, তার সবই এই বিশ্ব-অবস্থার অন্তর্ভুক্ত। এটি আমাদের বাস্তবতার সবচেয়ে সুস্পষ্ট এবং প্রত্যক্ষ স্তর, যেখানে আমরা বস্তুগত অস্তিত্বের সাথে সরাসরি interact করি। এই অবস্থায় আত্মা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বাইরের জগৎকে উপলব্ধি করে এবং জ্ঞান অর্জন করে। আমাদের কর্ম এবং প্রতিক্রিয়ার অধিকাংশই এই স্তরে ঘটে।
তৈজস (স্বপ্ন অবস্থা)—সূক্ষ্ম জগৎ, চিন্তা, ইচ্ছা, কল্পনার জগৎ: "তৈজস" হলো আত্মার স্বপ্ন অবস্থা, যা জাগ্রত অবস্থার চেয়ে আরও সূক্ষ্ম। এই স্তরে আমরা অভ্যন্তরীণ জগতে প্রবেশ করি, যেখানে চিন্তা, ইচ্ছা, কল্পনা, স্মৃতি এবং আবেগ প্রধান ভূমিকা পালন করে। স্বপ্নকালে আমরা বিভিন্ন দৃশ্য, ঘটনা এবং অনুভূতি অনুভব করি, যা আমাদের জাগ্রত অভিজ্ঞতার সাথে সরাসরি যুক্ত না-ও হতে পারে। এই জগৎ স্থূল নয়, বরং মন দ্বারা সৃষ্ট এবং পরিচালিত হয়। তৈজস অবস্থায় আত্মা তার নিজস্ব আলোয় (তেজ, tej) আলোকিত হয় এবং নিজস্ব সূক্ষ্ম অভিজ্ঞতার জগত তৈরি করে। এটি আমাদের সৃজনশীলতা, কল্পনা এবং গভীর আকাঙ্ক্ষার উৎস।
প্রাজ্ঞ (সুষুপ্তি অবস্থা)—কারণজগৎ, সম্ভাবনার স্তর: "প্রাজ্ঞ" হলো আত্মার সুষুপ্তি বা গভীর নিদ্রার অবস্থা, যেখানে সকল অভিজ্ঞতা লীন হয়ে যায় এবং কেবল আনন্দ (আনন্দময় কোষ) অবশিষ্ট থাকে। এই অবস্থায় কোনো স্বপ্ন বা জাগতিক সচেতনতা থাকে না। এটি কারণজগৎ, যেখানে সকল অভিজ্ঞতার বীজ সুপ্ত থাকে। এখানে স্থূল বা সূক্ষ্ম কোনও বস্তুর উপলব্ধি থাকে না, কেবল অবিচ্ছিন্ন একীভূত চেতনা বিদ্যমান থাকে। প্রাজ্ঞ অবস্থায় আত্মা 'একীভূতঃ' (একীভূত) রূপে অবস্থান করে, যেখানে দ্বৈততার বিলুপ্তি ঘটে। এই স্তরটি সকল জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার কারণ এবং সম্ভাবনা রূপে বিদ্যমান থাকে। এটি সেই গভীর বিশ্রাম, যেখানে মন তার সকল কার্যকলাপ থেকে মুক্ত হয়ে পরম শান্তিতে থাকে।
তুরীয় (চতুর্থ অবস্থা)—সকলের ভিত্তি, অনাহত ও অতিক্রমী: "তুরীয়" হলো চতুর্থ এবং পরম অবস্থা, যা বিশ্ব, তৈজস এবং প্রাজ্ঞ—এই তিনটির অতীত এবং তাদের সকলের ভিত্তি। এটি কোনো অবস্থা নয়, বরং সকল অবস্থার মধ্য দিয়ে বিদ্যমান এক নিত্য, অনাহত এবং নির্বিশেষ চেতনা। তুরীয় কোনো অভিজ্ঞতা বা উপলব্ধির বিষয় নয়, এটি নিজেই উপলব্ধি। এটি অদ্বৈত, যেখানে কোনো দ্বৈততা বা বিভেদ নেই। এটি শান্তি (শান্তম্, peace), শিব (শুভম্, benevolence) এবং অদ্বৈতম্ (অদ্বিতীয়, uniqueness)। এটি আত্মার বিশুদ্ধতম রূপ, যা কোনো গুণ বা বৈশিষ্ট্য দ্বারা সীমিত নয়। তুরীয় হলো পরমাত্মার সাথে জীবাত্মার একত্বের উপলব্ধি। এটি সেই স্তর, যেখানে সকল ভ্রম দূর হয় এবং আত্মা তার প্রকৃত, সীমাহীন প্রকৃতি উপলব্ধি করে। এটি হলো পরম মুক্তি এবং জ্ঞান।
এই চতুষ্পাদ্ ধারণাটির মূল উদ্দেশ্য হলো, মানুষকে তার সীমিত ব্যক্তিগত চেতনার বাইরে নিয়ে গিয়ে এক মহাজাগতিক চেতনার সাথে যুক্ত করা, যেখানে প্রতিটি স্তরই ব্রহ্মের বিভিন্ন প্রকাশ মাত্র। এই উপলব্ধি মানুষকে আত্ম-অনুসন্ধান এবং আধ্যাত্মিক মুক্তির পথে পরিচালিত করে।
তুরীয় হলো চেতনার চতুর্থ অবস্থা, যা জাগ্রত (স্থূল দেহ), স্বপ্ন (সূক্ষ্ম দেহ) এবং সুষুপ্তি (কারণ দেহ)—এই তিন অবস্থার ঊর্ধ্বে অবস্থিত। শঙ্করাচার্য তাঁর দর্শনে তুরীয়কে 'ত্রয়ী অবস্থার প্রত্যক্ষদর্শী' হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যার অর্থ—তুরীয় এই তিনটি অবস্থার সাক্ষী বা দ্রষ্টা, কিন্তু নিজে সেগুলোর দ্বারা প্রভাবিত নয়।