অবিদ্যা-বিদ্যা: ৪৭




এই উপলব্ধি বোঝাতে বেদান্তে শুক্তি-রজত-দৃষ্টান্ত (Śukti-Rajat-Dṛṣṭānta) দেওয়া হয়েছে—ঝিনুক দেখে কেউ ওটা রুপা মনে করে। কিন্তু সেই মিথ্যা রুপার প্রতীয়মানতা সম্ভব হয় কেবল ঝিনুকের উজ্জ্বলতার কারণেই। যদি ঝিনুক উজ্জ্বল না হতো, তাহলে রুপার ভ্রমও সম্ভব হতো না। অর্থাৎ, ভ্রম বাস্তবতার উপর নির্ভরশীল—মিথ্যার অস্তিত্বও সত্যের আলোয় প্রতীয়মান।


তেমনি জগৎও মিথ্যা, কিন্তু তার প্রতীয়মানতা সত্য ব্রহ্মের আলোতেই সম্ভব। প্রপঞ্চের সৌন্দর্য, গতি, সৃজন—সবই ব্রহ্মের চেতনার দীপ্তি ছাড়া অকল্পনীয়। মিথ্যা রুপার উজ্জ্বলতা যেমন মুক্তার বাস্তবতার উপর নির্ভর করে, তেমনি প্রপঞ্চের সমগ্র অভিজ্ঞতাই ব্রহ্মচেতনার প্রতিফলনমাত্র। ফলে মিথ্যা প্রপঞ্চও এক অর্থে “বাস্তবের দর্পণ”—যা শুদ্ধ চেতনার প্রতিচ্ছবি হিসেবে জগতে প্রকাশিত।


যখন এই সত্য উপলব্ধি হয় যে, মিথ্যা জগৎও আসলে ব্রহ্মের দীপ্তিরই বিকিরণ—তখন বহুত্ব বা নানাত্ব নিজেই শান্ত হয়ে যায়। একে বলে প্রপঞ্চ-উপশম (Prapancha-Upaśama)—অর্থাৎ, নাম-রূপের সমস্ত আন্দোলন চৈতন্যে লীন হয়ে যায়, কিন্তু চৈতন্য নিজে অপরিবর্তিত থাকে। তখন দেখা যায়, আত্মা সর্বাবস্থায় নীরব সাক্ষী—জাগ্রত (Jāgrat) অবস্থায় কর্ম ও অভিজ্ঞতার মধ্যে থেকেও অক্ষুণ্ণ, স্বপ্ন (Svapna) অবস্থায় চিন্তার প্রপঞ্চের মধ্যে থেকেও অপরিবর্তিত, এবং সুষুপ্তি (Suṣupti) অবস্থায় নিঃসংশয় শূন্যতার মধ্যেও সজাগ চেতনা।


এই তিন অবস্থার বাইরে আছে তুরীয় (Turīya)—চতুর্থ অবস্থা, যা জাগ্রত, স্বপ্ন, ও সুষুপ্তির সাক্ষী। এটি না জাগ্রত, না স্বপ্ন, না নিদ্রা—বরং তাদের সকলের মধ্য দিয়ে অবিচল এক চেতনা। তুরীয় হলো চিদ্‌-আনন্দ-রূপ আত্মা—চির-আলোকিত, চির-আনন্দময়, চির-অপরিবর্তনীয়।


এই আত্ম-সাক্ষাৎকারই ব্রহ্ম-সাক্ষাৎকার (Brahma-Sākṣātkāra)—চূড়ান্ত তত্ত্ব-জ্ঞান। তখন সাধক ও সাধ্য—অনুসন্ধানী ও অনুসন্ধিত—দুইয়েরই বিলোপ ঘটে। মুক্তি আর কোনো অর্জন নয়, বরং আত্মার নিজস্ব রূপের বা স্বরূপের জাগরণ। তখন জ্ঞানী বুঝতে পারেন—মুক্তি কখনও ভবিষ্যতের ফল নয়, এটি চিরন্তন বর্তমান।


এই অবস্থাকেই উপনিষদ ঘোষণা করে—“ব্রহ্মবিত্ ব্রহ্মৈব ভবতি” (মুণ্ডক উপনিষদ, ৩.২.৯)—যিনি ব্রহ্মকে সত্যরূপে জানেন, তিনিই ব্রহ্ম হয়ে যান। এটি অদ্বৈত বেদান্তের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তকে প্রকাশ করে।


ব্রহ্মজ্ঞান ও অভেদ: এই মন্ত্রটি প্রমাণ করে যে জ্ঞান (উপলব্ধি) এবং মুক্তি (মোক্ষ) অভিন্ন। মোক্ষ হলো কোনো বস্তু অর্জন করা নয়, বরং নিজের প্রকৃত স্বরূপকে অর্থাৎ ব্রহ্মকে জানা।


ভেদের বিনাশ: যতক্ষণ জীব অজ্ঞানবশত নিজেকে সীমিত কর্তা বলে মনে করে, ততক্ষণই সে জীবাত্মা থাকে। কিন্তু যখন সে ব্রহ্মকে জানে (ব্রহ্মবিত্), তখন তার সেই উপাধি (অজ্ঞানজনিত সীমাবদ্ধতা) ধ্বংস হয়ে যায়।


স্বরূপে স্থিতি: উপাধি দূর হওয়ার ফলে, জীব কেবল তার নিত্য এবং অবিচ্ছিন্ন স্বরূপ—অর্থাৎ ব্রহ্ম—হিসেবেই অবস্থান করে।


চূড়ান্ত ঘোষণা: "ব্রহ্মই হন" (ব্রহ্মৈব ভবতি)-এর অর্থ হলো, জ্ঞানী ব্যক্তি ব্রহ্ম থেকে আলাদা কোনো সত্তা নন। তিনি কেবল সেই সত্যে স্থিত হন, যা তিনি সবসময়ই ছিলেন। এই উক্তিটি অদ্বৈত বেদান্তের মহাবাক্য "অহং ব্রহ্মাস্মি" (আমিই ব্রহ্ম)-এর ফল বা পরিণতিকে ঘোষণা করে।


জানা ও হওয়া এখানে পৃথক নয়; জ্ঞানই অস্তিত্বে রূপান্তরিত হয়। জ্ঞানী তখন আর কোনো উপলব্ধির প্রয়োজন বোধ করেন না, কারণ তিনিই উপলব্ধি, তিনিই জ্ঞাতা, তিনিই ব্রহ্ম। এখানেই অদ্বৈত জ্ঞানের পরিণতি—যেখানে মায়া আর বন্ধন নয়, বরং ব্রহ্মেরই দীপ্ত প্রতিফলন; যেখানে জগৎ আর মিথ্যা নয়, বরং সত্যের উজ্জ্বল ছায়া; আর যেখানে সাধক আর পথিক নন—তিনি নিজেই সেই চির-আলোকিত পথ, সেই চিরন্তন গন্তব্য।


শেষপর্যন্ত এমনকি অবিদ্যা-ভঙ্গ (Avidyā-Bhaṅga)—অজ্ঞান-নিবৃত্তির ধারণাটিও অতিক্রম করতে হয়, কারণ তা-ও একপ্রকার দ্বৈত ভাবনার অবশিষ্ট ছায়া। যতক্ষণ “অবিদ্যা আছে” বা “অবিদ্যা নষ্ট হলো”—এই ধারণা থাকে, ততক্ষণ চূড়ান্ত অদ্বৈত উপলব্ধি সম্পূর্ণ হয় না। বেদান্তের চূড়ান্ত বাক্য “অয়ম্ আত্মা ব্রহ্ম (Ayam Ātmā Brahma)”—এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, অবিদ্যা কখনও সত্যিই ছিল না; ছিল কেবল মায়াবী প্রতীতি, একটি আভাস (Ābhāsa)।


সর্বং হ্যেতদ্‌ ব্ৰহ্মায়মাত্মা ব্রহ্ম সোঽয়মাত্মা চতুষ্পাৎ।। (মাণ্ডুক্য উপনিষদ, মন্ত্র ২)


অন্বয়: সর্বং হি এতৎ ব্রহ্ম (এই সকলই ব্রহ্ম); অয়ম্‌ আত্মা ব্রহ্ম (এই আত্মাও ব্রহ্ম); সঃ অয়ম্ আত্মা চতুষ্পাৎ (এই আত্মার চারটি অবস্থা)।


সরলার্থ: সমগ্র জগৎই ব্রহ্ম। এই জীবাত্মাও ব্রহ্ম। আপাতদৃষ্টিতে এই আত্মার চারটি অবস্থা।


ব্যাখ্যা: উপনিষদের এই মহাবাক্য—“সর্বং হি এতৎ ব্রহ্ম”—অর্থাৎ, যা-কিছু বিদ্যমান, সবই ব্রহ্ম—অদ্বৈত বেদান্তের মর্মবাণী। এখানে ব্রহ্মকে বলা হয়েছে একমাত্র পরম সত্য—যার বাইরে বা বিপরীতে আর কিছু নেই। অস্তিত্ব, জ্ঞান ও আনন্দ—এই তিনটি অনন্ত স্বরূপের নামই সৎ-চিত্-আনন্দ (Sat-Cit-Ānanda)। “সৎ” মানে যা আছে, যা চিরন্তনভাবে বিদ্যমান। তাই ব্রহ্ম কোনো সৃষ্টি নয়, তিনিই সমস্ত সৃষ্টির আশ্রয়; তিনিই অস্তিত্বের নিজস্ব রূপ।


যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য—যেমন দৃশ্যমান জগৎ, ধ্বনি, স্পর্শ, রূপ, গন্ধ—সবই ব্রহ্মের প্রকাশ। আবার যা ইন্দ্রিয়ের সীমার বাইরে—যেমন চিন্তা, স্মৃতি, বা বুদ্ধির সূক্ষ্ম ধারণা—তা-ও ব্রহ্মেরই এক রূপ। উপনিষদ ঘোষণা করছেন—“সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম”—এই সমস্তই ব্রহ্ম—অর্থাৎ, স্থূল, সূক্ষ্ম ও কারণ—এই তিন স্তরের সব কিছুই সেই এক ব্রহ্মেরই অন্তর্গত। তাই ব্রহ্ম সর্বব্যাপী, কারণ তিনিই প্রতিটি অস্তিত্বের মধ্যকার “অস্তিত্ব”-রূপ সত্তা। যেমন সোনার গয়না নানা রূপে থাকে, কিন্তু সবই সোনা; তেমনি সমস্ত রূপ, নাম ও ভাব—সবই ব্রহ্মের প্রকাশমাত্র।


“সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম”—বাক্যটি ছান্দোগ্য উপনিষদের (৩.১৪.১) এক মহামন্ত্র, এক চিরসত্য ঘোষণা, যা বলে—“এই সমস্তই ব্রহ্ম।” এখানে উপনিষদ জগতের প্রতিটি কণাকে, প্রতিটি অস্তিত্বকে, প্রতিটি চেতনার রূপকে এক সর্বব্যাপী, অদ্বিতীয় সত্তার প্রকাশ বলে স্বীকার করছে। এই একমাত্র বাক্যেই অদ্বৈত দর্শনের সারভাগ নিহিত—যা-কিছু দেখা যায়, শোনা যায়, চিন্তা করা যায়, সবই সেই এক চৈতন্যেরই প্রকাশ, ব্রহ্মেরই প্রতিফলন।


শব্দতত্ত্ব অনুযায়ী “সর্বম্‌” অর্থ—সব কিছু, সমস্ত অস্তিত্ব; “খলু” মানে—নিশ্চয়ই, নিঃসন্দেহে; “ইদম্‌”—এই দৃশ্যমান বিশ্ব, যা আমাদের ইন্দ্রিয় ও চিন্তায় প্রতীয়মান; আর “ব্রহ্ম”—পরম সত্য, অনন্ত চেতনা, পরমাত্মা। তাই সম্পূর্ণ অর্থ দাঁড়ায়—“এই সমস্তই নিশ্চয়ই ব্রহ্ম।” অর্থাৎ, ব্রহ্ম ব্যতীত কিছুই নেই; যা-কিছু প্রকাশিত, তা-ই ব্রহ্মের রূপ।


এই বাক্যটির মধ্যে নিহিত আছে দুইটি মৌলিক দার্শনিক তত্ত্ব—সর্বাত্মকতা এবং অদ্বৈতবাদ। সর্বাত্মকতা অর্থাৎ ব্রহ্ম সর্বত্র বিরাজমান; কোনো বস্তু, জীব বা শক্তি ব্রহ্ম থেকে পৃথক নয়। ব্রহ্ম কেবল জগতের কারণ বা স্রষ্টা নন, তিনিই জগতের অন্তঃস্থিত সত্তা, যা প্রতিটি রূপ, প্রতিটি গন্ধ, প্রতিটি স্পর্শের ভিতর দিয়ে প্রকাশিত। যেমন তরঙ্গ, ফেনা, ঢেউ—সবই জলের রূপে এক, তেমনি এই বৈচিত্র্যময় জগৎও সেই এক ব্রহ্মচেতনার তরঙ্গমাত্র। তাই উপনিষদ ঘোষণা করে—ব্রহ্মই সত্য—জগৎ মিথ্যা নয়, বরং জগৎ ব্রহ্মের নামরূপ-প্রকাশ। বহুত্বের নিচে এক চেতনা নিরন্তর প্রবাহিত—এটাই অদ্বৈতের প্রথম উপলব্ধি।


অদ্বৈতবাদ এখানে দ্বিতীয় তত্ত্ব হিসেবে প্রকাশিত। আমরা জগতে অসংখ্য ভেদ দেখি—আমি, তুমি, প্রকৃতি, জীব, ঈশ্বর—সব আলাদা মনে হয়, কিন্তু এই বিভেদ কেবল মায়াজনিত। অবিদ্যার আচ্ছাদনে ব্রহ্মের ঐক্য ঢাকা পড়ে, ফলে একই চেতনা নানারূপে প্রতীয়মান হয়। যখন জ্ঞানের উদয় হয়, তখন সাধক উপলব্ধি করে—যা-কিছু সে দেখছে, শুনছে বা অনুভব করছে, তা নিজেরই চৈতন্যের প্রতিফলন। তখন আর ‘আমি’ ও ‘তুমি’ থাকে না—যা-কিছু আছে, তা সবই এক আত্মা, এক ব্রহ্ম। এই উপলব্ধিই “অহং ব্রহ্মাস্মি” (আমি ব্রহ্ম) ও “তৎ ত্বম্ অসি” (তুমিই সেই)-এর সত্য রূপ।


“সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম” কেবল একটি দার্শনিক বাক্য নয়; এটি এক আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা। ব্রহ্মকে কোথাও বাইরে খুঁজতে হয় না; তিনিই এই বিশ্বে, এই মুহূর্তে, এই প্রাণে, এই চেতনার মধ্যে উপস্থিত। চোখ যখন দেখে, কান যখন শোনে, মন যখন চিন্তা করে—সব ক্রিয়াই ব্রহ্মেরই লীলা। ছান্দোগ্য উপনিষদ এই উক্তির পরেই বলে—“তদেকমেবাদ্বিতীয়ম্‌”—“সে-ই এক, যার দ্বিতীয় নেই।” বহুত্ব কেবল প্রতীয়মান, সত্য নয়; সত্য হলো একমাত্র অভেদ চেতনা, যা নিজেই সমস্ত নাম-রূপে রূপান্তরিত হয়েছে।


এই উপলব্ধির মধ্যে এক পরম শান্তি নিহিত। কারণ যখন জানা যায়—জগৎ ও আত্মা অভিন্ন, তখন ভয় বা আসক্তি আর থাকে না। তখন আর কিছু অর্জনের প্রয়োজন থাকে না, কারণ যা-কিছু আছে, তা ইতিমধ্যেই নিজেরই স্বরূপ। তখন জগৎ হয়ে ওঠে আত্মার প্রতিচ্ছবি, আর আত্মা হয়ে ওঠে জগতের অন্তর্লীন সত্তা। তখন সমস্ত দ্বন্দ্ব থেমে যায়, আর থাকে কেবল সেই এক অখণ্ড চেতনা—যা আলো দেয়, যা প্রাণ দেয়, যা সর্বত্র, সর্বকালে, সব অবস্থায় একইভাবে বিরাজমান।


“সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম”—এই এক বাক্যেই উপনিষদ ঘোষণা করেছে সমস্ত অস্তিত্বের ঐক্য। জগৎ ব্রহ্ম থেকে পৃথক নয়; প্রতিটি অভিজ্ঞতা, প্রতিটি সত্তা, প্রতিটি শ্বাসই ব্রহ্মের প্রকাশ। তাই সত্যের সন্ধান বাইরে নয়, নিজের মধ্যেই; কারণ তুমি যে-চেতনা, সেটিই ব্রহ্ম। যখন এই জ্ঞান সম্পূর্ণরূপে উদিত হয়, তখন সাধক উপলব্ধি করেন—সর্বত্র তিনি নিজেকেই দেখছেন, শুনছেন, স্পর্শ করছেন। তখন দ্বৈততার সীমা বিলীন হয়ে থাকে কেবল এক অখণ্ড আলো—যার নাম ব্রহ্ম, যার রূপ এই বিশ্ব, আর যার হৃদয়ে বাস করে “আমি” নিজেই।


এই উপলব্ধি থেকেই আসে দ্বিতীয় মহান ঘোষণা—“অয়ম্ আত্মা ব্রহ্ম (Ayam Ātmā Brahma)”। এটি অথর্ববেদের মুণ্ডক উপনিষদে (২.২.২) বর্ণিত একটি মহাবাক্য, যা অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের অন্যতম মৌলিক স্তম্ভ। এর অর্থ—“এই আত্মাই ব্রহ্ম”, অর্থাৎ, আমাদের প্রত্যক্ষ অন্তর্সত্তা, যা ‘আমি’ বলে অনুভব করি, সেটিই পরম, সর্বব্যাপী, অনন্ত ব্রহ্মসত্তা। এখানে আত্মা ও ব্রহ্মের অভেদ ঘোষণা করা হয়েছে—যা নিজের ভেতরে অনুভূত চেতনা, সেটিই সমগ্র জগতের মূল চেতনা।


‘অয়ম্‌’ শব্দের অর্থ ‘এই’, যা নিকটবর্তী, প্রত্যক্ষ এবং বর্তমানে অনুভবযোগ্য কিছু বোঝায়; ‘আত্মা’ মানে নিজস্ব সত্তা বা অন্তর্স্বরূপ, যা দেহ ও মন থেকে পৃথক; আর ‘ব্রহ্ম’ হলো পরম সত্য, অনন্ত চেতনা, সর্বব্যাপী এক সত্তা। সুতরাং “অয়ম্‌ আত্মা ব্রহ্ম” মানে—এই নিজস্ব চেতনা, যা প্রতিটি সত্তার অন্তরে জ্বলছে, সেটিই আসলে পরম ব্রহ্মচেতনা; আত্মা ও ব্রহ্মের মধ্যে কোনো বাস্তব ভেদ নেই।


এই মহাবাক্যে আত্মা ও ব্রহ্মের ঐক্যকে ধীরে ধীরে উদ্ঘাটন করা হয়েছে। উপনিষদ শুরুতেই বলে—“ওঁ”—এই মহামন্ত্রই সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতীক; অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ—সবকালের সারাংশ ও প্রকাশ। এরপর ঘোষণা করা হয়—“এই ব্রহ্মই সমগ্র, এই ব্রহ্মই আত্মা, এবং সেই আত্মা চার ভাগে বিভক্ত।” এখানে ব্রহ্মকে সমগ্র সৃষ্টির উৎস ও আত্মাকে তার অভ্যন্তরীণ সত্তা হিসেবে দেখানো হয়েছে। ব্রহ্ম থেকে যেমন আগুন থেকে অসংখ্য স্ফুলিঙ্গ নির্গত হয়, তেমনি অসংখ্য জীবও সেই ব্রহ্ম থেকেই উৎপন্ন, কিন্তু তাদের মূল সত্তা ব্রহ্ম থেকে কখনও পৃথক হয় না।


মুণ্ডক উপনিষদ বলে—“ব্রহ্ম অবিনশ্বর, দেহাতীত, অন্তর ও বাহির উভয় অবস্থায় বিরাজমান, অজ, মন ও প্রাণের অতীত, তথাপি তিনিই সমস্ত জীবনের অন্তর্নিহিত আত্মা।” এই ব্রহ্ম থেকেই শ্বাস, মন, ইন্দ্রিয়, আকাশ, বায়ু, আলো, জল, পৃথিবী—সব কিছুর জন্ম হয়; তিনি সমগ্র সৃষ্টির ভিত্তি ও আশ্রয়। এইভাবে উপনিষদ ব্রহ্মকে সমস্ত অস্তিত্বের উৎস ও আত্মাকে সেই ব্রহ্মেরই প্রতিফলন হিসেবে দেখায়।