অবিদ্যা-বিদ্যা: ৪৯



শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে স্পষ্ট করেছেন—“উপসংক্রামণং নাম ন তু গমনং, আত্মনঃ ব্রহ্মভেদ-অবিধায়ক-অবিদ্যা-নিবৃত্তিমাত্রম্”—অর্থাৎ, উপসংক্রামতি কোনো গতি নয়; এটি কেবল ব্রহ্ম ও আত্মার মধ্যে বিভেদের ধারণার, অর্থাৎ অজ্ঞানতার, অবসানমাত্র। যেমন সূর্য কোথাও গিয়ে উদিত হয় না, কেবল মেঘ সরে গেলে প্রকাশিত হয়; তেমনি আত্মাও কোথাও গিয়ে ব্রহ্মে মেশে না—অবিদ্যা সরে গেলেই প্রকাশ পায় যে, সে চিরকালই ব্রহ্ম ছিল। এই ব্যাখ্যাটি ব্রহ্মসূত্রের "অনাবৃত্তিঃ শব্দাত্" (৪.৪.২২) সূত্রের ভাষ্য বা মোক্ষ-আলোচনার প্রসঙ্গে প্রায়শই ব্যবহৃত হয়।


এই সূত্রটি মোক্ষের প্রক্রিয়া এবং "উপসংক্রামতি" শব্দের সঠিক অর্থ ব্যাখ্যা করে, যা অদ্বৈত বেদান্তের মূল সিদ্ধান্তের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ—


“উপসংক্রামণ গমন নয় (ন তু গমনম্)” অংশে সেই ধারণাটি বাতিল/খণ্ডন করা হয়েছে, যা মনে করে, উপসংক্রামণ (ব্রহ্মে প্রবেশ) হলো এক প্রকার স্থানিক গমন বা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়া। এর কারণ, ব্রহ্ম সর্বব্যাপী। যিনি সর্বব্যাপী, তাঁর কাছে গমন সম্ভব নয়। কোনো ব্যক্তি যদি ব্রহ্মেই অবস্থিত হন, তবে তিনি কীভাবে সেখানে "যেতে" পারেন?


উপসংক্রামণ হলো অবিদ্যার নিবৃত্তি (অবিদ্যা-নিবৃত্তিমাত্রম্)। মোক্ষ বা ব্রহ্মে প্রবেশ কোনো ভ্রমণ নয়, বরং এটি হলো আত্মার মধ্যে ব্রহ্ম থেকে যে-ভেদ (পার্থক্য) দেখা যাচ্ছিল, সেই ভেদ-সৃষ্টিকারী অবিদ্যার (অজ্ঞানের) কেবল নিবৃত্তি (নিবৃত্তিমাত্রম্)।


আলো-অন্ধকার—এটি সেই জ্ঞানের অনুরূপ—অন্ধকারে-থাকা ব্যক্তি যখন আলো জ্বালান, তখন তিনি কোথাও "যান না", কেবল তাঁর চারপাশের অন্ধকারটি (অবিদ্যা) দূর হয়।


এই সূত্রটি মোক্ষ সম্পর্কে অদ্বৈত বেদান্তের সিদ্ধান্তকে চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত করে—মোক্ষ হলো অজ্ঞান দূরীকরণ (নিবৃত্তি) মাত্র, এটি কোনো বস্তু অর্জন বা কোনো স্থানে গমন নয়। জীবাত্মা সর্বদা ব্রহ্মই ছিল, জ্ঞানলাভের মাধ্যমে কেবল এই সত্যের আবরণটি সরে যায়।


অন্যদিকে, অজ্ঞানীর উপসংক্রামতি হলো সত্যিকারের স্থানান্তর—এক দেহ থেকে অন্য দেহে, এক লোক (জগৎ) থেকে অন্য লোকে (জগতে) গমন। “যথা কর্মণো গতির্ভবতি, তথৈবৈষ উপসংক্রামতি”—“যেমন তাঁর কর্ম, তেমনই তাঁর গমন।” ব্রহ্মসূত্রের এই ৩.১.১ অংশে আলোচনা করা হয়েছে যে, মৃত্যুর পর জীবাত্মা তার কর্মের অবশিষ্ট ফল (সংস্কার) এবং সূক্ষ্ম উপাধি (যেমন মন) নিয়ে স্থানান্তরিত হয়। এই সূত্রটি বোঝায় যে, মুক্তিহীন জীবের পরবর্তী গন্তব্য (গতি) তার পূর্বকৃত কর্ম দ্বারাই স্থিরীকৃত হয়, যা অজ্ঞানী জীবের মৃত্যুর পরের গতি বর্ণনা করে। এটি অদ্বৈত বেদান্তের অন্যতম প্রাথমিক পাঠ।


কর্মের দ্বারা নির্ধারিত গতি: এখানে 'কর্মণো গতিঃ' বলতে বোঝায়, জীবাত্মা তার পুণ্য ও পাপের ফল (কর্মফল) অনুসারে মৃত্যুর পর কোন লোকে যাবে, তা নির্ধারিত হয়।

উপসংক্রমণ: 'উপসংক্রামতি' শব্দটি এখানে বোঝায় যে, জ্ঞানী ব্যক্তি ব্রহ্মে লীন হন না, বরং অজ্ঞানী জীব তার কর্ম অনুসারে অন্যান্য লোকে (যেমন স্বর্গ বা পিতৃলোক) প্রবেশ করে।

সৃষ্টির চক্র: এই নীতি অনুযায়ী, যতক্ষণ ব্রহ্মজ্ঞান লাভ না হয়, ততক্ষণ জীবাত্মা কর্মফলের বন্ধনে আবদ্ধ থাকে এবং কর্মের প্রকৃতি অনুসারে এই সংসার চক্রে (জন্ম-মৃত্যু-স্থানান্তর) ঘুরতে থাকে।


কর্মফল অনুসারে আত্মা স্বর্গ, পিতৃলোক, বা অন্য জাগতিক স্তরে গিয়ে সেই ফল ভোগ করে এবং পুনরায় জন্ম গ্রহণ করে। এই উপসংক্রামতি সংসারচক্রের অবিচ্ছিন্ন গতির প্রতীক।


অদ্বৈত-দৃষ্টিতে, এই দুই অর্থের মূল পার্থক্য হলো দৃষ্টিকোণ। জ্ঞানীর জন্য উপসংক্রামতি মানে অন্তঃস্থ আত্মার স্বরূপাবিভান, যেখানে কোনো গমন নেই; অজ্ঞানীর জন্য এটি কার্যত এক লোকে থেকে অন্য লোকে গমন। শঙ্করাচার্য বলেন, ব্রহ্ম সর্বব্যাপী; সুতরাং তাঁর দিকে গমন অর্থহীন। উপসংক্রামতি কেবল অবিদ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে, যেমন দ্বিত্ব দেখার পর একত্বে প্রত্যাবর্তন। অজ্ঞান যখন বিলীন হয়, তখন আত্মা বুঝতে পারে—সে কখনও কোথাও যায়নি, বরং সর্বদা সেই এক চেতনার মধ্যেই ছিল।


অদ্বৈত-আচার্য রমণ মহর্ষিও এই ব্যাখ্যাকে সমর্থন করেছেন। তাঁর মতে, ব্রহ্ম সর্বত্র; তাই উপসংক্রামতি মানে স্থান পরিবর্তন নয়, বরং মন থেকে চেতনার অন্তরকেন্দ্রে প্রত্যাবর্তন। আত্মা কোথাও যায় না—কেবল মিথ্যা পরিচয়ের আবরণ খসে যায়। তিনি বলেন, “ব্রহ্মে প্রবেশ” মানে নিজের অন্তরের আত্মায় প্রত্যাবর্তন; মৃত্যুর পরও আত্মার কোনো গতি নেই, কারণ সে অনাদি ও অবিনশ্বর।


‘উপসংক্রামতি’ শব্দটি একদিকে অজ্ঞানীর সংসারিক গমন, অন্যদিকে জ্ঞানীর আত্ম-প্রত্যাবর্তন। অজ্ঞানীর উপসংক্রামতি হলো কর্মফলভোগের স্থানান্তর, আর জ্ঞানীর উপসংক্রামতি হলো ব্রহ্ম-স্বরূপে স্থিতি। শেষপর্যন্ত অদ্বৈত বলে—উপসংক্রামতি মানে আত্মার চূড়ান্ত বিশ্রাম, সেই অভেদ-চেতনায় সম্পূর্ণ একীভবন, যেখানে আর ফিরে আসা নেই, নেই গমনাগমন, আছে কেবল নিত্য, নিঃশব্দ, অনন্ত ব্রহ্মসত্তা।


রমণ মহর্ষি “সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম” (Sarvam Khalvidam Brahma)—অর্থাৎ, “এই সমস্তই ব্রহ্ম”—এই মহাবাক্যটিকে অদ্বৈত বেদান্তের অন্যতম চূড়ান্ত সত্য হিসেবে দেখিয়েছেন। তাঁর শিক্ষার মূল অভিমুখই ছিল আত্ম-অনুসন্ধান (Ātma-vichāra), যার মাধ্যমে জানা যায় যে, “আত্মা” ও “ব্রহ্ম” এক ও অভিন্ন। এই উপলব্ধিই হলো “সবই ব্রহ্ম”—অর্থাৎ, যা-কিছু দৃশ্যমান, শ্রাব্য, চিন্তনযোগ্য, এমনকি চিন্তার অতীত, সবই সেই এক চৈতন্যের প্রকাশ।


Talks with Sri Ramana Maharshi গ্রন্থে (Talk 57, 23 জুন 1935) এই উক্তিটি সরাসরি উদ্ধৃত হয়েছে: “Sarvam Khalvidam Brahma (All this is Brahman); Brahmavid Brahmaiva Bhavati (the knower of Brahman becomes Brahman itself).”


এখানে মহর্ষি (ছান্দোগ্য উপনিষদ, ৩.১৪.১) এবং মুণ্ডক উপনিষদ (৩.২.৯)-এর এই দুটি উচ্চারণকে একত্র করে দেখিয়েছেন—প্রথমটি বলে, সবই ব্রহ্ম; আর দ্বিতীয়টি বলে, যিনি ব্রহ্মকে জানেন, তিনিই ব্রহ্ম হয়ে যান। তাঁর বক্তব্য ছিল: ব্রহ্মকে জানা মানে কোনো ধারণাগত বা বৌদ্ধিক জ্ঞান অর্জন করা নয়, বরং চেতনার গভীরে সেই ঐক্যকে প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করা। এই অভিজ্ঞতাই জীবন্মুক্তির চূড়ান্ত প্রকাশ।


প্রথম উচ্চারণটি এক শক্তিশালী মহাবাক্যের মর্যাদা বহন করে, যা ব্রহ্মের সর্বব্যাপকত্ব ঘোষণা করে। বাক্যটি অদ্বৈত বেদান্তের দুটি প্রধান সিদ্ধান্তকে প্রতিষ্ঠা করে—সর্বাত্মকতা (All-Pervasiveness) এবং অদ্বৈতবাদ (Non-dualism)। এটি ঘোষণা করে যে, আমাদের অভিজ্ঞতায় আসা সমস্ত দৃশ্যমান জগৎ বা প্রপঞ্চ—বস্তু, জীব, শক্তি—সব কিছুর মূল উপাদান হলো সেই এক এবং অদ্বিতীয় ব্রহ্মসত্তা। ব্রহ্ম এই জগৎ থেকে পৃথক নন, বরং তিনি এই জগতের আধার।


আপাতদৃষ্টিতে যে বহুত্ব বা দ্বৈততা প্রতীয়মান হয়, তা মূলত মায়া বা অজ্ঞানের কারণে সৃষ্ট ভ্রম। যখন এই ভ্রম দূর হয়, তখন জ্ঞাতা উপলব্ধি করেন, তিনি যা দেখছেন, শুনছেন বা অনুভব করছেন, তা সবই সেই এক ব্রহ্মই। এই বাক্যটি অন্য মহাবাক্যগুলির (যেমন "অহং ব্রহ্মাস্মি" বা "অয়ম্ আত্মা ব্রহ্ম") ভিত্তি তৈরি করে। ব্রহ্মকে বাইরে কোথাও খোঁজার দরকার নেই, কারণ তিনিই এই সমগ্র রূপে প্রকাশিত।


দ্বিতীয় উচ্চারণটি মোক্ষ (মুক্তি) সম্পর্কে অদ্বৈত বেদান্তের অবস্থানকে নিশ্চিত করে। এটি বলে, জ্ঞানের মাধ্যমেই মুক্তি। এই বাক্যটি প্রমাণ করে যে, মোক্ষ (মুক্তি) কোনো কর্মের ফল বা স্থানিক গমন নয়, বরং এটি জ্ঞান বা উপলব্ধির মাধ্যমে অর্জিত হয়। যিনি ব্রহ্মকে জানেন (ব্রহ্মবিত্), তিনি মুক্তি লাভ করেন। অভেদ জ্ঞান বোঝাতে গিয়ে এখানে বলা হয়েছে: ব্রহ্মৈব ভবতি—ব্রহ্মই হন। এই অংশটি ঘোষণা করে যে, জীবাত্মা এবং পরমাত্মার মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। জীবাত্মা ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন নয়। এই ভিন্নতা কেবল অজ্ঞান বা উপাধিজনিত ভ্রান্তি (মায়া) দ্বারা সৃষ্ট।


ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হলে সেই উপাধি বা অজ্ঞান ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে জীবাত্মা তার নিত্য ও অবিচ্ছিন্ন স্বরূপ অর্থাৎ ব্রহ্ম হিসেবেই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হন। এখানে "হওয়া" (ভবতি) বলতে কোনো নতুন কিছু সৃষ্টি হওয়া নয়, বরং যা সর্বদা ছিল, তাকেই জানা বা সেই সত্যে স্থিত হওয়া বোঝায়। এই উক্তিটি অদ্বৈত বেদান্তের মহাবাক্যগুলির (যেমন: অহং ব্রহ্মাস্মি) চূড়ান্ত পরিণতিকে ঘোষণা করে।


“অবতার (ঈশ্বরের অবতরণ) ও জ্ঞানীর মধ্যে পার্থক্য কী? যদি ‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম’, তবে কি অবতারও ব্রহ্ম থেকে পৃথক?”—একবার মহর্ষি রমণাচার্যকে এই প্রশ্ন করা হয়েছিল। মহর্ষি উত্তর দিয়েছিলেন, “যখন সবই ব্রহ্ম, তখন অবতার বা জ্ঞানীর পৃথকত্ব কোথায়? অবতারও সেই একই ব্রহ্মের প্রকাশমাত্র।” (Talks with Ramana Maharshi, Vol. 3, p. 524). এই জগতে কোনো ভেদ নেই—ঈশ্বর, জীব, জগৎ—সবই একই ব্রহ্মসত্তার বহিঃপ্রকাশ। এই প্রসঙ্গে, শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের মূল ভিত্তি হলো এই অভেদ জ্ঞান। তিনি বলেছেন, একমাত্র ব্রহ্মই সত্য, জগৎ মিথ্যা (ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা), এবং জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন (জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ)। মহর্ষির বক্তব্য এই অদ্বৈতবাদেরই প্রতিধ্বনি।


অবতারকে আমরা ঈশ্বরের সাকার রূপ হিসেবে দেখি, যিনি ধর্ম সংস্থাপনের জন্য ধরাধামে আবির্ভূত হন, যেমন রাম বা কৃষ্ণ। কিন্তু জ্ঞানীর ক্ষেত্রে, তিনি আত্মজ্ঞানের মাধ্যমে ব্রহ্মের সঙ্গে নিজের অভিন্নতা উপলব্ধি করেন। মহর্ষির মতে, এই পার্থক্য কেবল দৃষ্টির, স্বরূপের নয়। ব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়, তাঁর থেকে কোনো কিছুরই পৃথক অস্তিত্ব নেই। অবতার বা জ্ঞানী উভয়েই সেই অনন্ত ব্রহ্মেরই ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ। এটি একটি গভীর আধ্যাত্মিক সত্য, যা পরম একত্বের ধারণা দেয়। উপনিষদেও এই কথাই বলা হয়েছে—‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’, অর্থাৎ, ব্রহ্ম এক এবং অদ্বিতীয়। এই উপলব্ধিই সকল দ্বন্দ্ব ও ভেদের ঊর্ধ্বে নিয়ে যায় এবং পরম শান্তির পথে পরিচালিত করে।


অদ্বৈত বেদান্তে “অবতার”, “দেবতা” এবং “জ্ঞানী”—এই তিনটি রূপ এক পরম চেতনার তিনটি ভিন্ন প্রতিফলন মাত্র। আচার্য শঙ্করাচার্য বলেন, “সত্তামাত্রবিভাগো ন তু স্বরূপবেদঃ”—অর্থাৎ পার্থক্য কেবল প্রকাশের স্তরে, স্বরূপে নয়। এই উক্তিটি শঙ্করাচার্য এবং তাঁর পরবর্তী আচার্যদের দ্বারা সত্যের ত্রিবিধতা (Three Grades of Reality) ব্যাখ্যা করার সময় ব্যবহৃত হয়। যখন বেদান্তে বলা হয় "ব্রহ্ম সত্যম্, জগৎ মিথ্যা", তখন এই প্রশ্ন ওঠে যে, 'মিথ্যা' বলতে কী বোঝায়? এই সূত্রটি সেই প্রশ্নের উত্তর দেয়।


সূত্রটি অদ্বৈত বেদান্তের সত্তা-বিভাগ তত্ত্বের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত:


১. সত্তামাত্র-বিভাগ (Sattāmātra-Vibhāgaḥ): এই অংশে সত্যকে বিভিন্ন স্তরে ভাগ করা হয়েছে—পারমার্থিক সত্তা (Pāramārthika Sattā): ব্রহ্ম (চূড়ান্ত সত্য)। ব্যাবহারিক সত্তা (Vyāvahārika Sattā): জগৎ (ব্যবহারের জন্য সত্য, কিন্তু চূড়ান্তভাবে মিথ্যা)। প্রাতিভাসিক সত্তা (Prātibhāsika Sattā): ভ্রম (যেমন রজ্জুতে সর্পভ্রম—যা শুধু প্রতীয়মান)। এই সূত্রটি বলে যে, আমরা এই যে ভেদ বা বিভাগ দেখি, তা কেবল এই আপেক্ষিক সত্তার স্তরেই বিদ্যমান।


২. ন তু স্বরূপ-ভেদঃ (Na tu Svarūpa-Bhedaḥ): এর অর্থ হলো—কিন্তু স্বরূপের (Ultimate Essence) দিক থেকে কোনো ভেদ বা পার্থক্য নেই।


জীবাত্মা, জগৎ, এবং ঈশ্বরকে ভিন্ন ভিন্ন মনে হলেও, এদের সকলের মূল স্বরূপ হলো একমাত্র ব্রহ্ম। পার্থক্য শুধু আমাদের অভিজ্ঞতার স্তর বা অবিদ্যার কারণে প্রতীয়মান হয়। এই সূত্রটি নিশ্চিত করে যে, অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে বহুত্ব বা দ্বৈততা হলো আপাত-সত্য (ব্যাবহারিক), কিন্তু চূড়ান্ত স্বরূপ বা তত্ত্বত সব কিছুর মধ্যে একত্ব (অভেদ) বিরাজমান।


এক ব্রহ্মই মায়াশক্তির প্রভাবে কখনো ঈশ্বররূপে অবতীর্ণ হন, কখনো শক্তিরূপে দেবতা হয়ে প্রতীয়মান হন; আবার কখনো অবিদ্যা-নিবৃত অবস্থায় জ্ঞানীর রূপে উদ্‌ভাসিত হন। এই তিন স্তরের ভেতর দিয়েই ব্রহ্মের পূর্ণ প্রকাশ বোঝা যায়।


অবতার শব্দের অর্থ অবতরণ—অর্থাৎ, নিরাকার ও নির্গুণ ব্রহ্ম যখন মায়ার আশ্রয়ে জগতে প্রকাশিত হন, তখন তাঁকে অবতার বলা হয়। তিনি কোনো ব্যক্তি নন, বরং সেই ব্রহ্ম, যিনি জগতের শিক্ষার জন্য মানবরূপে প্রকাশিত। গীতায় কৃষ্ণ বলেন, “যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত, অভ্যুৎথানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।” (ভগবদ্গীতা, ৪.৭)